Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

ক্লদ মোনের আঁকা ‘ইম্প্রেশন: সানরাইজ’: সমকালে বিদ্রূপের শিকার, পরে কালজয়ী

উনিশ শতকে ফ্রান্সের শিল্পকলায় ইম্প্রেশনিজম আন্দোলন শুরু হয়। ছবি আঁকায় হুবহু বাস্তবতা তুলে ধরার প্রবণতা থেকে এ আন্দোলনের শিল্পীরা বেরিয়ে আসতে চেয়েছিলেন। ছবির বিষয়বস্তু ফুটিয়ে তোলার ক্ষেত্রে তারা আলোর প্রতিফলনের নির্ভুল ব্যবহারের মাধ্যমে একেবারে শতভাগ যথার্থতা ধরার চেষ্টা করেছিলেন।

তখনকার শিল্পজগত তাদের এই পরীক্ষা-নিরীক্ষা ভালো চোখে দেখেনি। তাদের আঁকা বিভিন্ন ছবি বেশ ব্যঙ্গ-বিদ্রূপের শিকার হয়েছিলো। কট্টর সমালোচকেরা নিন্দার ছলে এই আন্দোলনের নাম দেন ‘ইম্প্রেশনিজম’। আন্দোলনের শিল্পীরা এই নামকেই শিল্প নিয়ে তাদের নিরীক্ষার ক্ষেত্রে আপন করে নিয়েছিলেন। ক্লদ মোনে (১৮৪০-১৯২৬) এই আন্দোলনের অন্যতম প্রধান শিল্পী ছিলেন। তার বহুল আলোচিত ছবি ‘ইম্প্রেশন: সানরাইজ’ থেকেই ‘ইম্প্রেশনিজম’ নাম এই আন্দোলনের সাথে একভাবে জড়িয়ে গিয়েছিলো।

ক্লদ মোনে
ক্লদ মোনে; Image Source: alphabelart.com

ক্লদ মোনে ১৮৭২ সালে ৩২ বছর বয়সে এই ছবিটি আঁকেন। প্রথম দৃষ্টিতে যে কারো কাছে ছবিটি অতি সাধারণ মনে হবে। নদী, ভাসমান নৌকার আভাস, ভোরের উঠতে থাকা সূর্য ও নদীর পানিতে তার প্রতিফলন অনেকটা অনিয়মিত ও ব্যতিক্রম স্টাইলে ফুটে উঠেছে। আসলে তখনকার শিল্পজগতের স্বীকৃত কোনো স্টাইল এই ছবিতে ব্যবহৃত হয়নি। 

ইম্প্রেশন: সানরাইজ
ইম্প্রেশন: সানরাইজ; Image Source: art.com

ফ্রান্সের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে ‘লে আভ্রেঁ’ নামে একটি নদীবন্দর আছে। ক্লদ মোনের শৈশব সেখানেই কেটেছে। এই নদীবন্দর ক্লদ মোনের আরো কয়েকটি ছবিতে বিষয় হিসেবে এসেছে। এসব ছবির মধ্যে ১৮৭৩ সালে আঁকা ‘সানরাইজ: মেরিন’ এবং ১৮৭৪ সালে আঁকা ‘লে বেসিন দ্যুঁ কমার্স’ উল্লেখযোগ্য। তবে বিষয়বস্তু এক হলেও ‘ইম্প্রেশন: সানরাইজ’ ছবিটি ইতিহাসে বিশেষ কারণে অমর হয়ে আছে।

লে বেসিন দ্যুঁ কমার্স
লে বেসিন দ্যুঁ কমার্স; Image Source: lehavreregards.com

১৮৭৪ সালে ‘ইম্প্রেশন: সানরাইজ’ ছবিটি ক্লদ মোনের আরো কিছু ছবির সাথে এক প্রদর্শনীতে দেখানো হয়। এই প্রদর্শনী ইতিহাসে ‘এক্সিবিশন অব দি ইম্প্রেশনিস্টস’ নামে খ্যাত হয়ে আছে। এই প্রদর্শনীতে আরো অংশ নেন কামিল পিসারো, পল সেজান, বার্থ মোরিসো ও এদ্গার দেগা। তৎকালীন ফ্রান্সে প্রথাগত শিল্পের ধারা থেকে সম্পূর্ণ আলাদা পরীক্ষা-নিরীক্ষার উদাহরণ হিসেবে তারা এই প্রদর্শনীতে অংশ নেন।

কৌতূহলের ঘটনা হচ্ছে যে, সমালোচক ও দর্শকরা কিন্তু এ প্রদর্শনীতে দেখানো ছবিগুলোকে মোটেই প্রশংসার চোখে দেখেননি। উল্টো এই প্রদর্শনী ও তাতে অংশ নেওয়া শিল্পীদের আঁকা ছবিগুলো তীব্র সমালোচনা ও ঠাট্টার মুখে পড়ে। অনেকে বিদ্রূপ করে বলতে থাকেন যে, কোনো পোকার পায়ে রং মেখে কাগজের উপর ছেড়ে দিলে এর চেয়ে হাজার গুণ ভালো ছবি আঁকা হয়ে যাবে! বোঝাই যাচ্ছে যে, সমকালীন সমাজ ও শিল্পরসিক মানুষজন এই অভিনব নিরীক্ষা মেনে নিতে মোটেই প্রস্তুত ছিলেন না। ফ্রান্সের এক নামজাদা চিত্র সমালোচক লুই ল্যাঁরো বিদ্রূপ করে এসব ছবির শৈলীকে ‘ইম্প্রেশনিজম’ আখ্যা দেন। ক্লদ মোনে ও অন্যান্য শিল্পীরা এই বিদ্রূপে দমে যাননি। মোনে বরং ব্যঙ্গ করে দেওয়া এই নাম প্রদর্শনীতে ছবির নামের সাথে জুড়ে দেন। 

সাধারণ দর্শক ক্লদ মোনের এই ছবিটিতে প্রথম দেখায় তেমন অসাধারণ কিছু নাও পেতে পারেন। কারণ এই আন্দোলনের শিল্পীরা বিষয়বস্তুর উপর কম গুরুত্ব দিতেন। আগের যুগের রোমান্টিক বা বাস্তববাদী ধারার ছবিতে দৃশ্যের প্রয়োজনে বিষয়ের অবিকল ও নিখুঁত প্রতিকৃতি তৈরি করতে চাইতেন।  ইম্প্রেশনিস্ট শিল্পীরা হুবহু অনুকরণ করার প্রথা থেকে বের হয়ে আসতে চাইলেন। তারা রঙের ব্যতিক্রমী ব্যবহার ও ছবিতে আলোর প্রতিক্রিয়া সার্থকভাবে ফুটিয়ে তোলার কাজকে গুরুত্ব দিলেন।

‘ইম্প্রেশন: সানরাইজ’ ছবিটির দিকে তাকালেই এই দিকটি বুঝতে সহজ হবে। এতে ফিকে কমলা, নীল ও গাঢ় সবুজ রং ব্যবহার করা হয়েছে। সূর্য ও পানিতে এর প্রতিফলনে ফিকে কমলা রং দেওয়া হয়েছে। আর নদীতে ভাসমান নৌকা ও দিগন্তে আকাশের আভাস হিসেবে গাঢ় সবুজ ও নীল রং ব্যবহৃত হয়েছে। নদীতে উদীয়মান সূর্যের প্রতিবিম্ব ফুটে ওঠার দৃশ্য বেশ কৌতূহলজনক। এর আশেপাশের হালকা রংয়ের সাথে তুলনা করলে মনে হবে, ভোরের সূর্য ও তার প্রতিফলন যেন ঠিকরে বেরোচ্ছে। কোনো শিল্পী যখন তার ছবিতে আলোর কোনো উৎস- যেমন চাঁদ বা সূর্য আঁকেন, তাকে উভয় সংকটে পড়তে হয়। শিল্পীর পক্ষে তো আর সত্যিকারের আলো ছবিতে ব্যবহার করা সম্ভব নয়! আলোর দৃশ্য তৈরি করতে হলে যা করার- রং তুলির সাহায্যেই করতে হবে। আর সেজন্য তাকে ব্যবহার করতে হবে দৃশ্যের চারপাশে ব্যবহার করা রঙের নিখুঁত ও সার্থক টোন। আলোর উৎস হিসেবে সূর্য আঁকতে হলে এর আলোর তীব্রতা মনে রেখে রঙের ব্যবহার করতে হবে। এক্ষেত্রে সবচেয়ে ভালো উপায় হচ্ছে সূর্যের উজ্জ্বলতা ও নদীর পানিতে তার প্রতিফলন তুলে ধরতে রঙের গাঢ় ও হালকা টোন পাশাপাশি ব্যবহার করে।

সূর্য ও প্রতিফলনের দৃশ্য
সূর্য ও প্রতিফলনের দৃশ্য: Image Source: beverlyamitchell.com

এই ছবিতে তুলির ব্যবহার খুবই কৌতূহলের জন্ম দেয়। ছবি দেখে সহজেই বোঝা যায়, ব্রাশের ব্যবহারের ক্ষেত্রে সূক্ষ্মতার ব্যবহার যথাসম্ভব কম করা হয়েছে। সাধারণ চোখে কেউ হয়তো ভাবতে পারে, ক্লদ মোনে অনেক দ্বিধা-দ্বন্দ্বে ভুগে শেষে এই ছবিটি এঁকেছেন! নদীতে সূর্যের প্রতিফলন ও নৌকা আঁকার ক্ষেত্রে তুলির ছোট ছোট টান ব্যবহার করা হয়েছে। বিশেষ করে নৌকার দৃশ্যে মোটা ব্রাশের তুলির ব্যবহারে বেশ স্বচ্ছন্দ পারদর্শিতা ফুটে উঠেছে। ছবি আঁকার কৌশল হিসেবে এটি শুধু অভিনবই নয়- রীতিমতো বিস্ময়কর ও ইতিহাসে স্থান করে নেওয়ার মতো। ছবিতে নদী ও আকাশের কাছাকাছি স্থানের দৃশ্যও আশ্চর্য করার মতো।  

নদীতে নৌকার দৃশ্য
নদীতে নৌকার দৃশ্য: Image Source: art.com

নদীতে সূর্যের আলোর প্রতিফলন ফুটিয়ে তোলায় অভিনবত্বের প্রয়োগ করা হয়েছে। ভালোমতো খেয়াল করলে বোঝা যাবে যে, এই দৃশ্য আঁকতে শুধু কমলা রঙের ব্যবহার হয়নি। রঙের উজ্জ্বলতা বাড়াতে কমাতে বেশ সাবধানে সাদা রঙের ব্যবহার হয়েছে! কোথাও সাদা রং দিয়ে কমলা রঙের টানে সীমা দেওয়া হয়েছে, কোথাও সাদা ব্যবহৃত হয়েছে কমলার উজ্জ্বলতা কমানোর জন্য। ফলে আলোর প্রতিফলন সুষম আকারে না ফুটে স্থানে স্থানে উজ্জ্বল ও ম্লান হিসেবে প্রকাশিত হয়েছে। এতে বিষয়টি স্পষ্ট যে, ক্লদ মোনে পানিতে আলোর প্রতিফলন ও এর বিজ্ঞান সম্পর্কে খুব একটা খারাপ ধারণা রাখতেন না। সে কারণেই দৃশ্য ফুটিয়ে তোলার প্রথাগত পদ্ধতি ত্যাগ করে নিজের প্রতিভার অতুলনীয় স্বাক্ষর রাখতে পেরেছিলেন।

আপাতত ছবির স্টাইল ছেড়ে এর প্রতিক্রিয়ার প্রসঙ্গে আসা যাক। আগেই বলা হয়েছে, ইম্প্রেশনিস্টদের প্রদর্শনী কড়া বিদ্রূপের মুখোমুখি হয়। মজার ঘটনা হচ্ছে, এই ছবিটির নাম থেকেই আন্দোলনের নাম এলেও রক্ষণশীল সমালোচকদের দ্বারা সমালোচিত ছবিটি কিন্তু খুব বেশি আলোচনায় আসেনি! আন্দোলনের ছবি প্রদর্শনীর পর যে রিভিউ দেওয়া হয়েছিলো- তাতে ছবিটির প্রসঙ্গ মাত্র পাঁচবার এসেছিলো। তাও তেমন একটা বড় আকারে নয়।  

একটি উল্লেখযোগ্য বিদ্রূপ করেছিলেন বিশিষ্ট শিল্প সমালোচক লুই ল্যারয়। তিনি ‘লা শ্যারিভ্রি’ ম্যাগাজিনে এ ছবি সম্পর্কে লিখেছিলেন,

“এই ছবিটি দেখে আমি মুগ্ধ না হয়ে পারিনি! ‘ইম্প্রেশন: সানরাইজ’ নামের এই ছবিটিতে আমি চমৎকার ইম্প্রেশন পেয়েছি, সানরাইজ পেয়েছি কিনা, ঠিক মনে করতে পারছি না! প্রদর্শনী ভবনের দেওয়ালের কাগজের রং আর ছবিটির রং বেশ কাছাকাছি।”

রক্ষণশীল মেজাজের এই সমালোচক ক্লদ মোনের অভিনব নিরীক্ষা মন থেকে মোটেই মেনে নিতে পারেননি। দৈনিক সংবাদপত্র ‘লা সিক্লেঁ’ তে আরেকজন সমালোচক লুইস কাস্তাগনি লিখেছিলেন,

“এই প্রদর্শনীর শিল্পীদের আঁকা ছবিগুলো তাদের আন্দোলনের নামের মতোই সার্থক। ছবিতে প্রকৃতি নেই, মানুষ নেই, আসলে কোনো বিষয়ই নেই- আছে শুধু ইম্প্রেশন! সে হিসেবে তারা শতভাগ সফল!”

৩৫ বুলেভার্দ দ্যু ক্যাপুচিনে
৩৫ বুলেভার্দ দ্যু ক্যাপুচিনে, এখানেই ছবিটির ১ম প্রদর্শনী হয়; Image Source: someth1ng.com

সমকালে ব্যাপক সমালোচিত ও নিন্দিত এই ছবিটিকে কিন্তু বর্তমানে শিল্প সমালোচক ও অনুরাগীরা বেশ উচ্চ মূল্য দিয়ে থাকেন। ছবিটি বর্তমানে প্যারিসে ‘ক্লদ মোনে মিউজিয়াম’ এ রক্ষিত আছে। ক্লদ মোনের জীবদ্দশায় এই ছবি বিদ্রূপের শিকার হলেও পরবর্তীতে নিলামে এই ছবি কেনা নিয়ে ধনীদের মধ্যে প্রতিযোগিতা হয়েছে।

Related Articles