Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website. The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

গ্রিক মৃৎপাত্র চিত্রকলা ও কলাকৌশল

গ্রিস। নামটি মাথায় আসলেই যেন ঘুরতে থাকে রহস্যঘেরা একটি দেশের কাল্পনিক ছবি। গ্রিস ইউরোপ মহাদেশের দক্ষিণ-পূর্ব প্রান্তের একটি রাষ্ট্র। পাঁচ সহস্রাধিক ছোট-বড় দ্বীপ নিয়ে গ্রিস গঠিত। এর মধ্যে ২২৭টিতে মানুষ বসবাস করে। এজিয়ান সাগরের তীরে গড়ে ওঠা এই দেশ প্রাচীনকাল থেকেই তার সৌন্দর্যের জন্য বিখ্যাত, এবং গ্রিসে ১৮টি ইউনেস্কো স্বীকৃত ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট আছে। 

প্রাচীন সভ্যতাগুলোর মধ্যে শিল্প, বিজ্ঞান, সাহিত্য- সবদিক থেকেই যে সভ্যতার সবথেকে বেশি বিকাশ ঘটেছিল, সেটি হচ্ছে গ্রিক সভ্যতা। প্রাচীন এই গ্রিক দেশেই অ্যারিস্টটল, সক্রেটিস, প্লেটো, পিথাগোরাসের মতো বিখ্যাত মনীষীদের জন্ম; যাদের চিন্তাভাবনা দর্শন শুধু গ্রিসকেই নয়, বরং পুরো বিশ্বকেই প্রভাবিত করেছিল।

গ্রিক মৃৎপাত্র চিত্রকলা ও ইতিহাস

গ্রিক মৃৎপাত্র; Image source: Greeka

গ্রিক মৃৎপাত্র চিত্রকলা বলতে মূলত প্রাচীনকালের গ্রিসের বিভিন্ন চিত্রকলা সম্বলিত মৃৎপাত্রকে বোঝায়।

গ্রিক মৃৎপাত্র তার টেকসই মজবুত বৈশিষ্ট্যের জন্য অনেক পরে এসেও প্রত্নতাত্ত্বিক খননের ফলে বিপুল পরিমাণে পাওয়া যায়। গ্রিক মৃৎপাত্র সম্পর্কে আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রজেক্ট কর্পাস ভ্যাসোরাম অ্যান্টিকোরামের নথিমতে, প্রায় এক লক্ষ গ্রিক মৃৎপাত্র পাওয়া গেছে বিভিন্ন সময় খননকার্যের মাধ্যমে, যা সত্যিই অসাধারণ। বিপুল সংখ্যক গ্রিক মৃৎপাত্র পাওয়ার ফলে ও তার চিত্র বিশ্লেষণের মাধ্যমে প্রাচীন গ্রিক জাতি ও সভ্যতা সম্পর্কে অনেক কিছু অনুধাবন করা সম্ভব হয়ে উঠেছে।

আমরা ইতিহাস থেকে জানতে পারি, মৃৎপাত্র চিত্রকলার রীতি অনেক প্রাচীন আমল থেকে চলে আসছে। আমরা যদি মিশরীয় সভ্যতা লক্ষ করি, তাহলে দেখা যায় যে, সেই সময়েও চিত্র-সম্বলিত মৃৎপাত্র পাওয়া যায়, যেগুলো মূলত পিরামিডের মধ্যে তাদের ফারাওয়ের সমাধিস্থল বা মমির পাশে রাখা হতো এবং মৃত ফারাওয়ের বিভিন্ন প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি এতে সংরক্ষণ করা হতো।

প্রাচীন মিশরে এর প্রচলন ব্যাপক পরিসরে ছিল না। কারণ, এই পাত্রগুলো শুধু বিশেষ কাজের জন্য তৈরি করা হতো। চীন দেশেও খ্রিষ্টপূর্বকালে মৃৎপাত্র চিত্রকলার প্রচলন ছিল। তবে প্রাচীন সভ্যতাগুলোর মধ্যে শুধুমাত্র গ্রিস দেশেই ব্যাপক পরিসরে চিত্রকলা সম্বলিত মৃৎপাত্র পাওয়া যায় এবং তা ব্যবসা-বাণিজ্যের কারণে পৃথিবীর অনেক জায়গাতেই ছড়িয়ে পড়ে।

প্রাচীনকালের বেশিরভাগ সভ্যতা ও তাদের শিল্পকলার দিকে লক্ষ করলে তাদের ধর্মীয় বিশ্বাস, পুরাণ ও দর্শনের বিষয়গুলো সর্বাগ্রে চলে আসে। আর প্রাচীন গ্রিসও এর ব্যতিক্রম ছিল না। তাদের ধর্মীয় বিশ্বাস ও পুরাণ ছিল ঈশ্বর ও মহানায়কদের গল্প, পৃথিবীর প্রকৃতি, এবং ধর্ম পালনের গুরুত্ব ইত্যাদি নিয়ে গঠিত। আর তাদের দর্শন গুরুত্ব দিত কার্যকারণ অনুসন্ধানের উপর। তাদের এই ধর্মীয় বিশ্বাস, পুরাণ ও দর্শন নিয়ে তাদের শিল্পকলাও বিকাশ লাভ করেছিল, যার প্রমাণ তাদের মৃৎপাত্র চিত্রকলা, ভাস্কর্য, স্থাপত্য ইত্যাদিতে মেলে।

গ্রিসে মৃৎপাত্রে চিত্রকর্মের প্রথম উদাহরণ পাওয়া যায় গ্রিসের মিনোয়ান ও মিসিনিয়ান সভ্যতার কিছু মৃৎপাত্রে, যার সময়রেখা সম্ভাব্য খ্রিষ্টপূর্ব ১৭০০ থেকে ১৫০০ শতকে। তবে পরবর্তী সময়ে মিসিনিয়ান সভ্যতার পতন যুদ্ধ-বিগ্রহের কারণে গ্রিসে শিল্পকলা তেমন বিকাশ লাভ করেনি এবং গ্রিসে নেমে আসে এক অন্ধকার যুগ। তবে অন্ধকার যুগের সমকালীন সময়ে গ্রিসে টিকে থাকা অবশিষ্ট জাতির প্রথম শৈল্পিক অভিব্যক্তি হিসাবে গ্রিক মৃৎপাত্র চিত্রকলার যাত্রা শুরু হয় সম্ভাব্য খ্রিষ্টপূর্ব ১০৫০ অব্দে, এবং চলতে থাকে খ্রিষ্টপূর্ব ৩২০ অব্দ পর্যন্ত। গ্রিকরা তাদের নিত্য ব্যবহার এবং অন্যান্য কাজের জন্য এসব মৃৎপাত্র তৈরি করত, আর এসব মৃৎপাত্রের চিত্রকর্মের বিষয়বস্তু ছিল তাদের ধর্মীয় দর্শন, সাংস্কৃতিক বিশ্বাস এবং গ্রিক পুরাণের বিভিন্ন কাহিনী।

গ্রিকদের এই মৃৎপাত্রগুলোতে ব্যাপক পরিসরে চিত্রায়ন ও উৎপাদন শুরু হয় খ্রিষ্টপূর্ব ৬০০ থেকে ৪০০ শতকে।

কয়েকটি গ্রিক মৃৎপাত্র ও তার চিত্রকলার বিবরণ

  • ডিপাইলন ক্রেটার

এটি গ্রিসের মৃৎপাত্র চিত্রকলার ইতিহাসে একদম প্রথমদিকের মৃৎপাত্র, যেখানে ফিগার চিত্রিত করা হয়েছে, এবং প্রত্নতাত্ত্বিক খনন কাজের ফলে এটি গ্রিসের এথেন্স অঞ্চলের ডিপাইলন সমাধিক্ষেত্র থেকে পাওয়া গেছে। মৃৎপাত্রটির সময়রেখা সম্ভাব্য খ্রিষ্টপূর্ব ৭৪০ অব্দ। বড় এই পাত্রটি উচ্চতায় ৩ ফুট লম্বা এবং উপরের অংশটুকু খোলা। ধারণা করা হয়, কোনো ব্যক্তি সমাধিক্ষেত্রে গেলে এ ধরনের পাত্রে মৃত ব্যক্তির স্মরণে ফুল অর্পণ করা হতো।

ডিপাইলন ক্রেটার, সম্ভাব্য খ্রিষ্টপূর্ব ৭৪০ অব্দ; Image source: agefotostock / Alamy Stock Photo

চিত্রকলার বিবরণ ও বিষয়বস্তু

এই মৃৎপাত্রটিতে একজন মৃত ব্যক্তির শবযাত্রা চিত্রিত করা হয়েছে। মৃত ব্যক্তির শবযাত্রার জাঁকজমক দেখে ধারণা করা হয়, তিনি প্রাচীন সময়ের গ্রিসে সম্ভ্রান্ত পরিবারের মানুষ ছিলেন এবং তৎকালীন সমাজে তার মর্যাদা ছিল। মৃতপাত্রটির মাঝ বরাবর দুই সারিতে আনুভূমিকভাবে চিত্রিত করা হয়েছে, যাকে হরাইজন্টাল ন্যারেটিভ আর্ট বলা যেতে পারে। নিচের সারিতে লক্ষ করা যায়, ঘোড়াচালিত তিনটি রথ এবং তার সামনে সজ্জিত সৈন্যবাহিনী যাত্রা করছে। উপরের সারিতে লক্ষ করা যায় দু’পাশ থেকে বেশ কিছু ফিগার, যারা হয়তো মৃতব্যক্তির শেষ যাত্রার সাথে এসেছে। মাঝখানে মৃত ব্যক্তিটিকে রাখা হয়েছে, এবং মৃত ব্যক্তির আশেপাশের মানুষগুলো তার সৎকারের জন্য এসেছে। মৃত ব্যক্তির মাথার ডান পাশে একটি নারী অবয়ব দেখা যায়; হয়তোবা তিনি মৃত ব্যক্তির পরিবার, বা কাছের কোনো আত্মীয় অথবা মৃত ব্যক্তির পত্নী হিসেবে চিত্রিত হয়েছেন।

শৈলীগত বিবরণ

মৃৎপাত্রে চিত্রিত বিষয়বস্তুর ক্ষেত্রে জ্যামিতির বিশেষ উপস্থিতি লক্ষ করা যায়। ফিগার চিত্রিত করার ক্ষেত্রেও ত্রিভুজ, বৃত্ত, উপবৃত্ত ও বিভিন্ন ধরনের জ্যমিতিক আকার লক্ষ করা যায়। চিত্রিত ফিগার উপস্থাপনের ক্ষেত্রে শিল্পী একপাশ (প্রোফাইল ভিউ) থেকে উপস্থাপন করেছেন। ফিগারের আশেপাশের ফাঁকা স্থান পূরণ করার জন্য শিল্পী একধরনের বৃত্তাকার মোটিফ ব্যবহার করেছেন।

শিল্পী মৃৎপাত্রের হালকা রঙের পশ্চাৎপটের উপর কালো মসীবর্ণ ছায়া পরিলেখের মাধ্যমে তার চিত্রিত বিষয়বস্তুগুলোকে উপস্থাপন করেছেন। এছাড়াও শিল্পী তার মৃৎপাত্র চিত্রনের ক্ষেত্রে আনুভূমিকভাবে কয়েক সারি রেখা, ত্রিভুজাকার বলয় ব্যবহার করেছেন, যা পাত্রটিকে আরও নান্দনিক করে তুলেছে। আর একটি বিষয় লক্ষ করার মতো, শিল্পী পাত্রের নিচের অংশটুকু পুরোটা কালো না করে উপরের চিত্রিত বিষয়বস্তু ও নকশার সাথে ভারসাম্য রেখে কালো ও পাত্রের হালকা রঙের পশ্চাৎপট ফাঁকা রেখেছেন। ফাঁকা অংশটুকুতে আবার আনুভূমিক কালো রেখা ও ত্রিভুজাকার মোটিফ ব্যবহার করে অলংকরণ করেছেন, যা পুরো মৃৎপাত্রটিকেই চিত্রন ও অলংকরণের ক্ষেত্রে একধরনের ভারসাম্য দান করেছে, এবং নান্দনিকতার মাত্রা আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। 

  • ফ্রাংকোইস মৃৎপাত্র 

গ্রিক ব্ল্যাক ফিগার মৃৎপাত্রের প্রথম দিকের মৃৎপাত্রগুলোর মধ্যে ফ্রাংকোইস পাত্রের কথা বলা যেতে পারে। মৃৎপাত্রটি ১৮০০ খ্রিষ্টাব্দে চিউসিতে এট্রসকান সমাধিক্ষেত্র থেকে প্রত্নতাত্ত্বিক খননকার্যের ফলে পাওয়া যায়। প্রত্নতত্ত্ববিদের নামের সাথে মিল রেখে ৬৬ সেন্টিমিটার উচ্চতাবিশিষ্ট এবং সময়রেখা সম্ভাব্য ৫৭০ খ্রিষ্টপূর্বে নির্মিত এই মৃৎপাত্রটির নামকরণ করা হয় ‘ফ্রাংকোইস মৃৎপাত্র’।

ফ্রাংকোইস মৃৎপাত্র, সম্ভাব্য খ্রিষ্টপূর্ব ৫৭০ অব্দ; Image source: Pottery

চিত্রকলার বিবরণ ও বিষয়বস্তু

মৃৎপাত্রটিতে ছ’টি সারিতে বিভক্ত মোট ২৭০টি ফিগার রয়েছে। মনুষ্য ফিগার, মানুষ ও প্রাণীর সমন্বয়ে কাল্পনিক ফিগার, প্রাণী, কাল্পনিক প্রাণী, ঘোড়াচালিত রথ, জড়বস্তু ইত্যাদি দেখতে পাওয়া যায় চিত্রগুলোতে। 

ফ্রাংকোইস মৃৎপাত্র চিত্রগুলোতে গ্রিক পুরাণের বিভিন্ন ঘটনা চিত্রিত হয়েছে। চিত্রগুলো ভালোভাবে বুঝতে হলে গ্রিক পুরাণের ঘটনাগুলো জানা আবশ্যক। তাই চিত্রগুলো ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে পৌরাণিক ঘটনাসহ বিবৃত করাকে অধিক শ্রেয়।

  • প্রথম সারি, ক্যালিডোনিয়ান বোর হান্ট

ক্যালিডনের রাজা ওয়েনেউস তার রাজ্যে প্রচুর ফসলের জন্য দেব-দেবীদের উদ্দেশে বলিদান উৎসবের আয়োজন করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু তিনি শিকারের দেবী আর্টেমিসকে অবহেলা করেছিলেন। ফলে দেবী ক্রোধে ক্যালিডন অঞ্চলে শস্য-আঙুরের ক্ষেত ধ্বংসের জন্য একটি বিশাল আকৃতির বন্য শূকর পাঠান। রাজা শূকরটি প্রতিরোধের জন্য তার মহানায়কদের প্রেরণ করেন; সেই যুদ্ধের দৃশ্যটিই চিত্রিত হয়েছে প্রথম সারিতে। 

  • দ্বিতীয় সারি, ফিউনেরাল গেমস অভ প্যাট্রোক্লাস

প্যাট্রোক্লাস এবং অ্যাকিলিস খুব ভালো বন্ধু ছিলেন। ট্রোজান যুদ্ধের সময় অ্যাকিলিস এবং রাজা আরগামেমনের মধ্যে তর্ক হয়েছিল। এরপর অ্যাকিলিস গ্রিকদের লড়াইয়ে সহায়তা করতে অস্বীকার করেছিলেন। কিন্তু প্যাট্রোক্লাস যুদ্ধ করতে চেয়েছিলেন, তাই তিনি গোপনে অ্যাকিলিসের বর্ম ধার নিলেন এবং লড়াইয়ে নামলেন। যুদ্ধের সময় প্যাট্রোক্লাস নিহত হন। শোকাহত অ্যাকিলিস তার সম্মানে দুর্দান্ত এক অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া ক্রীড়াপর্বের আয়োজন করেছিলেন। এই ক্রীড়াপর্বটিই চিত্রিত হয়েছে দ্বিতীয় সারিতে।

  • তৃতীয় সারি, ম্যারেজ অভ পিলিউস টু থেটিস

মৃৎপাত্রটির মধ্যখানে গ্রিক পুরাণের একটি গুরুত্বপূর্ণ পৌরাণিক কাহিনী চিত্রিত হয়েছে। গ্রিক পুরাণ অনুসারে, দেবতা জিউস সমুদ্রদেবী থেটিসের সৌন্দর্যে মুগ্ধ ছিলেন এবং বিয়ে করতে চাইতেন থেটিসকে। কিন্তু দৈববাণী আসে, জিউস ও থেটিসের সম্পর্কের ফলে যে সন্তান জন্ম নেবে, সে জিউসের চেয়ে অধিক ক্ষমতাশীল হবে। ফলে, জিউস তার নিজের প্রভুত্ব রক্ষা করার জন্য থেটিসকে আর বিয়ে করেননি। তার পরিবর্তে থেটিসের বিয়ে হয়েছিল একজন নশ্বর মর্ত্যমানব পিলিউসের সাথে। তৃতীয় সারিতে সেই বিয়ের দৃশ্যটিই চিত্রিত হয়েছে।

  • চতুর্থ সারি, পারস্যুট অভ ট্রয়লাস বাই অ্যাকিলিস

দৈববাণী অনুসারে, ট্রয় নগরীর পতন হবে না; যদি রাজা প্রিয়ামের পুত্র ট্রয়লাসকে তার বিংশ জন্মদিনের আগে হত্যা না করা যায়। অ্যাকিলিসকে দেবী অ্যাথেনার দ্বারা ট্রয়লাসকে হত্যা করার আহ্বান জানানো হয়েছিল। অ্যাকিলিস পাহাড়ে ঝর্ণার কাছে একটি বাড়িতে অপেক্ষা করেছিলেন ট্রয়লাসকে ধরার জন্য, ট্রয়লাস ঝর্ণার কাছে তার ঘোড়াকে পানি পান করাতে নিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু পরমুহূর্তেই অ্যাকিলিস ট্রয়লাসের উপর অতর্কিত হামলা করেন। ট্রয়লাস ঘোড়ার পিঠে করে পালিয়ে যেতে চেষ্টা করেন। কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই অ্যাকিলিস তাকে অ্যাপোলোর মন্দিরের বেদীতে হত্যা করতে সক্ষম হন। অ্যাকিলিস কর্তৃক ট্রয়লাসকে হত্যা করার যে চেষ্টা বা সাধনা, সে দৃশ্যটি চিত্রিত হয়েছে চতুর্থ সারিতে।

  • পঞ্চম সারি, গ্রিফিন

পৌরাণিক কাল্পনিক প্রাণী গ্রিফিন চিত্রিত হয়েছে পঞ্চম সারিতে, যা সিংহের শরীর এবং ইগলের মাথার সমন্বয়ে গঠিত পৌরাণিক প্রাণী বিশেষ।

  • ষষ্ঠ সারি, ব্যাটল অভ পিগমিস অ্যান্ড ক্রেনস

গ্রিক পুরাণমতে, পিগমি হচ্ছে গ্রিস দেশের একটি ক্ষুদ্র উপজাতি। ইলিয়াড অনুসারে, তারা ক্রেনস (লম্বা মাথা ও পা বিশেষ পাখি)-এর সাথে অবিচ্ছিন্ন এক যুদ্ধে জড়িত ছিল। তাদের যুদ্ধের দৃশ্যটি চিত্রিত হয়েছে সবার নিচের শেষ সারিতে।

শৈলীগত বিবরণ

মৃৎপাত্রটিতে গ্রিক পুরাণ ও তাদের মহাকাব্য ইলিয়াডের বিভিন্ন ঘটনাদৃশ্য চিত্রিত হয়েছে। প্রাচীনকালে এ ধরনের ঘটনা চিত্রণের ক্ষেত্রে শিল্পীদের মূল লক্ষ্য থাকত সামগ্রিক ঘটনাটিকেই বেশি গুরুত্ব দিয়ে দেখা। ফলে অঙ্কনটি রিয়েলিস্টিক বা ন্যাচারিলিস্টিক করার ক্ষেত্রে বেশি গুরুত্ব আসত না। এর পরিবর্তে শিল্পী সহজ ও সাবলীলভাবে উপস্থাপন করার চেষ্টা করতেন বিভিন্ন ধরনের আকার ও জ্যামিতিক আকৃতি ব্যবহার করে। চিত্রিত করার ক্ষেত্রে শিল্পী ‘ব্ল্যাক ফিগার পদ্ধতি’ ব্যবহার করেছেন, অর্থাৎ পাত্রের হালকা রঙের বর্ণের উপর কালো মসীবর্ণ ছায়া পরিলেখের মাধ্যমে চিত্রিত বিষয়বস্তু উপস্থাপন করেছেন।

চিত্রিত বিষয়বস্তুকে শিল্পী প্রোফাইল ভিউ, তথা একপার্শ্বিক উপস্থাপন করেছেন। শিল্পী ফিগার চিত্রনের পাশাপাশি বিভিন্ন ধরনের আলংকারিক মোটিফ ব্যবহার করেছেন হাতল ও পাত্রের নিচের প্যানেল অলংকরণ করার জন্য, যা চিত্রিত ফিগার তথা গোটা চিত্রকর্মটিকেই একধরনের ভারসাম্য দান করেছে এবং নান্দনিকতা আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।

  • করিন্থিয়ান ব্ল্যাক ফিগার ওরিয়েন্টাল মৃৎপাত্র

ওরিয়েন্টাল গ্রিক মৃৎপাত্রগুলোর মধ্যে গ্রিসের করিন্থিয়ান অঞ্চলে প্রাপ্ত ব্ল্যাক ফিগার পদ্ধতিতে চিত্রিত একটা মৃৎপাত্রের কথা বলা যেতে পারে। এক ফুট দুই ইঞ্চি উচ্চতাবিশিষ্ট পাত্রটির সময়রেখা সম্ভাব্য খ্রিষ্টপূর্ব ৬২৫-৬০০ অব্দ, এবং বর্তমানে লন্ডনে ব্রিটিশ জাদুঘরে সংরক্ষিত আছে।

করিন্থিয়ান ব্ল্যাক ফিগার ওরিয়েন্টাল মৃৎপাত্র, সম্ভাব্য খ্রিষ্টপূর্ব ৬২৫- ৬০০ অব্দ; Image source: Gareth Hughes

চিত্রকলার বিবরণ ও বিষয়বস্তু

মৃৎপাত্রটিতে ছ’টি সারিতে পৌরাণিক কাল্পনিক প্রাণী ও বাস্তব বেশ কিছু প্রাণীর চিত্র অঙ্কিত হয়েছে। মৃৎপাত্রটির সবার উপরে গলার কাছে সিরেন (পাখি ও নারী দেহের সমন্বয়ে গঠিত কাল্পনিক প্রাণী) চিত্রিত হয়েছে। এছাড়া অন্যান্য সারিতে রয়েছে বন্য শূকর, সিংহ, চিতা বাঘ ও প্রাচ্য দেশীয় অনুপ্রাণিত কাল্পনিক প্রাণী স্ফিংস, লামাসু প্রভৃতি।

শৈলীগত বিবরণ

মৃৎপাত্রটি চিত্রিত বিষয়গুলো ব্ল্যাক ফিগার পদ্ধতিতে করা হয়েছে। যেহেতু ব্ল্যাক ফিগার পদ্ধতির মাধ্যমে চিত্রগুলো কালো মসীবর্ণ ছায়া পরিলেখ হতো, তাই ড্রইংয়ে সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম ডিটেইলিংয়ের কাজটুকু শিল্পী তীক্ষ্ণ কোনোকিছু দিয়ে খোদাই করতেন। তাই মাঝে মাঝে ওরিয়েন্টাল মৃৎপাত্রগুলো দেখলে মনে হয়, শিল্পী যেন কোনো ধাতব বস্তু খোদাই করে চিত্রিত করেছেন। চিত্রিত বিষয়বস্তু মৃৎপাত্রটিতে প্রোফাইল ভিউয়ে উপস্থাপন করা হয়েছে।

গ্রিক মৃৎপাত্র পেইন্টিং উপকরণ এবং উৎপাদন

  • মাটি তৈরি: একটি আদর্শ গ্রিক মৃৎপাত্র তৈরি করার প্রথম পদক্ষেপ হচ্ছে মাটি তৈরি করা। গ্রিসের অ্যাটিক শহরের অতিরিক্ত লোহাসমৃদ্ধ মাটি সংগ্রহ করা হতো, এই মাটি মূলত পাত্রকে এক ধরনের লালচে-কমলা বর্ণ দিত। মাটি সংগ্রহের পর মাটিতে মিশে থাকা, পাথর, নুড়ি পাথর, ও অন্যান্য অপদ্রব্য মাটি থেকে অপসারণের প্রয়োজন হতো। কুমোর প্রথমে মাটি পানির সাথে মেশাতেন, তারপর মাটিকে পানিতে আলোড়িত করা হতো। তারপর আস্তে আস্তে বিভিন্ন অপ্রয়োজনীয় অপদ্রব্য পানির উপরে ভেসে উঠত। তারপর এগুলো বাদ দিয়ে দেওয়া হতো। এই প্রক্রিয়াটি বেশ অনেকবার করা হতো। যত বেশি করা হতো, তত বেশি ভাল মাটি তৈরি করা সম্ভব হতো।

  • প্রস্তুতকরণ: কুমোর মাটিগুলো নিয়ে তারপর পা দিয়ে দলাদলি করতেন। এতে করে মাটির ভেতরের বাতাস বের হয়ে যেত, এবং মাটি আরও বেশি নরম হয়ে উঠত। তারপর কুমোর তার ঘূর্ণায়মান চাকার সাহায্যে পাত্র তৈরি করতেন। যখন কুমোর হাত দিয়ে মাটির বিভিন্ন আকৃতির ভাস তৈরি করতেন, তখন একজন সহকারী চাকাটি ঘোরাতেন এবং কুমোর তার ইচ্ছামতো বিভিন্ন আকৃতি দিয়ে পাত্র তৈরি করতেন। তারপর মাটির সাথে পানি মিশিয়ে একধরনের স্লিপ তৈরি করা হতো এবং এই স্লিপ দিয়ে কুমোর পাত্রের সাথে হাতল ও বিভিন্ন অংশ জোড়া দিতেন এবং হাত দিয়ে মসৃণ করতেন। তারপর এসব পাত্র তৈরি হয়ে যেত চিত্রিত করার জন্য।

  • কুমোর এবং শিল্পী: মৃৎপাত্র তৈরি হওয়ার পর চিত্রশিল্পীকে ডাকা হতো। যদিও অনেক কুমোরই তাদের নিজেদের মৃৎপাত্রের উপর নিজেরাই চিত্রকর্ম করতেন। বর্তমানে বেশিরভাগ মানুষই গ্রিক মৃৎপাত্রের ক্ষেত্রে কুমোরের চেয়ে চিত্রশিল্পীকে বেশি গুরুত্ব দেন। কিন্তু সে সময়ে গ্রিসে কুমোরদের অধীনে দোকান থাকত, আর তারাই চিত্রশিল্পী নিয়োগ করে থাকতেন। চিত্রশিল্পীরা এক বিশেষ ধরনের তরলীকৃত মাটি বা ক্লে স্লিপ দিয়ে কুমোরদের তৈরি করা মৃৎপাত্রের উপর একধরনের তুলিবিশেষ দিয়ে ছবি আঁকতেন। তারপর মৃৎপাত্রগুলো আগুনে পোড়ানো হতো। যেহেতু গ্রিক মৃৎপাত্রে কুমোর এবং শিল্পীরা তাদের কাজের উপর স্বাক্ষর করতেন, তাই বেশকিছু মৃৎপাত্রশিল্পীর নামও জানা যায়। এদের মধ্যে ছিলেন ডিপাইলন মাস্টার (জ্যামিতিক যুগ), ক্লেতিয়াস (ব্ল্যাক ফিগার যুগ), অ্যান্ডোকিডিস পেইন্টার (রেড ফিগার যুগ) প্রমুখ।

    Image Source: Wikimedia Commons

শিল্প এবং কলাকৌশল

প্রাচীনকাল থেকে শিল্পীরা তাদের কর্মশালাগুলোতে শিল্পের কৌশল রঙ ও বিভিন্ন উপকরণ নিয়ে নানা ধরনের গবেষণা চালাতেন, যা তাদের কল্পনাকে বাস্তবে রূপদান করতে সহায়তা করেছিল। তবে প্রাচীনকাল থেকেই শিল্পীদের মধ্যে তাদের নিজেদের কৌশল নিজেদের মধ্যেই সংরক্ষণের একধরনের প্রবণতা দেখা যায়।

প্রাগৈতিহাসিককাল থেকেই মানুষ ছবি এঁকে আসছে, তার প্রমাণ গুহাচিত্র। শিল্পী যে শিল্প তৈরি করে, তা যার মাধ্যমে যেভাবে সম্পাদন করে থাকে, এটিই হচ্ছে তার শিল্পের কলাকৌশল কিংবা শিল্পীর শিল্প রচনায় তার নিজস্ব বুদ্ধিবৃত্তিক কৌশল। তাই শিল্প এবং কলাকৌশল একটি অপরটির সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত।

তবে প্রযুক্তি ও বিজ্ঞানের প্রভূত উন্নয়ন সাধনের ফলে শিল্পের কলাকৌশল শুধু শিল্পীদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ আর থাকে না। প্রতিটি বিষয়ের বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা আসার ফলে শিল্পের কলাকৌশল আরও সহজ হয়ে পড়ে এবং ব্যাপকভাবে শিল্পের প্রসার হয়।

চিত্রকলা ও কলাকৌশল

কুমোরের মৃৎপাত্রগুলো বানানো হয়ে গেলে এগুলো চিত্রিত করার জন্য একজন পেশাদার শিল্পীর কাছে নিয়ে যাওয়া হয়। তারপর যে মাটি ব্যবহার করে মৃৎপাত্রটি বানানো হয়েছে, সেই মাটি বিশেষভাবে তরল করে নেওয়া হতো, যাকে ক্লে স্লিপ বলে। তারপর শিল্পী এই ক্লে স্লিপ দিয়েই মৃৎপাত্রের উপর ছবি আঁকতেন। আঁকা শেষে মৃৎপাত্রগুলো প্রস্তুত হয়ে যেত পোড়ানোর জন্য। এক বিশেষ ধরনের দুই প্রকোষ্ঠবিশিষ্ট চুল্লিতে তিন ধাপে মৃৎপাত্রগুলোকে পোড়ানো হতো মৃৎপাত্রে চিত্রগুলোকে ফুটিয়ে তোলার জন্য।

প্রথম ধাপে চুল্লির উপরের প্রকোষ্ঠে মৃৎপাত্রগুলোকে রাখা হতো। তারপর জ্বালানি হিসাবে নিচের প্রকোষ্ঠে শুকনা কাঠ দিয়ে আগুন দেওয়া হতো। বলে রাখা ভালো, চুল্লির ভেতর অক্সিজেন আসার জন্য বেশ কিছু ছিদ্র থাকতো। শুকনো কাঠের আগুনে চুল্লির তাপমাত্রা ৯০০-৯৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত বাড়ানো হতো। এতে করে পুরো মৃৎপাত্রটি এক লালচে-কমলা বর্ণ ধারণ করতো।

দ্বিতীয় ধাপে চুল্লির নিচের প্রকোষ্ঠ থেকে শুকনো কাঠগুলো সরিয়ে দিয়ে জ্বালানি হিসাবে ভেজা কাঠ দেওয়া হতো এবং চুল্লিতে অক্সিজেন আসার জন্য ছিদ্রগুলো বন্ধ করে দেওয়া হতো। এতে করে চুল্লির ভেতর কার্বনের কালো ধোঁয়া সৃষ্টি হতো, ফলে পুরো মৃৎপাত্রটি এবার কালো বর্ণ ধারণ করত।

এবার তৃতীয় ধাপে জ্বালানি হিসেবে ভেজা কাঠ সরিয়ে দিয়ে আবার শুকনো কাঠ ব্যবহার করা হতো। চুল্লিতে অক্সিজেন সরবরাহ করার জন্য চুল্লির ছিদ্রগুলো খুলে দেওয়া হতো। চূড়ান্ত এ ধাপে আবার চুল্লির তাপমাত্রা ৯৫০-১০০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস করা হতো। এতে করে মৃৎপাত্রের ক্লে স্লিপ দেওয়া অংশটুকু শুধু কালো থেকে যেত, এবং পুরো মৃৎপাত্রটিই লালচে-কমলা হয়ে যেত।

পুরো এই প্রক্রিয়াটির সঠিক প্রয়োগের মাধ্যমে সম্পন্ন হয়ে যেত চিত্র-সম্বলিত গ্রিক মৃৎপাত্র। আসলে আগুনে পোড়ানোর মাধ্যমে মৃৎপাত্রে চিত্র ফুটিয়ে তোলা একধরনের কৌশল, আর গ্রিকরা এতে বেশ পারদর্শী ছিল। তারা কখনো ক্লে স্লিপ দিয়ে ছবি এঁকে করে আগুনে মৃৎপাত্রগুলো পোড়াত, এতে করে যেমন মৃৎপাত্রের চিত্রিত অংশটুকু কালো হয়ে যেত; ঠিক তেমনি কখনো তারা মৃৎপাত্রে চিত্রের অংশটুকু ফাঁকা রেখে বাকি অংশটুকু ক্লে স্লিপ দিয়ে দিত, এতে করে ড্রইংয়ের অংশটুকু লালচে-কমলা থাকত, আর বাকি অংশটুকু কালো হয়ে যেত। আবার কখনো তারা দু ধরনের কৌশলই ব্যবহার করা হতো। জটিল এ প্রক্রিয়ার কারণে পরিষ্কারভাবে বলতেই হয়, এই শিল্পীরা আদপেই বেশ কৌশলী ছিলেন।

গ্রিক মৃৎপাত্রের অংশসমূহ

আদর্শ গ্রিক মৃৎপাত্রের বিভিন্ন অংশ; Image Credit: Khanacademy

একটি আদর্শ গ্রিক মৃৎপাত্র বেশ কিছু অংশের সমন্বয়ে গঠিত:

১। লিপ: মৃৎপাত্রের একেবারে উপরের অংশ, যার মাধ্যমে পাত্রের ভিতরে কিছু রাখা হতো বা কিছু বের করা হতো।

২। নেক: লিপের পরের অংশ হচ্ছে নেক বা গলা। ব্যবহারের উপর ভিত্তি করে এটি মোটা বা চিকন হতো।

৩। হ্যান্ডেল: মৃৎপাত্রকে ধরার জন্য এই হ্যান্ডেল বা হাতল ব্যবহার করা হতো।

৪। বডি: মৃৎপাত্রের মূল অংশ, যেখানে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র রাখা হতো।

৫। ফুট: মৃৎপাত্রের নিচের অংশ, যার উপর ভর করে মৃৎপাত্রটি দাঁড়িয়ে থাকত।

ব্যবহার অনুযায়ী আকার ও আকৃতি

বেশ কয়েক ধরনের আকৃতির গ্রিক মৃৎপাত্র দেখা যায়, কারণ তারা এসব মৃৎপাত্র তৈরি করেছিলেন নিত্য ব্যবহারের জন্য। আকার-আকৃতি ও ব্যবহারের দিক থেকে এসব মৃৎপাত্রের ভিন্ন ভিন্ন নামও রয়েছে।  

  • সংরক্ষণ এবং পরিবহনের জন্য ব্যবহৃত হতো এমফোরা, পিথস, পিলাইক, হাইড্রা, স্টমনস।

  • ক্রেটার, ডিনস, মিশ্রণ পাত্র হিসাবে ব্যবহৃত হতো।

  • কাইলিক্স পানপাত্র হিসাবে ব্যবহৃত হতো।

  • তেল, পারফিউম এবং কসমেটিক্স সংরক্ষণের জন্য ব্যবহৃত হতো বড় লেকাইথোস এবং ছোট অ্যারিব্যালোস, অ্যালাবাস্ট্রন প্রভৃতি।

গ্রিক মৃৎপাত্রের আকার-আকৃতি; Image Credit: Khanacademy

শৈলীগত দিক থেকে গ্রিক মৃৎপাত্র চিত্রকলা

সাজানোর শৈলী বা মৃৎপাত্রে চিত্রিত বিষয়বস্তু উপস্থাপনের কৌশলের দিক থেকে গ্রিক মৃৎপাত্র চিত্রকলাকে ছয় ভাগে ভাগ করা যায়:

  • প্রোটো-জিওমেট্রিক মৃৎপাত্র চিত্রকলা

গ্রিসের মিসিনিয়ান সভ্যতার পতন, যুদ্ধ-বিগ্রহ ও নানা কারণে গ্রিসে অন্ধকারাচ্ছন্ন সময় নেমে আসে, যা ইতিহাসে ‘গ্রিক অন্ধকার যুগ’ নামে পরিচিত এবং মহাকবি হোমারের নামে ‘হোমারিক যুগ’ও বলা হয়ে থাকে, যার সময়কাল ছিল সম্ভাব্য ১১০০ খ্রিষ্টপূর্ব থেকে ৮০০ খ্রিষ্টপূর্ব। স্বভাবতই সুখ-সমৃদ্ধি হারিয়ে যাওয়ার ফলে এ সময় শিল্পকর্মের তেমন বিকাশ হয়নি।

প্রত্নতাত্ত্বিক খননকার্যের ফলে এ সময় গ্রিসে টিকে থাকা সভ্যতার অল্প কিছু প্রাচীন শিল্পের যে নিদর্শন পাওয়া যায়, তাতে দেখা যায়, অলঙ্করণের ক্ষেত্রে জ্যামিতিকতা, যা অল্প কিছু অলঙ্কারিক মোটিফের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। এ সময় যেসব গ্রিক মৃৎপাত্র উদাহরণ হিসেবে পাওয়া যায়, তার অংকনশৈলী অনুযায়ী মৃৎপাত্রগুলোকে প্রোটো-জিওমেট্রিক শৈলীর মৃৎপাত্র বলা হয়, যার সময়কাল সম্ভাব্য ১০৫০ থেকে ৯৫০ খ্রিষ্টপূর্ব পর্যন্ত।

প্রোটো-জিওমেট্রিক শৈলীর মৃৎপাত্রগুলোর অলঙ্করণের ক্ষেত্রে বৃত্ত, ত্রিভুজ, ঢেউয়ের মতো রেখা বিভিন্ন বিমূর্ত মোটিফ লক্ষ করা যায়।  মৃৎপাত্রগুলোতে কিছু রেখায় কালো-লাল উভয় বর্ণের সংমিশ্রণ দেখা যায়, যা মূলত আগুনে পোড়ানোর তাপমাত্রা কম-বেশির ফলে হতো। পরে তিন ধাপে আগুনে পোড়ানোর প্রক্রিয়া আবিষ্কার হবার পর এ সমস্যার সমাধান হয়েছিল।    

প্রধান পার্থক্যকারী বৈশিষ্ট্য

  • মৃৎপাত্রের হালকা রঙের পশ্চাৎপটের উপর অল্প কিছু জ্যামিতিক মোটিফ, বৃত্ত, ত্রিভুজ, ঢেউয়ের মতো রেখা, আনুভূমিক রেখা প্রভৃতি মূলত কালো রঙ (যা সাধারণত পোড়ানোর ফলে আসতো) ব্যবহার করে চিত্রিত করা হতো।

প্রোটো-জিওমেট্রিক গ্রিক মৃৎপাত্র চিত্রকলা, সম্ভাব্য খ্রিষ্টপূর্ব ১০০০ শতক; Image source: wikimedia commons
  • জিওমেট্রিক মৃৎপাত্র চিত্রকলা

জিওমেট্রিক শৈলী হচ্ছে গ্রিক মৃৎপাত্র চিত্রকলার এক বিশেষ ধরনের শৈলী, যেখানে মৃৎপাত্র অলংকরণের ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরনের জিওমেট্রিক মোটিফ ব্যবহার হতো। মূলত জিওমেট্রিক শৈলীর যাত্রা শুরু হয় খ্রিষ্টপূর্ব ১১০০ অব্দ থেকে গ্রিক অন্ধকার যুগের সমকালীন সময়ে। প্রথম দিকের জিওমেট্রিক শৈলীর মৃৎপাত্রগুলো প্রোটোজিওমেট্রিক শৈলীর মৃৎপাত্র নামে পরিচিত। তবে খ্রিষ্টপূর্ব ১১০০ অব্দ থেকে যাত্রা শুরু হলেও মূলত খ্রিষ্টপূর্ব ৯০০ অব্দ থেকে গ্রিক মৃৎপাত্র চিত্রকলায় জ্যামিতিক শৈলী ব্যাপকভাবে বিকাশ লাভ করে, এবং চলতে থাকে খ্রিষ্টপূর্ব ৭০০ অব্দ পর্যন্ত। এর কেন্দ্রস্থল ছিল গ্রিসের এথেন্স অঞ্চল; পরবর্তী সময়ে ব্যবসা-বাণিজ্যের ফলে এজিয়ান সাগরের তীরবর্তী অন্যান্য দেশেও ছড়িয়ে পড়ে।

জ্যামিতিক শৈলীর মৃৎপাত্রের চিত্রকলাগুলো পূর্ববর্তী সময়ের চেয়ে আরও অনেক বেশি সুসজ্জিত ও নান্দনিক ছিল। মৃৎপাত্র চিত্রিত করার ক্ষেত্রে শিল্পী কর্তৃক গ্রিসের পৌরাণিক ও ধর্মীয় বিশ্বাসের বিভিন্ন ঘটনাও চিত্রিত হতে থাকে বিভিন্ন জ্যামিতিক প্যাটার্নে। এগুলো মূলত বর্ণনাধর্মী চিত্রকলা ছিল।

প্রধান পার্থক্যকারী বৈশিষ্ট্য

  • বিভিন্ন ধরনের জ্যামিতিক মোটিফ প্যাটার্ন ব্যবহার করে অলঙ্করণ করা হয়েছে। অধিক মাত্রায় সুসজ্জিত।

ডিপাইলন ক্রেটার, জিওমেট্রিক গ্রিক মৃৎপাত্র চিত্রকলা, সম্ভাব্য খ্রিষ্টপূর্ব ৮০০ শতক; Image source: James/Clustershot
  • ওরিয়েন্টাল মৃৎপাত্র চিত্রকলা

গ্রিস এবং পূর্ব ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের মধ্যে ভালো ব্যবসা-বাণিজ্য ছিল। দীর্ঘদিন ব্যবসা-বাণিজ্যের ফলে গ্রিসের সাথে পূর্ব ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলগুলোর সাংস্কৃতিক আদান-প্রদান ঘটে, যার ফলে গ্রিক মৃৎপাত্রে ওরিয়েন্টাল শৈলীর মৃৎপাত্রের যাত্রা শুরু হয় সম্ভাব্য খ্রিষ্টপূর্ব ৮০০ অব্দ থেকে, এবং চলতে থাকে খ্রিষ্টপূর্ব ৬০০ অব্দ পর্যন্ত। এ সময় অঙ্কিত গ্রিক মৃৎপাত্রের চিত্রের উপর পূর্ব ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের শিল্পকলারও প্রভাব লক্ষ করা যায়।  

গ্রিসের দু’টি অঞ্চলকে কেন্দ্র করে দু’ধরনের ওরিয়েন্টাল মৃৎপাত্র বিকাশ লাভ করে- এথেন্স এবং করিন্থিয়ান অঞ্চল। তবে মূলত ওরিয়েন্টাল শৈলীর মৃৎপাত্রের প্রথম যাত্রা শুরু হয় করিন্থিয়ান অঞ্চলে। এ অঞ্চলের মৃৎপাত্র পুরো গ্রিসেই সরবরাহ হতো। এথেন্স অঞ্চলের ওরিয়েন্টাল মৃৎপাত্রে দেখা যায়, বহিঃরেখার মাধ্যমে চিত্রাঙ্কন ও নকশা করা হয়েছে, যেন তারা কোনো দেওয়ালে আঁকিবুঁকি করেছেন। আবার অন্যদিকে করিন্থিয়ান অঞ্চলের মৃৎপাত্রে দেখা যায়, তারা অনেক ভালোভাবে ব্ল্যাক ফিগার পদ্ধতির মাধ্যমে প্রাণীর ছবি চিত্রিত করেছেন, এবং কালো মসীবর্ণ ছায়া পরিলেখের উপর খোদাই করে লাইনার ডিটেইলের কাজ করেছে। সাথে ফুলেল মোটিফও দেখা যায়। তাদের চিত্রিত করার ধরন এমন ছিল যে, তারা যেন কোনো ধাতব খোদাই করে চিত্রিত করেছে।

তাদের এই মৃৎপাত্রগুলোতে চিত্রিত করার বিষয়বস্তু ছিল স্ফিংস (কাল্পনিক প্রাণী), জিফরিন (কাল্পনিক প্রাণী), ইবেক্স (বন্য ছাগবিশেষ প্রাণী) সিংহ, ষাঁড় ইত্যাদি। মৃৎপাত্রের পেট বরাবর কয়েক সারিতে তারা এগুলো চিত্রিত করতেন। আর গ্রিক ওরিয়েন্টাল মৃৎপাত্রের ক্ষেত্রে হিউম্যান ফিগার খুবই দুর্লভ বিষয় ছিল। অল্প কিছু গ্রিক ওরিয়েন্টাল শৈলীর মৃৎপাত্রে মানব অবয়ব চিত্রিত পাওয়া যায়।

প্রধান পার্থক্যকারী বৈশিষ্ট্য

  • বিভিন্ন পৌরাণিক কাল্পনিক প্রাণী ও প্রাণীর চিত্র চিত্রিত করা হতো মৃৎপাত্রের পেট বরাবর কয়েক সারিতে।

  • রেখার মাধ্যমে নকশা ও ড্রইং সম্বলিত মৃৎপাত্র।

ওরিয়েন্টাল গ্রিক মৃৎপাত্র চিত্রকলা, সম্ভাব্য খ্রিষ্টপূর্ব ৮০০-৭০০ অব্দ; Image source: wikimedia commons   
  • ব্ল্যাক ফিগার মৃৎপাত্র চিত্রকলা

গ্রিক মৃৎপাত্র চিত্রকলার একটি বড় অংশ জুড়ে রয়েছে ব্ল্যাক ফিগার মৃৎপাত্র চিত্রকলা। মূলত খ্রিষ্টপূর্ব ৭০০ অব্দে গ্রিসের করিন্থিয়ান অঞ্চলে সর্বপ্রথম ব্ল্যাক ফিগার শৈলীর আবিষ্কার হয়। তবে খ্রিষ্টপূর্ব ৬৩০ শতকে গ্রিসের এথেন্স অঞ্চলের কুমোর ও শিল্পীরা মৃৎপাত্র চিত্রিত করার ক্ষেত্রে ব্ল্যাক ফিগার পদ্ধতিটি গ্রহণ করেন এবং তারা পূর্বের ওরিয়েন্টাল শৈলীতে মোটিফের পরিবর্তে মৃৎপাত্রে চিত্রিত করার ক্ষেত্রে মানব অবয়ব ও গ্রিক পুরাণের জনপ্রিয় পৌরাণিক কাহিনীগুলো চিত্রিত করতে থাকেন। খ্রিষ্টপূর্ব ৬০০ অব্দের মধ্যে গ্রিসের এথেন্স অঞ্চল একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র হয়ে ওঠে ব্ল্যাক ফিগার মৃৎপাত্র চিত্রকলার।

এটি মূলত মৃৎপাত্রের লালচে-কমলা-বাদামি বর্ণের উপর কালো বর্ণের মসীবর্ণ ছায়া-পরিলেখ ফিগার তৈরি করা হতো। এই ব্ল্যাক ফিগার পদ্ধতিতে মৃৎপাত্র চিত্রিত করার একটি বিশেষ কৌশল ছিল, কুমোর কর্তৃক মৃৎপাত্র তৈরির পর একধরনের ক্লে স্লিপ দিয়ে মৃৎপাত্রের নির্ধারিত অংশে ড্রইং করা হতো। পরবর্তীতে দেখা যেত, যখন মৃৎপাত্রগুলো প্রস্তুত করার জন্য তিন ধাপে আগুনে পোড়ানো হতো, তখন মৃৎপাত্রের ক্লে স্লিপযুক্ত অংশটুকু কালো থেকে যেত। এভাবেই সম্পন্ন হতো ব্ল্যাক ফিগার মৃৎপাত্র চিত্রকলা।

খ্রিষ্টপূর্ব ৫২০ শতকে গ্রিক মৃৎপাত্র চিত্রকলায় নতুন এক ধরনের চিত্রকলা দেখা যায়, যা ‘বাইলিঙ্গুয়াল ভাস পেইন্টিং’ নামে পরিচিত। এর এক পাশে ব্ল্যাক ফিগার এবং অন্য পাশে রেড ফিগার পদ্ধতিতে চিত্রকলা করা হতো। এরই পথ ধরে পরে রেড ফিগার মৃৎপাত্র চিত্রকলা জনপ্রিয় হয়ে ওঠে, ধীরে ধীরে ব্ল্যাক ফিগার মৃৎপাত্র চিত্রকলার প্রাধান্য কমতে থাকে।

প্রধান পার্থক্যকারী বৈশিষ্ট্য

  • মৃৎপাত্রের লালচে-কমলা রঙের পশ্চাৎপটের উপর চিত্রিত বিষয়বস্তু  ড্রইংয়ের অংশটুকু কালো মসীবর্ণ ছায়া পরিলেখের মাধ্যমে করা হতো। 

  • কিছুক্ষেত্রে ড্রইংয়ের লাইনার ডিটেইল কাজ খোদাই করে করা হতো।

ব্ল্যাক ফিগার গ্রিক মৃৎপাত্র চিত্রকলা, সম্ভাব্য খ্রিষ্টপূর্ব ৫২৫-৫২০ অব্দ; Image source: Caskey-Beazley, Attic Vase Paintings (MFA)
  • রেড ফিগার মৃৎপাত্র চিত্রকলা

গ্রিক মৃৎপাত্র চিত্রকলার ইতিহাসে রেড ফিগার মৃৎপাত্র চিত্রকলার যাত্রা শুরু হয় এথেন্স অঞ্চলে সম্ভাব্য খ্রিষ্টপূর্ব ৫২০ শতকে, এবং চলতে থাকে খ্রিষ্টপূর্ব ৩২০ শতক পর্যন্ত। রেড ফিগার মৃৎপাত্র চিত্রকলা মূলত ছিল ব্ল্যাক ফিগার চিত্রকলার বিপরীত। এখানে মূলত মৃৎপাত্রে ড্রইংয়ের অংশটুকু ফাঁকা রেখে বাকি অংশে ক্লে স্লিপ দেওয়ায় পোড়ানোর ফলে কালো হয়ে যেত, এবং চিত্রের অংশটুকু ফাঁকা রাখার ফলে পাত্রের সাধারণ লালচে-কমলা বর্ণই থাকতো। রেড ফিগার পদ্ধতির ফলে গ্রিক মৃৎপাত্র চিত্রকলায় ড্রইংয়ের ক্ষেত্রে নতুন সম্ভাবনার সৃষ্টি হয়েছিল।

কালো লাইনের মাধ্যমে ড্রইংয়ের অনেক ডিটেইল কাজ করা সম্ভবপর হয়েছিল, এছাড়াও চিত্রায়নের পরিপ্রেক্ষিত ব্যবহার দেখানোও সম্ভব হয়েছিল। আর একটি বিষয় লক্ষ করার মতো, পূর্বের মৃৎপাত্র চিত্রকলায় চিত্রিত করার ক্ষেত্রে শুধু প্রোফাইল ভিউতে চিত্রিত করা হতো চিত্রের বিষয়বস্তু, কিন্তু রেড ফিগার মৃৎপাত্র চিত্রকলায় এসে শিল্পী ফ্রন্টাল ভিউ এবং ওভারল্যাপিংয়ের বিষয়গুলোও গুরুত্বসহকারে উপস্থাপন করেন। ফলে পূর্বের মৃৎপাত্রে চিত্রে যে একধরনের একঘেয়েমি ছিল, তা কেটে যায়। আরও আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে মৃৎপাত্রের চিত্রগুলো।

যদিও গ্রিক রেড ফিগার মৃৎপাত্রে চিত্রিত বিষয়বস্তু মূলত গ্রিসের পুরাণ ও তাদের মহাকাব্যের জনপ্রিয় বিভিন্ন পৌরাণিক কাহিনী ছিল, কিন্তু তারপরও চিত্রিত বিষয়বস্তু পূর্বের চেয়ে বেশি সুস্পষ্ট হওয়ার কারণে চিত্রগুলো থেকে আরও বেশি তথ্য পাওয়া সম্ভব হয়।

প্রধান পার্থক্যকারী বৈশিষ্ট্য

  • মৃৎপাত্রে চিত্রিত অংশটুকুতে মৃৎপাত্রের লালচে-কমলা বর্ণের পশ্চাৎপট ব্যবহার করা হতো। তাছাড়া বাকি অংশটুকু কালো করা হতো।

রেড ফিগার গ্রিক মৃৎপাত্র চিত্রকলা, সম্ভাব্য খ্রিষ্টপূর্ব ৪৯০ অব্দ; Image source: Chuzeville—Rapho/Photo Researchers
  • হোয়াইট গ্রাউন্ড মৃৎপাত্র চিত্রকলা

হোয়াইট গ্রাউন্ড গ্রিক মৃৎপাত্রের ক্ষেত্রে একধরনের বিশেষ কৌশল, যেখানে সাদা পশ্চাৎপটের উপর চিত্রকলা করা হতো। খ্রিষ্টপূর্ব ৫০০ শতকে গ্রিসের অ্যাটিক অঞ্চলে সর্বপ্রথম হোয়াইট গ্রাউন্ড কৌশলের মৃৎপাত্রের প্রচলন শুরু হয়।

পরে গ্রিসের ল্যাকোনিয়া, এথেন্সসহ বিভিন্ন অঞ্চলে হোয়াইট গ্রাউন্ড মৃৎপাত্র প্রচলন শুরু হয়। এখানে মৃৎপাত্রের উপর কাওলিনাইট খনিজের তরলীকৃত রূপ দিয়ে পাত্রের উপর আস্তরণ দিয়ে পাত্রটিকে সাদা করা হতো। তবে রেড ও ব্ল্যাক ফিগার পদ্ধতির চেয়ে হোয়াইট গ্রাউন্ড পদ্ধতির মৃৎপাত্র চিত্রকলা কম টেকসই। তাই হোয়াইট গ্রাউন্ড পদ্ধতির গ্রিক মৃৎপাত্রগুলো নিত্য ব্যবহারের পরিবর্তে পূজা-অর্চনা, ব্রত ও গুরুত্বপূর্ণ কাজেই বেশি ব্যবহৃত হতো।

হোয়াইট গ্রাউন্ড গ্রিক মৃৎপাত্র চিত্রকলা, সম্ভাব্য খ্রিষ্টপূর্ব ৪৭০ অব্দ; Image source: wikimeda commons

প্রধান পার্থক্যকারী বৈশিষ্ট্য

  • মৃৎপাত্রে সাদা পশ্চাৎপটে কখনো মৃৎপাত্রের লালচে-কমলা বর্ণ ব্যবহার করে বিভিন্ন বিষয় চিত্রিত করা হতো, আবার কখনো ব্ল্যাক ফিগার পদ্ধতিতে চিত্রিত করে নিয়ে পুরো পাত্রের পুরো অংশ জুড়ে সাদা পশ্চাৎপট দিয়ে দেওয়া হতো।

সম্ভাব্য খ্রিষ্টপূর্ব ৩২০ অব্দের পর গ্রিস দেশে চিত্রকলার নতুন নতুন মাধ্যম আসার ফলে চিত্রকলার ক্ষেত্রে নতুন সম্ভাবনার সৃষ্টি হয়। এ সময় মোজাইকের মাধ্যমে দেয়ালচিত্র ও অন্যান্য মাধ্যম আরও জনপ্রিয় হয়ে ওঠে চিত্রকলার জন্য। ফলে দেখা যায়, গ্রিক মৃৎপাত্র চিত্রকলা তার জনপ্রিয়তা ধীরে ধীরে কমতে থাকে। তারপরও মৃৎপাত্র শিল্পীরা অনেক চেষ্টা করেছিলেন টিকিয়ে রাখার জন্য, কিন্তু ধীরে ধীরে তা বিলুপ্ত হয়ে যায়।

শেষ কথা

মানুষ এবং ধর্ম দুটো বিষয়ই একে অপরের সাথে বেশ ভালোভাবে জড়িত। প্রাচীন জাতি সভ্যতা ও মানুষগুলোর শিল্পকর্ম সামনে চলে আসলে বারবার একটি বিষয়ই স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, তারা সে সময় তাদের ধর্ম, বিশ্বাস, পুরাণ দ্বারা ঠিক কতটা প্রভাবিত ছিল। আমরা যদি প্রাগৈতিহাসিক সময়ে ফিরে যাই, তাহলে দেখা যাবে ঐ সময়ে যেসব গুহাগুলো চিত্রিত হয়েছে, তা বেশিরভাগই চিত্রনের পেছনের কারণ ছিল তাদের ধর্মীয় বিশ্বাস, জাদু বিশ্বাস ইত্যাদি। বেশিরভাগ গবেষক ও পণ্ডিতরা এটাই মনে করতেন যে, কোনো এক বিশ্বাসকে কেন্দ্র করেই শিল্পীরা গুহাগুলোকে চিত্রিত করে থাকতেন।

আর আমরা যদি আমাদের ভারতীয় উপমহাদেশের কথা বলি, খ্রিষ্টপূর্বকালে আমাদের উপমহাদেশেরও শিল্পকলা বিকশিত হয়েছিল ধর্মীয় বিশ্বাস, পুরাণ ও মহাকাব্যকে কেন্দ্র করে। যার প্রমাণ মৌর্য, সুঙ্গ, অন্ধ্র, কুশান, গুপ্ত, পাল সাম্রাজ্যের বিভিন্ন ভাস্কর্য- যা বিভিন্ন সময়ে প্রত্নতাত্ত্বিক খননকার্যের ফলে পাওয়া গিয়েছিল।

ইউরোপ মহাদেশে শিল্প, শিক্ষা, সাহিত্য সবদিক থেকেই উন্নত দেশ যদি গ্রিসও খুব বেশি ব্যতিক্রম ছিল না। তাদের শিল্পের উপরও তাদের দেশের গড়ে ওঠা ধর্মীয় বিশ্বাস, পুরাণ, মহাকাব্যের প্রভাব স্পষ্ট।

খ্রিষ্টপূর্বকালে একটি বড় সময় জুড়ে গ্রিসে মৃৎপাত্র চিত্রকলা চর্চা হয়েছে, আর সে অঞ্চলের মানুষরা তাদের নিত্য ব্যবহার্য ও বিভিন্ন কাজে ব্যবহারের জন্য একদম সাধারণ নকশা এবং জ্যমিতিক নকশার মাধ্যমে এই মৃৎপাত্রের যাত্রা শুরু করেছিল। যতই দিন গেছে, ততই সমৃদ্ধ এবং আরও বিকাশ লাভ করেছে গ্রিক মৃৎপাত্র চিত্রকলা।

এইসব মৃৎপাত্র চিত্রিত হয়েছিল তাদের ধর্মীয় বিশ্বাস, পুরাণ, দর্শন ও সাংস্কৃতিক জীবনের অনেক কাহিনী নিয়ে, যা দিয়ে তারা নিজের অজান্তেই তাদের সভ্যতা ও তাদের সভ্যতা জনগণ কী বিশ্বাস করে, কী পালন করে, কী পোশাক পরে- এমন সব গল্পই বলে গেছে। ফলে এসব মৃৎপাত্রের আবিষ্কারের কারণে তাদের সম্পর্কে জানা আরও সহজ হয়ে গেছে।

আসলে চিত্রকলা একধরনের ভাষা। শিল্পী হয়তো মনের মতো করে রঙ-তুলি দিয়ে কিছু একটা এঁকে ফেলছে, কিন্তু তিনি হয়তো তার পারিপাশ্বিক বা সমসাময়িক ঘটনাবলী এমন কিছুতেই প্রলুব্ধ হয়েছেন, যা তার জীবনে প্রভাব ফেলেছে। কারণ, শিল্পী মন তার বিশ্বাস-পারিপার্শ্বিকতা দ্বারাই প্রভাবিত হয়। আর পরে যখন সেই বিষয়টিই আবার খুঁজে পাওয়া যায়, তখন হয়তো দেখা যায় যে, শিল্পী তার অঙ্কিত চিত্রকলার মধ্যে অনেক কিছুই রেখে গেছেন, যা তার সময়কার কথা বলে, তার বিশ্বাসের কথা বলে। এটি ভাবতেই ভালো লাগে যে, ঠিক একইভাবে গ্রিক মৃৎপাত্র চিত্রকলার মাধ্যমেও এত বছর পরও প্রাচীন গ্রিস সভ্যতা সম্পর্কে অনেক কিছু জানা সম্ভব হচ্ছে।

This article is in Bangla language. It is about the arts and crafts of ancient greek pottery and mythology.

Featured Image: ShutterStock

References:

1. Gardner's Art through the Ages A Global History 13th edition- Chapter 4- Page: 107- Chapter 5- Page: 121,123,123.

2. https://www.britannica.com/place/ancient-Greece

Related Articles