Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

গ্রাফোলজি: হাতের লেখায় ব্যক্তিত্ব বিচার

ছোটবেলায় হাতেখড়ির সময় থেকেই লেখালেখির সূচনা। কখনো শিশুর হাতে পেন্সিলের আঁচড়ে অজানা আঁকিবুঁকি, কখনো কাঁচা হাতের বর্ণমালা, কখনো আবার গোটা গোটা হাতের লেখায় পাতার পর পাতা রচনা লেখা। আর হাতের লেখাকে সুন্দর এবং আকর্ষণীয় করার চেষ্টা তো সব বয়সেই রয়েছে। কিন্তু তারপরেও হাতের লেখায় রয়ে যায় কিছু নিজস্বতা, কিছু বৈশিষ্ট্য, যা কিনা আপনার ব্যক্তিত্বকেই ফুটিয়ে তোলে এবং তা বিশ্লেষণের মাধ্যমে বলা সম্ভম! হাতের লেখা বিশ্লেষণের এই প্রক্রিয়াকেই বলা হয় ‘গ্রাফোলজি’।

হাতের লেখা বলে দেয় অনেক কিছু; source: zmescience.com

গ্রাফোলজি কী?

‘গ্রাফোলজি’ বা ‘গ্রাফো-অ্যানালাইসিস’ বা ‘গ্রাফিমিক্স’ অথবা হাতের লেখা বিশ্লেষণ হলো এমন একটি প্রক্রিয়া যেখানে একজন ব্যক্তির হাতের লেখার নমুনা দেখে তাকে সনাক্ত করা যায়, লেখার মুহূর্তে তার মানসিক অবস্থা বোঝা যায় এবং তার ব্যক্তিত্ব মূল্যায়ন করা যায়। অনেকেই গ্রাফোলজিকে ‘ছদ্মবিজ্ঞান’ বা ‘মেকি বিজ্ঞান’ বলেও আখ্যায়িত করে থাকেন। অনেকে আবার এ বিষয়টিকে বিচারদলিল পরীক্ষার (গ্রাফানালাইসিস) সাথে মিলিয়ে ফেলেন। কিন্তু দুটি বিষয় আলাদা।

source: psmag.com

গ্রাফোলজির ইতিহাস

খ্রিস্টপূর্ব ৩০০০ অব্দে প্রথম স্বীকৃত লিপি পাওয়া গিয়েছিল। আর হাতের লেখা দেখে ব্যক্তির বৈশিষ্ট্য অবলোকন করা সম্ভব সে কথা সর্বপ্রথম অনুধাবন করা হয়েছিল খ্রিস্টপূর্ব ৫০০ অব্দে। খ্রিস্টপূর্ব চতুর্দশ শতাব্দীতে চীনা দার্শনিক কুও জো-সু বলেছিলেন, “হাতের লেখাই বলে দিতে পারে সেটি মহান ব্যক্তির নাকি অমার্জিত ব্যক্তির।” অ্যারিস্টটলের মতে, লেখা এবং চিন্তার মাঝে একধরনের বন্ধন রয়েছে, লেখা আসলে বাণীর প্রতীক, প্রতিটি বর্ণই মানসিক অভিজ্ঞতার নির্দেশক।

হাতের লেখার ধরণ থেকে ব্যক্তি বৈশিষ্ট্য বিশ্লেষণ; source: viewzone.com

তবে আধুনিক গ্রাফোলজির সূচনা সপ্তদশ শতাব্দীতে, ইতালির বোলোগনা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শনের অধ্যাপক ক্যামিলো বালদির হাত ধরে। সেই বিশ্ববিদ্যালয়ে এখনো গ্রাফোলজি শেখানো হয়ে থাকে। ১৬২২ সালে ক্যামিলো বালদি “কীভাবে বর্ণ দেখে লেখকের প্রকৃতি এবং গুণমান বিচার করা যায়” নামের একটি বই লেখেন। এ বইটি হাতের লেখার গবেষণা সংক্রান্ত প্রথম প্রকাশিত গ্রন্থ। ইতালি থেকেই মানুষের প্রকৃতি এবং ব্যক্তিত্ব শিক্ষণে গ্রাফোলজি একটি স্বীকৃত মাধ্যম হিসেবে সারা বিশ্বে পরিচিতি পায়। সেই সময়ে অনেকেই গ্রাফোলজিকে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে নিয়মাবদ্ধ করার চেষ্টা চালাতে থাকেন। তাদের মধ্যে রয়েছেন গডফ্রেড গুইলারমো লিবনিজ (১৬৪৬-১৭১৬), জোহান ক্যাস্পার ল্যাভাটার (১৭৪১-১৮০১), জোহার উলফগ্যাং ভন গোয়েথে (১৭৪৯-১৮৩২) প্রমুখ।

ক্যামিলো বালদির প্রতিকৃতি; source: wikimedia commons

এরপর ঊনবিংশ শতাব্দীতে এসে আনুষ্ঠানিকভাবে গ্রাফোলজির ভিত গড়ে তুলতে ফ্রান্স খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। এর ফলশ্রুতিতেই ইউরোপ, ইসরায়েল, উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকা, চীন এবং ভারতসহ বিশ্বের আরও কিছু দেশে গ্রাফোলজির শিক্ষা দেওয়া হয়। আধুনিক গ্রাফোলজির সূত্রপাতও ফ্রান্সের হাত ধরেই।

সত্যিকার অর্থে গ্রাফোলজির জনক যাকে বলা যায় তিনি হলেন ফ্রান্সের জিন হিপ্পোলাইট মাইকন (১৮০৬-১৮৮১)। তিনিই প্রথম গ্রিক দুটি শব্দ ‘graph’ (লেখা) এবং ‘logos’ (তত্ত্ব) এর সমন্বয়ে গ্রাফোলজি শব্দটি প্রস্তাব করেন।

জিন হিপ্পোলাইট মাইকন; source: slideplayer.com

ব্রিটেনে গ্রাফোলজি পরিচিতি পায় অষ্টাদশ শতাব্দীতে। ১৮৭১ সালে ব্রিটিশ স্ট্র্যান্ড ম্যাগাজিনে “হাতের লেখায় ব্যক্তিত্ব নির্দেশ” নামে একটি অনুচ্ছেদ প্রকাশিত হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে ইউরোপ থেকে গ্রাফোলজিস্টদের ইংল্যান্ডে এনে গ্রাফোলজির শেখানো হয়েছিল। সেই সকল গ্রাফোলজিস্টদের মধ্যে আধুনিক গ্রাফোলজির জনক লুডউইগ ক্যাগসের শিষ্য এরিক সিংগারও ছিলেন।

গ্রাফোলজি বর্তমানে সারা বিশ্বে খুব জনপ্রিয়তা পেলেও সমালোচনার অন্ত নেই। তবে যারা এর পক্ষে অবস্থান করেন তাদের মতে, “হাত লেখে না, লেখে মস্তিষ্ক”। তারা ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেন কীভাবে মস্তিষ্ক থেকে সংকেত স্নায়ুর মাধ্যমে পেশিতে সঞ্চালিত হয়ে হাতকে লিখতে  নির্দেশ দেয়। আর এ কারণেই লেখার সাথে ব্যক্তিত্ব প্রকাশিত হয়।

গ্রাফোলজির গুরুত্বপূর্ণ কিছু বিষয়

গ্রাফোলজি আসলে কী সেটা বুঝতে হলে ম্যাক্স পালভারের “শূন্যস্থান প্রতীকীবাদ” এবং ‘সুইস সিম্বোলিক স্কুল’ সম্পর্কে ভালভাবে জানতে হবে। গ্রাফোলজি এবং মনোবিজ্ঞানের আগ্রহের পূর্বে সাহিত্য এবং দর্শন সম্পর্কিত পালভারের অনেক লেখা প্রকাশিত হয়েছিল। সেই প্রকাশিত প্রতিটি লেখাতেই ছিল লেখার প্রতীকী বৈষম্য প্রদর্শন। তিনি দেখিয়েছেন যে, আমাদের সকলের মাঝেই প্রাচীন কিছু প্রতীক জন্ম থেকেই রয়েছে। দৈনন্দিন জীবনে মস্তিষ্ক যখন চিন্তার সংযোগ ঘটায় তখন আমরা সচেতন না হয়ে সেই প্রতীকগুলো ব্যবহার করে থাকি। এমনই কিছু মানসিক সংযোগের উদাহরণ হতে পারে এগুলো:

  • উপরে– আকাশ, ঈশ্বর, দিনের আলো, আধ্যাত্মিকতা
  • নিচে– রাত, অন্ধকার, গভীরতা, স্বভাবজাত
  • ডানে– একত্রিত হওয়া, ভবিষ্যৎ, বহির্মুখী, অর্জন, জনক
  • বামে– গতকাল, অতীত, সূচনা, জননী, আমিত্ব নষ্টের ভয়, অন্তর্মুখী
  • কেন্দ্রে– বর্তমান, আজ, চলতি ঘটনা, আমি, আত্মনিয়ন্ত্রণ

শূন্যস্থানে এই প্রতীকগুলো অসচেতনতাবশত প্রকাশের বিষয়টি আমাদের আচরণের সাথে সম্পর্কিত। এগুলো সম্পর্কে জানার পাশাপাশি জানতে হবে মনোবিজ্ঞানের সাধারণ জ্ঞান, যেমন- ফ্রয়েডের ইড্‌, ইগো, সুপার ইগো এবং এগুলোর সাথে সাইকো-অ্যানালাইসিসের কিছু জ্ঞান।

পরীক্ষা করে দেখতে পারেন নিজের হাতের লেখার সাথে ব্যক্তিত্বের সম্পর্ক

গ্রাফোলজির প্রাথমিক কিছু ধারণা নিয়ে নিজের ক্ষেত্রে পরীক্ষা করে দেখতে পারেন। যেমন-

লেখার আকার

অক্ষরের আকার ব্যক্তিত্ব নির্দেশক; source: bebee.com

  • যাদের ছোট হাতের লেখা তারা সাধারণত কিছুটা লাজুক প্রকৃতির, মনোযোগী এবং অতি সতর্ক।
  • যাদের হাতের লেখা বড় তারা অন্যের ভালবাসা পেতে চায়, সে চায় সব সময় তার আশেপাশে কেউ থাকুক এবং একইসাথে ঘুরতে পছন্দ করে।
  • অপরদিকে যাদের হাতের লেখা মাঝারি আকারের তারা যেকোনো পরিবেশে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারে।

দুইটি শব্দের মাঝে ব্যবধান

দুটি শব্দের মাঝে কতটুকু ব্যবধান সেটি দেখেও ব্যক্তিত্ব বিচার করা যায়; source: rd.com

  • যারা লেখার সময় দুইটি শব্দের মাঝে বেশি ব্যবধান রাখে তারা তাদের স্বাধীনতাকে ভালবাসে এবং ভীড় পছন্দ করে না। কোনো নির্দিষ্ট বিষয়ে মগ্ন হতেও ভালবাসে না।
  • অপরদিকে, যারা শব্দের মাঝে খুবই কম ফাঁকা স্থান রাখে তারা একা থাকতে পারে না। সকলের সান্নিধ্যে থাকতে  পছন্দ করে।

গোটা গোটা হাতের লেখা

গোটা গোটা অক্ষরে লেখা; source: medium.com

গোটা গোটা অক্ষরে যারা লেখেন তারা সাধারণত শৈল্পিক এবং সৃজনশীল হয়ে থাকেন।

সংযুক্ত অক্ষরবিন্যাস

যারা একটি বর্ণের সাথে আরেকটি বর্ণ সংযুক্ত রেখে লেখে তারা খুবই যৌক্তিক এবং নিয়মতান্ত্রিক হয়ে থাকে।

ইংরেজি ছোট হাতের ‘t’ এর কাটা দাগ

source: rd.com

  • যারা ইংরেজি ছোট হাতের ‘t’ এর বেশ উপরের দিকে কাটা দাগ দেন তাদের আত্মমর্যাদা বেশি থাকে, তারা স্বাধীনচেতা এবং উচ্চাকাঙ্ক্ষী।
  • যারা ইংরেজি ছোট হাতের ‘t’ এর মাঝামাঝি কাটা দাগ দেন তারা আত্মপ্রত্যয়ী হয়ে থাকে।

ইংরেজি ‘o’ লেখার ধরণ

  • ইংরেজি o লেখার সময় যদি উপরের অংশে কিছুটা বিচ্ছিন্ন থাকে, তাহলে বুঝতে হবে সেই ব্যক্তি খুব কথা বলতে পারে, অন্যের সাথে সহজেই মিশতে পারে এবং নিজেকে সকলের সামনে তুলে ধরতে পারে।
  • অপরদিকে যারা একবারে ঠিকঠাকভাবে o লেখতে পারে তারা সাধারণত নিজের গন্ডির মাঝে থাকেই পছন্দ করে এবং অন্তর্মুখী।

ইংরেজি ‘i’ এর উপরের ফোঁটা

source: rd.com

  • যারা i এর ফোঁটা বেশ উপরে দেয় তারা সাধারণত কল্পনাপ্রবণ।
  • যারা ঠিকঠাক দূরত্বে ফোঁটা দেয় তারা বিস্তারিত জানতে আগ্রহী, গোছালো এবং সহমর্মী।
  • আবার যারা ফোঁটার পরিবর্তে বৃত্ত দেয় তারা বাচ্চাসুলভ এবং স্বপ্নদ্রষ্টা হয়ে থাকে।

এরকমই আরও নানা উপায় রয়েছে যা দেখে নিজের ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। শুধু হাতের লেখাই নয়, ব্যক্তির স্বাক্ষরের ক্ষেত্রেও গ্রাফোলজি ব্যক্তিত্ব বিচার করে থাকে।

গ্রাফোলজির ব্যবহার

গ্রাফোলজি দিন দিন জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। বর্তমানে কর্মী বাছাইয়ের ক্ষেত্রে এর উল্লেখযোগ্য ব্যবহার দেখা যাচ্ছে, যদিও বাংলাদেশে এর চল খুবই কম। এছাড়াও রয়েছে এর আরও কিছু ব্যবহার।

কর্মী বাছাইয়ের ক্ষেত্রে

একটি কোম্পানিতে যখন নিয়োগ পরীক্ষা নেওয়া হয়, তখন প্রার্থীর হাতের লেখার নমুনা বিশ্লেষণ করে তার ব্যক্তিত্ব অনুযায়ী সঠিক পদে নিয়োগ দেওয়া যেতে পারে। তবে শুধুই গ্রাফোলজি ব্যবহার করে নয়, বরং অন্যান্য পদ্ধতির সাথে গ্রাফোলজির ব্যবহার যুক্ত করবে এক নতুন মাত্রা। পদোন্নতির ক্ষেত্রেও গ্রাফোলজির ব্যবহার উল্লেখযোগ্য। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে গ্রাফোলজির ব্যবহারকে আইনের বিরোধীতা করা হয় বলেও সমালোচনা চলে।

মনোবৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণে

ইউরোপিয়ান কাউন্সেলর এবং সাইকোথেরাপিস্টগণ গ্রাফোলজির ব্যবহার করে থাকেন। বিভিন্ন প্রক্ষেপণ পরীক্ষার পাশাপাশি গ্রাফোলজিকে ব্যবহার করা হয়।

বৈবাহিক সঙ্গতির ক্ষেত্রে

যৌন আগ্রহ এবং যৌন উদ্দীপনা সম্পর্কে ব্যাখ্যা করে গ্রাফোলজি। এছাড়াও পারস্পারিক সম্পর্ক কেমন হতে পারে এবং দুজনের বৈবাহিক সম্পর্ক কতটা স্থায়ী হতে পারে সে সম্পর্কেও বিস্তারিত ব্যাখ্যা পাওয়া যায় হাতের লেখা বিশ্লেষণে।

চিকিৎসাক্ষেত্রে

গ্রাফোলজি সবচেয়ে বেশি সমালোচনার মুখে পড়ে এ ক্ষেত্রে। তবে এক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে- হাতের লেখা বিশ্লেষণের চেয়ে রোগীর সঞ্চালন নিয়ন্ত্রণ, যেমন- গতি, চাপ, লেখার সামঞ্জস্যতা ইত্যাদিকে মাপা হয়, যা মেডিকেলের ভাষায় ব্যাখ্যা করা যায়। এ বিষয়টি সকল ক্ষেত্রে বুঝতে না পারার জন্য রোগ সনাক্তকরণে যুক্তরাষ্ট্রে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে গ্রাফোলজির ব্যবহারকে আইনত নিষিদ্ধ করা হয়েছে।

গ্রাফোথেরাপি

যে প্রক্রিয়ায় হাতের লেখায় পরিবর্তনের মাধ্যমে ব্যক্তিত্বে পরিবর্তন আনার চেষ্টা করা হয় তাকে গ্রাফোথেরাপি বলা হয়। ১৯৩০ সালে এটি প্রথম ফ্রান্সে পরিচিতি পায়। এর পর ১৯৫০ এর শেষের দিকে যুক্তরাষ্ট্রেও এর ব্যবহার দেখা যায়। সধারণত যারা ক্যালিগ্রাফি শিখে থাকেন তারাই গ্রাফোথেরাপি দিয়ে থাকেন। কখনও কখনও মিউজিক থেরাপি এবং ইতিবাচক আত্মকথনের সাথে এটি ব্যবহার করা হয়ে থাকে।

ফিচার ইমেজ- wikihow.com

Related Articles