বিতর্ক! শব্দটি শুনলেই আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে পরিচিত কিছু দৃশ্য। মুখোমুখি দুটি দল যুক্তির লড়াইয়ে একে অপরকে ঘায়েল করার চেষ্টা। কিন্তু সত্যিই কি তা-ই? বিতর্ক কি শুধুই দুটি পক্ষের মাঝে যুক্তি-তর্কের লড়াই? বিতর্ক করতে হলে সবসময়ই কি প্রতিপক্ষ থাকতে হবে? নাকি একজনেও বিতর্ক করা যায়? প্রশ্নগুলোর উত্তর জানতেই আমাদের আজকের এ আয়োজন৷ আজ পরিচিত হবো বিতর্কের নান্দনিক এক ধারার সাথে, যে বিশেষ বিতর্কের ধারায় একজন ব্যক্তি একাই বিতর্ক করে থাকেন। আর প্রচলিত এ জনপ্রিয় ব্যতিক্রমী ধারার বিতর্কের নাম হচ্ছে বারোয়ারী বিতর্ক!
বিতর্ক মূলত বেশ কিছু ধরনের হয়ে থাকে। ইংরেজি বিতর্কের মাঝে এশিয়ান পার্লামেন্টারি বা ব্রিটিশ পার্লামেন্টারি বিতর্ক আর বাংলার মাঝে সনাতনী ও সংসদীয় বিতর্কই মূলত অধিক হারে প্রচলিত। তবে এ সকল ফরম্যাটের বিতর্কে দুটি বা তার বেশি ভিন্ন ভিন্ন দল থাকে যারা একে অপরের প্রতিপক্ষ হিসেবে বিতর্ক করে থাকে। এ ধরনের প্রচলিত ধারার বিতর্ক থেকে বারোয়ারী বিতর্ক একটু ভিন্ন ঘরানার। ব্যক্তিকেন্দ্রিক এ বিতর্ক অনেকটা একক বক্তব্য প্রদানের মতোই। তবুও উপস্থিত বক্তৃতা বা একক বক্তৃতা থেকে বারোয়ারীর ভিন্নতা ঠিক কোন জায়গায়, তা জেনে আসার পূর্বে আমাদের জেনে আসতে হবে বারোয়ারী বিতর্কের ব্যাকরণিক কিছু কাঠামো।
বারোয়ারী বিতর্ক সাধারণত একটি অসমাপ্ত বাক্যকে পরিপূর্ণতা প্রদানের উদ্দেশ্যে করা হয়ে থাকে। এ লাইনটি হতে পারে কোনো কবিতার পঙতি, বিশেষ কারো উক্তি, সাহিত্যের কোনো লাইন বা প্রচলিত কোনো প্রবাদ। পূর্ব নির্ধারিত কোনো খন্ডবাক্যের ওপর ভিত্তি করে বারোয়ারী বিতর্ক প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণকারীরা ক্ষেত্রভেদে চার থেকে পাঁচ মিনিট সময় পান বিতর্ক করার জন্যে। বারোয়ারী বিতর্কের জন্যে সুনির্দিষ্ট কোনো সময়সীমা নেই৷ তবে, এ বিতর্কের জন্যে চার মিনিট সময়কে মোটামুটিভাবে আদর্শ সময় হিসেবে ধরা হয়ে থাকে।
এবার জেনে নেই বারোয়ারী বিতর্কের গড়ন কেমন হয়ে থাকে। শৈল্পিক ভাষায় বলতে গেলে, বারোয়ারী বিতর্ক হচ্ছে একটি তুলি, বিতর্কের ডায়াস হচ্ছে একটি ক্যানভাস আর বারোয়ারী বিতার্কিক হচ্ছেন একজন শিল্পী। নিজের মনের মতো করে তুলির আঁচড়ে ক্যানভাস সাজিয়ে তুলেন একেকজন বারোয়ারী বিতার্কিক। পর্যাপ্ত শব্দগাঁথুনি, যথাযথ বাক্যবিন্যাস আর উত্তেজনায় মোড়ানো চার-পাঁচটি মিনিটের ধ্রুপদী রূপ হচ্ছে বারোয়ারী বিতর্ক। একের পর এক বিতার্কিক এসে নিজের মতো করে বক্তব্য দিয়ে যাবেন, তব্য শ্রোতাদের একঘেয়ে লাগবে না, এ কারণেই প্রচলিতধারার বিতর্ক না হয়েও বিতর্কের এই ব্যতিক্রমী ধারাটি এত জনপ্রিয়!
তাহলে উপস্থিত বক্তব্য আর বারোয়ারী বিতর্কের মূল পার্থক্য কোথায়? কেনই বা একে বিতর্ক বলা হয়ে থাকে? এর উত্তরে বলা যায় এর ব্যাকরণিক যৌক্তিকতার ক্ষেত্র। উপস্থিত বক্তব্যে কোনো ধরনের ব্যাকরনিক নিয়ম থাকে না। বক্তারা যেকোনো বিষয়ের উপর নিজের খেয়াল মতো বক্তব্য দিয়ে যেতে পারেন। তবে বারোয়ারী বিতর্কে বক্তারা বক্তব্য দিবেন, কিছু সুনির্দিষ্ট নিয়ম মেনে। যে বক্তব্যে বিচারকেরা খুঁজে বের করার চেষ্টা করবেন গল্পের সাথে নির্ধারিত বিষয়টির সামঞ্জস্য আর যৌক্তিক স্বমন্বয়। যে কারণে কাঠামোগতভাবে অনেকটা উপস্থিত বক্তব্যের মতো হলেও বারোয়ারী বিতর্ক আর উপস্থিত বক্তব্য এক ঘরানার নয়!
বারোয়ারী বিতর্কে পূর্বপ্রদত্ত অসমাপ্ত একটি বাক্য নিয়ে নিজের মতো করে একটি গল্প সাজাতে হয়। গল্পটি হতে পারে উত্তম বা নাম পুরুষে। অর্থাৎ বিতার্কিক নিজেকে গল্পে রেখে বা না রেখে, উভয়ভাবেই তার গল্পটি সাজাতে পারেন। তবে, বক্তার গল্পটিকে হতে হবে নতুন কোনো গল্প। এমন একটি ঘটনা বা গল্প যা কেউ আগে কখনো শোনেনি। অর্থাৎ, বিচারক বা দর্শকদের আগ্রহের পুরোটুকু ধরে রাখতে পারাই বারোয়ারী বিতর্কের প্রধান শর্ত।
তাহলে কোন ধরনের গল্প করা যায় বারোয়ারী বিতর্কে? উত্তরে বলা চলে, যেকোনো ধরনের গল্প সাজিয়ে বারোয়ারী বিতর্ক করা যায়। সায়েন্স ফিকশান, প্রেমকাহিনী, ইতিহাস, ভুতুড়ে গল্প, কল্পকথা, বাস্তব ঘটনার সাথে মিলিয়ে গল্প বলা, সবকিছুই চলে বারোয়ারীতে। সুতরাং, যে কাহিনীটি বক্তা বলতে চায়, তার চরিত্রসমূহকে সেভাবেই সাজিয়ে গুছিয়ে উপস্থাপন করতে হবে। সেখানে মূল চরিত্র থাকতে পারে, থাকতে পারে নানাবিধ পার্শ্বচরিত্রও। সাধারণত, বারোয়ারী বিতর্কে উত্তমপুরুষে কাহিনীটি বিবৃত করা হয়ে থাকে। চাইলে, বক্তা মূল কাহিনীকার হিসেবে যেকোনো পুরুষে বর্ণনা করতে পারেন পুরো ঘটনাটি।
বারোয়ারীর শুরুটা করতে হয় বেশ সাবলীলভাবে। শুরুটা যাতে সবার কাছে ভালো লাগে। কথার শুরু যদি শ্রোতাদের আকৃষ্ট না করতে পারে তবে কেউ তা শুনতে আগ্রহ পাবে না। বারোয়ারী বিতর্কের শুরুটা তাই হলে হয় বেশ নান্দনিক। কোনো কবিতার লাইন বা জনপ্রিয় কোনো উক্তি দিয়ে বক্তব্য শুরু করলে বেশ সহজেই তা মনোযোগ কেড়ে নিতে সক্ষম। বারোয়ারীর শুরুতে গল্পের গতি প্রকৃতি কোনোভাবেই শ্রোতা বা বিচারকদের বুঝতে দেয়া চলবে না, তবে গল্পের প্রতি আগ্রহটা জাগিয়ে তুলতে হবে। শুরুতে বেশি সময় নেয়া যাবে না। বড়জোর এক মিনিট।
বিতর্কের মধ্যভাগে এসে বক্তাকে এবারে বেশ সাবধানী হতে হয়। খুব ছোটখাট প্রশ্ন থেকে যেতে পারে এমন জায়গাগুলো পূর্ণ করতে হয় এখানটায়। যাতে শ্রোতা বা বিচারকদের মনে কোনো প্রশ্নের উদ্রেক না হয়। মনে রাখতে হবে, সাধারণ বিতর্কে প্রশ্ন করার সুযোগ থাকলেও বারোয়ারী বিতর্কে সে সুযোগটি থাকে না। সুতরাং, সম্ভাব্য প্রশ্নের উত্তরগুলোও আপনাকেই দিয়ে যেতে হবে। উপস্থাপনা সুন্দর করার জন্যে এই অংশে ছোটখাট কবিতার লাইন, কিংবা উক্তি ব্যবহার করা যেতে পারে। তবে মনে রাখতে হবে, এই মাঝখানের জায়গাটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। বারোয়ারীর বিশেষত্বই হচ্ছে গল্পের শেষ পর্যন্ত সকলের আগ্রহ ধরে রাখা। গল্পের বিস্তার ঘটাতে গিয়ে যদি এ পর্যায়ে এসে মূল ঘটনা বলে ফেলা হয় বা বিচারক-শ্রোতারা বুঝে ফেলেন, তবে গল্পের বাকিটুকু শোনার আগ্রহও তাদের হারিয়ে যেতে পারে। মোটকথা, গল্পের শেষ হওয়ার আগ পর্যন্ত স্পয়লার দেয়া যাবে না। গল্পের ভিত্তি সাজানোর এ অংশের জন্যে দুই থেকে আড়াই মিনিট নেয়া যেতে পারে।
গ্রন্থিমোচন অংশে এসে এবারে বক্তাকে প্ল্যানমাফিক প্লট টুইস্ট দিতে হবে। এমন কোনো চমক নিয়ে আসতে হবে যা শ্রোতাদের কেউ এতক্ষণ ভাবেননি! যারা শুনছিল তারা হয়তো পুরো ঘটনাটাকে একভাবে ভাবছিলেন, এবারে এসে পুরো ঘটনাটিকে ঘুরিয়ে দেয়া যেতে পারে। এ অংশটুকু খুব ভালোভাবে করতে পারাটাই একজন বারোয়ারী বিতার্কিকের মূল সার্থকতা। একজন বারোয়ারী বিতার্কিক প্রতিযোগিতায় ভালো নম্বর পেতে যাচ্ছে কি না, তা মূলত নির্ভর করে গ্রন্থিমোচন অংশে তিনি শ্রোতা ও বিচারকদের কতটুকু নাড়া দিতে পারলেন তার উপরে। তবে এ অংশটুকুর জন্যে সর্বোচ্চ এক মিনিট রাখা যেতে পারে, তার বেশি নয়।
সর্বশেষে, সমাপন। এত লম্বা লেখা পড়তে পড়তে হয়তো ভুলে গিয়েছেন যে, একদম শুরুতে বলা হয়েছিলো বারোয়ারীর জন্যে কিছু অসমাপ্ত বাক্য দেয়া থাকে। সমাপন অংশে বক্তাকে তার নির্বাচিত সেই অসমাপ্ত বাক্যাংশের সাথে তার পুরো গল্পের স্বমন্বয় করে দেখাতে হবে। এটিও বারোয়ারীর খুব গুরুত্বপূর্ণ অংশ। বক্তা যদি খুব চমৎকারভাবে ইউনিক একটি গল্প নিয়ে আসে, অসাধারণ প্লট টুইস্ট দেয় কিন্তু বারোয়ারীর বিষয়ের সাথে মেলাতে না পারে তবে বিচারকের জন্যে বক্তাকে বিজয়ী করা খুব কঠিন হয়ে পড়ে। সুতরাং, অন্তত ত্রিশ সেকেন্ড সময় হাতে রাখতে হবে পুরো গল্পটির সাথে বিতর্কের বিষয়ের স্বমন্বয় করার জন্য।
বারোয়ারী বিতর্কের মূল সৌন্দর্য বক্তার বাচনভঙ্গি, গল্পের নতুনত্ব ও বিষয়ের সাথে সামঞ্জস্যতা। সুন্দর কণ্ঠ হয়তো অবচেতনভাবে কিছুটা অগ্রাধিকার পায়, তবে চমৎকার উপস্থাপনাশৈলী দ্বারা সে সমস্যা খুব সহজেই কাটিয়ে ওঠা সম্ভব। আর সব ধরনের বিতর্কের মতো বারোয়ারী বিতর্কে ভালো করতে হলেও প্রয়োজন নিয়মিত অনুশীলন। তার পাশাপাশি প্রচুর পড়াশোনা থাকতে হয় নতুন ধরনের তথ্যের সন্নিবেশনের জন্যে।
সুন্দর গল্প বলতে হলে বক্তাকেও অনেক সুন্দর গল্প উপন্যাস জানা থাকা লাগে। একজন বারোয়ারী বিতার্কিকের সার্থকতা তখনই ফুটে ওঠে যখন তার মৌলিকতার পাশাপাশি তার বক্তব্যে ফুটে ওঠে হুমায়ুন আহমেদের মতো কথাসাহিত্য, জাফর ইকবালের সায়েন্স ফিকশন কিংবা প্রমথ চৌধুরীর শুদ্ধ চলিতচর্চা। তাই বারোয়ারী বিতর্ক শুনতে সহজ মনে হলেও, বাস্তবে ততটা নয়! তবে নিয়মিত পড়াশোনার পাশাপাশি ভয় কাটিয়ে উঠে বারোয়ারী বিতর্কের চর্চা নিয়মিত চালিয়ে যেতে পারলে যে কেউ হয়ে উঠতে পারবেন চমৎকার একজন বারোয়ারী বিতার্কিক!
বিতর্ক সম্পর্কে আরও জানতে পড়ে নিন এই বইগুলো
This article is about a different form of debate, known as baroyarrii debate. The writer himself is a baroyarrii debater.
Featured image : kut.com
Reference : Hyperlinked in article