Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

বর্ণসংকর ‘অ্যাংলো ইন্ডিয়ান’দের ইতিকথা

সম্প্রতি অ্যাংলো ইন্ডিয়ান বা অ্যাংলো ভারতীয় শব্দগুচ্ছ ভারতে একটি বহুল আলোচিত বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। মোদী সরকার সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে লোকসভা ও ১৩টি রাজ্যের বিধানসভা থেকে অ্যাংলো ইন্ডিয়ানদের জন্য আসন সংরক্ষিত রাখার প্রথাকে বাতিল করছে চাইছে। পুরো ভারত জুড়ে তাই শুরু হয়েছে অ্যাংলো ইন্ডিয়ানদের প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ। মোদী সরকার এখানে একটি চাল চেলেছে। তারা আইনসভার আসন সংরক্ষণের বিষয়টির সাথে তফসিলি জাতি, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী ও দলিতদের জন্য আসন সংরক্ষণের মেয়াদকাল আরো দশ বছর বাড়ানো। অনেকে এই সংশোধনীকে যুগোপযোগী বলে দেখছেন, অনেকে বলছেন এখনও সময় আসেনি অ্যাংলো ইন্ডিয়ানদের আসন সংরক্ষণকে বাদ দেওয়ার। বিরোধীদল কংগ্রেস আপত্তি করা সত্ত্বেও সংশোধনীর পক্ষেই ভোট দিয়েছে।

সে যাই হোক। যেকোনো ঔপনিবেশিক দেশেই এমন কিছু জনগোষ্ঠীর উৎপত্তি হয় যাদের শরীরে বয় শাসক ও শাসিত উভয়ের রক্ত। মুঘল আমল, সুলতানি আমলেও এমনটি ঘটেছে। ব্রিটিশরাও তৈরি করেছিল সেরকমই একটি গোষ্ঠী যাদের পরে ডাকা হতো অ্যাংলো ইন্ডিয়ান নামে।

অ্যাংলো ইন্ডিয়ান শব্দটি কিন্তু অনেক পুরোনো। সপ্তদশ– অষ্টাদশ শতাব্দী থেকেই শব্দটির চল ছিল ইংরেজ মুলুকে, ইংরেজি সাহিত্যে। সে সময় যেসব ইংরেজ জাহাজে চেপে ভাগ্যান্বেষণে বা ব্যবসায়িক কাজে ভারতে আসে তারা যখন ভাগ্য উদ্ধার করে নিজ দেশে ফিরতে থাকে তাদের ডাকা হত ‘ইস্ট ইন্ডিয়ান’ বা ‘অ্যাংলো ইন্ডিয়ান’ নামে। এদের অনেকেরই আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হয়। মোটা অঙ্কের টাকার মালিক বনে যাওয়া এসব ইংরেজদের সম্বোধন করা হত ‘নবাব’ বলে।

ইংল্যান্ডের মতো পুজিঁবাদী দেশে পার্লামেন্টে পুঁজিপতিদের প্রভাব থাকবে না তা কি হয়? ভারতফেরত কোম্পানির এসব ধনী অংশীদাররা পার্লামেন্টে শক্তিশালী লবি গড়ে তোলে।

এ তো গেল ওয়ারেন হেস্টিংসের আমলের অ্যাংলো ইন্ডিয়ানদের কথা। এ যুগের অ্যাংলো ইন্ডিয়ানরা কিন্তু ভারতফেরত কোম্পানির কর্মচারী নয়। এরা ব্রিটিশ পিতা এবং ভারতীয় মাতার সংকর সন্তান। অষ্টাদশ শতক এর মাঝামাঝি থেকে উনবিংশ শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত সামরিক-বেসামরিক উভয় প্রকার চাকরিতেই ব্রিটেন থেকে কয়েক হাজার শ্বেত চর্মধারীর আগমন ঘটে ভারতে।

উপমহাদেশে ব্রিটিশদের অধিকৃত এলাকা বাড়ার সাথে সাথে নিত্য নতুন সার্ভিসের সূচনা করতে থাকে ব্রিটিশ সরকার। অ্যাডমিনিস্ট্রেশন সার্ভিস, রেলওয়ে সার্ভিস, ফরেস্ট সার্ভিস, পুলিশ সার্ভিস, পোস্টাল সার্ভিস ইত্যাদি। বিংশ শতক পর্যন্তও এসব চাকরির প্রথম শ্রেণির পদগুলোতে নিয়োগ পেত ব্রিটিশরা। ব্রিটিশ কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের অনেকে এদেশেই বিয়ে করে স্থায়ীভাবে বসবাস করা শুরু করে।

একটি অ্যাংলো ইন্ডিয়ান পরিবার; Image Source : mansfield.ox
একটি অ্যাংলো ইন্ডিয়ান পরিবার; Image Source : mansfield.ox

একসময় ব্রিটিশ অফিসারদের ভারতীয় নারীদের বিয়ে করার ব্যাপারে উৎসাহ দেওয়া হতো। বিয়ের পর পদোন্নতিসহ অন্যান্য সুযোগ সুবিধা প্রদানের মাধ্যমে পুরষ্কৃত করা হতো। রানী ভিক্টোরিয়াকে তার উপদেষ্টাগণ ভারতে ব্রিটিশ-ইন্ডিয়ান সংকর গোষ্ঠী তৈরীর প্রশ্রয় দেওয়ার ব্যাপারে পরামর্শ দিতেন। তারা ভাবতেন এমন একটি গোষ্ঠী যাদের শরীরে বইবে ব্রিটিশ পিতার রক্ত এবং যারা ভারতভূমি ও ভারতীয় সংস্কৃতির ব্যাপারে হবে যথেষ্ট ওয়াকিবহাল। যারা ব্রিটিশ শাসনের ভিত মজবুত করবে নিঃসন্দেহে। সিপাহী বিদ্রোহের সময় এরা বাবার দেশের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করে তার প্রমাণও দিয়েছিল।

গোড়াতে এদের ডাকা হতো ‘ইউরেশিয়ান’ বলে। এশিয়ান মা ও ইউরোপীয় পিতার সংমিশ্রণজাত তাই ইউরেশিয়ান। বিশ শতকের প্রথম দশকের আগ পর্যন্ত যতগুলো আদমশুমারি হয়েছে সেখানে এদের ইউরেশিয়ান হিসেবেই অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। অবশ্য, তখন ইউরোপীয় বা মধ্য এশীয় অনেক দেশের নাগরিককেই ‘ইউরেশিয়ান’ বলে বোঝানো হত।

১৯১১ সালে হওয়া আদমশুমারিতে সরকারিভাবে প্রথম অ্যাংলো ইন্ডিয়ান পরিচয়কে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ১৯১১ এর আদমশুমারি অনুসারে ভারতীয় মাতা এবং ব্রিটিশ পিতার সন্তান অথবা যেকোনো অবস্থায় বাংলায় বসবাসরত সমস্ত ইউরোপীয়দের অ্যাংলো ইন্ডিয়ান বলে অন্তর্ভুক্ত করার পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়। বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকের শেষের দিকে অ্যাংলো ইন্ডিয়ানদের সংখ্যা ছিল মোটামুটি হাজার পঁচিশেক। কিন্তু ১৯১৯ এর ভারত শাসন আইন প্রণয়ণের সময় ২৫০ সদস্যের আইনসভায় তাদের সংখ্যা ছিল ২৫! ১৯১৯ এর ভারত শাসন আইনের ব্যর্থতা থেকে জন্ম নেয় ১৯৩৫ এর ভারত শাসন আইন। এ আইনে, অ্যাংলো ইন্ডিয়ানদের জন্য আইনসভায় ৪টি আসন সংরক্ষিত করা হয়। 

অভিনেতা জর্জ বেকার, যিনি অ্যাংলো ইন্ডিয়ান কোটায় লোকসভার সদস্য হয়েছিলেন; Image Source : indianexpress.com
অভিনেতা জর্জ বেকার, যিনি অ্যাংলো ইন্ডিয়ান কোটায় লোকসভার সদস্য হয়েছিলেন; Image Source: indianexpress.com

বর্ণসংকর এই জনগোষ্ঠী একদম ইংরেজি কায়দা কানুনে বেড়ে উঠলেও ইংল্যান্ডে তাদের সাথে বৈষম্য করা হয়। ইংরেজ ধাঁচে ইংরেজি বলার ক্ষমতা থাকলেও তাদের খোদ ইংরেজভূমিতে অবমূল্যায়ন করা হতো দূষিত রক্ত বলে। তখন তারা আবার মাতৃভূমি ভারতে ফিরে আসে। ভারতে তারা কর্মসংস্থানের চেষ্টা করে। সফলও হয়। তৎকালীন ব্রিটিশ শাসকেরা রেলওয়ে সার্ভিস, স্টিমার সার্ভিস, পোস্টাল সার্ভিসের মতো কয়েকটি জায়গায় অ্যাংলো ইন্ডিয়ানদের একচেটিয়া নিয়োগ দেয়। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে তারা এ ক্ষেত্রগুলোতে সেবা দিয়ে যায়। অনেকে পাটের ব্যবসা শুরু করে। কেউ কেউ ঘোড়দৌড়ের জকিও হয়। মেয়েরা অফিস সহকারী, শিক্ষকতার মতো পেশায় যুক্ত হয়।

১৮৯৬ এ অ্যাংলো ইন্ডিয়ানদের হাতে গড়ে ওঠে কলকাতা রেঞ্জার্স ক্লাব। মার্জিত, শৌখিন, শিক্ষিত অ্যাংলো ইন্ডিয়ানদের পদচারণায় মুখরিত হতে থাকে ক্লাবটি। ভারতীয় ও ব্রিটিশ দুটো সংস্কৃতির মিলনে সৃষ্টি হয় অ্যাংলো ইন্ডিয়ান কালচার। খানা-খাদ্য থেকে পায়ের জুতো, মাথার টুপি থেকে রান্নাবাড়া সবখানেই দুই দেশীয় সংস্কৃতির মেলবন্ধন দেখা যায়। আরেকটি বিষয় এখানে লক্ষ্য করার মতো। সেটা হচ্ছে, দক্ষিণ ভারতীয় অ্যাংলো ভারতীয় রেসিপির সাথে আবার পূর্ব ভারতীয় অ্যাংলো ভারতীয় রেসিপির বিস্তর ফারাক দেখা যায়।

অ্যাংলো ইন্ডিয়ান চিকেন এক্সপ্রেস; Image Source : cookpad.com
অ্যাংলো ইন্ডিয়ান চিকেন এক্সপ্রেস; Image Source: cookpad.com

ঐতিহ্যগতভাবে মধ্য কলকাতার রিপন স্ট্রিট ছিল অ্যাংলো ইন্ডিয়ানদের বসতি। রিপন স্ট্রিটের ভাঙা, চটা দেয়ালের বাড়িগুলোতে তাদের পুরুষানুক্রমে বাস। আরেকটি জায়গায় অ্যাংলো ইন্ডিয়ান বসতির দেখা মিলবে। বো ব্যারাক বা বো স্ট্রিট। বর্তমান অ্যাংলো ইন্ডিয়ান সংস্কৃতির সবচেয়ে বড় পূণ্যভূমি। কলকাতার হেয়ার স্ট্রিট থেকে বউবাজার থানার মাঝামাঝি এর অবস্থান। রাস্তার দুপাশে লাল ইটের সুন্দরতম, প্রাসাদোপম অবকাঠামো চোখে পড়বে। প্রকাণ্ড লাল ইটের বাড়িগুলো প্রাচীনতার সাক্ষী। যেন লন্ডনের বো স্ট্রিটের ভারতীয় সংস্করণ।

বাড়িগুলো ইতিহাস থেকে জানা যায়, এগুলো মূলত তৈরি হয়েছিল প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্রিটিশ সৈনিকদের মেস হিসেবে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ধাক্কা কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই শুরু হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। তারপর দেশভাগ হয় এবং ইংরেজরা ভারত ছাড়ে। ইংরেজ সৈন্যদল চলে যাওয়ার পর বো ব্যারাক ফাঁকা হয়ে গেলে সেখানে এসে উঠে পড়ে অ্যাংলো ইন্ডিয়ানদের দল। বসতির কোনো আনুষ্ঠানিক দলিল না থাকা সত্ত্বেও মোটামুটি শ’দেড়েক পরিবার এখনও ঘাঁটি গেড়ে বসে আছে সেখানে।

কলকাতার বিখ্যাত বো ব্যারাকস; Image Source : times of india.
কলকাতার বিখ্যাত বো ব্যারাকস; Image Source : times of india.

জাতে খ্রিষ্টান হওয়ায় অ্যাংলো ভারতীয়দের প্রধান উৎসব বড়দিন। কলকাতার বো ব্যারাকসের বড়দিন পুরো দুনিয়া বিখ্যাত। সারা পৃথিবী থেকে অ্যাংলো ইন্ডিয়ানরা বড়দিনে বো ব্যারাকসে এসে ভিড় করে। উৎসব পরিণত হয় মিলনমেলায়। বো ব্যারাকসের অ্যাংলো ভারতীয়দের সংস্কৃতিচর্চা দেখে অনেকেই অজান্তে বলে ফেলেন ‘কলকাতায় ভেতর আরেকটি কলকাতা’।

বো ব্যারাকসের ক্রিসমাস; Image Source : pctures india
বো ব্যারাকসের ক্রিসমাস; Image Source : pictures india

অ্যাংলো ইন্ডিয়ান সম্প্রদায় কাল পরিক্রমায় একটি সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ে পরিণত হয়েছে। জরিপ বলে, পুরো পৃথিবীতে বর্তমানে ১০ থেকে ১৫ লাখের মতো অ্যাংলো ইন্ডিয়ান অবশিষ্ট রয়েছে। অ্যাংলো ইন্ডিয়ানদের বাস শুধু ভারতে বা যুক্তরাজ্যেই নয়, ভারত ছাড়াও কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, নিউজিল্যান্ড, মিয়ানমার, শ্রীলঙ্কা ও বাংলাদেশেও আছে। বিশুদ্ধ অ্যাংলো ইন্ডিয়ান রক্ত খুব কমই পাওয়া যাবে। স্বাধীনতা উত্তর ভারত হয় একটি বহুজাতিক রাষ্ট্র। ভারতীয় জাতিগত ধারণাই দিনদিন বড় হয়ে উঠতে থাকে। ফলে, অ্যাংলো ইন্ডিয়ান পরিবারের সাথে অনেক ভারতীয় পরিবার বৈবাহিক সূত্রে আবদ্ধ হওয়া শুরু করে। একই ঘটনা যুক্তরাজ্যসহ অন্যান্য দেশেও ঘটে। এভাবে দুটো জাতির মিশেলে তৈরি হওয়া বিশুদ্ধ অ্যাংলো ইন্ডিয়ান রক্ত বা সংস্কৃতি আরো বহুজাতিক হওয়া শুরু করে।

২০০৪-এ অঞ্জন দত্ত অ্যাংলো ইন্ডিয়ান জীবনাচরণ নিয়ে তৈরী করেন ‘বো ব্যারাকস ফরেভার' সিনেমা; Image Source : allmovie.com
২০০৪-এ অঞ্জন দত্ত অ্যাংলো ইন্ডিয়ান জীবনাচরণ নিয়ে তৈরি করেন ‘বো ব্যারাকস ফরেভার’ সিনেমা; Image Source: allmovie.com

অ্যাংলো ইন্ডিয়ানরা ভারতে সংখ্যালঘু হলেও তাদের প্রতি খুব বৈষম্যের ঘটনা দেখা যায় না। ভারতীয় বিমান বাহিনীতে এ পর্যন্ত মোট আটজন এয়ার ভাইস মার্শাল এসেছেন অ্যাংলো ইন্ডিয়ান পরিবার থেকে। এরকম একজন ছিলেন এয়ার মার্শাল ম্যালকম উলেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে তার অবদানকে বাঙালি আজীবন মনে রাখবে। সুপ্রীম কোর্ট অব পাকিস্তানের সাবেক প্রধান বিচারপতি ও বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধকালীন পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় আইনমন্ত্রী এলভিন রবার্ট কার্নেলিয়াস ছিলেন একজন অ্যাংলো ইন্ডিয়ান। কলকাতা পুলিশের সাবেক কমিশনার গৌতমমোহন চক্রবর্তী রনি, যিনি তার অসীম সাহসিকতার জন্য স্মরণীয় হয়ে আছেন, তিনি উঠে এসেছিলেন এক অ্যাংলো ইন্ডিয়ান পরিবার থেকে।

শুধু সামরিক বা আইনবিভাগীয় ক্ষেত্রেই নয় খেলাধুলা, শিল্প, সাহিত্যসহ অনেক ক্ষেত্রেই অ্যাংলো ইন্ডিয়ান পরিবার থেকে উঠে আসা অনেক সদস্য সৎভাবে অবদান রেখে গেছেন এবং চিরস্মরণীয় হয়ে রয়েছেন।

Related Articles