Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website. The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

ফিরে এসো চাকা: বিনয় মজুমদার-গায়ত্রীর অমীমাংসিত প্রেম

ষাটের দশকের কলকাতায় জোরেশোরেই চলছিলো কবিদের ‘আরও কবিতা পড়ুন’ আন্দোলন। হঠাৎই রাস্তায় বড় বড় মিছিল যায়, ব্যানারে-ফেস্টুনে লেখা থাকে- ‘আরও কবিতা পড়ুন’। সকল উত্তাল আড্ডায়, কফি হাউজে বিষয়বস্তু হয় রাজনীতি, নয় সাহিত্য। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোর সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে ছোকরারা কবিতা আওড়ায়, পাঠক আকৃষ্ট করে। তখন এক ছোকরা বলে,

আমি এখন যা লিখছি সে হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যপুস্তক। তার মানে ভবিষ্যতে আমার কবিতা ছাত্রছাত্রীরা পড়তে বাধ্য হবে। সেহেতু আমার এখন কোনো পাঠক না হলেও চলবে।

সে ছোকরার নাম বিনয় মজুমদার, ষাটের দশকের বাংলা সাহিত্যের এক অনন্য সাড়াজাগানিয়া কবি। কালজয়ী ধ্রুপদী কবিতায় যিনি লিখলেন,

একটি উজ্জ্বল মাছ একবার উড়ে
দৃশ্যত সুনীল কিন্তু প্রকৃত প্রস্তাবে স্বচ্ছ জলে
পুনরায় ডুবে গেলো — এই স্মিত দৃশ্য দেখে নিয়ে
বেদনার গাঢ় রসে আপক্ক রক্তিম হ’লো ফল ।

বিনয় মজুমদার যে তুখোড় মেধাবী ছিলেন, সে বিষয়ে হয়তো আমাদের মতো সাধারণ পাঠক হতে বিদগ্ধজন পর্যন্ত- কারোরই কোনো সন্দেহ নেই। ছাত্রজীবন হতে কবিতার ক্লাস- মেধার ছাপ রেখেছেন সবখানে। ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় রেকর্ড নম্বর প্রাপ্তি, এরপর শিবপুর কলেজ থেকে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট হলেন। বিদেশের বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিতের শিক্ষক হবার সুযোগ প্রত্যাখ্যান করে শুধু কবিতার আবেদনে রয়ে গেলেন কলকাতায়। কবিতার ময়দানেও শুরুতেই তাকে চিনতে বাধ্য হলো কলকাতার উন্নাসিক সাহিত্যসমাজ। তার ‘ফিরে এসো চাকা’ বাংলা কবিতার জগতে সৃষ্টি করল এক অদ্ভুত আলোড়ন।

‘ফিরে এসো চাকা’ বাংলা কবিতার জগতে সৃষ্টি করল এক অদ্ভুত আলোড়ন

এই বইয়ের সমালোচনাপত্রে শক্তি চট্টোপাধ্যায় লিখলেন- ‘‘বিনয় চাইলে যেকোন কিছু নিয়েই কবিতা লিখতে পারে। মল-মূত্র-গোবর নিয়েও পারে।’’ হাংরি আন্দোলনের জনক মলয় রায়চৌধুরীর মতে- ‘ফিরে এসো চাকা’ ছিল বাংলা কবিতার জগতে এক ক্যামব্রিয়ান বিষ্ফোরণ। ঐ কাব্যগ্রন্থের পাশে বাকি কবিদের কাজ ‘জেলো’ হয়ে যাচ্ছিল।

শুরুতে যা বলছিলাম, বিনয়ের মেধার বিষয়ে আসলে খুব একটা দ্বিমত নেই কারও। জীবনানন্দের পরে এইরকম বাঁকবদলের কবি আর আসেননি, এমনটাও ভাবা যায়। ঋত্বিক ঘটক তো বলেই দিয়েছেন, ‘‘আমি সাম্প্রতিককালের এক কবির সম্পর্কে আস্থা রাখি, যিনি কবিতার জন্য যথার্থ জন্মেছেন। আমার মনে হয় এ-কালে বাংলাদেশে এতোবড় শুভবুদ্ধিসম্পন্ন কবি আর জন্মাননি। তিনি বিনয় মজুমদার।’’

অথচ এই তুমুল মেধাবী কবিই তার জীবনের দুই-তৃতীয়াংশ সময় কাটিয়েছেনে অসহ্য মানসিক যন্ত্রণায়। একাধিকবার আত্মহত্যার চেষ্টা করেছেন, আটবারের বেশি তাকে ভর্তি করতে হয়েছে মানসিক হাসপাতালে, একত্রিশবার দিতে হয়েছিল ইলেকট্রিক শক! নিজেই ব্যঙ্গ করে বলতেন- ‘‘পশ্চিমবঙ্গের পাগলাগারদসমূহের পরিদর্শক আমি’’। প্রেম, বেদনা, বিজ্ঞান, যুক্তির মতো বিষয়বস্তু খুঁজে ফিরতেন যিনি, তিনি তার কবিতা ছাপিয়ে নিজেই বনে গেলেন এক আশ্চর্য আঁধার। প্রায় পুরোটা জীবন কাটালেন সিজোফ্রেনিয়ায়, কষ্টে, অযত্নে আর একা।

প্রায় পুরোটা জীবন কাটালেন সিজোফ্রেনিয়ায়, কষ্টে, অযত্নে আর একা; Image Source: jiyobangla.com

বিনয় মজুমদার কেন সিজোফ্রেনিক হলেন, কেন এভাবে নিঃশেষ হলেন- তার কারণ সম্পর্কে আমরা নিশ্চিত হতে পারি না। তবে এবার আমরা একটু অন্যদিকে যেতে চাই। বিনয় মজুমদার সাহিত্য সমাজে আলোচনায় আসলেন তার তৃতীয় বই ‘ফিরে এসো চাকা’র মধ্য দিয়ে। আসলে এটি তার দ্বিতীয় বই ‘গায়ত্রীকে’রই পরিবর্ধিত ও পরিশোধিত রূপ, সেক্ষেত্রে এটিকে তার দ্বিতীয় বইও বলা চলে। ‘গায়ত্রীকে’ নাম থেকেই বোঝা যায় কবিতাগুলো কাকে নিয়ে লেখা। এরপরও যখন ‘ফিরে এসো চাকা’ নামে সে বই পরিমার্জিত হয়ে বেরুলো, সেখানেও উৎসর্গ করেছেন গায়ত্রী চক্রবর্তীকে। প্রশ্ন আসে, কে এই গায়ত্রী চক্রবর্তী ? স্বাভাবিক জিজ্ঞাসার পর জানা যায়, তিনি হলেন পঞ্চাশের দশকের শেষের দিকে প্রেসিডেন্সি কলেজের এক উজ্জ্বল ছাত্রী গায়ত্রী চক্রবর্তী, পরবর্তী কালে যিনি গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাক নামে পরিচিতি পেয়েছেন। আধুনিক সময়ের একজন তাত্ত্বিক-ভাবুক হিসেবে যিনি খ্যাতি পেয়েছেন গোটা দুনিয়ায়।

কিন্তু বিনয়ের সঙ্গে তার কী সম্পর্ক? বস্তুত কোনো সম্পর্ক ছিলো কখনও। থাকার মতো কোনো প্রমাণ অন্তত নেই। বিনয়ের আসলে গায়ত্রীর সঙ্গে কখনও সেভাবে আলাপই হয়নি।

– গায়ত্রীকে কি তুমি ভালোবাসতে?

– আরে ধ্যুৎ, আমার সঙ্গে তিন-চারদিনের আলাপ, প্রেসিডেন্সি কলেজের নামকরা সুন্দরী ছাত্রী ছিলেন ইংরেজি সাহিত্যের, তারপর কোথায় চলে গেলেন, আমেরিকা না কোথায়, ঠিক জানি না।

– তাহলে ওকে নিয়ে কবিতা কেন?

– কাউকে নিয়ে তো লিখতে হয়— আমগাছ, কাঁটাগাছ, রজনীগন্ধা নিয়ে কি চিরদিন লেখা যায়!

কিন্তু এই বক্তব্য আবেগকে আড়াল করা এক ছলচাতুরি বলে মনে হয়। কৌশলি প্রেমিকের মতো প্রেম লুকানোর প্রবণতা মনে হয়। যেমনটি কবিতায় বলেছেন,

বিদেশী ভাষায় কথা বলার মতোন সাবধানে
তোমার প্রসঙ্গে আসি; অতীতের কীর্তি বাধা দেয়।

যাকে নিয়ে বিনয় লিখেছেন সাতাত্তরটি কবিতার গোটা এক বই, যার পরতে পরতে আছে বিচ্ছেদের যন্ত্রণার কথোপকথন, সে শুধুই কাঁটাগাছ-রজনীগন্ধা হবে- সে তো আর আমরা মানতে পারি না!

অবশ্য বিনয়ের এই বক্তব্যই তার একমাত্র নয়। ‘গ্রন্থি’ পত্রিকার এক সাক্ষাৎকারে বিনয় বলেছেন,

আরে আমি তো ছিলাম শিবপুর কলেজের ইঞ্জিনিয়ারিং এর ছাত্র। সেখান থেকে মেকানিক্যালে হলাম ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট। আর গায়ত্রী প্রেসিডেন্সি থেকে ইংরেজিতে ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট। যেই জানলাম- অমনি মনে হলো, এ মেয়েও তো আমার মতো ডুবে যাবে। কেননা এই রেজাল্টের পর আমারও তো পতন হয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে তাকে নিয়ে কবিতার বইটি লিখে ফেললাম।

অথচ গায়ত্রীর সঙ্গে বিনয়ের তখন ভাল করে পরিচয়ই হয়নি। কিন্তু তার জন্য তিনি উন্মাদনার সকল পারদ অতিক্রম করে ফেলেছেন, গায়ত্রীকে বানিয়েছেন ‘ঈশ্বরী’। গায়ত্রী চক্রবর্তীর সঙ্গে বিনয়ের সাক্ষাৎ মাত্র দিন দুয়েকই হয়েছিল, কফি হাউজে- তাও ছিল নেহাতই সৌজন্যমূলক। কিন্ত সেখান থেকে উন্মাদনায় পৌঁছানো, সে কি কেবলই কবিতার আকুতি, নাকি প্রাণের?

শমীক বন্দ্যোপাধ্যায়ের (যিনি গায়ত্রী চক্রবর্তীর সহপাঠীও ছিলেন) সঙ্গে এক কথোপকথনের সময় জানা যায়, একদিন গায়ত্রী কলেজে ক্লাস করছেন জেনে বিনয় প্রেসিডেন্সির ইংরেজি ডিপার্টমেন্টে এসে হাজির হলে, তার থেকে নিস্তার পেতে গায়ত্রী অন্য দরজা দিয়ে বেরিয়ে যান। এই সব ঘটনা যখন ঘটছে, বিনয়ের বয়স তখন আঠাশ। গায়ত্রী যেন তার অবসেশন হয়ে আছেন পুরোপুরি। একমাত্র কবিবন্ধু শক্তির কাছে বিনয় দুর্গাপুর থেকে জানতে চাইছেন গায়ত্রীর ঠিকানা, যার উত্তরে শক্তি লিখছেন, ‘‘গায়ত্রীর ঠিকানা আমি সুনীলের ভরসায় না থেকে জোগাড়ের চেষ্টা করছি এবং করে ফেলবোই। এক সপ্তাহের মধ্যে কথা দিচ্ছি তুমি ওর ঠিকানা পাবে। কেয়া বলে মেয়েটির খোঁজে আছি। তার সঙ্গে আমার পরিচয়ও আছে, দেখা হলেই চেয়ে নেব।’’

আরেকটি চিঠিতে শক্তি লিখছেন, ‘‘দুদিন কেয়ার সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম, দেখা হয়নি। তবে আগামী সপ্তাহে দেখা করে ঠিকানা জোগাড় করব, তুমি সুনীলকে ও বিষয়ে কিছু লিখো না।’’ অর্থাৎ বিনয় বোধহয় সুনীলকেও লিখেছিলেন এবং সুনীল বিরক্তই হয়েছিলেন, যার জন্য শক্তির এই সতর্কবার্তা। আরও অনেককেই বিনয় লিখেছিলেন। সলিল চক্রবর্তী বলে গায়ত্রীর দূর সম্পর্কীয় এক আত্মীয় থাকতেন ধানবাদ। তিনি লিখছেন, ‘‘ওর ঠিকানা জানি না, তবে শুনেছি আমেরিকা গেছে। কিন্তু আমার জিজ্ঞাস্য হল গায়ত্রীকে আপনার কী প্রয়োজন? ওকে কি আপনি ভালোবেসে ফেলেছেন? আমি বলব ওর সম্বন্ধে আপনার কৌতূহল না থাকাই ভালো।’’

গায়ত্রীর সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে বারবার বক্তব্য পাল্টেছেন বিনয় মজুমদার। একবার এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন- গায়ত্রীকে দেখে, তার মেধার কথা শুনে বিনয়ের হুট করে মনে হয়েছিল- তার কবিতা বোঝার মতো বিবেচনা, মেধা হয়তো এই মেয়েটারই আছে। তাই তিনি তাকেই বানিয়ে ফেলেছিলেন তার কবিতার কেন্দ্রবিন্দু। পরে তার কবিতার ঈশ্বরী তাকে ছেড়ে চলে যাওয়ায় হতাশ হয়ে পড়েছিলেন।

এছাড়াও বিভিন্নবার লুকোতে চেষ্টা করেছেন, অসংলগ্ন কথা বলেছেন, বিভ্রান্তিকর তথ্য দিয়েছেন। তার বিভ্রান্তির তথ্য ধরেই আরও এক গায়ত্রীর সন্ধান পাওয়া যায়। বিনয় কিছু দিন হিন্দু হোস্টেলের আবাসিক ছিলেন। তখন সেখানে সুপারিনটেনডেন্ট ছিলেন অধ্যাপক জনার্দন চক্রবর্তী। তার কন্যার নামও গায়ত্রী, যদিও বয়সে সে বেশ খানিকটা ছোট। যে সময়টায় বিনয় হিন্দু হোস্টেলে থাকছেন, তখন সেই তরুণীর বয়স চৌদ্দ-পনেরো হবে। সেই গায়ত্রীকে নিয়েও গল্প ফেঁদেছিলেন বিনয়। পরে জানা যায় এর সবটাই ভাঁওতা। তবে বক্তব্যে লুকালেও কবিতায় ঠিকই বলেছেন-

আমরা দুজনে মিলে জিতে গেছি বহুদিন হলো।
তোমার গায়ের রঙ এখনো আগের মতো, তবে
তুমি আর হিন্দু নেই, খৃষ্টান হয়েছো।
তুমি আর আমি কিন্তু দুজনেই বুড়ো হয়ে গেছি।
আমার মাথার চুল যেরকম ছোটো করে ছেঁটেছি এখন
তোমার মাথার চুলও সেইরূপ ছোটো করে ছাঁটা,
ছবিতে দেখেছি আমি দৈনিক পত্রিকাতেই; যখন দুজনে
যুবতী ও যুবক ছিলাম
তখন কি জানতাম বুড়ো হয়ে যাব?
আশা করি বর্তমানে তোমার সন্তান নাতি ইত্যাদি হয়েছে।
আমার ঠিকানা আছে তোমার বাড়িতে,
তোমার ঠিকানা আছে আমার বাড়িতে,
চিঠি লিখব না।

আমরা একত্রে আছি বইয়ের পাতায়।

গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাক; Image Source: Scholar Pics

গায়ত্রীকে যে বিনয় ভালোবেসেছিলেন সে বিষয়ে সন্দেহের কোনো অবকাশ থাকে না। কিন্তু এই ভালোবাসার পুরোটাই ছিল একপাক্ষিক। তার এই ভালোবাসার কথা গায়ত্রী হয়তো জানতেও পারেননি। তবে বিনয় এই না জানানোর বেদনায় জ্বলে পুড়ে গেছেন সারাজীবন। গায়ত্রীর বিয়ের বছরের সঙ্গে বিনয়ের জীবনের দুটি ঘটনার বিস্ময়করভাবে মিল লক্ষ্য করা যায়। প্রথমত, সে বছরই বিনয় তার ‘ফিরে এসো চাকা’ রচনা শুরু করেন আর দ্বিতীয়ত, কোনো বন্ধুর মাধ্যমে গায়ত্রীর বিয়ের খবর শোনার পর এক বিহ্বল দশায় প্রবেশ করেন, মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েন। বইটি লেখার মাঝেই বিনয় প্রথমবারের জন্য মানসিক রোগে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন। তার ছয় মাস পরে সুস্থ হয়ে ফিরে এসে তিনি বইটি রচনা সমাপ্ত করলেন, নাম দিলেন ‘ফিরে এসো চাকা’৷ এই ‘চাকা’ মানেই হয়তো চক্রবর্তী। গায়ত্রী চক্রবর্তীকে কবিতায় বারবার ফিরে আসতে বলছেন বিনয়৷ লিখেছেন,

বেশ কিছুকাল হলো চ’লে গেছো, প্লাবনের মতো
একবার এসো ফের; চতুর্দিকে সরস পাতার
মাঝে থাকা শিরীষের বিশুষ্ক ফলের মতো আমি
জীবন যাপন করি; কদাচিৎ কখনো পুরানো
দেওয়ালে তাকালে বহু বিশৃঙ্খল রেখা থেকে কোনো
মানসির আকৃতির মতো তুমি দেখা দিয়েছিলে।
পালিত পায়রাদের হাঁটা, ওড়া, কুজনের মতো
তোমাকে বেসেছি ভালো; তুমি পুনরায় চ’লে গেছো।

গায়ত্রীর প্রেমে, বিচ্ছেদে জ্বলেপুড়ে ছারখার হয়ে গেছেন। বিনয়কে উদ্দেশ্য করে জয় গোস্বামী তার ‘হাসপাতালে’ কবিতায় লিখেছেন- ‘‘স্বপ্নে স্বপ্নে পুরো একটা মানুষ পুড়ে খাক।’’

হয়তো প্রেম প্রকাশে ভীরু ছিলেন বিনয়। হয়তো ইংরেজি কনভেন্টে পড়া, আধুনিক, স্মার্ট গায়ত্রীর প্রত্যাখ্যানের ভয়ে দ্বিধায় পড়েছেন বারবার। হয়তো যখন সাহস সঞ্চয় করলেন তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। আবার হয়তো গায়ত্রীকেই কবিতার প্রেরণা, কবিতার একাগ্র পাঠক হিসেবে কল্পনা করে নিয়েছিলেন বিনয়। সেই পাঠক তাকে সমাদর না করেই চলে গেল, কবিতা নিয়ে গায়ত্রীর সঙ্গে কিছু আড্ডা দেয়া গেল না, সে তিনি আর মেনে নিতে পারলেন না। আর সেই যন্ত্রণা থেকেই অব্যক্ত এই প্রেমকে পুঁজি করে দৈনন্দিন নিঃসঙ্গতাটিকে ক্রমেই সমৃদ্ধ করেছেন। কবিতায় বলেছেন,

আমরা যে জ্যোৎস্নাকে এত ভালোবাসি- এই গাঢ় রুপকথা
চাঁদ নিজে জানে না তো; না জানুক শুভ্র ক্লেশ
তবু অসময়ে তোমার নিকট আসি
সমাদর নেই তবু আসি

সেই যন্ত্রণা থেকেই অব্যক্ত এই প্রেমকে পুঁজি করে দৈনন্দিন নিঃসঙ্গতাটিকে ক্রমেই সমৃদ্ধ করেছেন; Image Source: Bangla Tribune

গায়ত্রীর প্রেমে পড়ে বিনয় আমাদেরকে দিয়েছেন অসাধারণ সব কবিতা। কিন্তু তার বিচ্ছেদে ব্যক্তি বিনয় যে একবার পড়ে গেলেন, তারপরে সেভাবে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারলেন কই! পরবর্তী জীবন তো পাগল আখ্যায়, সকলের ঠাট্টায়, অসহায় হয়ে বেঁচে রইলেন। বন্ধু মনোজ বিশ্বাসকে একবার বলেছিলেন- নামটা তার মজুমদার না হয়ে মজুতদার হলেই বরং ভালো হতো। সকল যন্ত্রণা, ব্যর্থতা, কষ্ট সব একটা খাঁচার মধ্যে মজুত করে বসে আছেন যিনি, তার নামটা মজুতদারই তো হওয়া উচিত! পরবর্তী জীবনে বিনয়কে দেখা যায় উষ্কোখুষ্কো চুলে, মালিন্যের প্রধানতম ধারক ও বাহকের সাজে, ছেঁড়া জামায়, শরীরে দুর্গন্ধ আর মনে গাঢ় বিষাদ নিয়ে বসে থাকেন কফি হাউজে। হুটহাটই রেগে যান, এর ওর গায়ে থুতু ছেটান, গালাগাল দেন অথবা কাউকে মারতে গিয়ে জেল খাটেন। হয়তো প্রেমে, হয়তো নিঃসঙ্গতায়, হয়তো কোনো এক অমীমাংসীত রহস্যে ধীরে ধীরে নিঃশেষ হয়ে গেলেন বাংলা সাহিত্যের এই উজ্জ্বল কবিটি। বলে গেলেন,

আমার আশ্চর্য ফুল, যেন চকোলেট, নিমিষেই
গলাধঃকরণ তাকে না ক’রে ক্রমশ রস নিয়ে
তৃপ্ত হই, দীর্ঘ তৃষ্ণা ভুলে থাকি আবিষ্কারে, প্রেমে।
অনেক ভেবেছি আমি, অনেক ছোবল নিয়ে প্রাণে
জেনেছি বিদীর্ণ হওয়া কাকে বলে, কাকে বলে নীল-
আকাশের হৃদয়ের; কাকে বলে নির্বিকার পাখি।
অথবা ফড়িঙ তার স্বচ্ছ ডানা মেলে উড়ে যায়।
উড়ে যায় শ্বাস ফেলে যুবকের প্রানের উপরে।
আমি রোগে মুগ্ধ হয়ে দৃশ্য দেখি, দেখি জানালায়
আকাশের লালা ঝরে বাতাসের আশ্রয়ে আশ্রয়ে।
আমি মুগ্ধ; উড়ে গেছ; ফিরে এসো, ফিরে এসো, চাকা,
রথ হয়ে, জয় হয়ে, চিরন্তন কাব্য হয়ে এসো।
আমরা বিশুদ্ধ দেশে গান হবো, প্রেম হবো, অবয়বহীন
সুর হয়ে লিপ্ত হবো পৃথীবীর সব আকাশে।

অনলাইনে কিনুন- ফিরে এসো, চাকা

Related Articles