Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

নওয়াজুদ্দিন সিদ্দিকী: শূন্য থেকে উঠে আসা এক অভিনয়-সম্রাট

বলিউডের মূলধারার একজন অভিনেতা হতে হলে কী কী যোগ্যতা থাকা প্রয়োজন? প্রশ্নটা হাস্যকর। কারণ, অভিনেতা হতে হলে ভালো অভিনয় জানতে হবে। এটা তো সহজ অঙ্ক। কিন্তু বলিউড সম্বন্ধে যদি আপনার ধারণা থেকে থাকে, তাহলে অবশ্যই জানেন বি টাউনের অঙ্কটা এত সহজ না। বি টাউনে নিজের নাম লেখাতে হলে আপনার অভিনয়ে এত পারদর্শী না হলেও চলবে। আপনার বাহ্যিক চেহারা আকর্ষণীয় হতে হবে, নাচ-গানে পারদর্শী হতে হবে, এর সাথে বর্তমান সময়ের সংযোজন ‘সিক্স প্যাক এবস’ থাকতে হবে। আর এগুলোর কোনোটায় কমতি থাকলে আরেকটা বাইপাস রাস্তা আছে বলিউডে ঢোকার। আপনাকে হতে হবে বলিউডের কোনো সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিত্বের সন্তান। এর বাইরে খুব কম অভিনেতাকে পাবেন, যারা শুধু অভিনয় দিয়েই বলিউড পাড়ায় নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছে। এবং এদের মধ্যে একজন অভিনেতা আছেন যে স্রেফ অভিনয় দিয়ে এই পাড়ায় নিজেকে বাদশাহির আসনে বসিয়েছেন। তিনিই নওয়াজুদ্দিন সিদ্দিকী।

নওয়াজুদ্দিন সিদ্দিকী; Source:TopYaps

অভিনয়ের বাদশার মতো এত বড় খেতাব এইরকম তরুণ একজন অভিনেতাকে দিয়ে দেয়া হচ্ছে, অবাক হচ্ছেন নিশ্চয়ই। খোদ বলিউডের বাদশা এই গুণী অভিনেতা সম্বন্ধে কী বলেছেন, শুনলে আরও অবাক হবেন।

“সত্যি কথা বলতে নওয়াজ ভাই যত বড় অভিনেতা, আমি নিজেও এত বড় অভিনেতা না। তিনি নিজেও হয়তো জানেন না তিনি কত বড় অভিনেতা। অনেক ফিল্মে কাজ করেছেন, থিয়েটার থেকে এসেছেন। নওয়াজ ভাই আসলেই অনেক বড় ও আলাদা মাপের অভিনেতা। ২৫ বছর ধরে আমি ফিল্মে কাজ করছি। এই দিক দিয়ে আমি সিনিয়র হতে পারি, কিন্তু অভিনয়ের দিক থেকে আমি মোটেও তার চেয়ে সিনিয়র না। যেকোনো অভিনয়ের কাজই তিনি অনেক আলাদা তরিকায় করেন। এবং আমরা যারা সামনে থাকি, তারা ইন্সপায়ার্ড হয়ে যাই। অভিনয়ে তার যে দ্যুতি, তা আমাদের গায়েও এসে পড়ে, যার ফলে আমাদেরকেও ভালো দেখায়।”

শাহরুখ খানের সাথে নওয়াজুদ্দিন সিদ্দিকী; Source: Business Recorder

আজ পর্যন্ত কিং খানের এরকম প্রশংসা অন্য কেউ পেয়েছেন কিনা, বলা যাবে না। বলিউড-বাদশা শাহরুখ খানের এমন প্রশংসা শুনেই বোঝা যায়, আজ বলিউডে নওয়াজুদ্দিন সিদ্দিকী কতটা সমাদৃত। আজকের এই সমাদরের পেছনে রয়েছে অনেক বছরের সাধনা, কঠোর পরিশ্রম এবং অভিনয়ের প্রতি নিজের ভালোবাসা। ‘গ্যাংস অব ওয়াসিপুর’, ‘বাদলাপুর’, ‘দ্য লাঞ্চবক্স’ কিংবা অস্কার মনোনীত ছবি ‘লায়ন’-খ্যাত এই তুখোড় অভিনেতা উঠে এসেছেন একদম শূন্য থেকে। ভারতের মুজাফফর  নগরের ছোট্ট এক গ্রাম থেকে শুরু হয়েছিল তার যাত্রা।

উত্তরপ্রদেশের মুজাফফর নগর জেলার বুধানা নামক ছোট এক গ্রামের এক নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারে নওয়াজুদ্দিন সিদ্দিকী জন্মগ্রহণ করেন, ১৯৭৪ সালের ১৯শে মে। বাবা ছিলেন কৃষক। পরিবারের ৯ ভাই বোনের মধ্যে তিনিই সবচেয়ে বড়। যে গ্রামে নওয়াজের জন্ম, সেটি এতই পশ্চাৎপদ যে সেখানকার লোকজন সম্বন্ধে নওয়াজুদ্দিন বলেছিলেন, এখানকার লোকজন শুধু তিনটি জিনিস চেনে। আখ, গম আর বন্দুক। প্রাথমিক শিক্ষাও অনেক দুষ্প্রাপ্য বস্তু ছিল এই অঞ্চলে। এই পারিপার্শ্বিকতার মধ্যে বড় হয়েও নওয়াজুদ্দিন বড় কিছুর স্বপ্ন দেখেছিলেন।

নিজের গ্রাম এবং আশেপাশের সাত গ্রামের প্রথম গ্রাজুয়েট হিসেবে কেমিস্ট্রিতে অনার্স করেন নওয়াজ। গ্রাজুয়েশন শেষ করে বারোদার একটি পেট্রো-কেমিক্যাল কোম্পানিতে কেমিস্ট হিসেবে চাকরিও নিয়েছিলেন। কিন্তু সেখানে মন টিকলো না। চলে এলেন দিল্লী। চাকরির খোঁজে যখন দিল্লী ঘুরছেন, তখন একজনের কথায় একদিন থিয়েটারে গিয়ে একটি মঞ্চনাটক দেখলেন। মঞ্চনাটক দেখে এতটাই মুগ্ধ হলেন যে তার কাছে মনে হল, এই অভিনয় করার জন্যই তার জন্য হয়েছিল। মঞ্চে কাজ করা শুরু করলেন। মঞ্চে কাজ করে থাকা-খাওয়ার খরচ মিলত না। অপারগ হয়ে নওয়াজুদ্দিন সিকিউরিটি গার্ডের চাকরি নিলেন। সারাদিন গার্ডের দায়িত্ব পালন করতেন। রাতে চলে যেতেন থিয়েটারে। এক-দেড় বছর এভাবে চলার পর নওয়াজ অ্যাডমিশন পেলেন ন্যাশনাল স্কুল অব ড্রামাতে (এনএসডি)।

১৯৯৬ সালে এনএসডির গ্রাজুয়েশন শেষে পাড়ি জমালেন বোম্বেতে। প্রথমে নাটকের জন্য ধরনা দিলেন। ভাগ্য খুললো না। চেহারা দেখেই তাকে বাদ দিয়ে দেয়া হল। ধরনা দিলেন সিনেমার রোলের জন্য। সেখানেও প্রায় একই অবস্থা। অভিনয় না দেখে চেহারা আর শরীরের অবয়ব দেখেই সবাই নাকচ করে দিতে লাগলো। তবে কিছুদিন ঘোরাঘুরির পর ছোটখাটো কিছু রোল পাওয়া শুরু করলেন। পকেটমার, ভিক্ষুক, দারোয়ান, মালীর মতো ছোটখাটো চরিত্রে কাজ করতে লাগলেন।

প্রায় এক যুগ ধরে ছোটখাটো চরিত্রে অভিনয় করে গিয়েছেন নওউয়াজুদ্দিন; Source: Tunes Zone

নওউয়াজুদ্দিনের বলিউড ক্যারিয়ার শুরু হয়েছিল ১৯৯৬ সালে। আমির খানের ‘সারফারোস‘ ছবিতে ছোট একটি চরিত্রে অভিনয়ের মাধ্যমে। ২০০৩ সালে রাজকুমার হিরানীর ‘মুন্নাভাই এমবিবিএস‘ ছবিতেও একটি পকেটমারের চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন। ২০০৩ সালে ইরফান খানের সাথে ‘বাইপাস’ নামে একটা শর্টফিল্মে অভিনয় করেছিলেন। এরপরই শুরু হল খরা। ছোটখাটো রোলও যেন আর মিলছিল না। আর যেসব রোল মিলত, তার জন্য পেতেন মোটে চার-পাঁচশ রূপি। হতাশ হয়ে প্রায়ই চিন্তা করতেন গ্রামে ফিরে যাবেন। বাপ-দাদার মত ক্ষেত খামারে কাজ শুরু করবেন। কিন্তু গ্রামে গেলে আবার মানুষ ‘পরাজিত সৈনিক’ আখ্যা দেবে, এটাও মানতে পারছিলেন না। তাই বারবার গ্রামে ফিরে যাওয়ার চিন্তা মাথায় এলেও অভিনয়ের সাথেই লেগে ছিলেন।

একসময় নওয়াজের অবস্থা এমন হলো যে বাড়িভাড়া দিতে পারছেন না। এনএসডির এক সিনিয়রের কাছে গেলেন। ওই সিনিয়র তাকে থাকার জায়গা দিতে রাজি হলেন। তবে এক শর্তে। বাসার সব রান্না-বান্না নওয়াজের করতে হবে। খুশি মনে রাজি হলেন নওয়াজ।

এরই মধ্যে ২০০৮-০৯ সালের দিকে বলিউডে কিছু নতুন ধারার পরিচালকের উত্থান ঘটলো। প্রথমবারের মতো বলিউডে ইন্ডি ফিল্ম একটি আলাদা জায়গা করে নিতে সক্ষম হল। নন্দিতা দাস, হ্যানসল মেহতা, আনুরাগ কাশ্যপের মত পরিচালকরা লাইমলাইটে আসা শুরু করলো। কোনো এক নাটকে নওয়াজের অভিনয় দেখে আনুরাগ কাশ্যপ ‘ব্ল্যাক ফ্রাইডে’-তে তাঁকে মোটামুটি একটা বড় রোল দিয়েছিলেন। সেখানে দুর্দান্ত অভিনয় করলেও অন্য কোনো পরিচালকের নজরে পড়লেন না। অবশেষে আবার এই আনুরাগ কাশ্যপই এলেন রক্ষাকর্তা হয়ে। বাস্তব ঘটনা অবলম্বনে নির্মিত তার গ্যাংস্টার ফিল্ম ‘গ্যাংস অব ওয়াসিপুর’-এ নওয়াজকে দিলেন লিড রোল।

গ্যাংস অব ওয়াসিপুরের একটি দৃশ্যে নওয়াজ; Source: Gonzo

গ্যাংস অব ওয়াসিপুরের বক্স অফিস সাফল্য ছিল বলিউডে মুক্তধারার চলচ্চিত্রের জন্য একটি বিজয় নিশান। সেইসাথে বিজয় নিশান উড়ল আরেকজন যোদ্ধার। বলিউডের মূলধারায় আসার জন্য নওয়াজুদ্দিনের এক যুগের সংগ্রাম ও অপেক্ষা শেষ হল।

গ্যাংস অব ওয়াসিপুরের পর নওয়াজুদ্দিন বলিউডের অজস্র মুক্তধারার চলচ্চিত্রে প্রধান প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেছেন। বলতে গেলে এখন মুক্তধারার চলচ্চিত্রে যেকোনো পরিচালকেরই প্রধান টার্গেট থাকে নওয়াজুদ্দিন। মুক্তধারার চলচ্চিত্র বাদে প্রচুর বাণিজ্যিক ছবিতেও অভিনয় করেছেন। যেখানে যে চরিত্রেই অভিনয় করুন না কেন, সেখানেই সহশিল্পীদের প্রশংসা কুড়িয়েছেন। কুড়িয়েছেন ভক্তদের ভালোবাসা।

বাণিজ্যিক ছবিতে অভিনয় প্রসঙ্গে নওয়াজুদ্দিনকে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেছিলেন, তাদের গ্রাম থেকে সবচেয়ে কাছের সিনেমা হলটিও ৪০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। তিনি যেসব ছোটখাটো ইন্ডি ফিল্মে কাজ করতেন দেখা যেত ওগুলো সে হলে মুক্তিই পেতো না। মুক্তি পেলেও গ্রামের লোকজন এসব সিনেমা দেখে মজা পেতো না। তাই গ্রামের লোকজনের কথা চিন্তা করেই প্রথম বাণিজ্যিক ছবিতে নাম লিখিয়েছিলেন। যাতে করে ৪০ কিলোমিটার হেঁটে শুধু তার চেহারা দেখতে সিনেমা হলে আসা লোকগুলো একটু আনন্দে সময় পার করতে পারে।

বাজরাঙ্গি ভাইজানে সালমান খানের সাথে নওয়াজ; Source: DNA India

এই গুণী অভিনেতা কয়েকদিন আগেই ৪৪ এ পা রাখলেন। এ বয়সেই তিনি তার অভিনয় প্রতিভা দিয়ে নিজেকে অনন্য এক উচ্চতায় নিয়ে এসেছেন। শাহরুখ খান, রনবীর কাপুরের মতো অনেক প্রথম সারির অভিনেতাই এখন এক বাক্যে তাকে বলিউডের সেরা অভিনেতা হিসেবে মেনে নেন। শুধু সহশিল্পীদের প্রশংসা আর ভক্তদের ভালোবাসাই না, দেশ-বিদেশ থেকে কুড়িয়েছেন প্রচুর সম্মাননাও। অভিনয়ে ইতোমধ্যে জাতীয় পুরস্কার পেয়েছেন, যা শাহরুখ খান, সালমান খানদের কাছেও এখনো অধরা রয়ে গেছে। এছাড়া এশিয়ান ফিল্ম অ্যাওয়ার্ডস, এশিয়া প্যাসিফিক ফিল্ম ফেস্টিভাল ও এশিয়া প্যাসিফিক স্ক্রিন অ্যাওয়ার্ডের মতো মর্যাদাপূর্ণ চলচ্চিত্র আসর থেকেও ঘরে তুলেছেন সেরা অভিনেতার পুরষ্কার। কান ফিল্ম ফেস্টিভালেও প্রতি বছর তার কোনো না কোনো ছবির স্ক্রিনিং থাকেই। এ বছর যেমন থাকছে প্রখ্যাত লেখক সাদাত হাসান মান্টোর জীবনী নিয়ে নন্দিতা দাশের নির্মিত চলচ্চিত্র ‘মান্টো’।

কিংবদন্তি লেখক সাদাত হোসেন মান্টো চরিত্রে নওয়াজ; Source: DNA India

নওয়াজুদ্দিনকে আমরা লাঞ্চবক্সে একজন প্রান্তিক অফিস সহকারী হিসেবে দেখছি, বাজরাঙ্গি ভাইজানে দেখছি একজন খাস-দিল সাংবাদিক হিসেবে। আবার গ্যাংস অব ওয়াসিপুরে দেখেছি একজন গ্যাংস্টার হিসেবে,  রামান রাঘব ২.০ ও বাদলাপুরের মত ছবিতে দেখেছি সিরিয়াল কিলারের চরিত্রে।  বিভিন্ন রেঞ্জের বহুমাত্রিক সব চরিত্রে অভিনয় করেছেন নওয়াজুদ্দিন। চরিত্র যেমনই হোক, অভিনয়ের সময় নওয়াজুদ্দিন চেষ্টা করেন প্রতিটি চরিত্রের ভিতরে প্রবেশ করতে। মেথড অ্যাক্টিং করতে গিয়ে প্রায় সময়ই সিনেমার চরিত্রকে এতটা আপন করে নেন যে নিজের মৌলিকত্ব হারিয়ে ফেলেন কিছুটা। সিনেমার চরিত্র ও ব্যক্তি নওয়াজের ট্রানজিশনটা তাই তার জন্য অনেক কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। প্রায়ই তাই সিনেমা শেষ করে চলে যান গ্রামের বাড়িতে। নিজের আসল সত্ত্বার দেখা পেতে।

শুধু প্রতিভা নয়, পরিশ্রম ও ত্যাগের দিক বিবেচনাতেও নওয়াজ অদ্বিতীয়। বলিউডে প্রতিষ্ঠিত এই অভিনয় সম্রাটের বহু বছরের সংগ্রামের ইতিহাস হয়তো মানুষ মনে রাখবে না। কিন্তু তার উপহার দেয়া অসাধারণ চরিত্রগুলোকে মানুষ চাইলেও ভুলতে পারবে না। সিনেমাজগতের অমূল্য সংযোজন হিসেবে থাকবে তার অভিনীত সিনেমাগুলো।

ফিচার ইমেজ- reacho.com

Related Articles