তার ছবিগুলো বুঝতে হলে চিত্র সমালোচক হতে হয় না। তিনি আঁকেন সাধারণ মানুষের জন্য। তার মিনিমালিস্ট চিত্রকর্মগুলো স্থান পায় বিশ্বের সেরা দৈনিকগুলোতে, ম্যাগাজিনে, এবং কখনো কখনো বেস্টসেলার লেখকদের বইয়ের প্রচ্ছদে। হাতে গোনা কয়েকটি দাগের মাধ্যমে চমৎকারভাবে তিনি ফুটিয়ে তোলেন তার বিষয়বস্তুকে, যেগুলোকে সমালোচকরা আখ্যায়িত করেন ‘ডিসিপটিভলি সিম্পল’ তথা প্রতারণামূলক সরল চিত্রকর্ম হিসেবে। তার চিত্রকর্মগুলো অধিকাংশ ক্ষেত্রেই হয়ে থাকে দ্ব্যর্থবোধক, কেবলমাত্র ভালোভাবে লক্ষ্য করলেই যেগুলোর প্রকৃত মর্ম বোঝা যায়।
বলছিলাম নোমা বারের কথা। নোমা বার একজন ইসরায়েলি চিত্রশিল্পী। তার জন্ম ১৯৭৩ সালে। জেরুজালেম অ্যাকাডেমি অফ আর্ট অ্যান্ড ডিজাইন থেকে তিনি ২০০০ সালে স্নাতক সম্পন্ন করেন। পরের বছর তিনি জীবিকার সন্ধানে ইসরায়েল ছেড়ে ইংল্যান্ডে পাড়ি জমান। ছোটবেলা থেকেই তার আঁকাআঁকির ঝোঁক ছিল, তাছাড়া তার পড়াশোনাও ছিল আর্ট নিয়ে। কিন্তু এছাড়াও যেহেতু তিনি হিব্রুর বাইরে অন্য কোনো ভাষা তেমন জানতেন না, তাই পেশা হিসেবে স্বাভাবিকভাবেই তিনি বেছে নিয়েছিলেন বিশ্বজনীন ভাষা চিত্রাঙ্কনকেই।
নোমা বারের দ্ব্যর্থবোধক চিত্রাঙ্কনের শুরুটা হয় সাদ্দাম হুসেনকে দিয়ে। নব্বইয়ের দশকের শুরুতে প্রথম উপসাগরীয় যুদ্ধের সময় সাদ্দাম হুসেনের ছবিই ছিল পত্র-পত্রিকায় সবচেয়ে বেশি প্রকাশিত। নোমা বার তখনও টিনেজার। তখনই একদিন পত্রিকার পাতা উল্টাতে গিয়ে তিনটি তীলক বিশিষ্ট রেডিয়েশনের প্রতীক দেখে হঠাৎ করে তার কাছে মনে হয়, সেটি দেখতে অনেকটাই সাদ্দাম হুসেনের মুখের মতো। এর দুটি তীলককে উপরের দিকে সমান্তরালে রাখলে তা সেগুলোকে সাদ্দামের ঘন ভ্রুর মতো এবং অবশিষ্ট তীলকটি নিচে অবস্থিত সাদ্দামের ঘন গোঁফের মতো মনে হয়।
নোমা বার রেডিয়েশনের চিহ্নটি নতুন করে আঁকেন এবং তার উপরে একটি সবুজ রংয়ের মিলিটারি হ্যাট আর নিচে একটি ইউনিফর্ম বসিয়ে দেন। মুখের জায়গাটি তখনও ফাঁকা, কিন্তু কারোই বুঝতে অসুবিধা হয় না যে এটি সাদ্দাম হুসেনেরই ছবি। এক দশক পরে তিনি যখন লন্ডনে যান, তখন আর্টিস্ট হিসেবে চাকরির খোঁজে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে তিনি সাদ্দাম হুসেনের এই ছবিটিকেই তার কাজের উদাহরণ হিসেবে জমা দেন। এই ছবি দেখিয়েই তিনি টাইম আউট লন্ডনে প্রথবারের মতো কাজ পেয়েছিলেন। এরপর তাকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি।
নোমা বার তার কাজের অংশ হিসেবে অনেক বিখ্যাত মানুষের ছবি এঁকেছেন। কিন্তু তার আঁকা ছবিতে তারা দেখতে কীরকম, তার চেয়ে বেশি প্রাধান্য পেয়েছে তাদের পেশা বা তাদের কর্মজীবনের বিশেষ অর্জনগুলো। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প তার টুইটার অ্যাকাউন্টের জন্য বেশ পরিচিত। ফলে নোমা বার টুইটারের লগোটি একটি মুখের অবয়বের উপর এমনভাবে স্থাপন করেন যে, তা হয়ে ওঠে ট্রাম্পের চুলের মতো। এবং মুখে কোনো চোখ, কান, নাক না থাকলেও কারো বুঝতে অসুবিধা হয় না, ছবিটি ট্রাম্পেরই। একইভাবে সাবেক উত্তর কোরীয় নেতা কিম জং ইলের ছবিতে তিনি দুই চোখের চশমার ফ্রেমের পরিবর্তে ব্যবহার করেন দুটি নিক্ষিপ্ত মিসাইল, আর তার ঠোঁটের স্থলে ব্যবহার করেন কোরিয়ার মানচিত্রের ছবি।
জোসেফ স্ট্যালিনের ছবি আঁকতে গিয়ে কমিউনিজমের প্রতীক হাতুড়ি এবং কাস্তেকে নোমা বার এমনভাবে স্থাপন করেন যে, উল্টানো কাস্তেটি হয়ে ওঠে স্ট্যালিনের গোঁফ, আর হাতুড়িটি হয়ে ওঠে তার নাক। নেলসন ম্যান্ডেলার চোখ, নাক, ঠোঁট সবকিছুর পরিবর্তে তিনি ব্যবহার করেন ভাঙা শিকলের টুকরোর ছবি। ওসামা বিন লাদেনের ছবিতে তার মাথার পাগড়ির স্থলে তিনি ব্যবহার করেন নীল আকাশের বুকে এক ফালি উল্টানো চাঁদ, দুই চোখের পরিবর্তে ব্যবহার করেন দুটি প্লেন, আর দাড়ির জায়গায় ব্যবহার করেন টুইন টাওয়ারের দুটি ভবন।
তবে শুধু রাজনৈতিক ব্যক্তিদের ছবিই না, নোমা বার অন্যান্য বিশ্ববিখ্যাত ব্যক্তিদের ছবিও এঁকেছেন। গীতিকার এবং সঙ্গীতশিল্পী বব ডিলানকে আঁকতে গিয়ে তিনি ব্যবহার করেছেন তিনি যন্ত্রাংশ। ববের চুলগুলোতে ব্যবহৃত হয়েছে মিউজিকের প্রতীক, চোখের সানগ্লাসের পরিবর্তে ব্যবহৃত হয়েছে গিটার, আর ঠোঁটের জায়গায় ব্যবহৃত হয়েছে হারমোনিকা। চিত্রতারকা হ্যারিসন ফোর্ডকে আঁকতে গিয়ে তিনি বেছে নিয়েছেন ইন্ডিয়ানা জোনস চলচ্চিত্রে ব্যবহৃত তার চাবুক এবং ছুরিটিকে। ছুরিটি ব্যবহৃত হয়েছে চোখ হিসেবে, আর পেঁচানো চাবুকটি ব্যবহৃত হয়েছে নাক এবং ঠোঁট হিসেবে।
তার আঁকা চিত্র পরিচালক স্টিভেন স্পিলবার্গের ছবিটি আরো দারুণ। সেখানে স্পিলবার্গের দাড়ির জায়গায় ব্যবহৃত হয়েছে তার জুরাসিক পার্ক চলচ্চিত্রের একটি ড্রাগন, আর দুই চোখের জায়গায় ব্যবহৃত হয়েছে সায়েন্স ফিকশন চলচ্চিত্র ই.টির উড়ন্ত সাইকেলের দুটি চাকা। তার আরেকটি মুগ্ধকর সৃষ্টি হচ্ছে পাল্প ফিকশন চলচ্চিত্রের পোস্টার। এখানে তিনি দুই প্রধান চরিত্রকে এমনভাবে এঁকেছেন যে, একজনের গোঁফ এবং ঠোঁট অন্যজনের চুল এবং চোখ হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে একই ছবিতে দুজনের চেহারাই ফুটিয়ে তুলেছে।
নোমা বার তার ছবির অনুপ্রেরণা খুঁজে পান প্রকৃতি থেকে। লন্ডনে তার বাড়ির সামনের বাগানে বসে তিনি ঘন্টার পর ঘন্টা স্কেচ করেন। কেবলমাত্র সন্তুষ্ট হওয়ার পরেই তিনি কম্পিউটারে ইলাস্ট্রেশন শুরু করেন। এছাড়াও তার নির্বাক চলচ্চিত্রও তার অনুপ্রেরণার অন্যতম উৎস। সেখানে কোনো কথা ছাড়াই যেভাবে অঙ্গভঙ্গি দ্বারা বিভিন্ন বার্তা ফুটিয়ে তোলা হয়, তা তাকে মুগ্ধ করে। আর সেজন্যই তার ছবিগুলোর সংগ্রহ নিয়ে প্রকাশিত বইয়ের প্রচ্ছদ হিসেবে তিনি ব্যবহার করেছেন নির্বাক চলচ্চিত্রের রাজা চার্লি চ্যাপলিনের একটি ছবি।
নোমা বারের চিত্রকর্মের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো তার নেগেটিভ স্পেসের ব্যবহার। নেগেটিভ স্পেস হচ্ছে চিত্রকর্মের সাবজেক্টের চারপাশে অবস্থিত শূন্যস্থান, যা মূলত আরেকটি সাবজেক্টকে নির্দেশ করে। উদাহরণ হিসেবে নোমা বারের দ্য বিগ স্কুইজ ছবিটির কথা বলা যেতে পারে। এই ছবিতে দেখা যায় একটি বড় হাত তার দুটি আঙ্গুল দিয়ে ইরাকের মানচিত্র ধরে রেখেছে। কিন্তু ধরতে গিয়ে তর্জনী এবং বৃদ্ধাঙ্গুলির মধ্যে যে ফাঁকাস্থানের সৃষ্টি হয়েছে, সেটাকেই শিল্পী রূপ দিয়েছেন তেলের ফোঁটা হিসেবে। ফলে ছবিটি হয়ে উঠেছে ইরাকের তেল শোষণ করে নেওয়ার এক প্রতীকী চিত্র।
নোমা বারের অধিকাংশ চিত্রকর্মই মূলত নেগেটিভ স্পেসের কৌশলী ব্যবহার। উপরে উল্লেখিত পাল্প ফিকশনসহ অনেকগুলো ছবিও মূলত নেগেটিভ স্পেসেরই উদাহরণ। তবে এ জাতীয় ছবির মধ্যে আরেকটি ছবি বিশেষভাবে উল্লেখ করা যায়। সেটি হলো প্রিন্সেস ডায়ানার দুর্ঘটনার ছবি। এই ছবিতে একপাশে একটি জুম লেন্স বিশিষ্ট ক্যামেরা স্থাপন করা হয়েছে। সেই ক্যামেরার পাশের খালি স্থানগুলোই তৈরি করেছে ডায়ানার মুখাবয়ব। সেটিকে পূর্ণতা দিয়েছে অন্য পাশে তার সোনালী চুল এবং চোখের জায়গায় ব্যবহৃত উল্টানো গাড়ি।
তবে নোমা বারের সবচেয়ে শক্তিশালী ছবিগুলোর মধ্য একটি সম্ভবত আবু গারিব কেলেঙ্কারির পর জর্জ বুশকে নিয়ে আঁকা তার ছবিটি। এই ছবিতে বৈদ্যুতিক তার দিয়ে তিনি অসাধারণ নৈপুণ্যের সাথে বুশের মুখাবয়ব ফুটিয়ে তুলেছেন। আর ভেতরে মুখে মুখোশ পরা, টুলের উপর দাঁড়ানো, দুই হাত প্রসারিত করে সেই তার দিয়ে ইলেক্ট্রিক শক খেয়ে নির্যাতিত হতে থাকা বন্দীর মাধ্যমে ফুটিয়ে তুলেছেন বুশের নাক, চোখ এবং মুখ। একটি ছবি যে হাজার শব্দের চেয়েও শক্তিশালী হতে পারে, এই ছবিটি তার অসংখ্য উদাহরণের একটি।
This article is in Bangla language. It's about the artworks of Noma Bar.
For references, please check the hyperlinks inside.
Featured Image: archief.fontanel.nl