ঐতিহ্যে দেশজ কাপড়ঃ মসলিন, জামদানির ইতিহাস

রূপ-বৈচিত্র্যে বাংলা যেমন মনোলোভা ও অনন্য তেমনি শিল্পে-ঐতিহ্যেও কিছুমাত্র কম যায়না। বাংলার শিল্প, ইতিহাস, কৃষ্টি, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য এবং সর্বোপরি কারিগরি সূচারুতার মেলবন্ধন বাংলাদেশের পোশাকশিল্প। বাংলাদেশী কাপড়ের পরতে পরতে লুকিয়ে আছে যেমন ঐতিহ্যের ইতিবৃত্ত তেমনি ঠাস বুনটের জালে আটকে গেছে যেনো বাঙ্গালিয়ানার নিপুণ আবেগ ও স্বপ্নের মিশেল।

ঢাকাই মসলিন, জামদানী; টাঙ্গাইলের তাঁত; রাজশাহী সিল্ক কিংবা মিরপুরের বেনারসী শৈল্পিক আভিজাত্যে যেরূপ অনুপম, গুণাগুণ ও মানে ততোধিক আকর্ষণীয়ও বটে! এগুলোর সমাদর বাঙ্গালীর ঘরে ঘরে, আর এসবের ছোঁয়ায় সর্বত্র প্রস্ফুটিত বাংলার জয়ধ্বনি। এই লেখনীর সম্পূর্ণ নির্যাস তাই ঐতিহ্যবাহী বাংলাদেশী বস্ত্রের রং-সুতোর গল্পেরই প্রতিচ্ছবি।

মসলিন

বাংলাদেশের ইতিহাসে আদি ও অকৃত্রিম ঐতিহ্যের এক অনন্য নাম মসলিন তথা ঢাকাই মসলিন। মসলিন অত্যন্ত সূক্ষ, মিহি, বিশুদ্ধ, উজ্বল এবং মোলায়েম একপ্রকার বস্ত্রবিশেষ যা মুঘল আমলের প্রাচীন বাংলার এক অপূর্ব সম্পদ ছিলো। অনেকের মতে ইরাকের বাণিজ্যনগরী মসুল থেকে মসলিন নামটি এসেছে। মসলিন মুঘল আমলের বাদশাহী ও খানদানী নারী-পুরুষ এবং উচ্চপদধারী বিত্তবানদের পোশাক ছিলো।

d1

‘লেডি ইন মসলিন’ চিত্রকর্ম, ফ্রান্সেসকো রোনালডি, ১৭৯২, ঢাকা।

মসলিন প্রস্তুত করা হতো বর্তমান বাংলাদেশের সোনারগাঁও অঞ্চলে, এছাড়াও ধামরাই, তিতবাড়ি এবং জঙ্গলবাড়িতেও মসলিন বয়ন করা হতো। চিত্তাকর্ষক অপরূপ এ কাপড়টি বোনা হতো হাতে। চড়কায় সুতো কেটে হাতে বোনা এই মিহি কাপড় তৈরিতে প্রয়োজন হতো সর্বনিম্ন ৩০০ কাউন্টের এর সুতো। কাঁচের ন্যায় স্বচ্ছ মসলিন বয়নে ব্যবহৃত অতি চিকন সুতো ফুটি কারপাস নামক তুলো থেকেই তৈরি হতো। কোনরূপ প্যাটার্ন ছাড়াই দক্ষ হাতের কারিগরী দক্ষতায় তৈরি মসলিন এতটাই সূক্ষ ছিল যে একটি আংটির ভেতর দিয়ে প্রায় কয়েক গজ কাপড় প্রবেশ করানো যেত। কথিত আছে যে, মসলিনে তৈরি করা পোশাকসমূহ এতই সুক্ষ্ম ছিলো যে ৫০ মিটার দীর্ঘ মসলিনের কাপড়কে একটি দিয়াশলাই বাক্সে ভরে রাখা যেতো।

d2

১৭৮৩ সালে মেরি এন্টোইনেতে, তাঁর বিখ্যাত মসলিন পোশাক পরিহিতা অবস্থায় চিত্রকর্ম

সূক্ষতা, বৈচিত্র্য ও নকশাগত পার্থক্যের মাপকাঠিতে প্রায় আঠাশ প্রকার মসলিন ছিলো যার মধ্যে সর্বোৎকৃষ্ট ছিলো ‘মলমল খাস’ এবং ‘মলবুস খাস’। নাম থেকেই বোঝা যাচ্ছে যে এগুলো তৈরি হতো খাস বা বিশেষ মানুষের জন্য। মলবুস খাস অর্থ খাস বা আসল কাপড় যা তৈরি হতো সম্রাটদের জন্য। মলমল খাস রপ্তানীও করা হতো। এছাড়াও, সরকার-ই-আলা, ঝুনা, আব-ই-রওয়ান, রঙ, তানজীব, চারকোনা, খাসসা, শবনম, সরবুটি, নয়ন সুখ, বদন খাস, সর-বন্ধ, ডোরিয়া, জামদানী প্রভৃতি রকম মসলিনের চল ছিলো যার প্রতিটিই ছিলো নিজ নিজ বৈশিষ্ট্যে অনন্য।

পলাশীর যুদ্ধে নবাবের পতনের পর মসলিনের পৃষ্ঠপোষকতা কমতে থাকে এবং মসলিন ক্রমাগত বিলুপ্তির পথে চলে যায়। এর পেছনে ব্রিটিশ কর্তৃক মসলিনের প্রতি অতিরিক্ত আরোপিত কর ও তাঁতিদের বৃদ্ধাঙ্গুলী কেটে নেয়াকে দায়ী করা হয়। আবার অনেকের মতে, তাঁতিরা নিজেরাই এই কাজ ছাড়ার জন্য আঙ্গুল কেটে ফেলেছিলো। বর্তমানে ‘মসলিন’ নামক আধুনিক মিহি কাপড় বাজার দখল করলেও সেই আদি ও খাঁটি মসলিন কালের গর্ভে হারিয়ে গেছে। ক্বদাচিৎ কোন সংরক্ষণশালা, তৈলচিত্র কিংবা জাদুঘরেই আজ এর দেখা মেলে।

জামদানী

জামদানী প্রাচীন মসলিনের উত্তরাধিকারী যার জাম অর্থ ফুল এবং দানী অর্থ ধারণকারী পাত্র। প্রাচীনকালে নকশাদার মসলিন কেই জামদানী বলা হতো। জামদানী তার বাহারি নকশা ও চমৎকার কারুশৈলীর জন্য বিখ্যাত। হালে জামদানী নানা স্থানে তৈরী করা হলেও ঢাকাকেই জামদানির আদি জন্মস্থান বলে গণ্য করা হয়। জামদানী বয়নের অতুলনীয় পদ্ধতি ইউনেস্কো কর্তৃক একটি অনন্যসাধারণ ‘ইনট্যাঞ্জিবল কালচারাল হেরিটেজ’ হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে।
d5d3

বনেদি ও আভিজাত্যের প্রতীক জামদানী সর্বদাই বাঙ্গালী নারীর নিকট আদরণীয়। জামদানী বলতে আমরা মূলত শাড়ি বুঝলেও এটি দিয়ে কুর্তি, পাগড়ী, রুমাল প্রভৃতি এবং ১৭০০ শতকে শেরওয়ানি তৈরির চল ছিলো। কারপাস তুলা থেকে বানানো সুতার নানান রঙের বুননে গড়ে ওঠা নকশাবাহী জামদানী শুধু আভিজাত্যই নির্দেশ করেনা বরং এটি বিয়ের কনের ক্ষেত্রেও পছন্দসই পোশাক বটে।

d4

জামদানীর নকশাগুলোর মধ্যে সর্বাধিক মূল্যবান হলো ‘পান্না হাজারী’ নকশা যেখানে সোনালী-রুপোলী সুতোর দক্ষ চালনা ও সূচারু কারুকাজে কাপড়ে ফুটিয়ে তোলা হয় অনিন্দ্য সৌন্দর্য। শিল্পমন্ডিত নান্দনিক ঢাকাই জামদানীর নকশায় ফুটে ওঠে কলকি, ফুল, লতা কিংবা জ্যামিতিক কোন ধাঁচ যার অপূর্ব পরিস্ফুটন জামদানীকে করেছে বিপুল জনপ্রিয় ও স্বতন্ত্র। অন্যতম বয়নরীতি, বিন্যাস এবং সৌন্দর্যের জন্যই পুরো বিশ্বে জামদানী এক সমাদৃত নাম।

রাজশাহী সিল্ক

d6

বাংলাদেশী বস্ত্রশিল্পের জগতে রাজশাহী সিল্ক একটি বিখ্যাত ও অন্যতম নাম। সেরিসিন নামক প্রোটিনে আবৃত রেশম পোকার কোকুন বা গুটি থেকে তৈরি এ কাপড় অত্যন্ত নরম ও মোলায়েম। রাজশাহীতে তৈরি হয় বলে এরূপ নামকরণ করা হয়েছে। সিল্ক তিন প্রকার যেমন- মালবেরি সিল্ক বা পাট সিল্ক, এরি বা এন্ডি সিল্ক এবং তসর সিল্ক। মালবেরি সিল্ক ফকফকে সাদা কিংবা ফিকে সাদা হতে পারে, এটি অত্যন্ত উন্নত এবং ভেজা কাপড় ছায়ায় শুকিয়ে ফেলা যায়। উন্নত মান ও সৌন্দর্যের জন্য রাজশাহী সিল্ক বহন করে চলেছে আভিজাত্য ও আকর্ষণের এক অপরূপ উপাখ্যান।

বেনারসী সিল্ক

d7

১৯৫০ এর দিকে ঢাকায় এর বুনন শুরু হয়। বর্তমানে রাজশাহী সিল্ক, কৃত্রিম চাইনিজ রেশম প্রভৃতি দিয়ে বিভিন্ন রকম বেনারসী তৈরি হয়। রাজধানীর মিরপুরের বেনারসী পল্লী এই সকল শাড়ির অবাধ প্রাপ্তিস্থল। হাত ও পায়ের সাহায্যে চালিত তাঁতযন্ত্রে এই সকল শাড়ি বোনা হয়। বিভিন্ন রকম বেনারসীর মধ্যে কাতান, সার্টিন বেনারসী, কার্পেট বেনারসী, হানিকোট বেনারসী, রাজকোট কাতান, বালুচরী বেনারসী, চুন্দ্রী, সিল্ক কাতান, ফুল সিল্ক জামদানি, জামদানি কাতান, কন্টেস্ট কাতান অন্যতম। নানান উৎসব ও পার্বণে, আনন্দমেলা ও বিয়েতে কিংবা বাঙ্গালির বিশেষ অনুষ্ঠানে বেনারসী সিল্ক বাঙ্গালি নারীর একটি অন্যতম প্রিয় পরিধেয়।

d8

টাঙ্গাইলের তাঁত

d11

বাংলার ঐতিহ্যের অন্যতম বাহক এই টাঙ্গাইলের তাঁতের শাড়ি। টাঙ্গাইল সদর, কালিহাতী, নাগরপুর, সখীপুর এর বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে গড়ে উঠেছে অসংখ্য তাঁতিপল্লী। ইতিহাস থেকে জানা যায়, বসাক তাঁতিরাই তন্তুবায় গোত্রের যারা কিনা টাঙ্গাইলের আদি তাঁতি। জগদ্বিখ্যাত পর্যটক হিউয়েন সাঙ ও ইবনে বতুতার কাহিনীতেও টাঙ্গাইলের তাঁতবস্ত্র শিল্পের উল্লেখ আছে। তাঁতপল্লীতে পুরুষেরা তাঁত বোনে। মেয়েরা করে চরকা কাটা, রং করা আর জরির কাজ।

d10

শাড়ি বোনায় ব্যস্ত একজন তাঁতি

তাঁতে তৈরি হয় নানান রঙ, নকশার নানাবিধ শাড়ি যেমন- জামদানী, হাফ সিল্ক, টাঙ্গাইল বি.টি, বালুচরি, জরিপাড়, হাজারবুটি, সূতিপাড়, কটকি, স্বর্ণচুড়, ইককাত, আনারকলি, দেবদাস, কুমকুম, সানন্দা, নীলাম্বরী, ময়ুরকন্ঠী এবং সাধারণ মানের শাড়ি।

খাদি

d12

বাঘা বাঘা কাপড়ের তুলনায় কুমিল্লার বিখ্যাত খাদিও শিল্পবৈচিত্র্যে মোটেও পিছুপা নয়। খাদির সঙ্গে জড়িয়ে আছে ঐতিহাসিক স্বদেশী আন্দোলনের নাম। মহত্মা গান্ধী সে সময়ে সবাইকে চরকায় সুতো কেটে তা দিয়ে তৈরি মোটা কাপড় পরিধান করতে বলেছিলেন। কালপরিক্রমায় সেই আদি খাদি আজ যেমন পাতলা ও ফ্যাশনেবল হয়ে উঠেছে, তেমনি নিজের স্বতন্ত্র সাদা বা সাদাটে রঙের খোলস ছেড়ে নিজেকে রাঙিয়ে নিয়েছে নতুন সব রঙে। পাশাপাশি এতে শোভা পাচ্ছে বিশেষায়িত প্যাটার্ন বা চেক। খাদি দিয়ে পোশাকের পাশাপাশি পরদা, চাদর প্রভৃতিও তৈরি হচ্ছে। বর্তমানে কুমিল্লা সদর, চান্দিনা, দেবীদ্বার এবং মুরাদনগরের তাঁতিগণ খাদি উৎপাদন করে যাচ্ছেন। বাংলার কৃষ্টি, ইতিহাস, বাজার ও ঐতিহ্যে খাদি একটি শক্ত স্থান দখল করে আছে।

পাট

বাংলাদেশের সোনালি আঁশ নামে পরিচিত এই পাট থেকেও বহুকাল যাবত কাপড় তৈরি হয়। পাটের তৈরি কাপড় পরিবেশবান্ধব ও পচনশীল। পাটের তৈরি কাপড় নরম ও আরামদায়ক এবং কোন ক্ষতিকর প্রতিক্রিয়া নেই বলে এর চাহিদা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে।

কটন

d13

তুলা থেকে তৈরি তাঁতে বোনা এই কাপড় গুলি খুবই আরামদায়ক এবং যুগোপযোগী।

বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী এই সকল কাপড় যেমন কালের নানান অধ্যায়ের সাক্ষী তেমনি বর্তমান ফ্যাশন ও যুগের সাথে তাল মিলিয়ে চলারও উপযোগী। সঠিক পৃষ্ঠপোষকতা ও দিকনির্দেশনাই পারে বাংলার এই অমূল্য সম্পদ কে এক অনন্য উচ্চতা ও যথাযথ মর্যাদা।

 

This article is in Bangla Language. Its about some well-known traditional clothes of Bangladesh and their types.

References:

1. https://www.adenandanais.com/what-is-muslin
2. https://en.wikipedia.org/wiki/Muslin
3. https://www.facebook.com/teb.bd/posts/115253738628482
4. http://www.goldnfiber.com/2015/01/luxurious-traditional-fabrics.html
5. https://en.wikipedia.org/wiki/Textile_arts_of_Bangladesh
6. https://bn.wikipedia.org/wiki/%E0%A6%AE%E0%A6%B8%E0%A6%B2%E0%A6%BF%E0%A6%A8
7.  https://sareez.wordpress.com/2011/03/10/most-popular-sarees-of-bangladesh/
8.  http://www.bangladesh.com/textiles/
9.  https://en.wikipedia.org/wiki/Jamdani
10. https://www.newsroom24bd.org/images/cache/1220x480/crop/images%7Ccms-image-000002013.jpg
11. http://www.dainikamadershomoy.com/todays-paper/features/shomoyer-bazzar/22190/%E0%A6%AE%E0%A6%BF%E0%A6%B0%E0%A6%AA%E0%A7%81%E0%A6%B0%E0%A7%87%E0%A6%B0%E0%A6%AC%E0%A7%87%E0%A6%A8%E0%A6%BE%E0%A6%B0%E0%A6%B8%E0%A6%BF%E0%A6%B6%E0%A6%BE%E0%A7%9C%E0%A6%BF/print
12.  http://dailysunamganjprotidin.com/wp-content/uploads/2014/07/images106.jpg
13. http://www.online-dhaka.com/english/1_2_451_0-benarashi-palli-mirpur-dhaka-city.html
14. http://www.somewhereinblog.net/blog/khnivhuta/29634785
15. http://www.khola-janala.com/portal/k-xtra/lifestyle/fashion/fashion_4.html
16. http://blog.bdnews24.com/sahidislam/34812
17. http://www.comillaweb.com/wp-content/uploads/2015/06/14.jpg

Featured Image: mybengaliheritageandculture.blogspot.com

Related Articles