১৯৭২ সালের যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের পুনঃনির্মাণে সবাই হন্যে হয়ে কাজ করছেন। পাশাপাশি নানাবিধ আক্রমণে বিকল হয়ে আছে আমাদের রাষ্ট্রযন্ত্র। এমন সময় আঠেরো বছর বয়সী এক অসুখী কিশোরের হাতে প্রথমবারের মতো আমরা একটি ক্যামেরা দেখতে পাই। অবাক বিস্ময়ে কিশোর লক্ষ্য করে ক্যামেরাটি। যন্ত্র আবিষ্কারের এক ফাঁকে হঠাৎ করে কয়েকটি ক্লিক করে বসে। বুঝতে পারে, এতদিন যাবৎ পত্র-পত্রিকায় যে ছবি দেখে এসেছে, কেটে কেটে জমিয়ে রেখেছে অ্যালবামের পাতায় পাতায়- সেই জীবনকে স্থির করে রাখার মোক্ষম যন্ত্রটি এতদিনে তার হাতে এসে ধরা দিয়েছে। ফটোগ্রাফি বা আলোকচিত্র সম্বন্ধে ন্যূনতম জ্ঞানহীন সেই কিশোর হঠাৎ ঠিক করে বসে তার জীবনের লক্ষ্য। কিছুদিন আগে মরণাস্ত্রের গর্জনে তছনছ হয়ে যাওয়া সোনার বাংলার বুকে আবার তিনি ফুল ফোটাবেন। আর এ কাজে তার অস্ত্র হবে ইয়াশিকা ৬৩৫ ১২০ মিমি মডেলের ক্যামেরাটি।
দীর্ঘ ছয়টি বছর নিজের কোনো ক্যামেরা ছিল না। এর-ওর কাছ থেকে ধার করেছেন নিজের সততার বিনিময়ে। আলোকচিত্র বিষয়ে প্রাতিষ্ঠানিক পাঠ গ্রহণের সুযোগও হয়নি। প্রাথমিক হাতেখড়ির দিনগুলো পেরিয়ে গেলে তিনি লক্ষ্য করলেন, সংবাদপত্রে বা বইয়ের ফ্ল্যাপে বিখ্যাত মানুষদের যে ছবিগুলো ছাপা হয়, সেগুলো বড্ড নিষ্প্রাণ। বাস্তবের মানুষটির সাথে ছাপা হওয়া ছবির যোজন যোজন ফারাক। ঠিক করলেন, পোর্ট্রেইট ফটোগ্রাফির এই হাল বদলাতে হবে। ছবির মানুষটিকে জীবন্ত ক্যামেরাবন্দী করার মিশনে নেমে পড়লেন। সঙ্গী সেই ইয়াশিকা ৬৩৫ ১২০ মিমি মডেলের ক্যামেরাটি।
সেই আশির দশক থেকে আজ অবধি তিনি তুলেছেন পাঁচ হাজারেরও বেশি মানুষের পোর্ট্রেইট, সংখ্যায় তা লক্ষাধিক। সে সুবাদে পরিচিত হয়েছেন এদেশের প্রায় সকল গুণীজনের সাথে, তাদের ব্যক্তিজীবনকে নিবিড় অধ্যয়ন করার সুযোগ পেয়েছেন। অনেকে বলেন, তিনি যার পোর্ট্রেইট তুলবেন, রাতারাতি বিখ্যাত বনে যাবেন সে মানুষটি। কবি শামসুর রাহমান তাকে ‘ক্যামেরার কবি’ বলে আখ্যা দিয়েছিলেন। এমনই এক বিস্ময় নাসির আলী মামুন।
নিজের কেনা প্রথম ক্যামেরার সাথে নাসির আলী মামুন। এটিও ইয়াশিকা ৬৩৫ ১২০ মিমি ক্যামেরা। ক্যামেরাটি কেনার মাত্র দুই মাসের মাথায় স্টুডিও নেহার থেকে চুরি হয়ে যায়; Photographer: Shahab Wasi Uddin
উপরের ছবিটি দেখলে মনে হয়, নাসির আলী মামুন ট্রাইপডে ছবি তুলতে অভ্যস্ত। অথচ তিনি কখনোই ট্রাইপডে ছবি তোলেননি, ব্যবহার করেননি কোনো কৃত্রিম আলো। স্টুডিওর সমস্ত কৃত্রিমতাকে তিনি বর্জন করেছিলেন ছবিগুলোতে প্রাণসঞ্চার করবার আকাঙ্খায়। তার পূর্বসূরী আলোকচিত্রীদের বেশিরভাগই ঝুঁকেছিলেন প্রেস ফটোগ্রাফির দিকে। যারা সৃষ্টিশীল ফটোগ্রাফার ছিলেন, তারা নিসর্গকে ভিত্তি করে ছবি তুলতেন। নাসির আলী মামুন সে পথে হাঁটলেন না, খুঁজে বের করতে থাকলেন তৎকালীন সব বিখ্যাত মানুষদের, যাদের বেশিরভাগই এখন ইতিহাসের অংশ হয়ে গেছেন।
সেই নতুন পথ তৈরিতে পদে পদে বিপত্তির মুখোমুখি হলেন নাসির। দেখলেন, তিনি যাদের ছবি তুলবেন, তারা সৃষ্টিশীল ক্ষেত্রগুলোর গুরুত্বপূর্ণ সব ব্যক্তিত্ব। কিন্তু তাদের নামের তালিকা নেই কোথাও। বাংলা একাডেমি পুরষ্কার ব্যতীত আর কোনো রাষ্ট্রীয় পুরষ্কার বা সম্মাননা তখন ছিল না। নাসির বাংলা একাডেমি থেকে পুরষ্কারপ্রাপ্তদের একটি তালিকা নিলেন। কিন্তু যারা লেখক নন, কিন্তু গুণী শিল্পী, যেমন গুণী আঁকিয়ে, অভিনয় শিল্পী কিংবা গায়ক তাদের তেমন কোনো তালিকা পেলেন না। তিনি নিজেই কয়েকজনের সাথে আলাপ করে তৈরি করে নিলেন একটি তালিকা এবং চলে গেলেন জাতীয় অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক সাহেবের কাছে। সেটা ১৯৭৩ সালের কথা। আবদুর রাজ্জাক সাহেব সেই তালিকা দেখে যে মন্তুব্য করেছিলেন তা তার বয়ানেই তুলে দিচ্ছি –
তালিকাটাতো ভালোই দেখতেছি… এর মধ্যে গরু আছে, ছাগল আছে – আবার কয়েকটা গাঁধারেও দেখতেছি!
জ্ঞানতাপস আবদুর রাজ্জাক; Photographer: Nasir Ali Mamun
নাসির আলী মামুন এতে সামান্য বিরক্ত হলেন। কিশোর বয়সে ঠিক বুঝে উঠতে পারেননি কী বললেন জ্ঞানতাপস। নাসির এগোতে থাকলেন তার তালিকা ধরে। যখনই যার কাছে যেতেন, তালিকাটি সাথে নিতে ভুলতেন না। সেই ব্যক্তিকে দেখাতেন তালিকাটি এবং আরো কিছু নাম জুড়ে দিতে অনুরোধ জানাতেন, তাদের বাসার ঠিকানা চাইতেন। কিন্তু এ পদ্ধতি সবসময় খুব বেশি সহজ ছিল না তার জন্য। সৃষ্টিশীল মানুষদের সৃষ্টির অহংবোধে বার বার ঝলসে গিয়েছেন তিনি। পর্দার পেছনে সেলিব্রেটিদের একে অপরের প্রতি প্রতিযোগীতামূলক মনোভাবের সাক্ষী হয়ে থেকেছেন।
গ্রিন রোডের নেহার স্টুডিওর সামনে প্রতি রাতে ঠিক নয়টা নাগাদ দেখা যেতে লাগলো সেই কিশোরকে। নিজের ক্যামেরা নেই, কিন্তু ফটোগ্রাফার হওয়ার অসম্ভব স্বপ্ন লালন করছেন বুকে। নিজের সততার বিনিময়ে প্রতি রাতে স্টুডিও বন্ধের সময় ধার নিতেন নেহার স্টুডিওর একমাত্র ক্যামেরাটি। সারা রাত ধরে ছবি তুলতেন এবং পরের দিন স্টুডিও খুলবার আগেই ক্যামেরা হাতে দাড়িয়ে থাকতেন স্টুডিওর সামনে। স্টুডিওর মালিক ছেলেটির নিষ্ঠা দেখে মুগ্ধ হন। এভাবেই চলতে থাকে রাতবিরাতে ক্যামেরা নিয়ে তার সংগ্রাম।
নাসির আলি মামুন, ঝালকাঠি, ১৯৮৪; Photographer: আহমদ ছফা
ঋতুর পালাবদলের মতো চেহারার পরিবর্তন আসে সৃষ্টিশীল মানুষদের, নাসির আলী মামুন তাদের সে চেহারা ক্যামেরাবন্দী করতে থাকলেন। প্রায় পাঁচ দশক ধরে তিনি অবিরাম ফ্রেমবন্দী করেছেন পাঁচ হাজারেরও বেশি মুখ। তাদের মাঝ থেকে কম করে হলেও পাঁচশত গুণীজন মারা গেছেন। এতসব সৃষ্টিশীল মানুষদের সংস্পর্শে তিনি এসেছেন, তাদের পরিবারের সাথে খাতির করেছেন এমনকি তিন পুরুষ পর্যন্ত তিনি তাদের সাথে আলাপ রেখে চলেছেন ইত্যাদি মিলিয়ে বিচিত্র অভিজ্ঞতার এক ভাণ্ডার নাসির আলী মামুন। সেগুলো তিনি কিছু কিছু লিখতে শুরু করেছেন।
প্রকাশিত হয়েছে কবি জসীম উদ্দীনকে নিয়ে প্রায় নয়শো পৃষ্ঠার নিরীক্ষাধর্মী একটি বই। শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ, আহমদ ছফা, অ্যালেন গিন্সবার্গ, গুন্টার গ্রাস, অরুন্ধতী রায়, ভাষাসৈনিক আব্দুল মতিন, সরদার ফজলুল করিম, আবু ইসহাক প্রমুখের সাক্ষাৎকার মলাটবন্দী করেছেন ‘আলাপন’ শিরোনামে। শামসুর রাহমান এবং আল মাহমুদকে তিনি বিচার করেছেন আপন ভঙ্গিতে। আদর্শিকভাবে দুই মেরুতে অবস্থান করা বাংলা সাহিত্যের এই দুই প্রধান কবিকে এক করেছিলেন তিনি। বিস্তর এক সাক্ষাৎকার নিয়েছেন প্রায় চার বছর ধরে। ‘শামসুর রাহমান – আল মাহমুদ: তফাৎ ও সাক্ষাৎ’ বইটি তাই পাকাপাকিভাবে স্থান করে নিয়েছে বাংলা সাহিত্যের অঙ্গনে। এছাড়াও হুমায়ূন আহমেদ, আহমদ ছফা, গুন্টার গ্রাসেরা বারে বারে উঠে এসেছে তার লেখায়।
শামসুর রাহমান এবং আল মাহমুদ। নাসির আলী তাদের কথা রেকর্ড করে চলেছেন শামসুর রাহমানের বাসায়। ছবি তুলেছেন শামসুর রাহমানের পুত্রবধু টিয়া রাহমান; Photograph: শামসুর রাহমান – আল মাহমুদ: তফাৎ ও সাক্ষাৎ বইয়ের ফ্ল্যাপ থেকে
মানুষের মুখের ভাষাতেই তিনি লিখেন, প্রথম আলোতে আলোকচিত্র সম্পাদক হিসেবে যোগদানের পর তিনি নিতে শুরু করলেন ছিন্নমূল মানুষদের সাক্ষাৎকার। অদ্ভুত সব প্রশ্ন ছুড়ে দিতেন তাদের, তার থেকে অদ্ভুত সব উত্তরে তিনি ভুল ব্যকরণে মুখের ভাষাতেই লিখে যেতেন, দীর্ঘদিন ধরে ‘ঘর নাই’ শিরোনামে তা প্রকাশ পায় প্রথম আলোতে। পরে তা বই আকারেও প্রকাশ করে মাওলা ব্রাদার্স।
ক্যামেরার কবি; Photographer: আরিফ আহমেদ
বেশ মজার একটি শখ আছে তার- যারা ছবি আঁকেন না, তাদেরকে অনুরোধ করে ছবি আঁকিয়ে নিতেন। চল্লিশেরও অধিক পোর্ট্রেইট পেইন্টিং করে দিয়েছেন নামজাদা সব চিত্রশিল্পীরা। গ্রামীন ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা ড. মুহাম্মদ ইউনুস এভাবে এঁকেছেন নাসির আলী মামুনের ক্যামেরা।
নাসির আলী মামুনের ক্যামেরা; আঁকিয়ে: ড. মুহাম্মদ ইউনুস
এস. এম. সুলতানের আঁকা নাসির আলী মামুনের পোর্ট্রেইট; Courtesy: ফটোজিয়াম
পটুয়া কামরুল হাসান এভাবেই এঁকেছেন নাসিরকে; Courtesy: ফটোজিয়াম
নাসির আলী মামুন ছবি তোলেন একেবারে ভিন্ন কায়দায়। বেশিরভাগ ছবিরই একটি বড় অংশে থাকে প্রগাঢ় অন্ধকার। নাসির নিজেও জানেন না, কেন ঘুরে ফিরে এভাবে খানিকটা অন্ধকার করে ছবিগুলো ধরা দেয় তা ক্যামেরায়। আর্ট ক্রিটিক মইনুদ্দীন খালেদ তার চমৎকার ব্যাখ্যা করেছেন। তিনি বলেন,
নাসির আলী মামুন যাদের নিয়ে কাজ করেন, তার বেশিরভাগ গুণী শিল্পীকেই রাষ্ট্র তেমন কোনো স্বীকৃতি দিতে পারেনি। মোটের ওপর আর্থিক অবস্থা প্রায় সবারই খারাপ। অনেক ক্ষেত্রেই অবমূল্যায়িত হয়েছেন আমাদের সমাজে। অন্য দিকে নাসিরের প্রাথমিক জীবনের শ্রেষ্ঠাংশ কেটেছে চরম দারিদ্র্যে, প্রথম ছয়টি বছর ছবি তুলেছেন মানুষের ক্যামেরা ধার করে। দু’পক্ষের এই না পাওয়ার বেদনা মিলেমিশে ছবিগুলো এত কালো, এত অন্ধকার, এত কান্নামাখা।
কেমন শক্তিশালী ছিল তার ক্যামেরার কবিতা? তার কিছু পোর্ট্রেইট আমরা এবার দেখে নেব।
কমরেড মনি সিং (১৯০১ – ১৯৯০), পেছন থেকে তাকিয়ে আছেন কার্ল মার্কস; Photographer: Nasir Ali Mamun
আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক মুহম্মদ আতাউল গনি ওসমানী (১৯১৮ – ১৯৮৪)। ১৯৭৮ সালে তোলা ছবি; Photographer: Nasir Ali Mamun
কবি ও সাহিত্য সমালোচক শঙ্খ ঘোষ (১৯৩২ – বর্তমান); Photographer: Nasir Ali Mamun
সাংবাদিক এবং পরবর্তীতে তথ্য মন্ত্রী এনায়েতউল্লাহ খান (১৯৩৯ – ২০০৫), ১৯৭৪ সালে তোলা ছবি; Photographer: Nasir Ali Mamun
গোলাম কাসেম ড্যাডি (১৮৯৪ – ১৯৯৮), বাংলাদেশের আলোকচিত্রের অন্যতম দিকপাল এবং প্রথম বাঙালী ছোট গল্পকার। ছবিটি ইন্দিরা রোডের ক্যামেরা রিক্রিয়েশান ক্লাবে তোলা, ১৯৭৩ সাল; Photographer: Nasir Ali Mamun
১৯৭৮ সালে নাসির আলী মামুনের একটি প্রদর্শনীর আয়োজন করে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃতি সংসদ। কিন্তু প্রদর্শনীর কয়েকদিন আগে দেখা যায় বিপত্তি। প্রদর্শনীর জন্য প্রয়োজনীয় টাকা জোগাড় করতে পারে না তারা, নাসিরের কাছেও কোনো টাকা নেই। তিনি তখন ‘বিশিষ্ট বেকার’। অর্থনীতির ছাত্ররা তাকে বললেন, ‘আমাদের এক স্যার আছেন। আপনি যদি তাকে ছবি তুলে খুশি করতে পারেন, তবে টাকাটা মিলতে পারে। উনার একটি ব্যাংক আছে।’ নাসির আলী মামুন তাদের কথা মতো চলে গেলেন পরবর্তীতে নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহম্মদ ইউনুসের কাছে। ছবি তুললেন ঠিকই, কিন্তু দু’দিন পর প্রিন্ট করে নিয়ে গিয়ে প্রদর্শনীর টাকা চাওয়াতে বাঁধলো আরেক বিপত্তি। জানা গেল, ড. ইউনুসের প্রতিষ্ঠিত গ্রামীণ ব্যাংকের মূলধন মাত্র ৬৬ হাজার টাকা। সেখান থেকে তিন হাজার টাকা দিয়ে দিলে তো ভারি মুশকিল! তবু টাকার ব্যবস্থা করে দিলেন ড. ইউনুস।
এর আগে ১৯৭৭ সালে প্রথমবারের মতো নাসিরের প্রদর্শনীর আয়োজন করে বাংলা একাডেমি। আজ পর্যন্ত নাসিরের একক প্রদর্শনীর সংখ্যা কমপক্ষে ৫৭টি।
ড. মুহম্মদ ইউনুস, ১৯৭৮ সাল, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়; Photographer: Nasir Ali Mamun
ড. মুহম্মদ ইউনুস, ২০০৯ সালে তোলা; Photographer: Nasir Ali Mamun
তারপর মাস তিনেক নাসির আলী মামুন বোহেমিয়ান জীবনযাবপ করলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় এবং তার আশেপাশে। ড. ইউনুসের একান্ত সহচর ‘আসাদ ভাই’-এর সাথে তিনি ঘুরে ঘুরে দেখলেন ড. ইউনুসের প্রথম ‘ল্যাবরেটরি’ যোবরা গ্রাম। তিনি দেখতেন, ড. ইউনুস প্রতি সন্ধ্যায় ক্লাস শেষে হারিকেন নিয়ে বেরিয়ে পড়তেন আর বাড়ি বাড়ি গিয়ে মহিলাদের উদ্বুদ্ধ করতেন গ্রামীণ ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়ার ব্যাপারে।
প্রথম বাঙালী মুসলমান চিত্রশিল্পী ও কার্টুনিস্ট কাজী আবুল কাসেম (১৯১৩ – ২০০৪) (বাঁ দিকে) এবং তার ছোটভাই কাজী মাসুম; Photographer: Nasir Ali Mamun
ছোট গল্পকার ও কথাসাহিত্যিক হাসান আজিজুল হক (১৯৩৯ – বর্তমান); Photographer: Nasir Ali Mamun
সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হক (১৯৩৫ – ২০১৬)। লেখকের নিজ বাসায় তোলা ছবিটি, ১৯৭৯ সাল; Photographer: Nasir Ali Mamun
১৯৭৯ সালে কবি আল মাহমুদ (১৯৩৬ – বর্তমান)। সেদিন কবির চশমাটা ভেঙে যায়, নাসির কবিকে সেই ভাঙা চশমা পরিয়েই ক্যামেরায় ক্লিক করেন। কবির কাঁধে কবির মেয়ে, এই ছবির অলংকার; Photographer: Nasir Ali Mamun
কবি শামসুর রাহমান (১৯২৯ – ২০০৬), দৈনিক বাংলার অফিসে, ১৯৭৮ সাল; Photographer: Nasir Ali Mamun
কবি আহসান হাবীব (১৯১৭ – ১৯৮৫); Photographer: Nasir Ali Mamun
কবি মাহমুদা খাতুন সিদ্দীকা (১৯০৬ – ১৯৭৭)। ১৯৭৪ সালে তোলা ছবি, কবি তখন অসুস্থ অবস্থায় ভর্তি ছিলেন পি জি হাসপাতালে; Photographer: Nasir Ali Mamun
ড. মুহম্মদ আবদুস সালাম (১৯২৬ – ১৯৯৬), ১৯৭৯ সালে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল বিজয়ী। ১৯৮১ সালে ড. সালাম ঢাকায় আসেন, নাসির টিএসসি-তে তুলেছিলেন ছবিটি; Photographer: Nasir Ali Mamun
শিক্ষাবিদ এবং সাহিত্যিক প্রফেসর ইব্রাহীম খাঁ (১৮৯৪ – ১৯৭৮), ১৯৭৩ সালে তোলা ছবি; Photographer: Nasir Ali Mamun
কবি নির্মলেন্দু গুণ (১৯৪৫ – বর্তমান); Photographer: Nasir Ali Mamun
আবু ইসহাক (১৯২৬ – ২০০৩); Photographer: Nasir Ali Mamun
বিখ্যাত ফোকলোরিস্ট প্রফেসর মুহাম্মদ মনসুর উদ্দীন (১৯০৪ – ১৯৮৭), শান্তিনগরের বাসায় তোলা ছবিটি, ১৯৭৪ সাল; Photographer: Nasir Ali Mamun
মাহবুবুল আলম, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের একজন সৈনিক। কাজী নজরুল ইসলামের সহযোদ্ধা। ১৯৭৬ সালে চট্টগ্রামে তার বাসায় তোলা ছবিটি; Photographer: Nasir Ali Mamun
সাঈদ আহমদ (১৯৩১ – ২০১০), বাংলাদেশে অ্যাবস্ট্রাক্ট নাটকের জনক; Photographer: Nasir Ali Mamun
কবি ও সমালোচক হাসান হাফিজুর রহমান (১৯৩২ -১৯৮৩); Photographer: Nasir Ali Mamun
বিজ্ঞানী এবং শিক্ষাবিদ কাজী মোতাহার হোসেন দাবা খেলায় মগ্ন। নাসির তেমনই একটি ছবি তুলতে চান। হঠাৎ করে মোতাহার হোসেনের দুই নাতি কাজী শাহনূর হোসেন এবং কাজী মায়মুর হোসেন এসে দাদুর গালে চুমু দিয়ে যায়; Photographer: Nasir Ali Mamun
নাসির তার কাঙ্খিত ছবিটি পেয়ে গেছেন; Photographer: Nasir Ali Mamun
বাংলা একাডেমির বর্ধমান হাউজে কাজী মোতাহার হোসেন; Photographer: Nasir Ali Mamun
১৯৭৮ সালে ফেরদৌসী মজুমদার এবং মেয়ে ত্রপা মজুমদার; Photographer: Nasir Ali Mamun
ড. আবদুল্লাহ আল-মুতী (১৯৩০ – ১৯৯৮); Photographer: Nasir Ali Mamun
এসরাজ বাজাচ্ছেন ওস্তাদ ফুলঝুরি খান (১৯২০ – ১৯৮৪); Photographer: Nasir Ali Mamun
১৯৭৩-এ গুল মোহাম্মাদ খাঁ (১৮৭৬ – ১৯৭৯)। ৯৫ বছর বয়সে জীবনসায়াহ্নে তিনি বসবাস করতেন পুরান ঢাকার এক বস্তিতে; Photographer: Nasir Ali Mamun
শওকত ওসমান (১৯১৭ – ১৯৯৮); Photographer: Nasir Ali Mamun
নিজের স্টুডিওতে পটুয়া কামরুল হাসান (১৯২১ – ১৯৮৮), ১৯৭৯-এর ছবি; Photographer: Nasir Ali Mamun
কবি শহীদ কাদরী (১৯৪২ – ২০১৬), ১৯৭৮-এ তোলা ছবি; Photographer: Nasir Ali Mamun
সুচরিত চৌধুরী, চট্টগ্রাম, ১৯৭৮; Photographer: Nasir Ali Mamun
কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় (১৯১৯ – ২০০৩), হোটেল পূর্বানীতে, ১৯৭৪; Photographer: Nasir Ali Mamun
শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীন (১৯১৪ – ১৯৭৬), ৭ জুন, ১৯৭৪ সাল; Photographer: Nasir Ali Mamun
কবি সিকদার আমিনুল হক (১৯৪২ – ২০০৩) এবং তার ছেলে; Photographer: Nasir Ali Mamun
ভাষা সৈনিক গাজিউল হক (১৯২৯ – ২০০৯); Photographer: Nasir Ali Mamun
কমরেড আব্দুল মতিন (১৯২৬ – ২০১৪); Photographer: Nasir Ali Mamun
প্রিন্সিপাল দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ (১৯০৬ – ১৯৯৯); Photographer: Nasir Ali Mamun
মাসুদ রানার জনক কাজী আনোয়ার হোসেন (১৯৩৬ – বর্তমান), টাইপরাইটারে টাইপ করছেন; Photographer: Nasir Ali Mamun
কবি পূর্নেন্দু পত্রী (১৯৩৩ – ১৯৭৭); Photographer: Nasir Ali Mamun
সমরেশ বসু (১৯২৪ – ১৯৮৮); Photographer: Nasir Ali Mamun
কথাসাহিত্যিক আখতারুজ্জামান ইলিয়াস (১৯৪৩ – ১৯৯৭); Photographer: Nasir Ali Mamun
নিজ ঘরে আখতারুজ্জামান ইলিয়াস; Photographer: Nasir Ali Mamun
কবি আবু হাসান শাহরিয়ার (১৯৫৯ – বর্তমান), ১৯৯৯ সালের জানুয়ারী মাসে তোলা ছবিটি, কবির নিজ বাসায়; Photographer: Nasir Ali Mamun
প্রখ্যাত বিজ্ঞানী জামাল নজরুল ইসলাম (১৯৩৯ – ২০১৩); Photographer: Nasir Ali Mamun
সুর সম্রাজ্ঞী মমতাজ বেগম, বর্তমানে এমপি; Photographer: Nasir Ali Mamun
দ্বিজেন শর্মা (১৯২৯ – ২০১৭); Photographer: Nasir Ali Mamun
সমালোচক ও বুদ্ধিজীবী সলিমুল্লাহ খান (১৯৫৮ – বর্তমান); Photographer: Nasir Ali Mamun
কবি মুজিব ইরম; Photographer: Nasir Ali Mamun
আরো কিছু ছবি
মাওলানা ভাসানীর সাথে নাসির; Courtesy: ফটোজিয়াম
কাজী নজরুল ইসলাম এবং কিশোর নাসির; Courtesy: ফটোজিয়াম
কাজী নজরুল ইসলাম এবং নাসির আলী মামুন; Courtesy: ফটোজিয়াম
১৯৯৯ সালে প্রথম আলোর অফিসে মুখোমুখি সরদার ফজলুল করিম এবং ব্রাত্য রাইসু; Photographer: Nasir Ali Mamun
১৯৯২ সালের জুলাই মাস। কবি মোহাম্মদ রফিক এসেছেন যুক্তরাষ্ট্রে (ছবিতে শুধু সাদা চুল দেখা যাচ্ছে)। সামনে হাস্যেজ্জ্বল সলিমুল্লাহ খান, পেছনে নাসির আলী মামুন; Courtesy: ফটোজিয়াম
কবি শামসুর রাহমান এবং নাসির আলী মামুন; Courtesy: ফটোজিয়াম
বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের ২৫ তম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীতে ড. মুহম্মদ ইউনূস এবং আহমাদ মাজহার; Photographer: Nasir Ali Mamun
উপমহাদেশের বাইরের লোকজন
নোবেলজয়ী জার্মান সাহিত্যিক গুন্টার গ্রাস (১৯২৭ – ২০১৫)। ১৯৮৬ সালে মোহাম্মাদপুর জেনেভা ক্যাম্পে; Photographer: Nasir Ali Mamun
যুক্তরাষ্ট্রের সর্বোচ্চ বেসামরিক পদক ‘প্রেসিডেন্সিয়াল মেডেল অফ ফ্রিডম’ জয়ী ড. মুহম্মদ ইউনুস এবং সদ্য প্রয়াত স্টিফেন হকিং, ২০০৯ সালের ছবি; Photographer: Nasir Ali Mamun
২০০৯ সালে তোলা বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিংয়ের ছবি হাতে নাসির আলী মামুন; Photographer: জাওয়াদ
মাদার তেরেসা, ১৯৮১ সালে ঢাকায় তোলা ছবি; Photographer: Nasir Ali Mamun
আহমদ ছফার সাথে
আহমদ ছফা (১৯৪৩ – ২০০১), ৬ই আগস্ট, ১৯৯৮; Photographer: Nasir Ali Mamun
কবি শামসুর রাহমানের শয্যাপাশে আহমদ ছফা; Photographer: Nasir Ali Mamun
কাঁটাবনে অবস্থিত শিল্পী সুলতান কর্ম ও শিক্ষাকেন্দ্রে শিল্পীর সাথে আহমদ ছফা, ২১ শে ফেব্রুয়ারী ১৯৮৩; Photographer: Nasir Ali Mamun
নাসিরের ক্যামেরায় হুমায়ূন আহমেদ
হুমায়ূন আহমেদ; Photographer: Nasir Ali Mamun
সাক্ষাৎকার গ্রহণের পূর্বে; Photographer: Nasir Ali Mamun
নাসির আলী মামুন ও হুমায়ূন আহমেদ, নুহাশ পল্লীতে; Photographer: ইকবাল হাসান; Courtesy: ফটোজিয়াম
কবি আল মাহমুদের আরো ছবি
কবি আল মাহমুদ, এক সময়ের সকলের প্রিয় ‘মাহমুদ ভাই’ ততদিনে স্বজনহারা হয়েছেন; Photographer: Nasir Ali Mamun
কবি কবিকে দেখছেন – শামসুর রাহমানের ছবির দিকে তাকিয়ে আছেন আল মাহমুদ। ১৪ জুন ২০১৬ সালে তোলা ছবিটি; Photographer: Nasir Ali Mamun
সকলের প্রিয় মাহমুদ ভাই, সর্বডানে নাসির আলী মামুন, তার পাশে কবি আবু হাসান শাহরিয়ার; Courtesy: ফটোজিয়াম
নাসিরের সুলতান আবিষ্কার
সুলতান; Photographer: Nasir Ali Mamun
নাসির আলী মামুন সিরিজ করেছেন বেশ কিছু মানুষের উপর। শামসুর রাহমান, ড. মুহম্মদ ইউনুস এবং এস এম সুলতানের কথা এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য। সুলতানকে গুরু মানেন নাসির। নাসির মাসের পর মাস থেকেছেন গুণী এই শিল্পীর সাথে তার নড়াইলের বাসায়।
সুলতান, বিটল (বাঁ দিকে) এবং সোনা (ডানে); Photographer: Nasir Ali Mamun
নড়াইলের মাছিমদিয়া গ্রামে থাকতেন সুলতান। বাবা ছিলেন রাজমিস্ত্রী, তবু সুলতানের চোখে তিনি ছিলেন মস্ত বড় এক শিল্পী। তার বাবা যে জমিদার বাড়িতে কাজ করতেন, তারই একটি পরিত্যাক্ত অংশে দুটো ঘর নিয়ে সুলতান থাকতেন। ঘর দুটোতে কোনোটারই দরজার জানালার দুটো পাল্লা ছিল না। নাসির সেখানে গেলে সুলতান তাকে ‘আদর করে’ থাকতে দিতেন তার পোষা জন্তু জানোয়ারদের ঘরে! সে ঘরের চারিদিকে খাঁচায় বন্দি ছিল বড় বড় সাদা ইঁদুর, সাপ, বেজি, খরগোশ, বন মোরগ। সে ঘরের দরজা জানালা তো ছিলই না, এমনকি একটা বালিশ বা তোষকও ছিল না। মাঘ মাসের শীতের দিনগুলোয় জুতা জামা সব পরে, গলায় মাফলার পেঁচিয়ে গুটিসুটি মেরে শুয়ে কোনো রকমে রাত পার করতেন নাসির। বিচিত্র সব জন্তুর ততোধিক বিচিত্র ডাকে ঘুম হতো না তার। এভাবেই তিনি দিনের পর দিন থেকেছেন সুলতানের সাথে এবং তুলে এনেছেন অমূল্য সব ছবি।
সুলতান, তার ঘরে; Photographer: Nasir Ali Mamun
সুলতান খেতে বসতেন পোষা বেড়ালগুলোকে সাথে নিয়ে; Photographer: Nasir Ali Mamun
১৯৭৯-র ডিসেম্বরে হারিকেনের আলোয় সুলতান। ডিসেম্বরে বেরিয়ে যেত পরের বছরের ডায়েরী, নাসির তেমনই একটি ডায়েরী উপহার দিয়েছিলেন সুলতানকে। দাম নিয়েছিল দুই টাকা; Photographer: Nasir Ali Mamun
বাঁশি থামালেন সুলতান; Photographer: Nasir Ali Mamun
সুলতান হারিকেন হাতে ঢুকতেন সে ঘরে। একটু আগে যে বিটক শব্দে তোলপাড় করছিল জীবজন্তুর দল, হঠাৎ তা মিলিয়ে গেল। সুলতান প্রতিটি খাঁচার সামনে গিয়ে কথা বললেন। শুয়ে থাকা নাসিরের মনে হয় সুলতানের সব কথা বুঝতে পারছে তারা, তার কথার উত্তরও দিচ্ছে ছোট ছোট করে। একবার সুলতান বললেন,
ঢাকা থেকে মেহমান আসছে, আমার বন্ধু। সে অনেক ছবি তুলবে কালকে, আমরা গ্রামে যাব। তাকে একটু ঘুমাতে দে। আজকে তোদের খেতে দিতে পারিনি, কালকে দেবো।
মহান এই শিল্পীর দারিদ্র্যের সাথে লড়াই খুব কাছ থেকে দেখেছেন নাসির আলী মামুন। ছবি আঁকার শুরুতে, আঁকার সময় এবং আঁকা শেষে পরিতৃপ্ত কিংবা নিজের কাজ দেখে বিরক্ত সুলতানকে যেমন দেখেছেন, তেমনি দেখেছেন শিল্পীসত্ত্বার বাইরের খুব ব্যক্তিগত সুলতানকে।
নড়াইলের বাজার দিয়ে হেঁটে বেড়াচ্ছেন সুলতান; Photographer: Nasir Ali Mamun
বাজারে হাঁটতে হাঁটতে নাসিরকে বলতেন, “দেখেন কত কালার! পঞ্চাশ টাকায় এত কালার পাওয়া যায়! পৃথিবী আর কোনো দেশে পাওয়া যাবে?” খানিক পরে আবার কাছিম ইশারা করে বলে উঠতেন, “পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে মানচিত্রের মতো না কাছিমের খোলটা?” একটা কাছিমকে উল্টে আবার নাসিরকে দেখাতেন, “দেখেন কত কালার!” এমনই অদ্ভুৎ বোহেমিয়ান চরিত্র ছিলেন সুলতান। নড়াইলের যেসব রাস্তায় কেউ হাঁটতেন না সাপ, বেজি, বিছা ইত্যাদির ভয়ে, সুলতান সেসব রাস্তা দিয়ে অবলীলায় হাঁটতেন।
বিশাল এক ক্যানভাসের সামনে সুলতান; Photographer: Nasir Ali Mamun
ছবির একাংশ এবং সুলতান; Photographer: Nasir Ali Mamun
‘ওয়াইল্ড ক্যারেক্টার’ সুলতান; Photographer: Nasir Ali Mamun
নাসির আলী মামুন সুলতান সম্পর্কে বলেন-
সুলতানকে তিন দিনের বেশি সহ্য করা যাইতো না। এত আনগ্রেইটফুল, এত মিস্টেরিয়াস, এত বিরক্তিকর এবং তিনদিন পরে, বাহাত্তর ঘন্টা- সত্তর ঘন্টা পরে মনে হইতো যে তাকে খুন করি। এরকম বহুবার আমার নিজের মনে হইছে।
সুলতান বাঁশি বাজাচ্ছেন; Photographer: Nasir Ali Mamun
তা সত্ত্বেও সুলতানকে ‘গ্রেইট ম্যান’ বলেই মানেন নাসির আলী মামুন। শুধু চিত্রশিল্পী ছিলেন না সুলতান, ছিলেন দার্শনিক এবং মিউজিশিয়ান। খুব ভালো বাঁশি বাজাতেন। বলতেন –
– বাঁশি শুনলে জীবজন্তু আসে।
নাসির শুধালেন – মানুষ আসে?
– কারা আসে?
– যারা ভালোবাসতে চায়, তারা আসে।
– আপনার কাছে আসতেছে না ক্যান?
– আমার তো দাঁত নাই, আমি তো বুড়া। আপনি বাঁশি বাজান, দেখবেন আসবে!
গ্রামের সেলুনে দাড়ি কামাচ্ছেন সুলতান, নাসির সেলুন সেল্ফ পোর্ট্রেইট করলেন; Photographer: Nasir Ali Mamun
আরেকটি সেল্ফ পোর্ট্রেইট, ধানমন্ডিতে তোলা। ছবি ব্যাপারে সুলতান নির্বিকার, তিনি অন্য দুনিয়ায় ছিলেন; Photographer: Nasir Ali Mamun
“এস এম সুলতান আমাদের দেশে এমন একটা ক্যারেক্টার যিনি একাই শুরু, একাই শেষ। এইরকম কোনো মানুষ এই উপমহাদেশে আমি দেখি নাই” – এস এম সুলতান সম্পর্কে নাসির আলী মামুন।
নাসির আলী মামুনকে ‘ক্যামেরার কবি’ নামটি দেন শামসুর রাহমান। ২০০৫ সালে কবি তার ‘গোরস্থানে কোকিলের করুণ আহ্বান’ বইটির উৎসর্গপত্রে লেখেন ‘ক্যামেরার কবি নাসির আলী মামুনকে’। সেই থেকেই ক্যামেরার কবি হিসেবে খ্যাত হন নাসির।
কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো, এতসব অমূল্য ছবির প্রায় সব নেগেটিভই এখন হারিয়ে যাবার পথে। তার প্রায় ৫০ শতাংশ নেগেটিভের বেশিরভাগ অংশ নষ্ট হয়ে গেছে এবং ২০ শতাংশ নেগেটিভ পুরোটাই নষ্ট হয়ে গেছে। যা এখনো টিকে আছে, তা দিয়ে তিনি গড়ে তুলতে চান ফটোগ্রাফির একটি জাদুঘর। এর নাম তিনি দিয়েছেন- ফটোজিয়াম। এক নাসির আলী মামুনের পক্ষে জাদুঘর প্রতিষ্ঠা করবার মতো মহাযজ্ঞ খুবই দুরুহ একটি কাজ। তাই সেই কাজ এগিয়ে চলছে গুটি গুটি পায়ে। আমরা আশা রাখি, সব কাজ সেরে খুব দ্রুতই উদ্বোধন করা হবে ফটোজিয়াম এবং খুলে দেওয়া হবে জনসাধারণের জন্য।
হুমায়ূন আজাদ খুব করে চাইতেন নাসির যেন তার ছবি তোলেন, এমন আক্ষেপ তিনি বহুজনের কাছে করেছেন। নাসিরের কাছেও আবদার জানিয়েছেন একাধিকবার। নাসির সুযোগ বুঝে সে কথা তাকে দিয়ে লিখিয়েও নিয়েছিলেন।
হুমায়ুন আজাদের আক্ষেপ; Source: ফটোজিয়াম
নাসির আলী মামুনের জন্ম ১৯৫৩ সালের ১ জুলাই, ঢাকায়। তার ভাষায়, ‘অসম্ভব’ এক পরিবারে তার জন্ম। ‘না, দেবো না, হবে না, পারবা না’ ইত্যাদি শুনতে শুনতে বড় হয়েছেন তিনি। তিনি যে আসলে কী করছেন সে সম্পর্কে তেমন কোনো ধারণাই ছিল না নাসিরের পরিবারের। তাই, কোনো বাঁধা আসেনি পরিবারের পক্ষ থেকে, আবার পরিবারের সমর্থনও পাননি কোনো। সেই কিশোরটি যে আজ নাসির আলী মামুন হয়ে উঠেছেন, নিজের বুকে বয়ে বেড়াচ্ছেন এক টুকরো বাংলাদেশ, আমরা কি পেরেছি তাকে তার প্রাপ্য সম্মান দিতে? আমাদের রাষ্ট্রযন্ত্রের কাছে একটি আবদার রেখে গেলাম, বাংলাদেশের ইতিহাস সংরক্ষণে নাসির আলী মামুনের ‘ফটোজিয়াম’ প্রতিষ্ঠায় এগিয়ে আসুন। এমন প্রামাণ্য তথ্যভাণ্ডার হারিয়ে গেলে পরে আফসোসের সীমা থাকবে না।
“বিখ্যাত মানুষদের ছবি তুলতে আমার আঙুল ক্লান্ত প্রজাপতির মতো নড়তে থাকে” – নাসির আলী মামুন; Photographer: সুদীপ্ত সালাম
২০১৩ সালে ষাট বছরে উপনীত হন তিনি। মুনেম ওয়াসিফের নেওয়া বিশাল এক সাক্ষাৎকার মলাটবন্দী হয়ে প্রকাশিত হয় ‘নাসির আলী মামুন: তার আলো তার ছায়া’ শিরোনামে। ২০০৯ সালে মনজুরুল আলম নাসিরের ওপর একটি তথ্যচিত্র নির্মাণ করেন, নাম দেন ‘পোয়েট অব ক্যামেরা’।
ছবিমেলা আয়োজিত একটি সেমিনারে নাসির আলী মামুন। ৩১ জানুয়ারী ২০১৩, গোথে ইনস্টিটিউট, ঢাকা; Courtesy: Chobi Mela
“আমি শিল্পী হইতে আসছিলাম, শিল্পী হইতে পারছি কিনা তার বিচারের ভার যাদের বয়স এখন বিশ-পঁচিশ-ত্রিশ, তাদের। তাদের কাছে আমি নতজানু হইয়া থাকি, ইতিহাসে আমারে রাইখেন।” – নাসির আলী মামুন
অসম্ভব বিনয়ী এই শিল্পী বেঁচে থাকুন যুগ যুগ এবং বাংলাদেশকে লালন করতে থাকুন তার ক্যামেরায়। ক্যামেরার কবি সামনের দিনগুলোয় যে কবিতা লিখে যাবেন, তার অপেক্ষায় বিদায় নিলাম।
Feature Image: Photoseum/Nasir Ali Mamun