Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

ওতোমাৎসুরি: জাপানের ঐতিহ্যবাহী আগুন উৎসব

জাপানের ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতির একটি অংশ হচ্ছে আগুন উৎসব। জাপানের তিনটি বৃহত্তম আগুন উৎসবের অন্যতম এক উৎসবের নাম ‘ওতোমাৎসুরি’। ১,৪০০ বছরের পুরনো ওয়াকামায়ার এই আগুন উৎসব। জাপানীরা এই উৎসবকে খুবই পবিত্র মনে করে। সবুজ পাহাড়ে ঘেরা আর প্রশান্ত মহাসাগরের খুব কাছেই অবস্থিত জাপানের ‘কী’ উপদ্বীপের শিঙ্গু শহরের কুমানো নামক অঞ্চলে আয়োজিত হয় এই উৎসব।

অঞ্চলটি বিভিন্ন শিল্প ও মৎস্যজীবীদের মূল বাণিজ্যিক কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত। এখানেই রয়েছে জাপানের সবচেয়ে প্রাচীন কামিকুরা মঠ। আর এই মঠকে কেন্দ্র করে আয়োজিত হয় জাপানের ঐতিহ্যবাহী অনন্য এক উৎসব, জাপানী ভাষায় যাকে বলা হয় ‘ওতোমাৎসুরি’ বা আগুন উৎসব। মূলত দেবতাদের ‍উদ্দেশ্যে নিবেদিত হয় এই উৎসব। নতুন বছরকে স্বাগত জানানো এবং নিজেদেরকে শুদ্ধ করে নিতেই স্থানীয়রা প্রতি বছর ৬ ফেব্রুয়ারি প্রবল জাঁকজমকের সাথে পালন করে এই উৎসব।

প্রাচীন কামিকুরা মঠ; Source: jnto.go.jp

এই উৎসবের শুরুটা কীভাবে? সে সম্পর্কে তেমন যথাযথ তথ্য পাওয়া না গেলেও কুমানো অঞ্চলের কিছু প্রাচীন পুঁথি থেকে জানা যায়, ৫৭৪ খ্রিস্টাব্দের দিকে সম্রাট বিনতাৎসুর শাসন ক্ষমতা নেওয়ার তৃতীয় বছরে কামিকুরা পাহাড়ে অন্ধকার ভেদ করে আলোর রোশনাই দেখা যায়। এই তথ্যানুসারে অনুমান করা হয়, আনুমানিক ৫৭৫ খ্রিস্টাব্দের দিকে জাপানী লুনা ক্যালেন্ডার অনুযায়ী ৫ জানুয়ারি আর ইংরেজী ক্যালন্ডার অনুযায়ী ৬ ফেব্রুয়ারি কামিকুরা মঠে সর্বপ্রথম এই আগুন উৎসবের আয়োজন করা হয়।

আবার স্থানীয়দের প্রাচীন উপকথা অনুসারে, জাপানীরা তাদের সম্রাটকে দেবতা হিসেবে মান্যতা দিতো। জাপানের প্রথম সম্রাট জিমনু যখন পূর্বদিকের অঞ্চলগুলোর দিকে অভিযান শুরু করেন, সেসময় গ্রামবাসীরা মশাল জ্বালিয়ে সম্রাট ও তার বাহিনীকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যান যেন আগুনের প্রজ্জ্বলিত শিখায় দেবতাদের পথ করে দিচ্ছেন অনুরাগীরা। সেখান থেকেই এই আগুন উৎসবের প্রাথমিক ধারণা এসেছে বলে স্থানীয়রা মনে করে থাকেন।

জাপানর ঐতিহ্যবাহী আগুন উৎসব; Source: FAST JAPAN

প্রাচীনকাল থেকেই পাহাড়ের এই জায়গাটিকে পূজা করে আসছে এখানকার মানুষ। তাদের বিশ্বাস, স্থানটি ধর্মবিশ্বাসী মানুষদের কাছে বড়ই পবিত্র। কারণ, দেবতা বাস করেন এখানে। পাহাড়ের পfশ দিয়ে কুমানো নদীর নিরন্তর বয়ে চলা। সাড়ে চারশ’ ফুট উপর থেকে নেমে আসছে জলের ধারা।

জলস্রোতের গা ঘেঁষে রয়েছে নিস্তব্ধতায় মোড়া পর্বতমালা। পাহাড়ের এই রহস্যময় সৌন্দর্য থেকেই বোধহয় বহু আগে জাপানীরা পর্বতকে পূজো করতে শুরু করেছিল। আর তা থেকেই জন্ম নিয়েছিল এক নতুন ধর্মের, যার নাম শুগেন্দো। জাপানীদের বিশ্বাস, মানুষ মারা যাওয়ার পর তাদের আত্মা চলে যায় কুমানো রেঞ্জের এই পর্বতের চূড়ায়।

নাচি তাইসা মঠের পাশে রহস্যময় ঝর্ণা; Source: Japan Specialist

তিনটি পবিত্র জায়গা রয়েছে অঞ্চলটিতে- হঙ্গু তাইসা, হায়াতমা তাইসা আর নাচি তাইসা। এই জায়গাগুলোতে ঘন ঘন যাতায়াত করতেন অভিজাত ব্যক্তি, পুরোহিত আর সামুরাই যোদ্ধারা। এখানকার মানুষের বিশ্বাস, এখানে এলে তারা তাদের মৃত প্রিয়জনদের সাথে দেখা করতে পারবে। এই পবিত্র জায়গা দেখার জন্য দর্শনার্থীদের বিরাট লাইন পড়ে যায় প্রতি বছর।

হঙ্গু তাইসা, হায়াতমা তাইসা আর নাচি তাইসার অবস্থান; Source: meetup.com

কুমানোর অধিবাসীরা মনে করেন, আগুন তাদের জীবনের সমস্ত শক্তির উৎস। তাই তারা শ্বাস-প্রশ্বাসের সঙ্গে আগুন থেকে সমস্ত শক্তি আহরণ করে নিতে চান। আগুন থেকে তারা পান প্রেরণা, জীবন সংগ্রামে জয়ী হওয়ার তীব্র আকাঙ্ক্ষা। স্থানীয় প্রথা অনুসারে, প্রত্যেক পরিবারের প্রতিটি ছেলেকে বড় হওয়ার আগেই অন্তত একবার পাহাড়ের ওপর এই পবিত্র স্থান দেখতে যেতেই হবে। এখানে গিয়ে সে ফসলের দেবতা থেকে শুরু করে অন্যান্য দেবতাদের শ্রদ্ধা জানাবে।

নোবোরিকো অংশগ্রহণে পরিপূর্ণতা পায় আগুন উৎসব; Source: traveller.com.au

এজন্য এই আগুন উৎসবে যারা যোগদান করে তাদের বলা হয় ‘নোবোরিকো’ অর্থাৎ ‘পর্বতারোহী’, যাদের সংখ্যা থাকে দুই হাজারেরও অধিক। এই উৎসবে যোগদানের মধ্য দিয়ে তারা নিজেদেরকে শুদ্ধ করে নেন বলে তারা মনে করেন। উৎসবে নারীদের যোগদানে বাধা রয়েছে, যা জাপানের অন্যান্য ঐতিহ্যবাহী উৎসবেও দেখতে পাওয়া যায়। উৎসবে যোগদানকারীরা জাপানের ঐতিহ্যবাহী পোশাক পরিধান করেন, আর হাতে থাকে জ্বলন্ত আগুনের মশাল। এদের মধ্যে ১২টি থাকে বিশালাকারের মশাল, যার একেকটার ওজন প্রায় ৫০ কিলোগ্রাম। ১২ জন দেবতার উদ্দেশ্যে পুরোহিতরা এই ১২টি মশাল বহন করে নিয়ে যান।

১২ জন দেবতার উদ্দেশ্যে পুরোহিতরা ১২টি মশাল বহন করে নিয়ে যান; Source: zekkeijapan.com

এই আগুন উৎসবে যারা যোগদান করে তাদের পবিত্রতার জন্য খেতে দেওয়া হয় সাদা রঙের খাবার। যেমন- তফু (শিম দিয়ে তৈরি দই), স্থানীয় মাছের সসেজ, সাদা মিসো স্যুপ, সাদা ভাত এবং কামাবোকো (সিদ্ধ মাছের মণ্ড)। এগুলো দেন তাদের প্রতিবেশী ও আত্মীয়রা। খাবার সাদা হওয়ার কারণ হলো সাদা শুভ্রতা ও বিশুদ্ধতার প্রতীক।

আগুন উৎসবে যোগদানকারীদের খাবার; Source: en.mi-kumano.com

আহার শেষ করার পর নোবোরিকোগণ  নিজেদের পোশাক পরিবর্তন করে উৎসবের জন্য শ্বেত-শুভ্র পোশাক এবং খড়ের স্যান্ডেল পরিধান করেন। এরপর একধরনের মোটা দড়ি দিয়ে শরীরের ওপর থেকে কোমড় পর্যন্ত নিজেদের প্যাঁচাতে থাকেন তারা। প্রত্যেককে দেওয়া হয় একটি করে মশাল, আর সেসব মশালের গায়ে লেখা থাকে মশাল বহনকারীর নাম, বয়স সহ আরও নানারকম তথ্য। এছাড়া প্রত্যেকের হাতে থাকে নতুন বছরের চারটি ইচ্ছে সম্বলিত চিঠি।

নোবোরিকোদর উৎসবে অংশগ্রহণের পোশাক; Source: mi-kumano

মশাল নিয়ে যাওয়ার সময় চারপাশের লোকজন সিঁড়ির পাশে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে মশাল বাহকদের উৎসাহ দেয়। ক’দিন আগেও যে-জায়গাটা ছিল নিস্তব্ধতায় ঢাকা, কোলাহলবিহীন; সেখানে সেদিন যেন মানুষের চিৎকার আর উল্লাসের ধ্বনিতে কানপাতা দায়, চারদিকে থাকে ব্যস্ত কোলাহল। “আগুন জ্বালো, আগুন জ্বালো” এই প্রচণ্ড চিৎকার ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে, জ্বলে ওঠে দু’হাজার মশাল।

উৎসবে মেতে উঠা জাপানী জনগণ; Source: goodlucktripjapan.com

কামিকুরা পর্বতের পেছনে সূর্য মুখ লুকায়, তারপরেই আরম্ভ হয় উৎসবের আনুষ্ঠানিকতা। তারা আসুকা মঠ, কুমনো হাইতামা তাইসা এবং মৈশিন-জি মঠ প্রদক্ষিণ শেষে উপস্থিত হয় কামিকুরা পাহাড়ের পাদদেশে। এরপর পাহাড়ের পাদদেশ থেকে ৫৩৮ ধাপ পেরিয়ে পাহাড়ের উপরে রয়েছে ঐতিহ্যবাহী প্রাচীন কামিরাকুরা মঠ, যেখানে রয়েছে গোতোবিকি নামে বিরাট এক পাথর। পবিত্র মশাল নিয়ে উৎসবের চূড়ান্ত ধাপে ‘গোতোবিক’ নামের এই পাথরের সামনে সকলে এসে দাঁড়ায়। এই সময় তারা এত উত্তেজিত হয়ে পড়ে যে, প্রচণ্ড বেগে দোলাতে থাকেন তাদের হাতের মশালগুলি। এভাবে তারা শ্রদ্ধা জানায় তাদের আরাধ্য দেবতাকে। এই সময় পুড়িয়ে ফেলা হয় মশাল বহনকারীদের ইচ্ছে চিঠিগুলো।

উৎসব শেষ হয়ে যাওয়ার পর জ্বলন্ত মশাল হাতে দ্রুতবেগে খাড়াই বেয়ে সকলে নিচে নামতে থাকে। মশাল বহনকারী মিছিলটি এমনভাবে নিচে নামতে থাকে, তা দেখে কখনো মনে হয় কোনো ড্রাগনের মুখ থেকে আগুণের স্ফুলিঙ্গ বের হতে হতে পাহাড় দিয়ে নেমে আসছে, আবার কখনো বা মনে হয় যেন আগুনের নদীর স্রোত বয়ে চলেছে। পাহাড়ে বহু দূর অবধি ছড়িয়ে পড়ে এই রক্তাক্ত আভা। তৈরি হয় যেন এক রহস্যময় রূপকথার জগৎ।

মশাল বহনকারী মিছিল এমনভাবে নামতে থাকে মনে হয় যেন কোনো ড্রাগনের মুখ থেকে আগুনের স্ফুলিঙ্গ বের হচ্ছে; Source: japan-attractions.jp

এই উৎসব দেখার জন্য ছোট ছোট শিশুরা বাবার কাঁধে চেপে আসে, উৎসবের জোয়ারে যেন তারা কান্না করতেও ভুলে যায়। উৎসবের আবেদন তাদেরকেও মোহবিষ্ট করে রাখে।

এই আগুন উৎসবকে জাপানের লোকসংস্কৃতির এক অন্যতম অঙ্গ হিসেবে মনে করা হয়। ওয়ার্ল্ড হেরিটেজের মর্যাদা পাওয়া এই উৎসব শুধু স্থানীয়দের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই, প্রতি বছর দেশ-বিদেশের অসংখ্য পর্যটকও এই উৎসবে অংশ নিয়ে থাকেন।

ফিচার ইমেজ- kansai.gr.jp

Related Articles