দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য এবং এর সমৃদ্ধি বিশ্বে বেশ প্রসিদ্ধ। থাইল্যান্ড, কম্বোডিয়া ও লাওস তাদের দেশজ ঐতিহ্যের বিশেষ বিশেষ ধারার জন্য নিজ স্থানে উজ্জ্বল হয়ে আছে। এই দেশগুলোর বিভিন্ন ঐতিহ্য বিভিন্ন সময় বিশ্বের সংস্কৃতিমনা মানুষের তৃষ্ণা মিটিয়েছে। এমনই এক অনন্য ঐতিহ্য হচ্ছে থাইল্যান্ডের ঐতিহ্যবাহী ‘খোন’ থিয়েটার।
‘খোন’ মূলত থাইল্যান্ডের এক বিশেষ ধাঁচের নৃত্যনাট্য। জমকালো কস্টিউম, একত্রে প্রায় একশ অভিনেতা-অভিনেত্রীর উপস্থিতি, মঞ্চে গানের প্রয়োজনে বেশ বড় আকারের অর্কেস্ট্রা, কাহিনীর বক্তাদের মাধ্যমে ঘটনার নাটকীয় বর্ণনা ও যুদ্ধবিগ্রহের অভিনব উপস্থাপনা খোন থিয়েটারকে সবদিক থেকে ব্যতিক্রমধর্মী করে তুলেছে।
এই থিয়েটারে অভিনেতাদের ব্যবহৃত মুখোশ বেশ অনন্য বৈশিষ্ট্যে উজ্জ্বল। মজার বিষয় হচ্ছে, এই থিয়েটারে নাটক চলাকালে অভিনয়ের কলাকুশলীরা নিজে থেকে নাটকের কোনো সংলাপ বলেন না। আকর্ষণীয় অভিনয় শৈলী, বর্ণময় প্রকাশভঙ্গি ও থাই শাস্ত্রীয় নাচের মাধ্যমে তারা শুধু চরিত্রের বর্ণনা তুলে ধরেন। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ঐতিহ্যবাহী মহাকাব্য ‘রামাকিয়েন’ (ভারতবর্ষে যা ‘রামায়ণ’ নামে পরিচিত) এ থিয়েটারের মূল উপজীব্য।
খোন থিয়েটারে ঐতিহ্যবাহী মুখোশ ‘পাপিয়ের মাশে’ নামে পরিচিত। ‘রামাকিয়েন’ মহাকাব্যে বর্ণিত বানর, রাক্ষস ও রাজপরিবারের দৃশ্য উপস্থাপনে ভিন্ন ভিন্ন মুখোশ ব্যবহৃত হয়। এছাড়া অলঙ্করণ, যুদ্ধের বর্ম, অস্ত্র ও রাজকীয় মুকুটের প্রদর্শন থাইল্যান্ডের আয়ুত্থিয়া অঞ্চলের সোনালী অতীতের কথাও মনে করিয়ে দেয়।
‘খোন’ থিয়েটারের ইতিহাস এর নিজের মতোই সমৃদ্ধ। ধারণা করা হয়, থাই রাজা দ্বিতীয় রামা (১৮০৯-২৪) এই থিয়েটারের জনক। তবে এখনকার ইতিহাসবিদগণ এই থিয়েটারের বয়স আরো বেশি বলে মনে করেন। অনেক ঐতিহাসিক বলে থাকেন, থাইল্যান্ডের আয়ুত্থিয়া অঞ্চলে ১৬৯১ সালে আগত ফরাসি কূটনীতিকদের লেখা বর্ণনা এই থিয়েটারের অস্তিত্বের প্রথম নিদর্শন। অন্য একটি বর্ণনায় পাওয়া যায় যে, আঠারো শতকে থাইল্যান্ডে যেকোনো সাংস্কৃতিক উৎসবে অন্যান্য আয়োজনের সাথে ‘খোন’ থিয়েটারের ব্যবস্থাও থাকতো। দেশটির প্রাচীন বিভিন্ন রাজকীয় দলিলে এই উল্লেখ দেখে মনে হয় যে, রাজপরিবার এই সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের বিশেষ গুণগ্রাহী ছিলেন।
অনেকে বলেন, ‘নাং ইয়াই’ নামক ছায়ামঞ্চ শিল্প ‘খোন’ থিয়েটারের সবচেয়ে প্রাচীন উৎস। দুটি ধারাতেই প্রায় একই ধাঁচের মঞ্চসজ্জা, মসলিনের পর্দার উপস্থিতি ও আবহ সঙ্গীতের কাছাকাছি রকমের ব্যবহার দেখে এরকম মনে হয়। আবার অনেকে বলেন, থাইল্যান্ডের প্রাচীন ধর্মীয় ঐতিহ্য ‘চাক নাক দুকদামবান’ এই থিয়েটারের প্রাথমিক উৎস। এই ধর্মীয় উৎসবটি সাধারণত রাজপরিবারের অভিষেক অনুষ্ঠানে পালিত হতো। এই অভিষেক অনুষ্ঠান ‘ইন্দ্রাপিসেকা’ নামে পরিচিত ছিলো (তুলনা করুন- সংস্কৃত ‘ইন্দ্রাভিষেক’)। এই উৎসবে সেনাবাহিনীর উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাগণ পৌরাণিক সাজে সজ্জিত হয়ে অভিনয়ে মেতে উঠতেন। ভারতীয় পুরাণের অন্তর্গত উপাখ্যান ‘আকাশ গঙ্গার পৃথিবীতে আগমন’ ছিল অভিনয়ের অন্যতম উপাখ্যান। ইন্দোনেশিয়ার জাভা, কম্বোডিয়ার আঙ্কোরভাট ও দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার অন্যান্য অনেক এলাকায় কাছাকাছি ধাঁচের অভিনয় ভঙ্গি প্রচলিত ছিলো।
‘খোন’ থিয়েটারে থাই শাস্ত্রীয় নাচের প্রায় সবদিক ব্যবহৃত হয়। থাই শাস্ত্রীয় নাচ স্থানীয় ভাষায় ‘নাতাসিন’ নামে পরিচিত। মঞ্চের চরিত্র হিসেবে বানর ও রাক্ষসদের অভিনয় উপস্থাপনের নিজস্ব ধরন রয়েছে। চরিত্রগুলোর বাহ্যিক উপস্থাপনে বীরত্ব বোঝানোর জন্য থাই মার্শাল মুয়াইথাইয়ের সার্থক ব্যবহার করা হয়। কস্টিউম ডিজাইনে ভারতীয় পৌরাণিক শিল্পের বিশেষ প্রভাব রয়েছে। সাধারণত রাক্ষস চরিত্র উপস্থাপনে বীরত্ব ও আধিপত্যব্যঞ্জক নাচ ব্যবহৃত হয়। অন্যদিকে বানর চরিত্র উপস্থাপনে অ্যাথলেটদের মতো ক্ষিপ্র ও সাবলীল ভঙ্গির নাচ ব্যবহৃত হয়। উল্লেখ্য, বানর চরিত্রের উপস্থাপনে বানরের ভঙ্গির যে প্রদর্শন হয়, তাতে চীনের মার্শাল আর্টের প্রভাব আছে বলে অনেকে মনে করেন।
‘খোন’ থিয়েটারের মূখ্য চরিত্রগুলোকে প্রধানত চার ভাগে ভাগ করা যায়। নায়ক চরিত্রের নাম ‘ফ্রা রাম’ ও ‘ফ্রা লাক’ (তুলনা করুন- রাম ও লক্ষ্মণ !) এবং নায়িকা চরিত্রের নাম নাং 'সিদা' ও 'মন্থো' (সীতা ও মন্থরা নামের কাছাকাছি)। অন্যান্য উল্লেখযোগ্য চরিত্র হচ্ছে বানর ও রাক্ষস। আগেকার দিনে সকল চরিত্রের অভিনেতাই মুখোশ পরতো, কিন্তু পরে শুধু বানর ও রাক্ষস চরিত্রের জন্য মুখোশ পরার নিয়ম করা হয়।
‘খোন’ থিয়েটার মূলত ‘রামাকিয়েন’ মহাকাব্যভিত্তিক হওয়ায় এতে যুদ্ধবিগ্রহের উপস্থিতি বেশ সরব অবস্থাতেই পাওয়া যায়। যুদ্ধবিগ্রহের দৃশ্যে মার্শাল আর্টের ব্যবহার বেশ আকর্ষণীয় করে উপস্থাপন করা হয়। মঞ্চে জমকালো মুখোশ ও অভিনব কস্টিউমে আচ্ছাদিত বানর ও রাক্ষস সেনার যুদ্ধের দৃশ্য দর্শকদের উত্তেজনা কয়েকগুণ বাড়িয়ে দেয়। আধুনিকতার ছোঁয়া লাগার ফলে বর্তমানে যুদ্ধের দৃশ্যে আতশবাজিও ব্যবহৃত হয়। এ থিয়েটারের আরেকটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে রাজকীয় দরবারের দৃশ্য সার্থকভাবে তৈরি করা। রাক্ষস রাজা ‘তোতসাকান’ (খেয়াল করুন- রাবণ অর্থে দশানন শব্দের কাছাকাছি) এবং নায়ক 'ফ্রা রাম' দুই প্রধান চরিত্রের রাজকীয় দরবারই বেশ কড়া নিয়মের সাথে প্রদর্শিত হয়। বলা হয়ে থাকে, রাজকীয় ঢঙে ও রাজাদের মনোরঞ্জনের অন্যতম উপাদান হবার কারণে ‘খোন’ থিয়েটারের মঞ্চে রাজদরবারের দৃশ্যের জমকালো উপস্থিতি খুব স্বাভাবিক ছিলো।
এই থিয়েটারে নাটকের মঞ্চায়ন সাধারণত খোলা জায়গায় হয়। প্রথমদিকে এই থিয়েটারে ব্যতিক্রমী কোনো প্রকারের মঞ্চসজ্জা ব্যবহৃত হতো না। সাধারণ কাঠের তৈরি মঞ্চ ও মঞ্চে কিছু উঁচু স্থান দরবারের দৃশ্যে রাজা, মন্ত্রী ও সেনাপতিদের আসন হিসেবে ব্যবহৃত হতো। আগেকার দিনের মঞ্চায়নে নায়ক ‘ফ্রা রাম’ অথবা খলনায়ক ‘তোতসাকান’ এর রাজদরবারের দৃশ্য ও কার্যকলাপ দ্বারা নাটকের প্রথম দৃশ্য শুরু হতো। এ ধরনের দৃশ্য তুলে ধরার ক্ষেত্রে থাই রাজদরবারের নিয়মকানুন বেশ কঠোরভাবে পালন করা হতো। মজার ঘটনা হলো, থাই রাজদরবারে প্রদর্শনের সময় রাজার অনুগত কোনো সেনাপতি অথবা মন্ত্রীও কখনও কখনও এতে অভিনয় করতেন। আড়ালে একজন বক্তা বা প্রম্পটার এক দৃশ্য থেকে অন্য দৃশ্যের পরিবর্তন বেশ অভিনব কায়দায় বর্ণনার মাধ্যমে দর্শকদের উৎসুক করে রাখতেন।
‘খোন’ থিয়েটারের সবচেয়ে আকর্ষণীয় দিক হচ্ছে এর যুদ্ধদৃশ্য। যুদ্ধের দৃশ্যে হামলা ও হতাহত হবার দৃশ্যের পূর্বে দুই প্রবল বিরোধী রাজার মধ্যে কূটনৈতিক আচার-আচরণ ও সমঝোতার দৃশ্য বেশ কুশলতার মাধ্যমে শৈল্পিকভাবে উপস্থাপিত হয়। কূটনৈতিক দৃশ্যের ঠিক পরই দুই চিরশত্রু রাজার মধ্যকার যুদ্ধের ময়দানে সৈন্য সমাবেশ মঞ্চে দেখানো হয়।
যুদ্ধের একপর্যায়ে নাটকের নায়ক ‘ফ্রা রাম’ ও খলনায়ক ‘তোতকাসান’ মঞ্চের পরস্পর বিপরীত দিক দিয়ে প্রবেশ করে। তাদের বাহন হিসেবে থাই ঐতিহ্যে তৈরি রাজকীয় রথের দৃশ্য দেখানো হয়। রথের ঘোড়া হিসেবে একদল সুঠামদেহী অভিনেতা ঘোড়ার মুখোশ পরে নিজ নিজ ভূমিকায় দেখা দেয়। নায়ক ও খলনায়কের হাতে দেখানো হয় অলঙ্কারে মোড়ানো শৈল্পিক ধনুক ও তীর। খলনায়ক ‘তোতকাসান’ এর পেছনে থাকে অস্ত্রধারী বিশাল দেহের রাক্ষস সেনা। নাচের মুদ্রায় তাদের চোখ-মুখের বিধ্বংসী ভাব দর্শকের রুদ্ধশ্বাসের অনুভূতি তৈরি করতে যথেষ্ট। নায়ক ‘ফ্রা রাম’ ও তার ভাই ‘ফ্রা লাক’ এর পেছনে থাকে দক্ষ ও ক্ষিপ্র বানর সেনা।
মঞ্চে যুদ্ধের দৃশ্য চলাকালে শেষ পর্যায়ে নায়ক ও খলনায়ক তীর-ধনুকের যুদ্ধ শেষে নিজ নিজ রথ থেকে নেমে এসে একে অপরের সাথে মল্লযুদ্ধে লেগে পড়ে। মল্লযুদ্ধের একপর্যায়ে খলনায়ক পরাজিত হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। তখন নায়ক বীরের মতো পরাজিত যোদ্ধার উরুতে পা ঠুকে নিজের বিজয় ঘোষণা করে। নায়কের এই বিজয়ের অসাধারণ দৃশ্য থাইল্যান্ডের ঐতিহ্যবাহী মন্দিরে আঁকা ছবি ও মূর্তির দৃশ্যের চেয়ে কোনো অংশে কম সুন্দর নয়।
সময়ের পরিবর্তনের সাথে সাথে এই থিয়েটারের উপস্থাপনে অনেক পরিবর্তন এসেছে। পূর্বে রাজদরবারে অভিনীত নাটকে নারী কলাকুশলী নেওয়া হতো না। নারী চরিত্রে পুরুষ অভিনেতারাই অভিনয় করতেন। বর্তমানে ‘ন্যাশনাল থিয়েটার অব ব্যাংকক’ এ নারী চরিত্রে নারী কলাকুশলীর বেশ বর্ণময় উপস্থিতি আছে। থাইল্যান্ডের অনেক বিখ্যাত অভিনেত্রী ‘খোন’ থিয়েটারের মাধ্যমে খ্যাতি লাভ করেছেন।
‘খোন’ থিয়েটারের শিল্পবৈচিত্র্য এখনও পাশ্চাত্যের ব্যাপক সংখ্যক শিল্পী ও রসিক ব্যক্তিত্বের মন কাড়ে। ইউনেস্কো এই শিল্পকে ‘ইনট্যানজিবল কালচারাল হেরিটেজ অব হিউম্যানিটি’ হিসেবে ঘোষণা করেছে।
This Bangla article is about amazing 'Khon Theatre' of Thailand.
References:
01. Khon, “The Masked Pantomime” - Disco
02. Khon Dance legacy of the Ramayana epic - Tour Bangkok Legacies
03. KHON MASKS OF THAILAND - Seasite