Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website. The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

লিম্বাহ বালিম: ইন্দোনেশিয়ার রোমাঞ্চকর এক আদিবাসী উৎসব

হাজার হাজার দ্বীপ আর অসংখ্য আদিবাসী জনগোষ্ঠীর সমন্বয়ে গঠিত বৈচিত্র্যময় দেশ ইন্দোনেশিয়া। পৃথিবীর অনেক প্রাচীন জনগোষ্ঠীর বসবাস রয়েছে এ দেশটির বিভিন্ন দ্বীপে। বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকেও দেশটির অনেক দ্বীপ ছিল অনাবিষ্কৃত বা পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন। তেমনই একটি দ্বীপের নাম ওয়েস্টার্ন নিউ গিনি। এই দ্বীপে পাহাড় ও নদীবেষ্টিত একটি উপত্যকা রয়েছে, নাম ‘বালিম’। বালিম উপত্যকায় ইন্দোনেশিয়ার প্রাচীনতম কয়েকটি আদিবাসী জনগোষ্ঠীর বসবাস রয়েছে। 

১৯৩৮ সালে আমেরিকান প্রাণীবিজ্ঞানী রিচার্ড আর্চবোল্ড বিমান যোগে ওয়েস্টার্ন নিউ গিনির উপর দিয়ে যাচ্ছিলেন। এমন সময় তিনি একখণ্ড সবুজ ভূমি দেখতে পেলেন। কৌতূহল নিয়ে তিনি এই দ্বীপে অবতরণ করেন। এ সময় তিনি দ্বীপে বসবাসরত আদিবাসীদের রহস্যময় জীবনাচারের সন্ধান পান। এজন্য তাকে দ্বীপটির আবিষ্কারকও বলা হয়। তবে অনেকের মতে, রিচার্ড আর্চবোল্ডের আগেও ১৯০৯-১০ সালের দিকে নেদারল্যান্ডের গবেষক লরেন্টজা নিউ গিনি দ্বীপটির সন্ধান পেয়েছিলেন, কিন্তু তিনি সেখানকার কোনো মানুষের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করতে পারেননি।

ওয়েস্টার্ন নিউ গিনি দ্বীপের মানচিত্র; Image Source: wikipedia.org

১৯৪৫ সালে একটি জার্মান বিমান বিধ্বস্ত হয়ে বালিম উপত্যকায় আছড়ে পড়ে। এ সময়ে উপত্যকাটি বিশ্বব্যাপী আলোচিত হয়ে ওঠে।১৯৬২ সালে ওয়েস্টার্ন নিউ গিনি ইন্দোনেশিয়ার অন্তর্ভুক্ত হয়, ফলশ্রুতিতে বালিম উপত্যকাও ইন্দোনেশিয়ার অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়। এরপর থেকে বালিম উপত্যকা সমাজ বিজ্ঞানী, নৃবিজ্ঞানী, পরিবেশ বিজ্ঞানীসহ নানা পর্যায়ের গবেষকদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। তারা গবেষণা করে প্রমাণ পান, যখন থেকে মানুষ পাথর দ্বারা শিকারের অস্ত্র তৈরি করতে শিখেছে, তখন থেকেই এই উপত্যাকায় মানুষ বসবাস করে আসছে।

বালিম উপত্যকার একটি দৃশ্য; Image Source : captureindonesia.com

বালিম উপত্যকা নিয়ে আমেরিকার বিশিষ্ট পরিবেশ বিজ্ঞানী পিটার ম্যাথেসসেন ‘আন্ডার দ্য মাউন্টেন ওয়াল‘ নামক একটি গবেষণা গ্রন্থ রচনা করেন। বইটির পেছনের দিকে সারমর্মে লেখা রয়েছে,   

নিউ গিনির কেন্দ্রে অবস্থিত বালিম উপত্যকায় আদিম প্রস্তর যুগের একটি আদিবাসী সম্প্রদায় বসবাস করে। সম্প্রদায়টির নাম ‘কুরেলু’। বিংশ শতাব্দীতে এসেও তাদের অস্তিত্ব বিদ্যমান। পিটার ম্যাথেসসেন হার্ভার্ডের একটি প্রজেক্টে ১৯৬১ সালে কুরেলুদের আবাসভূমিতে যান এবং তাদের নিয়ে গবেষণা করেন। ‘আন্ডার দ্য মাউন্টেন ওয়াল’ সেই গবেষণারই বিবরণ। এ সময় তিনি সেখানে কয়েকজন বড় বড় যোদ্ধার সন্ধান পান। যেমন উইকলিকিক, সোনাহেরদ তুকুম, ইউ-মুই প্রমুখ। এরা আকস্মিক হামলা চালিয়ে যে কাউকে হত্যা করে ফেলতে পারে। তিনি দেখলেন, এরা নিয়মিত বিভিন্ন কাজ, খেলাধুলা ও যুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়ে ব্যস্ত থাকে। পিটার ম্যাথেসসেন তার বইয়ের মাধ্যমে কুরেলু সম্প্রদায়ের একটি দারুণ চিত্র ফুটিয়ে তুলতে সক্ষম হয়েছেন। ম্যাথেসসেন ছিলেন একজন দক্ষ বর্ণনাকারী।  

এই কুরেল সম্প্রদায়ের লোকেরা স্থানীয়ভাবে দানি আদিবাসী নামে পরিচিত। পেশার ভিত্তিতে এদের মধ্যে আরও দুটি শাখা রয়েছে। তা হচ্ছে লানি ও ইয়ালি। এসব আদিবাসী প্রাচীনকাল থেকেই তাদের একটি বার্ষিক উৎসব পালন করে আসছে। বালিম উপত্যকার ওয়ামেনা এলাকায় অনুষ্ঠিত এই উৎসবের নাম ‘লিম্বাহ বালিম’

লিম্বাহ বালিম উৎসবের একটি দৃশ্য, যেখানে যুদ্ধের সজ্জা গ্রহণ করেছে বেশ কয়েকজন আদিবাসী পুরুষ; Image Source: captureindonesia.com

লিম্বাহ বালিম উৎসবের মূল আকর্ষণ দুই দল যোদ্ধার প্রতীকী যুদ্ধ। জানা যায়, প্রাচীনকালে এই যুদ্ধ প্রতীকী ছিল না। তারা যোদ্ধা বাছাই ও নিজেদের বীরত্ব প্রকাশের উপায় হিসেবে এই উৎসবের আয়োজন করতো। সময়ের পরিবর্তনে ও বাহিরের মানুষের সংস্পর্শে এসে সেই সহিংস যুদ্ধ পরিহার করে এখন শান্তিপূর্ণ উৎসবের আয়োজন করে এখনকার আদিবাসীরা। বর্তমানে অনুষ্ঠানটি স্থানীয় জায়াউইজায়া সরকার (ইন্দোনেশিয়ার ওয়েস্টার্ন নিউ গিনি প্রাদেশিক সরকারের অধীনস্থ স্থানীয় সরকার) আয়োজনে করে।

প্রতীকী যুদ্ধের মহড়া দিচ্ছে একদল আদিবাসী যোদ্ধা; Image Source: goodnewsfromindonesia.id

সাধারণত আগস্টের ৮-১০ তারিখ এই উৎসবটি অনুষ্ঠিত হয়। এজন্য ৪০০ মিটার দৈর্ঘ্য এবং ২৫০ মিটার প্রস্থের মাঠ প্রস্তুত করা হয়। উপত্যকার ৫০০-১০০০ জন শক্তিমান যোদ্ধাকে বাছাই করে, তাদেরকে ৩০-৫০টি দলে বিভক্ত করা হয়। তারা সবাই যুদ্ধের ঐতিহ্যবাহী পোশাক পরিধান করেন। নিজেদের প্রযুক্তিতে তৈরি যুদ্ধাস্ত্র সঙ্গে ধারণ করেন। যুদ্ধাস্ত্রগুলো দেখতে অনেকটা বর্শা ও তীর-ধনুকের মতো।

শুধু অস্ত্র নয়, উৎসবে তাদের পোশাক পরিধানের ধরনও বেশ লক্ষণীয়। যোদ্ধারা প্রায় নগ্ন দেহে থাকেন। সাধারণত পুরুষরাই যোদ্ধা হিসেবে নির্বাচিত হয়ে থাকেন। তাদের গোপনাঙ্গে সাধারণত পশুর শিং গাছের বাকল দিয়ে তৈরি লম্বাকৃতির বিশেষ রক্ষাকবচ লাগানো থাকে। একে স্থানীয় ভাষায় বলা হয় কোটেকা।

যুদ্ধের পোশাকে সজ্জিত একদল আদিবাসী যোদ্ধা; Image Source: theguardian.com

উৎসবে অংশগ্রহণকারী নারীদের দেহের নিচের অংশ গাছের পাতা বা ঘাস দিয়ে তৈরি বিশেষ ধরনের পোশাক দ্বারা আবৃত থাকে। এছাড়া নারী-পুরুষ উভয়ের মাথায় বৈচিত্র্যময় অলঙ্কার এবং গলায় পশুর হাড় দিয়ে তৈরি মালা পরিধান করা থাকে। চেহারা ও শরীরে প্রধানত কালো ও সাদা রঙ মেখে বিভিন্ন ঐতিহ্যবাহী সজ্জা গ্রহণ করা হয়।  

বিভক্ত দলের মধ্য থেকে পর্যায়ক্রমে দুই দল সম্মুখ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া ও উত্তেজনাকর ভাব-ভঙ্গিমার মাধ্যমে যোদ্ধারা লড়াই জমিয়ে তোলে। মাঠের চারপাশে দাঁড়িয়ে স্থানীয় বাসিন্দা ও পর্যটকেরা তা পর্যবেক্ষণ করেন।

লিম্বাহ বালিম উৎসবের সাজে সজ্জিত একদল নারী ও পুরুষ; Image Source: indonesia.biz.id

যুদ্ধের সময় ঐতিহ্যবাহী পাপুয়া সঙ্গীত বাজানো হয়। শুধুমাত্র দক্ষ সঙ্গীতজ্ঞরা এই বাদ্য বাজাতে পারেন। এজন্য ‘পিকন’ নামক গাছের বাকল থেকে বিশেষ বাদ্যযন্ত্র তৈরি করা হয়। এই বাদ্যের সুর অত্যন্ত গম্ভীর ও শোকার্ত প্রকৃতির। এ সময় সবাই মুগ্ধ হয়ে যুদ্ধের কসরত উপভোগ করতে থাকে।

যুদ্ধের পাশাপাশি দুই দিনের উৎসবে ঐতিহ্যবাহী পাপুয়ান নৃত্য, শূকরের দৌড় প্রতিযোগিতা, পুরাডাল রাতার (তীর সদৃশ) নিক্ষেপ, হস্তশক্তি পরীক্ষাসহ নানা প্রকারের আয়োজন থাকে। 

পিকন গাছের বাকল দিয়ে তৈরি বাদ্যযন্ত্র বাজাচ্ছেন এক আদিবাসী শিল্পী; Image Source : ibtimes.co.uk

কিন্তু প্রাচীনকাল থেকে কেন এই উৎসব চলে আসছে? স্থানীয়দের বিশ্বাস, তাদের দুজন আধ্যাত্মিক পূর্বসূরী রয়েছে। তারা পরস্পর স্বামী ও স্ত্রী ছিলেন, যারা এই উপত্যকার প্রাচীনতম  নিবাসী। তারা যখন এই উপত্যকা ছেড়ে চলে যান, তখন দুই সন্তান জন্ম দিয়ে যান। একজনের নাম ওইটা, অপরজনের নাম ওয়ারো। ঐ দুই সন্তানের মাধ্যমে পরবর্তীতে এই উপত্যকায় মানুষের বিস্তৃতি ঘটেছে। কিন্তু সেই দুজন আধ্যাত্মিক পূর্বসূরী চলে যাওয়ার সময় সন্তানদের বলে যান, যদি তোমরা আমাদের সম্মান করো তাহলে তোমরা তিনটি বিষয়ে নিরাপত্তা পাবে। প্রথমত, তোমাদের সবুজ বাগান ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা পাবে। দ্বিতীয়ত, মাটির উর্বরতা কখনো নষ্ট হবে না। তৃতীয়ত, রোগের প্রাদুর্ভাব থেকে তোমরা রক্ষা পাবে। তখন সন্তানরা জানতে চান, আমরা আপনাদের কীভাবে স্মরণ করবো। তখন তারা এই বার্ষিক উৎসব উদযাপনের আদেশ প্রদান করেন। পরবর্তীতে নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগ, লড়াই, সংগ্রাম ও বহিঃশত্রু মোকাবেলার কৌশল হিসেবে এই উৎসব পালনের পদ্ধতি ও ধরনের বিবর্তন ঘটেছে।

দুই গ্রুপের মধ্যে লড়াইয়ের একটি দৃশ্য; Image Source : topindonesiaholidays.com

সমাজ পরিচালনার জন্য প্রতি তিন-চার পরিবার মিলে একজন ছোট রাজা নিযুক্ত হন। এসব রাজার সমন্বয়ে ‘পারশ’ নামে সামাজিক কাঠামো গড়ে তোলা হয়। আর এসব সামাজিক কাঠামোর সমন্বয়ে গঠিত হয় সমগ্র উপত্যকার পরিচালনা পরিষদ। এই পরিষদে তিনজন প্রভাবশালী ব্যক্তি থাকেন- একজন যুদ্ধ পরিচালনার প্রধান, একজন দরবেশ বা ধর্মীয় নেতা এবং একজন সর্দার। মূলত সর্দার রাজনৈতিকভাবে পুরো বালিম উপত্যকা পরিচালনা করে থাকেন। তবে সবার উপর দরবেশের বিশেষ প্রভাব বিদ্যমান থাকে। আদিবাসীদের বিশ্বাস, এই ধর্মীয় নেতা তাদের পক্ষ থকে ক্ষমতাধর আদি পূর্বপুরুষের সাথে যোগাযোগ অব্যহত রাখেন এবং তাদের পরামর্শ সাধারণ আদিবাসী জনগণের নিকট পৌঁছে দেন। যুদ্ধ পরিচালনার প্রধান লিম্বাহ বালিম উৎসবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। সর্দার সমাজসমূহ পরিচালনার পাশপাশি স্থানীয় সরকারের সাথে সমন্বয়ের ভূমিকা পালন করে থাকেন।

লিম্বাহ বালিম উৎসবের মাঠ প্রস্তুতকরণ নিয়ে ব্যস্ত সময় পার করছেন উপত্যকাটির যুদ্ধ পরিচালনার বিষয়ক প্রধান; Image Source: wikipedia.org

বালিম উপত্যকার আদিবাসীদের প্রধান খাদ্য আলু ও শূকরের মাংস। শূকরের মাংস সংরক্ষণের জন্য তারা শিকারের পাশাপাশি নিজেরা প্রতিপালনও করে থাকেন। শূকর হত্যা করার পর শুকনো গাছের কুণ্ডলী তৈরি করেন। সেখানে আস্ত শূকরটি রেখে নানা প্রকারের লতাপাতা দিয়ে সেটি ঢেকে দেন। লতাপাতার উপরে পাথর খণ্ড দিয়ে সেটি চাপা দেন। তারপর সেখানে আগুন ধরিয়ে দেন। পোড়া গন্ধ বের হলে লাঠি দিয়ে আগুন সরিয়ে শূকরের দেহটি বের করেন। তারপর হাত দিয়ে ছিড়ে ছিড়ে সবাই শূকরের মাংস খেতে থাকেন। মাংসে সাধারণত কোনো মশলা ব্যবহার করা হয় না। একইভাবে তারা আলু পুড়িয়ে খেয়ে থাকেন।

শূকর পোড়ানোর কুণ্ডলী প্রস্তুত করছেন একদল আদিবাসী নারী; Image Source : apex-expeditions.com

বসবাসের জন্য তৈরি ঘরগুলোর দেয়াল কাঠ দিয়ে তৈরি করা হয়। ঘাস বা গাছের পাতা দিয়ে চাল ছেয়ে দেয়া হয়। ঘরগুলো দেখতে আমাদের দেশের কুঁড়েঘরের মতো। সর্বোপরি আধুনিক বিশ্বের সাথে বালিম আদিবাসীদের যোগাযোগ স্থাপিত হলেও তারা তাদের আদিবাসী বিশ্বাস ও সংস্কৃতি ধরে রাখার চেষ্টা করছে। পাশপাশি প্রচুর সংখ্যক বিদেশি পর্যটক তাদের উপত্যকায় গিয়ে জ্ঞান-গবেষণা ও এক রোমাঞ্চকর উৎসবের দর্শক হওয়ার সৌভাগ্য অর্জন করছে। 

লিম্বাহ বালিম উৎসবের একজন যোদ্ধা। নিজেদের তৈরি অস্ত্রের পাশপাশি ঐতিহ্যবাহী সজ্জায় পুরো দেহ; Image Source: theguardian.com

ফিচার ইমেজ- scoopwhoop.com

Related Articles