Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

নুশু: চীনের এক গোপন ভাষালিপি

চীনের দক্ষিণ-পূর্ব দিকে হুনান প্রদেশ। পাহাড়ের চূড়া, সবুজের সমারোহ, উপচে পড়া নদীর উপত্যকা এবং অসংখ্য ধানক্ষেতে ঝুলে থাকা কুয়াশা- এক প্রাকৃতিক আর অলৌকিক সৌন্দর্য দিয়েছে এই প্রদেশকে। এই অঞ্চলের আশি ভাগই পাহাড়; এবং এসব পাহাড়ই অসংখ্য গ্রাম গড়ে তুলতে সাহায্য করেছে। এই নৈসর্গিক সৌন্দর্যের মধ্যে পাহাড়ের ঢালু উপত্যকার গা বেয়ে গ্রামের অন্তরালেই নুশুর জন্ম।

নুশু চীনের একটি লিখিত ভাষা। সম্ভবত বিশ্বের একমাত্র ভাষা, যা নারীদের দ্বারা, নারীদের জন্য এবং নারীদের মাধ্যমেই ব্যবহৃত ও নিয়ন্ত্রিত। তাই একে গোপন ভাষা বলেও অভিহিত করা হয়। কেননা, কেবলমাত্র নুশুতে দক্ষ একজন নারীই বুঝতে পারবে নুশুর অর্থ।

জ্যাংইয়াং গ্রামেই মূলত এই ভাষার প্রসার ঘটে। এছাড়া দাওসিয়ান এবং জ্যাংঘুয়া প্রদেশেও ভাষাটি ছড়িয়ে পড়ে। তবে এটি ঠিক তখনই এটি বিশ্বের নজরে আসে যখন তা বিলুপ্তির পথে। বিংশ শতাব্দীর প্রথমদিকে কিছু লিপি উদ্ধার করা হলেও ধারণা করা হয় প্রাচীনযুগ থেকেই গোপনে ব্যবহৃত হয়ে আসছে এই ভাষা। কিছু বিশেষজ্ঞের ধারণা, ভাষাটি নবম শতকের দিকে জন্মলাভ করে, যখন সং রাজবংশ (৯৬০-১২৭৯) চীনের শাসনে ছিল। 

চোখধাঁধানো পাহাড়ি সৌন্দর্যের দেখা মিলে চীনের হুনান প্রদেশে; Image Credit: lingqi xie/Getty Images

চিং রাজবংশের (১৬৪৪-১৯১১) এবং পরবর্তী সময়েই নুশু ভাষা এর সমৃদ্ধির সর্বোচ্চ চূড়ায় অবস্থান করেছিল। তবে এই ভাষার বহুল ব্যবহার শুরু হয় উনিশ শতকে হুনান প্রদেশের জ্যাংইয়াংয়ের মতো গ্রামগুলোতে। ওখানকার হান, ইয়াও এবং মিয়াও গোষ্ঠীর নারীরা একে স্বেচ্ছায় গ্রহণ করেছিল।

চীনের সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থায় নারীরা ছিল অবহেলিত। যেকোনো বিষয়েই তাদেরকে দমিয়ে রাখার একটা প্রবণতা ছিল। এমনকি বাড়ির সীমানা পার করারও অনুমতি দেয়া হতো না। শিক্ষাগত সুযোগ তো ছিল আকাশ-কুসুম কল্পনা। বাইরের বিশ্বের সঙ্গে নারীদের কোনো যোগাযোগই ছিল না। তাই তারা নিজেদের মধ্যে এই গোপন ভাষার মাধ্যমে মত বিনিময় এবং কথোকপথন চালিয়ে যাওয়ার রীতি চালু করে। 

নুশু ভাষা ব্যবহারের ক্ষেত্রে অন্যতম একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎস ছিল বিয়ে। সাধারণত চীনের রীতি অনুসারে, বিয়ের পর কনে পিতামাতার বাড়ি ছেড়ে বরের বাড়িতে চলে যায়। এই নতুন জীবনে নববধূর খানিকটা বিচ্ছিন্নতা বা একাকিত্ব অনুভব হয়। সুতরাং, দুঃখ প্রকাশ এবং বন্ধুত্ব গড়ে চাঙ্গাভাব আনার জন্য নুশুর তুলনা ছিল না।

নুশু ভাষালিপির বর্ণমালা; Image Credit: CPA Mediat Pte Ltd/Alamy

নববধূর এই চলে আসার প্রক্রিয়ায় আরেকটি জিনিস অন্তর্ভুক্ত ছিল। শেনঝাশু বা থার্ড-ডে বুক নামে কাপড়ের তৈরি একটি বাঁধাইকৃত বই নববধূকে দেয়া হতো বিয়ের তিন দিন পর। কনের মা, ভাই-বোন, ঘনিষ্ঠ আত্মীয়-স্বজন এবং বন্ধুবান্ধবরা তাদের দুঃখ এবং স্বজন দূরে যাবার অনুভূতিগুলো লিপিবদ্ধ করত সেই বইয়ে। একইসঙ্গে কনের ভবিষ্যতে সুখ-সমৃদ্ধির জন্যও প্রার্থনাবাণীও থাকতো। তবে এসবই বইয়ের শুরুর দিকের কয়েক পাতায় থাকতো। বাদবাকি পাতা খালি থাকতো কনের নিজের ডায়েরি হিসেবে ব্যবহারের জন্য। 

নুশু ব্যবহারকারী বেশিরভাগ নারীরাই নিরক্ষর ছিলেন। অক্ষরজ্ঞান সম্পর্কে জানার সুযোগ হয়নি তাদের। তাহলে তারা কী করে এই ভাষায় দক্ষ হয়ে উঠেছিল? ইংরেজিতে একটা প্রবাদবাক্য আছে, “Practise makes a man perfect” অর্থাৎ, চর্চাই মানুষকে দক্ষ করে তোলে। আর এই প্রবাদবাক্যের যথার্থ ব্যবহারই করেছিল নুশু ব্যবহারকারীগণ। তারা কেবল অন্ধবিশ্বাসের মতোই স্ক্রিপ্ট বা লিপি অনুলিপি করার অনুশীলন করতো। সময়ের আবর্তে তারাও একসময় এই ভাষায় দক্ষ হয়ে উঠত। এভাবেই যুগের পর যুগ ধরে ভাষাটি লুকিয়ে থেকেও স্বতন্ত্র এক নারী সংস্কৃতির জন্ম দেয়। 

শেনঝাশু বা থার্ড-ডে বুক; Image Credit: Xin Hu

নুশু আসলে একটি ধ্বনি নির্দেশক ভাষালিপি, যা ডান থেকে বামে পড়তে হয়। ধারালো বাঁশের কঞ্চি এবং রান্নার সময় পুড়ে যাওয়া ওক থেকে অস্থায়ী কালি সংগ্রহ করা হয়ে থাকে। এই বর্ণমালার বেশিরভাগ প্রতীকই চৈনিক ভাষার বর্ণমালা থেকে অনুপ্রাণিত। তবে এর অক্ষরশৈলী অনেক বেশি ঐতিহ্যগত, দীর্ঘায়িত আর বাঁকানো। সুতোর মতো চিকন রেখাগুলো তীর্যকভাবে নীচের দিকে নেমে আসে। আর এর সূক্ষ্ম রেখার কারণে একে মশার লিখন পদ্ধতি বলেও আখ্যায়িত করা হয়।

বাচ্চাদের ঘুমপাড়ানি থেকে জন্মদিনের গান, ব্যক্তিগত অনুশোচনা থেকে বিয়ের আসরের গান- এসবই তারা নুশুর বিভিন্ন বাগবৈশিষ্ট্য এবং অভিব্যক্তি থেকে ব্যক্ত করতো। আবার বয়স্ক নারীরা তাদের জীবনের দুঃখজনক অভিজ্ঞতা জানাতে আত্মজীবনীমূলক গান রচনা করতো। অথবা নৈতিকতা প্রচার করতে এবং অন্য নারীদেরকে সতীত্ব, ধর্মনিষ্ঠা এবং মর্যাদার মধ্য দিয়ে কী করে একজন ভালো স্ত্রী হওয়া যায় তা শেখানোর উদ্দেশ্যেই জীবনীমূলক গান রচনা করতো। 

দেখতে কেবলই কারুকার্যমণ্ডিত হাতপাখা মনে হলেও এতে নুশু ভাষায় লেখা আছে কোনো নারীর বক্তব্য। Image Credit: Xin Hu

যদিও বর্তমানে নুশু কেবলই নারীদের যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে বর্ণনা করা হয়, তবে প্রকৃতপক্ষে এটি ছিল তখনকার পিতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার বিরুদ্ধে নারীদের অবাধ বাকস্বাধীনতার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। ঐতিহাসিক সূত্রমতে, চীনা নারীদের ব্যক্তিগত জীবনের অনুশোচনা, কৃষি জীবনের কষ্ট, ব্যক্তিগত বেদনার উপলব্ধি, দুঃখ, চিন্তা-চেতনা এবং বিষাদের গল্প কখনোই সামাজিকভাবে গ্রহণযোগ্য ছিল না। নুশু সেখানে এক জগত উন্মোচন করে দিয়েছিল তাদের জন্য। নিজেদের মধ্যে বন্ধুত্ব এবং সমর্থনের একটা বন্ধন তৈরি করে দিয়েছিল।

উল্লেখযোগ্য ব্যাপার হলো, কয়েকশো অথবা হতে পারে হাজার বছর ধরে এই অব্যক্ত ভাষালিপি জ্যাংইয়াং প্রদেশের বাইরে অজানা ছিল। ১৯৮০ এর দশকের পর থেকেই মূলত এর চর্চার কথা বিশ্বব্যাপী প্রচার পায়। এই প্রাচীন ও সুরক্ষিত ভাষালিপিতে কথা বলা সর্বশেষ নারীর মৃত্যুর ১৭ বছর পর। 

পুওয়েইয়ের সেই নুশু যাদুঘর; Image Credit: Xin Hu

এই পুনরুজ্জীবনের কেন্দ্রবিন্দু হচ্ছে ছোট্ট এক গ্রাম, নাম পুওয়েই। গ্রামটি শাও নদী দ্বারা পরিবেষ্টিত এবং একমাত্র প্রবেশপথ হচ্ছে একটি সাসপেনশন ব্রীজ। পুওয়েইর বাসিন্দা শিন হুয়ের মতে, একসময় নুশু পুওয়েইর নিকটবর্তী চারটি জনপদ এবং প্রায় আঠারটি গ্রামের বহুল প্রচলিত এক ভাষা ছিল। ১৯৮০ এর দশকে ২০০ জনের গ্রামটিতে নুশু ভাষায় লিখতে পারে এমন তিনজন নারীকে খুঁজে পাওয়া গেলে পুওয়েই নুশু গবেষণার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়। 

২০০০ সালে পিওয়েইতে নুশু ভাষার বিদ্যালয় চালু করা হয়। ২০০৬ সালে ভাষালিপিটি চীনের স্টেট কাউন্সিলের তত্ত্বাবধানে ন্যাশনাল ইনট্যাঞ্জিবল কালচারাল হেরিটেজের তালিকাভুক্ত করা হয়। 

নুশু ভাষার একজন উত্তরাধিকারী শিন হু; Image Credit: Xin Hu

বর্তমানে নুশু ভাষালিপি সম্পর্কে যেটুকু তথ্যই পাওয়া যায়, তার একান্ত দাবীদার একজন পুরুষ গবেষক। তার নাম ঝৌও শুয়াইয়ি। নুশু সম্পর্কে তিনি জানতে পারেন তার এক আন্টির কাছে, যার বিয়ে হয়েছিল এমন এক পুরুষের সাথে যিনি নুশু ভাষার প্রচলন আছে তেমন এক গ্রাম থেকে এসেছিলেন। পঞ্চাশের দশকের শুরুতেই তিনি এই ব্যাপারে জানতে পারেন তার আন্টির কাছে। পরবর্তীতে ১৯৫৪ সালে; জ্যাংইয়াং কালচারাল ব্যুরোতে এই হারানো ভাষালিপি নিয়ে গবেষণা শুরু করেন। 

কিন্তু ষাটের দশক শুরু হতে না হতেই মাও সে তুংয়ের নেতৃত্বে সাংস্কৃতিক বিপ্লবের সূচনা হয়। বিপ্লবের অংশ হিসেবে চীনের বেশিরভাগ কমিউনিস্ট নেতাই দেশের সামন্ততান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার অতীত ইতিহাস মুছে দেয়ার পক্ষে জোর দেন। নুশুতে লেখা বই এবং চিঠি সংগ্রহ করে পুড়িয়ে দেয়া হয় এবং নিষিদ্ধ করা হয় গবেষণাকর্ম। তাই নুশুর মতো ভাষা নিয়ে গবেষণা তখন ছিল রাষ্ট্রদ্রোহিতার শামিল। এমনকি এজন্য ঝৌওকে শ্রমশিবিরে কাটাতে হয়েছিল টানা ২১ বছর। 

উপরন্তু, পঞ্চাশের দশক থেকে নারীরা আনুষ্ঠানিক শিক্ষা পেতে থাকলে হারিয়ে যেতে থাকে এই ঐতিহ্যবাহী ভাষালিপি। মুক্তি পাবার পর দেরি না করে ঝৌও নুশু ভাষাকে চৈনিক ভাষায় রূপান্তরের কাজে হাত দেন। ২০০৩ সালে, তার মৃত্যুর এক বছর পূর্বে, ঝৌও প্রথমবারের মতো নুশু অভিধান বের করেন। এমনকি এখন অবধি ঝৌওই হচ্ছে একমাত্র ব্যক্তি যিনি কিনা নারীদের এই ভাষালিপিতে দক্ষতা অর্জন করেছেন। 

নুশু ভাষার গবেষক ঝৌও শুয়াইয়ি; Image Credit: Frederic J Brown/Alamy

নুশুর সত্যিকারের নিদর্শনের অনেক কিছুই ধ্বংস হয়ে গেছে বিপ্লবের কারণে। তবে ইদানীং নুশুর প্রসার হচ্ছে সিনেমা, সঙ্গীত এবং সাহিত্যের মাধ্যমে। বছরের পর বছর ধরে হুনান প্রদেশে নৃতাত্ত্বিক গবেষণার পর ২০১৩ সালে অস্কার ও গ্র্যামি অ্যাওয়ার্ডস বিজেতা চীনা সুরকার, এবং ইউনেস্কোর শুভেচ্ছদূত প্রতিনিধি ত্যাং ডান, একটা মাল্টিমিডিয়া সিম্ফোনি তৈরি করেছেন নুশু: দ্য সিক্রেট সং অফ উইমেনস শিরোনামে। 

শিন হু নুশু ভাষায় দীক্ষা দিচ্ছেন; Image Source: Yin Yijun/Sixth Tone

নুশুর উপর ভিত্তি করে লেখা সাহিত্য হচ্ছে লিসা সীয়ের লেখা স্নো ফ্লাওয়ার অ্যান্ড দ্য সিক্রেট ফ্যান যা পরবর্তীতে সিনেমাতে রূপান্তরিত হয়েছে ২০১১ সালে। জ্যাংইয়াং প্রদেশের তরুণীরা বর্তমানে নুশু বিদ্যালয়ে নুশু ভাষালিপির উপর দীক্ষা নেয়াতে ব্যাপক আগ্রহী হয়ে উঠেছে। এমনকি করোনার দিনগুলোতে চীনের জনপ্রিয় সোশ্যাল অ্যাপ উইচ্যাটের মাধ্যমে অনলাইনেও ক্লাস নেয়া হয়েছে।

Related Articles