উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে ইউরোপে ইমপ্রেশনিস্ট শিল্প আন্দোলন শুরু হয়। রোমান্টিক যুগে চিত্রকলার ক্ষেত্রে প্রকৃতির অভাবনীয় বিশালতা ও ব্যক্তিগত আধ্যাত্মিক অনুভূতি প্রাধান্য পেতো। এই যুগের শিল্পীরা সেই গণ্ডী থেকে বেরিয়ে এলেন। এতকাল রোমান্টিক শিল্পীরা তাদের ছবি আঁকায় প্রকৃতিকে একরকম আলৌকিক আবহে ভরিয়ে তুলতেন। ইমপ্রেশনিস্ট শিল্পীরা আলোর উপস্থিতি ও ছায়ার মিশ্রণ দেখে একেবারে মূল প্রকৃতির আসল ছবি তাদের আঁকায় ধরতে চাইলেন। এ যুগের শিল্পীদের মধ্যে ক্লদ মোদে, এডগার দেগা, পিয়েরে রেনোয়াঁ, পল সেজান উল্লেখযোগ্য।
শুরুতে এই আন্দোলন শিল্প-রসিকদের অবহেলা ছাড়া কিছুই অর্জন করতে পারেনি। এসব চিত্রের যথাযথ মর্যাদা বুঝতে তাদের অনেক দিন সময় লেগেছিলো। এরপর বিভিন্ন প্রতিভাবান শিল্পীর পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে পোস্ট-ইমপ্রেশনিস্ট আন্দোলনের সূচনা করেন। এই আন্দোলনের কারণে তখনকার চিত্রকলায় ইউরোপীয় অঙ্কনশৈলী ছাড়াও অন্য সংস্কৃতির আঙ্গিক সার্থকভাবে ব্যবহৃত হয়েছিলো। পল গগ্যাঁ ছিলেন এই ধারারই একজন সার্থক শিল্পী। এখন তার শিল্পের জন্য যত খ্যাতি, তার চেয়ে বেশি খ্যাতি শেষ জীবন সভ্য ইউরোপের বাইরে তাহিতি দ্বীপে কাটানোর জন্য।
পল গগ্যাঁ ১৮৪৮ সালের ৭ জুন ফ্রান্সের প্যারিসে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা ক্লোভিস গগ্যাঁ একজন সাংবাদিক ছিলেন। তার মা অ্যালিনা মারিয়া শ্যাজাল সেসময়ের উল্লেখযোগ্য সমাজতান্ত্রিক সংগঠক ও লেখিকা ফ্লোরা ত্রিস্তানের কন্যা ছিলেন। ১৮৫০ সালে পলের পিতা পরিবারসহ পেরু যাত্রার সময় মৃত্যুবরণ করেন। পেরুতে পল তার মাতৃবংশীয় আত্মীয়দের তত্ত্বাবধানে বেড়ে উঠতে থাকেন। ১৮৫৪ সালে পেরুতে রাজনৈতিক অস্থিরতা তীব্র হয়ে উঠলে পলের মা অ্যালিনা সন্তানসহ প্যারিসে চলে আসেন। শিশু পলকে তার দাদার কাছে রেখে তিনি প্যারিসে পোশাক তৈরির শ্রমিকের কাজ নেন। তিনি ১৮৬৭ সালের ৭ জুলাই মৃত্যুবরণ করেন।
ছোটবেলায় শিক্ষাজীবনে বেশ কয়েকটি বোর্ডিং স্কুলে পল গগ্যাঁ পড়াশোনা করেছেন। এরপর ফরাসি নৌবাহিনীতে যোগ দিয়ে সেখানে দুবছর নাবিকের জীবন কাটান। ১৮৭১ সালে তিনি প্যারিসে ফিরে এসে স্টক এক্সচেঞ্জে ব্রোকার হিসেবে নতুন কর্মজীবন শুরু করেন। ১৮৭৩ সালে ডেনমার্কের সোফিয়ে গ্যাদের সাথে গগ্যাঁর বিয়ে হয়। শেয়ার মার্কেটের ব্রোকার হিসেবে গগ্যাঁ প্রথম দিকে ১১ বছর সফল ব্যবসায়ী হিসেবে বেশ ভালোই উপার্জন করছিলেন, তবে ১৮৮২ সালে প্যারিস শেয়ার মার্কেটে দরপতনের কারণে এই ব্যবসা ত্যাগ করেন।
১৮৭৩ সাল থেকে গগ্যাঁ তার শিল্পী জীবন শুরু করেন। প্যারিসে তার বাসভবনের কাছাকাছি একটি ক্যাফেতে সেকালের অনেক ইমপ্রেশনিস্ট শিল্পী আড্ডায় মিলিত হতেন। এমনই এক আড্ডায় সেই ধারার অন্যতম শিল্পী ক্যামিলে পিসারোর সাথে তার বন্ধুত্ব হয়। মূলত পিসারোর উৎসাহেই গগ্যাঁ পুরোমাত্রায় চিত্রকরের জীবন বেছে নেন। ব্যবসা ছেড়ে দেবার পর ১৮৮১ ও ১৮৮২ সালে তার আঁকা ছবির প্রথম প্রদর্শনী হয়। সেসময়ের আঁকা ছবির মধ্যে ‘মার্কেট গার্ডেনস অব ভগিরাঁদ’ বিশেষ উল্লেখযোগ্য। মজার ঘটনা এই যে, এই ছবি সেসময়ে ভালোভাবে মূল্যায়িত হয়নি, আজ সেই ছবি কেনার জন্য ধনীরা নিলামে অবিশ্বাস্য দাম হাঁকেন।
ক্রমান্বয়ে তিনি অন্য ইমপ্রেশনিস্ট বা প্রতিচ্ছায়াবাদী শিল্পীদের সাথে এক হয়ে কাজ করতে থাকেন। ক্যামিলে পিসারো ছাড়াও অন্যতম ইমপ্রেশনিস্ট শিল্পী পল সেজান ছিলেন তার ব্যক্তিগত বন্ধু ও সমঝদর। মাঝে কাজের সন্ধানে ডেনমার্কের কোপেনহেগেনে গেলেও ব্যর্থ হয়ে ১৮৮৫ সালে গগ্যাঁ প্যারিসে ফিরে আসেন। এসময় তিনি ছবি আঁকায় তার নিজস্ব স্টাইল নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে থাকেন।
ক্যামিলে পিসারো তাকে জর্জেস সেরোয়াতের সাথে পরিচয় করিয়ে দেন। জর্জেস সেরোয়াত সেসময় পয়েন্টালিজম নামে এক ধরনের অভিনব স্টাইল নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছিলেন। গগ্যাঁর কিন্তু সেরোয়াতের স্টাইল একেবারে পছন্দ হয়নি! ক্রমান্বয়ে এককালের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ক্যামিলে পিসারোর সাথেও সম্পর্কে ভাঙন ধরলো। এছাড়া দারিদ্র্য তার জীবনে অনটন এনে দিয়েছিলো। ১৮৮৬ সালে তার আঁকা ছবির মধ্যে ‘লা বাঁর্গ্রেরে ব্রেতোনে’ উল্লেখযোগ্য।
১৮৮৯ সালে পল গগ্যাঁ ইউরোপের বাইরের লোকশিল্প আর জাপানী চিত্রকর্ম দ্বারা দারুণভাবে প্রভাবিত হন। এসময় তিনি নতুন এক ধরনের চিত্রকলা নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে থাকেন। এই স্টাইলে গাঢ় রং ও আঙ্গিকের ব্যবহার করে ইমপ্রেশনিস্ট আন্দোলনের ছবিগুলো থেকে ভিন্ন ধাঁচ ও আবেদনের ছবি আঁকেন। এসব ছবির মধ্যে ‘দ্য ইয়েলো ক্রাইস্ট’ ছবিটি বিশেষ উল্লেখযোগ্য। যিশু খ্রিস্টের ক্রুশবিদ্ধ হবার উপাখ্যান নিয়ে আগেও ছবি আঁকা হয়েছে, তবে এই ছবিটি রঙের এমন অভিনব ব্যবহার এখনও পৃথিবীর শিল্পরসিকদের মধ্যে এখনো এক বিস্ময়ের ব্যাপার।
১৮৯১ সালে নিজের আঁকা ছবির এক সফল প্রদর্শনীর পর গগ্যাঁ তাহিতি ভ্রমণের সিদ্ধান্ত নেন। বর্তমানে তাহিতি দ্বীপের অন্য নাম ফ্রেঞ্চ পলিনেশিয়া, যা প্রশাসনিকভাবে ফরাসি সাম্রাজ্যের অধীনে ছিলো। প্রদর্শনী ও ছবি বিক্রির অর্থ গগ্যাঁর ভ্রমণে সহায়ক হয়েছিলো। সেবছরের ১ এপ্রিল তিনি তাহিতির উদ্দেশ্যে সমুদ্রযাত্রা করেন। ইউরোপের যান্ত্রিক ও নির্মম সভ্যতা ছেড়ে সরল আদিবাসী অধ্যুষিত অঞ্চলের শান্তি অনুভব করা এ যাত্রার অন্যতম উদ্দেশ্য ছিলো।
তাহিতির পাপেতি অঞ্চলে তিনি তিন মাস অবস্থান করেন। সেখানকার ইউরোপীয় নিবাসগুলোতে না থেকে তিনি তাহিতির অধিবাসীদের কুঁড়েঘরের মতো ঘর বানিয়ে বসবাস করছিলেন। তাহিতির প্রকৃতি ও জনজীবনের দৃশ্য তাকে দারুণভাবে আকৃষ্ট করেছিলো। এখানে তার নিরীক্ষাধর্মী ছবি আঁকা অন্য ধাপে উত্তীর্ণ হয়। তার অনেকগুলো শ্রেষ্ঠ ছবির কয়েকটি এসময়ে আঁকা। এর মধ্যে ‘ভাঁনেনো তে তিয়েরে’, ‘মিডডে ন্যাপ’, ‘তাহিতিয়ান উইমেন অন দ্য বিচ’, ‘দ্য মুন অ্যান্ড দ্য আর্থ’, ‘ডিলাইটফুল ল্যান্ড’ ও ‘ফাতাতে তে মিতি’ উল্লেখযোগ্য।
১৮৯৩ সালের আগস্ট মাসে গগ্যাঁ পুনরায় ফ্রান্সে ফিরে আসেন। এখানে তিনি তাহিতিতে আঁকা কিছু ছবির প্রদর্শনী করেন। এতে তাৎক্ষণিকভাবে কিছুটা সফলতা আসে। তার ১১টি ছবি বেশ ভালো মূল্যে বিক্রি হয়েছিলো। তবে এই সফলতা সাময়িক ছিলো। তার বন্ধু বেশ কয়েকজন আর্ট ডিলার ধীরে ধীরে তার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে থাকেন। এছাড়া অন্যান্য প্রতিষ্ঠিত শিল্পীদের সাথেও বিভিন্ন কারণে তার দূরত্ব তৈরি হয়ে যায়। অন্যদিকে তাহিতি থেকে ফেরার পর তার বেশভূষা ও চলাফেরা তাহিতির স্থানীয় মানুষের মতো হয়ে গিয়েছিলো। ফরাসি রক্ষণশীল অভিজাত সমাজ তার এমন পরিবর্তন ভালো চোখে দেখেননি। অন্যদিকে, জীবনযাত্রার অনিশ্চয়তার কারণে তার স্ত্রী ও সন্তানদের সাথে পাকাপাকিভাবে সম্পর্কের ছেদ হয়ে যায়।
১৮৯৫ সালে পল গগ্যাঁ ফ্রান্স ও ইউরোপের সাথে সম্পর্ক একেবারে শেষ করে দিয়ে আবার তাহিতির উদ্দেশ্যে পাড়ি জমান। এখানে তিনি পূর্ণমাত্রায় ছবি আঁকায় মনোনিবেশ করেন। প্যারিসের মতো এখানেও তার অনেক বন্ধু ও শুভাকাঙ্ক্ষী ছিলেন। উল্লেখ্য, প্রথমবার তাহিতি ভ্রমণে এসে গগ্যাঁ মেরাহি মেতুয়া তেহামানা নামক এক স্থানীয় তাহিতিয়ান নারীকে বিয়ে করেন। গগ্যাঁ তার কয়েকখানি পোট্রেইটও এঁকেছিলেন। দ্বিতীয়বার তাহিতি এসে গগ্যাঁ যেসব কালজয়ী ছবি এঁকেছেন, তাঁর মধ্যে ‘হয়ার ডু উই কাম ফ্রম’, ‘টু তাহিতিয়ান উইমেন’, ‘ম্যাটার্নিটি’, ‘টু উইমেন’ গুরুত্বপূর্ণ।
পল গগ্যাঁ শুধু প্রতিভাবান চিত্রশিল্পীই ছিলেন না। তিনি একজন প্রতিভাবান কাঠখোদাই শিল্পীও ছিলেন। তবে একাজ তিনি খুব বেশি করেননি। তার ছবি আঁকা প্রথমত ইমপ্রেশনিস্ট শিল্পীদের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছিলো। তবে এই ধারায় তিনি বেশিদিন সন্তুষ্ট থাকতে পারেননি। এজন্য আঙ্গিক, রং ও আকার-আকৃতি নিয়ে নতুন নতুন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন। এই নিরীক্ষার অংশ হিসেবে ইউরোপের প্রথাগত পদ্ধতি থেকে বেরিয়ে এসে প্রাচ্য ও অন্যান্য সংস্কৃতির লোকশিল্পে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। যার ফলে আজকের শিল্পরসিক মানুষ পেয়েছে কালজয়ী সব ছবি।
কিন্তু পরিতাপের বিষয় এই যে, জীবদ্দশায় এই মহান চিত্রকর তার নিজের শিল্পের যথাযথ ও সম্মানজনক মূল্য পাননি। অভাব ও টাকাপয়সার টানাটানি মৃত্যু পর্যন্ত তার জীবন বিপর্যস্ত করে রেখেছিলো। আর আজ তার আঁকা একেকটি ছবি ইউরোপ ও আমেরিকার বিখ্যাত ও আর্ট গ্যালারি ও জাদুঘরে শোভা পায়। শিল্পী সমঝদর ধনীরা নিলামে তার ছবি অবিশ্বাস্য দামে কেনেন। ১৯০৩ সালের শুরুর দিকে পল গগ্যাঁ শারীরিকভাবে বেশ অসুস্থ হয়ে পড়েন। সেবছরের ৮ মে এই অমর শিল্পী তার কল্পনার স্বর্গ তাহিতিতেই মৃত্যুবরণ করেন।
This Bangla article is about Paul Gauguin. He was a French post-impressionist artist who created immortal artworks throughout his life.
References:
02. https://arthive.com/paulgauguin?fbclid=IwAR1vRP8joJ0YokU_9C3_nOOYV4Jk6e2FCLOT0AiMpAA5DVphvrUYO09miD0
03. https://www.theartstory.org/artist-gauguin-paul-life-and-legacy.htm