বর্ষার দীর্ঘ বর্ষণ শেষে যখন সাদা তুলোর পেঁজার মতো মেঘদল আকাশে ভেসে বেড়ায়, রাতে ঝরে মৃদু শিশির, তখন শরতের প্রাক্কালে অরুণ রাঙা দৃপ্ত চরণে সূচনা হয় দেবীপক্ষের। শাঁখ-কাঁসার শব্দে, উলুধ্বনিতে, চণ্ডীপাঠের মাধ্যমে মর্ত্যালোকে আমন্ত্রণ জানানো হয় দেবী দুর্গাকে। শ্রী শ্রী চণ্ডীপাঠের মধ্য দিয়ে দেবী দুর্গার ধরাধামে আগমনই শুভ মহালয়া হিসেবে পরিচিত। অসুরনাশিনী দেবী দুর্গা প্রতি বছর মর্ত্যে আসেন তার ভক্তকূলের জন্য শক্তির বর নিয়ে। মহালয়ার সময়, ইতিহাস, পালনপ্রথা ইত্যাদি নিয়েই আমাদের আজকের এ আয়োজন।
প্রথমে দুর্গাপূজার আবির্ভাব নিয়ে সামান্য করে হলেও কিছু না বললেই নয়। দুর্গাপূজা মূলত শুক্লপক্ষে হয়ে থাকে। আশ্বিন মাসের শুক্লায় যে পূজা করা হয়, তাকে শারদীয় দুর্গাপূজা আর চৈত্রমাসে যে দুর্গাপূজা হয়, তাকে বাসন্তী দুর্গাপূজা বলা হয়। সনাতনীদের মাঝে দু ধরনের পূজা পালন দেখা গেলেও সাধারণত বাসন্তী পূজাটি খুব কম সংখ্যক মানুষের মাঝেই সীমাবদ্ধ। মূলত বাসন্তীকালে দেবী দুর্গার পূজা দেয়ার রীতি থাকলেও ভগবান শ্রীরাম যখন সীতাকে উদ্ধার করার জন্যে লঙ্কাপানে যাচ্ছিলেন, তখন তিনি রাবণকে দমন ও সীতাকে উদ্ধারের জন্যে শক্তির দেবী দুর্গার পূজা করেন। আশ্বিন মাসে রামচন্দ্র এ পূজা দিয়েছিলেন বিধায় তার ধারাবাহিকতায় শরৎকালে দুর্গাপূজার আয়োজন করা হয়। অকালে এ পূজা দেয়া হয়েছিল বিধায় একে অকালবোধনও বলা হয়ে থাকে।
দুর্গাপূজার মূল উৎসবকাল পাঁচদিন- মহা ষষ্ঠী, মহা সপ্তমী, মহা অষ্টমী, মহা নবমী ও বিজয়া দশমী। বিজয়ার দিনে দেবী দুর্গা মর্ত্যলোক ত্যাগ করে ফেরত চলেন। তবে দেবী দুর্গা কবে আসেন মর্ত্যে? এর উত্তরই শুভ মহালয়া। মহালয়া শব্দের আক্ষরিক সমার্থ হলো 'আনন্দ নিকেতন’। দেবী মায়ের আগমনী সুরে আনন্দের বার্তা আসে পৃথিবী জুড়ে। দেবীপক্ষের সূচনাকালেই ধরাধামে আবির্ভূত হন দুর্গা। চাঁদের হিসেব অনুসারে দেবীপক্ষের সূচনা হয় পূর্বের অমাবস্যার দিনে। এই দিনটিই মহালয়া নামে পরিচিত। যেহেতু চাঁদের হিসেবে প্রতি অর্ধমাসে একবার করে পূর্ণিমা ও অমাবস্যা হয়, তাই দেবীপক্ষের সমাপ্তি যে পঞ্চদশ দিনে অর্থাৎ পূর্ণিমায়, এই দিনটি কোজাগরী পূর্ণিমা নামে পরিচিত। সনাতন ধর্মাবলম্বীরা এ দিনটিতে লক্ষ্মীপূজার আয়োজন করে থাকেন। দুর্গাপূজা মূলত পাঁচদিন ব্যাপ্তির পূজো হলেও মহালয়া থেকেই প্রকৃত উৎসবের সূচনা ও কোজাগরী লক্ষ্মীপূজায় তার সমাপ্তি হয়।
পঞ্চদশীয় চান্দ্র আবর্তনের মাঝে সাধারণত পনেরোটি তিথি থাকে। এই সব কয়টিকেই মহালয়ার তিথি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। মহালয়া পক্ষের পনেরোটি তিথির নাম হলো প্রতিপদ, দ্বিতীয়া, তৃতীয়া, চতুর্থী, পঞ্চমী, ষষ্ঠী, সপ্তমী, অষ্টমী, নবমী, দশমী, একাদশী, দ্বাদশী, ত্রয়োদশী, চতুর্দশী ও অমাবস্যা। সনাতনী বিশ্বাস অনুযায়ী, যে ব্যক্তি তর্পণে ইচ্ছুক হন, তাকে তার পিতার মৃত্যুর তিথিতে তর্পণ করতে হয়।
তর্পণ শব্দটির সাথে হয়তো সনাতনী ধর্মাবলম্বীদের বাইরে অন্যরা সেভাবে অনেকে পরিচিত নয়। তর্পণ মানে কাউকে সন্তুষ্ট করা, খুশি করা। সনাতন ধর্মে কোনো শুভ কাজ করতে গেলে পূর্বপুরুষদের জন্য, যাদের পিতা-মাতা নেই, তাদের পিতা-মাতার জন্য, সাথে সমগ্র জীব-জগতের জন্য তর্পণ করতে হয়। শ্রীরাম যখন রাবণের হাত থেকে সীতাকে উদ্ধারের জন্যে লঙ্কায় যান, তার পূর্বে তিনিও তর্পণ করেছিলেন। হিন্দুদের মতে, প্রকৃতির সন্তুষ্টি ব্যতীত কোনো শুভ কাজ সঠিকভাবে সম্পন্ন হওয়া কঠিন বলে মনে করা হয়। মহালয়াতে যারা গঙ্গার জলে অঞ্জলি প্রদান করে থাকেন, তারা মূলত পৃথিবীর সকল সৃষ্টির মঙ্গলের জন্য প্রার্থনা করেন ও তর্পণ প্রদান করেন। যারা নির্দিষ্ট দিনে শ্রাদ্ধ করতে ভুলে যান, তারা এই দিন শ্রাদ্ধ করতে পারেন।
তর্পণের জন্যে শ্রাদ্ধকর্তাকে স্নান করে শুদ্ধ হয়ে ধুতি পরে শ্রাদ্ধ করতে হয়। তর্পণে পূর্বপুরুষের আত্মাদের খুশি করতে জল ও তিল সহযোগে অঞ্জলি প্রদান করতে হয়। তর্পণের উপকরণ হলো কূশ ও কালো তিল। ছয়টি কূশ প্রথমে জলে ভিজিয়ে রেখে সেটা নরম হলে একত্রে তিনটি কূশ নিয়ে অনামিকা আঙুলে আংটির মতো ধারণ করে তর্পণ করতে হয়। বাঁ আঙুলেও একইভাবে কূশাঙ্গরীয় ধারণ করা প্রয়োজন। বিশেষ অবস্থায় কূশ ও তিল যদি না পাওয়া যায়, তবে শুধু জলেই তর্পণ করা হয়ে থাকে।
মহালয়ার দিনটি হচ্ছে পিতৃপক্ষের শেষদিন এবং দেবীপক্ষের সূচনা। সনাতন ধর্মমতে, পিতৃপক্ষ পূর্বপুরুষের তর্পণাদির জন্য প্রশস্ত এক বিশেষ পক্ষ। এই পক্ষ পিতৃপক্ষ, ষোলা শ্রাদ্ধ, কানাগাত, মহালয়া পক্ষ ও অমরপক্ষ নামেও পরিচিত। মহালয়া মূলত পূর্বপুরুষের পূজার বিশেষ তিথি। হিন্দু সংস্কৃতিতে ধর্মীয় কার্যাদি সাধারণত দিন হিসেবে হয় না, বরঞ্চ তিথির হিসেবে হয়ে থাকে। সনাতন ধর্ম অনুসারে বছরে একবার পিতা-মাতার উদ্দেশ্যে পিণ্ডদান করতে হয়, সেই তিথিতে করতে হয়, যে তিথিতে তারা প্রয়াত হয়েছেন।
প্রথানুসারে মহালয়া তিথিতে যারা পিতৃ-মাতৃহীন, তারা তাদের পূর্বপূরুষকে স্মরণ করে, পূর্বপূরুষের আত্মার শান্তি কামনা করে অঞ্জলি প্রদান করেন। হিন্দু পুরাণ অনুযায়ী, জীবিত ব্যক্তির পূর্বের তিন পুরুষ পর্যন্ত পিতৃলোকে বাস করেন। এই পিতৃলোক স্বর্গ ও মর্ত্যের মাঝামাঝি স্থানে অবস্থিত। পরবর্তী প্রজন্মের একজনের মৃত্যু হলে পূর্ববর্তী প্রজন্মের একজন পিতৃলোক ছেড়ে স্বর্গে গমন করেন এবং এভাবে মৃত ব্যক্তি শ্রাদ্ধানুষ্ঠানের ঊর্ধ্বে উঠে যান। এ কারণে, কেবলমাত্র জীবিত ব্যক্তির পূর্ববর্তী তিন প্রজন্মেরই শ্রাদ্ধানুষ্ঠান হয়ে থাকে। সনাতন ধর্মবিশ্বাস বলে, মহালয়ার দিনে মৃত সকল ব্যক্তির আত্মাদের ধরায় পাঠিয়ে দেয়া হয়। প্রয়াত সকল আত্মার যে মহা এক সমাবেশের সৃষ্টি হয়, তাহাকে মহালয় বলা হয়। মহালয় থেকে মূলত মহালয়া শব্দটি এসেছে।
মহালয়ার শেষে আসে মহাপঞ্চমী। শারদোৎসব আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয় এই দিনে। পূজামন্ডপগুলোতে দেবী প্রতিমা স্থাপিত হয়, দেবীর আগমন ঘটে মণ্ডপে মণ্ডপে। পূজার দ্বিতীয় দিন হচ্ছে মহাষষ্ঠী। পুরামতে, ষষ্ঠীর দিনটিকে দুর্গার বাপের বাড়ি আসার দিন বলে মনে করা হয়। এ দিনে দেবী তাঁর চার সন্তান (কার্তিক, গণেশ, স্বরস্বতী, ও লক্ষ্মী) নিয়ে মর্ত্যে আগমন করেন। মহাসপ্তমীর দিন থেকে শুরু হয় দেবীর আরাধনা। এ দিন প্রকৃতিপূজার মাধ্যমে দেবীকে আহ্বান করা হয়। প্রতিমায় দেবীর প্রাণ প্রতিষ্ঠা করানো হয় এই দিনটিতে।
শারদোৎসবের মূল আনন্দোৎসব শুরু সপ্তমী থেকেই। মহাষ্টমীর মূল আকর্ষণ হলো কুমারীপূজা। কূমারীপূজায় একটি কূমারী মেয়েকে দেবীরূপে অর্পণ প্রদান করা হয়। এই দিনটিতে সন্ধিপূজাও হয়। দেবী দুর্গা যখন অসুরনাশের জন্যে কালীর রূপ ধারণ করেন, সে সময়কালকে সন্ধিকাল বলা হয়। হিন্দু ধর্মবিশ্বাস মতে, সন্ধিপূজার মাধ্যমে দেবী স্বয়ং আসেন প্রতিমার মধ্যে। সেই সময় মাকে সাক্ষী রেখে তাঁর সামনে কলা ও চালকুমড়ো উৎসর্গ করা হয়। এ কারণে অষ্টমীর দিনে বেশিরভাগ বাড়িতেই নিরামিষ আহারের আয়োজন করা হয়ে থাকে।
মহানবমীর দিনে দেবীকে অন্নভোগ প্রদান করা হয়। মহানবমীকেই মূলত দুর্গাপূজার শেষদিন হিসেবে ধরে নেয়া হয়। তার পরের দিন অর্থাৎ দশমীতে দেবী বিসর্জনের মাধ্যমে আনুষ্ঠানিক সমাপ্তি হয় দুর্গোৎসবের। মহালয়ায় শুরু, বিজয়ায় শেষ! বিজয়ার দিনে দেবী দুর্গা তাঁর বাপের বাড়ি থেকে আবার শ্বশুর বাড়ি কৈলাসের উদ্দেশে রওনা দেন। এ দিনটিতে দেবীকে সিঁদুর খেলার মাধ্যমে বিদায় জানান সনাতনীরা। এরপর প্রতিমাকে নিয়ে যাওয়া হয় ভাসানের জন্য। এভাবেই সমাপ্তি ঘটে হিন্দুদের সর্ববৃহৎ বাৎসরিক ধর্মীয় উৎসবের।
হিন্দু ধর্মবিশ্বাস মতে, অশুভ শক্তির বিনাশ আর ধর্ম রক্ষায় যুগে যুগে মর্ত্যলোকে দেবতাদের আবির্ভাব হয়েছে। যার ধারাবাহিকতাতেই অসুরকূলের হাত থেকে দেবগণকে রক্ষায় দেবী দুর্গার আগমন ঘটেছিল। পৃথিবীতে যখনই ব্রহ্মার বরপ্রাপ্তের মতো শক্তিশালী মহিষাসুরেরা ফিরে আসে বারবার, ধর্মের গ্লানি হয় এবং পাপ বৃদ্ধি পায়, তখন তাদের ত্রাস-সংহারে দেবী দুর্গা ফিরে আসেন বারবার। আর দেবীর এ শুভাগমন ঘটে শুভ মহালয়ায়। মহালয়ার শুভক্ষণে যাবতীয় আঁধার গ্লানি মুছে যায় অসুরনাশীনী দুর্গার তেজচ্ছটায়।
This article is about brief history & the rules of celebrating Mahalaya, the starting of Durga Puja which is the most prominent festival in Hindu religion.
Featured image: istock.com
Reference : Hyperlinked in the article.