Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

জাপানী বাঁশ-বুনন শিল্পের কথা: ইতিহাস ও বর্তমান

জাপানীদের রুচিশীলতা বিশ্বজুড়ে সমাদৃত। যে শিল্পে জাপানীদের হাত পড়বে, সেই শিল্প যেন নিশ্চিতভাবেই এক অনন্য উচ্চতায় গিয়ে পৌঁছাবে।

সেই হিসেবে সারাবিশ্বের রুচিশীল ও সৌন্দর্যপিপাসু মানুষদের সৌভাগ্যই বলতে হবে, জাপানে বাঁশ-বুনন শিল্পের বিকাশও ঘটেছিলো। তা না হলে হয়তো জানাই যেত না, শুধুমাত্র বাঁশ নামক গাছটিই যে কত ধরনের সৌন্দর্যের উৎস হতে পারে!

তবে অবাক করার মতো বিষয় হচ্ছে, জাপানের কারিগররা এই বাঁশের বুননের মাধ্যমে তৈরিকৃত জিনিসপত্রগুলোকে বহুদিন যাবত কোনো শিল্পকর্ম হিসেবে বিবেচনাই করেননি! আপাতদৃষ্টিতে সাধারণ এই কাজটিরও যে অনেক উঁচু শিল্পমূল্য থাকতে পারে, তা পশ্চিমাদেরকেই প্রথম আবিষ্কার করতে হয়েছিলো।

জাপানে বাঁশ-বুনন শিল্পের সূচনা, বিকাশ এবং এর শিল্পকর্ম হয়ে ওঠার ইতিহাসের দিকে আলোকপাত করতে গেলে অন্তত কয়েক শতাব্দী পেছনে ফিরে যেতে হবে। তাহলে ধারাবাহিকভাবে এর সংক্ষিপ্ত ইতিহাস জেনে নেওয়া যাক।

ইতিহাসে বাঁশের ব্যবহার

মানবসভ্যতার ইতিহাসে চীনারা সবচেয়ে প্রাচীন জাতি, যারা বাঁশের ব্যবহার জানতো, এ বিষয়ে মোটামুটি সকল ইতিহাসবিদেরা একমত। আনুমানিক পাঁচ থেকে সাত হাজার বছর কিংবা তারও আগে থেকেই তারা গৃহস্থালী ও জীবিকার সাথে সংশ্লিষ্ট নানাবিধ কাজে বাঁশের বিভিন্ন অংশ ব্যবহার করে আসছে। এমনকি তারা এই বাঁশের গায়ে লেখালেখির কাজটাও করতো, যার ফলে আজ আমরা চীনাদের বাঁশ ব্যবহারের প্রাচীনতম ইতিহাস সম্পর্কে জানতে পারছি।

চীনে আজ থেকে প্রায় দুই হাজার বছর কিংবা তারও পূর্বে থেকেই বাঁশের গায়ে লেখালেখির প্রচলন ছিলো; Image source: busy.org

প্রাচীনযুগে চীন বাদে পৃথিবীর অন্য কোনো অঞ্চলে বাঁশ ব্যবহার করার কথা জানা যায়নি। চীনারা বাঁশ থেকে কাগজ বানানোর কৌশল আবিষ্কার করেছিলো অনেক আগেই। তবে অষ্টম শতাব্দীর দিকে কাগজ তৈরির সে পদ্ধতি যখন চীনের বাইরে প্রকাশ হয়ে পড়লো, সম্ভবত তখন থেকেই বিশ্বের নানা অঞ্চলের মানুষ ধীরে ধীরে বাঁশের বহুমুখী ব্যবহারের সাথে পরিচিত হতে থাকে। কিন্তু ততদিনে বাঁশের বিভিন্ন অংশ ব্যবহার করে নিত্যপ্রয়োজনীয় বাহারি পণ্য তৈরিতে গ্র্যান্ডমাস্টার হয়ে গেছে চীন!

জাপানে বাঁশ ব্যবহারের সূচনা ও বাঁশ শিল্পের বিকাশ

যদিও জাপানে পাওয়া বাঁশের তৈরি সবচেয়ে পুরনো নিদর্শন প্রায় ৮০০০ বছর আগের (খ্রিস্টপূর্ব ৬০০০ অব্দ), তবুও এত আগে থেকেই জাপানের মানুষ বাঁশের তৈরি সামগ্রী ব্যবহার করতো কি না তা জানা সম্ভব হয়নি। তবে অষ্টম বা নবম শতাব্দী থেকে জাপানে বৌদ্ধ ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান পালনের জন্য বাঁশ থেকে ফুলদানী ও ঝুড়ি বানানো হতো; যদিও তা ছিলো খুবই সীমিত পরিসরে। আজকের যুগের জাপানী কিছু কারিগরকেও সেরকম বুনন-রীতি অনুসরণ করতে দেখা যায়।

মোটামুটি দ্বাদশ শতাব্দীর পর থেকে বিভিন্ন চীনা পণ্য জাপানে আসতে শুরু করে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলো বাঁশের তৈরি বিভিন্ন তৈজসপত্র।

জাপানি চা অনুষ্ঠানের একটি দৃশ্য; Image source: kankou-shimane.com

Tea Ceremony বা চা-অনুষ্ঠান’ জাপানের একটি প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী সামাজিক রীতি। এতে শান্তিপূর্ণ ও শান্ত ঘরোয়া আবহে অতিথিদের আপ্যায়ন ও সমাদর করা হয় এবং সেই আপ্যায়নের প্রধানতম আনুষ্ঠানিকতা হিসেবে একটি বিশেষায়িত কক্ষে বিশেষভাবে তৈরি ‘সবুজ চা’ পরিবেশন করা হয়। দ্বাদশ শতাব্দী থেকে শুরু করে পঞ্চদশ শতাব্দীর মধ্যভাগ পর্যন্ত এই ‘চা অনুষ্ঠান’ এর অনুষঙ্গ হিসেবে চীন থেকে  আমদানিকৃত তৈজসপত্র, যেমন- চামচ, ঝুড়ি, ফুলদানী, পাত্র ইত্যাদি ব্যবহার করা হতো। জাপানে তখন চীনা পণ্য বা চীনা পণ্যের অনুকরণে তৈরি উপকরণগুলোর বিশেষ একটা নাম ছিলো, তা হলো ‘ক্যারামোনো’ (Karamono)।

চা অনুষ্ঠানে ব্যবহৃত বাঁশের তৈরি উপকরণ; Image source: 

এসব চীনা পণ্য, বিশেষ করে বাঁশ থেকে তৈরি সামগ্রীগুলোর উপর জাপানীরা ছিলো অনেকটাই নির্ভরশীল। জাপানের মানুষেরা এগুলো ব্যবহার করতে গিয়ে ধীরে ধীরে বাঁশের উপযোগিতা ও গুণাগুণ সম্পর্কে ধারণা পেতে শুরু করলো। পঞ্চদশ শতাব্দীর প্রথমভাগে জাপানেও চীনা পণ্যের অনুকরণে বাঁশের তৈরি জিনিসপত্র উৎপাদন শুরু হয়ে যায়। যতটুকু ইতিহাস আমাদের জানাশোনা, তা থেকে বলা যায়, এ সময়টাতেই জাপানে পুরোদমে বাঁশ-বুনন শিল্পের সূচনা ঘটে। প্রাথমিকভাবে জাপানি কারিগররা চীনা ধাঁচেই বাঁশের সামগ্রী ও উপকরণ বানাতো এবং ব্যবহারিক প্রয়োজনীয়তা অনুসারে সেগুলোর নকশা কিঞ্চিৎ পরিবর্তন করে নিতো। কিন্তু তবুও তাদের কাজে চীনা পণ্যের প্রভাব ছিলো স্পষ্ট। তবে দিন যতই গড়াতে লাগলো, জাপানী পণ্যগুলোতে ভিন্নতা ও বৈচিত্র আসতে শুরু করলো।

Karamono শৈলীর বাঁশের তৈরি একটি ফুলদানী; Artist: Tanabe Chikuunsai I (1877-1937), Image source: kagedo.com

এদিকে, পঞ্চদশ শতকেরই কোনো এক সময় থেকে জাপানে গড়ে উঠতে শুরু করে নতুন এক প্রকারের দার্শনিক মতধারা; যাকে ‘ওয়াবি-সাবি’ (Wabi-Sabi) বলে অভিহিত করা হয়। এই দর্শনের মূলনীতি হচ্ছে– অপরিপূর্ণতা, অপ্রতিসমতা ও অকৃত্রিমতা। এর মধ্যে একধরনের আধ্যাত্মিকতা নিহিত রয়েছে। এ দর্শনানুসারে, কোনো শিল্পকর্মে পরিপূর্ণতা, প্রতিসমতা ও কৃত্রিমতার উপস্থিতিকে শিল্পীর কল্পনাশক্তির সীমাবদ্ধতা হিসেবে দেখা হতো। কেননা, প্রকৃতি আমাদেরকে অপরিপূর্ণতা ও নশ্বরতার বার্তা দেয়, এবং শিল্পীর উচিত তার শিল্পে এ বার্তা ফুটিয়ে তোলা। তা না হলে শিল্পের প্রকৃত ও অন্তর্নিহিত শিল্পগুণ থাকে না। এ যেন এক প্যারাডক্সের মতো, ত্রুটি না থাকাটাই একটি ত্রুটি! তবে ইচ্ছাকৃতভাবেই খুঁত রাখতে হবে, বিষয়টা সেরকমও না। এ দার্শনিক চিন্তাধারা তৎকালীন জাপানী সমাজের অনেক কিছুকেই প্রভাবিত করেছিলো, বিশেষ করে জাপানের কিছু ধর্মীয় আচার-প্রথা ও বিভিন্ন শিল্পকর্মে ‘ওয়াবি-সাবি’ দর্শনের প্রভাব আজকের এই যুগেও কম-বেশি দৃশ্যমান। এমনকি জাপান বাইরেও কিছু অঞ্চলের মানুষেরা তাদের জীবনে অকৃত্রিম সৌন্দর্য ধারণ করার উদ্দেশ্যে এই ‘ওয়াবি-সাবি’ ধারার জীবনযাপন করে থাকেন।

‘ওয়াবি-সাবি’ ধারায় অনুপ্রাণিত একটি শিল্পকর্ম; Image source: tofugu.com

ষোড়শ শতাব্দীতে জাপানের বাঁশ-বুনন শিল্প এ দর্শনের দ্বারা সরাসরি প্রভাবিত হয়; ক্রমেই চীনা নকশার সাথে জাপানী নকশার পার্থক্য স্পষ্ট হয়ে উঠতে থাকে। বলা চলে, ইতিহাসের এ বাঁক থেকেই চীনা ও জাপানি বাঁশ-বুনন শিল্পের পথ পরিষ্কারভাবে আলাদা হয়ে গেছে। জাপান একসময় শিল্পে স্বনির্ভর হয়ে ওঠে; তাদের নিজেদের পণ্য ‘ওয়ামোনো’ (Wamono, অর্থ ‘জাপানী পণ্য’) নামে পরিচিতি পায় এবং নিজ দেশে এর কদর বাড়তে শুরু করে। সপ্তদশ শতাব্দীতে ‘ক্যারামোনো’ এবং ‘ওয়ামোনো’- উভয় শৈলীর কাজগুলোর, বিশেষ করে বাঁশের ঝুড়ি ও ফুলদানীর জনপ্রিয়তা জাপানে ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায়। অর্থাৎ, এই শিল্পটি জাপানী সমাজে শিকড় গেঁড়ে বসে।

তবে উল্লেখযোগ্য ব্যাপার হলো, এই খাতের কারিগররা তখনো একে পৃথকভাবে শিল্পকর্ম হিসেবে বিবেচনা করতো না। যদিও তখন থেকেই তাদের বুননে শৈল্পিকতা ছিলো, তবুও বাঁশ থেকে তৈরি সেসব পণ্যকে কেবলই নিত্যপ্রয়োজনীয় ব্যবহার্য সামগ্রী হিসেবেই বানানো হতো।

পারিবারিক ঐতিহ্য ও পেশা

যে পণ্যগুলো জাপানী কারিগরেরা নিতান্ত দৈনন্দিন ব্যবহার্য সামগ্রী হিসেবেই তৈরি করতো, সেগুলোর যে একটা শিল্পমূল্যও থাকতে পারে, সেটা বুঝে উঠতে তাদের বেশ সময় লেগেছিলো। উনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে হাতে গোনা যে কয়জন কারিগর তাদের কাজের শিল্পগুণ অনুধাবন করতে পেরে সেগুলোকে নিজেদের শিল্পকর্ম হিসেবে চিহ্নিত ও সংরক্ষণ করার উদ্যোগ নেন, তাদের মধ্যে হায়াকাওয়া শোকোসাই উল্লেখযোগ্য। এ সময় থেকে জাপানে বাঁশ-বুননের শিল্পটি বিভিন্ন পরিবারের পারিবারিক ঐতিহ্যের সাথে জড়িয়ে পড়তে শুরু করে; বংশানুক্রমে এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মের নিকট হস্তান্তরিত হতে থাকে। এক্ষেত্রে হায়াকাওয়া ও তানাবি পরিবারের নাম উল্লেখ করার মতো। মোটামুটি তারাই প্রথম এ কাজটিকে পারিবারিক পেশায় রূপ দেন। প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে তারা সহ আরও কয়েকটি পরিবারের দক্ষ কারিগরেরা বাঁশ-শিল্পকে সুচারু করে তুলেছেন এবং তাদের কাজগুলো মানুষের মন জয় করে নিয়েছে।

‘চাবাকো’, বা চা-অনুষ্ঠানের উপকরণ রাখার জন্য বাঁশের তৈরি ঝুড়ি; Artist: Hayakawa Shokosai I (1815-1895), Image source: kagedo.com

এ পেশার একটি উল্লেখযোগ্য দিক হচ্ছে, এতে বাঁশ কর্তন থেকে শুরু করে বাঁশের ফালি তৈরি করা, প্রয়োজনে সেগুলোকে প্রক্রিয়াকরণ করা এবং সবশেষে তা থেকে কোনোকিছু বানানোর কাজটি একই ব্যক্তিকে করতে হয়। এখানে কাজ ভাগ করে নেওয়ার সুযোগ নেই। কারণ, বাঁশ থেকে একজন কারিগর ঠিক কোন জিনিস বানাবেন, তা শুধুমাত্র তিনি নিজেই জানেন এবং সে অনুসারেই তার বাঁশগুলোকে নিজের মনের মতো করে টুকরো বা ফালি এবং প্রসেসিং করে নিতে হয়। এসব কারণে এ পেশায় প্রবেশ করাটা সহজ নয় এবং কোনো দক্ষ প্রশিক্ষকের তত্ত্বাবধানে না থেকে এ শিল্পের বিষয়ে জ্ঞান ও প্রশিক্ষণ লাভ করা দুঃসাধ্য ব্যাপার।

পশ্চিমে জাপানী এ শিল্পের শিল্পকর্ম হয়ে ওঠা

উনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগ পর্যন্ত জাপান নিজেকে পৃথিবী থেকে একপ্রকার বিচ্ছিন্নই করে রেখেছিলো। যখন জাপান পৃথিবীর সামনে নিজেকে মেলে ধরতে শুরু করলো, তখন থেকেই সমুদ্রপথে শুরু হয় পাশ্চাত্যের সাথে তাদের ব্যবসা-বাণিজ্য। তবে জাপান মূলত আমদানিই করতো বেশি। জাপানে পণ্য নিয়ে আসা ইউরোপ-আমেরিকার জাহাজাগুলোও খালি ফেরত যেত না, টুকটাক পণ্য নিয়েই ফিরতো। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল জাপানী বাঁশজাত পণ্যগুলো। ইউরোপের মানুষ রেঁনেসা যুগ থেকেই বেশ শিল্প সচেতন। তারা সহসাই জাপানি এসব বাঁশজাত পণ্যের শিল্পমান দেখে মুগ্ধ হয়ে উঠলো। ফলে ফিরতি জাহাজে করে আসা এসব বাঁশের পণ্যগুলো ইউরোপে চড়া দামে বিক্রি হতে লাগলো, যদিও জাপানী কারিগররা বাঁশজাত পণ্যগুলো তৈরির ক্ষেত্রে শিল্পগুণের চেয়ে বরং দৈনন্দিন জীবনে এগুলোর ব্যবহারযোগ্যতাকেই বেশি প্রাধান্য দিতো তখন পর্যন্ত। বলা চলে, এটাই বহির্বিশ্বে জাপানী বাঁশ-বুনন শিল্পের সমাদৃত হওয়ার প্রথম ঘটনা।

Rewind নামক এ শিল্পকর্মটি ২০১৭ সালে তৈরি; Artist: Osamu Yokoyama, Image source: japanobjects.com

বিংশ শতাব্দীতে পৃথিবীতে অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে যায়, যার মধ্যে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য। এ সময়টাতে শিল্পায়নের গতি ত্বরান্বিত হয় এবং মানুষের জীবনযাত্রার উপর শিল্পায়নের প্রভাব অনেক বেড়ে যায়। তখন প্লাস্টিকের পণ্য সহজপ্রাপ্য হয়ে ওঠে। প্লাস্টিকের অনেক আকাঙ্ক্ষিত গুণাগুণ ও সহজলভ্যতা থাকায় বাঁশ থেকে উৎপাদিত পণ্যের বাজার দ্রুতই দখল করে নিতে লাগলো প্লাস্টিক। ফলে এ খাতের কারিগর বা শিল্পীদেরকে তাদের কাজ নিয়ে পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটের ভিত্তিতে নতুন করে চিন্তাভাবনা করতে হলো। এ পর্যায়ে জাপানে তৈরি বাঁশজাত পণ্যের গঠনশৈলী এবং তা বানানোর উদ্দেশ্য পরিবর্তিত হতে থাকে; কারিগররা তাদের বানানো পণ্যের শিল্পমানের উপর গুরুত্বারোপ করতে শুরু করলেন। ফলে বাঁশের তৈরি ছোটোখাট ও নিত্য ব্যবহার্য তৈজসপত্র ও অন্যান্য দ্রব্যের উৎপাদন একপ্রকার বন্ধই হয়ে গেলো।

নোবোরু ফুজিনুমা, বাঁশ-শিল্পের সাথে জড়িত জাপানের একজন শীর্ষস্থানীয় শিল্পী, যিনি ‘জীবন্ত জাতীয় সম্পদ’ সম্মাননা পেয়েছেন; Image source: dailyillini.com

জাপান সরকারের যুগোপোযোগী উদ্যোগের ফলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এ শিল্প পুরোপুরি হারিয়ে যায়নি, বরং জাপানী ঐতিহ্য হিসেবে এ শিল্পের কয়েকটি দিক আরও বিকশিত হতে থাকে। ১৯৬৭ সাল থেকে জাপান সরকার বাঁশ শিল্পের সাথে জড়িত দক্ষ ও মেধাবী আর্টিস্টদেরকে ‘জীবন্ত জাতীয় সম্পদ’ হিসেবে সম্মাননা দিয়ে তাদের কাজকে মূল্যায়ন করা শুরু করে। তাছাড়া, বাঁশ-বুনন শিল্পে জাপানের অন্যতম প্রসিদ্ধ অঞ্চল, ‘বেপু’ শহরের বাঁশের তৈরি শিল্পকর্মকে ‘ঐতিহ্যবাহী কারুশিল্প’ হিসেবে ঘোষণা করা হয়। এর বাইরে, বিশ্বব্যাপী জাপানী এই শিল্পটির প্রতি ব্যাপক আগ্রহ থাকায় কারিগররাও তাদের পারিবারিক এই ঐতিহ্য ছেড়ে চলে যাননি, বরং যুগের চাহিদানুসারে তারা তাদের শিল্পকর্মকে আধুনিকায়ন করেছেন, বিশ্বের পরিবর্তনশীল রুচির সাথে মানিয়ে নিয়ে তাদের শিল্পকে ধাপে ধাপে করে তুলেছেন আরও তাৎপর্যপূর্ণ ও যুগোপযোগী। ফলে সম্প্রতি পশ্চিমা জগতে এই শিল্পটি পুনরায় তার আবেদন ফিরে পেতে শুরু করেছে। তবে এবার ভিন্নভাবে, নতুন ধরনের স্বাদ নিয়ে তা উঠে আসছে। উল্লেখ্য, বর্তমানকালের জাপানী আর্টিস্টদের কাজগুলোতেও সেই প্রাচীন ‘ওয়াবি-সাবি’ দর্শনের প্রভাব অনেকটা লক্ষ্য করা যায়, বিশেষ করে নকশাগুলোর অপ্রতিসমতায়।

সাম্প্রতিক প্রদর্শনী ও সম্ভাবনা

সাম্প্রতিককালে পাশ্চাত্যে জাপানের কিছু বাছাই করা বাঁশের শিল্পকর্ম নিয়ে বেশ কিছু প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়েছে এবং সেগুলোতে আশাব্যঞ্জক সাড়াও পাওয়া গেছে। এসব প্রদর্শনীর ফলে পশ্চিমের সংস্কৃতিপ্রেমীরা জাপানী অনন্য এ শিল্পটিকে ভিন্ন আঙ্গিকে দেখার সুযোগ পাচ্ছেন এবং একইসাথে সরাসরি এই শিল্পের শিল্পীদের সংস্পর্শেও আসতে পারছেন।

গত বছরের জুন মাসে শুরু হয়ে এ বছরের ফেব্রুয়ারিতে সমাপ্ত হওয়া মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বৃহৎ শিল্প জাদুঘর দ্য মেট্রোপলিটান মিউজিয়াম অফ আর্ট কর্তৃক আয়োজিত এমনই এক প্রদর্শনী ছিলো ‘Japanese Bamboo Art: The Abbey Collection’। এই আয়োজনে প্রদর্শিত সবচেয়ে সুন্দর শিল্পকর্মগুলোর সিংহভাগই আর্থার অ্যাবে ও ডায়ান অ্যাবে দম্পতির কাছ থেকে পাওয়া। চোখধাঁধানো সব শিল্পকর্মের সমাহারে ভরপুর এ প্রদর্শনীটি ছিলো জাপানের বাঁশ-শিল্প নিয়ে বড় পরিসরে করা সর্বশেষ আয়োজন।

ধারণা করা হয়, জাপানে বর্তমানে ৫০ জনের মতো পরিপূর্ণ পেশাদার লোক এই বাঁশ-বুনন শিল্পের সাথে জড়িত আছেন। তাদের মধ্যে একজন হলেন জাপানের ‘জীবন্ত জাতীয় সম্পদ’ সম্মাননা পাওয়া শীর্ষস্থানীয় বাঁশ-শিল্পী নোবোরু ফুজিনুমা। তিনি মনে করেন, জাপানী এই বাঁশ-বুনন শিল্প জাপানের চেয়ে পাশ্চাত্যেই বেশি জনপ্রিয়। তবে তিনি এ আশঙ্কাও করেন যে, জাপানী এ শিল্পটি হয়তো টিকে থাকবে না। কারণ হিসবে তিনি উল্লেখ করেন, বর্তমানে মেধাবীরা এ শিল্পের দিকে তেমন একটা ঝুঁকছে না। কিংবা যারা ঢুকছেও, তাদের চিন্তা ও কাজে মৌলিকত্ব ও সৃজনীশক্তি খুব একটা লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। অথচ এ শিল্পের মূল চালিকাশক্তিই হচ্ছে শিল্পীর সৃজনশীল কল্পনাশক্তি।

তবে ফুজিনুমা আশার কথাও শোনান, পাশ্চাত্যের সাম্প্রতিক আগ্রহ হয়তো এ শিল্পকে আবারও চাঙ্গা করে তুলতে পারে। সেক্ষেত্রে জাপানের ঐতিহ্যবাহী ও দৃষ্টিনন্দন এ শিল্পটি হয়তো আবারও স্বমহিমায় উজ্জ্বল হয়ে উঠবে বিশ্ব দরবারে।

This article is in Bangla language. It focuses on the history and the current situation of Japanese bamboo-weaving craft.

References:

1. Bamboo Flooring History - BuildDirect

2. Origin of Bamboo - BambooGrove

3. The Many Bamboo Uses Throughout History to Today – AmaZuluInc.

4. The History of Bamboo Plants - GardenGuides

5. Karamono: Imported Chinese Artwork - TNM

6. Chinese, Korean & Japanese Utensils - Omotesenke

7. Bamboo: Tradition in Contemporary Form – The National Gallery of Victoria

8. A Brief History of Wabi-Sabi – Medium.com

9. Western Taste for Bamboo Art Is Transforming an Ancient Japanese Tradition: CNN

Featured image: kagedo.com

Related Articles