Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

বর্ণবাদের শিকার পিগমী জাতির শান্তিপ্রিয় জীবনের ইতিহাস

‘পিগমী’ শব্দটা শুনলে হয়তো প্রচলিত সামাজিক প্রচারণার বদৌলতে বেশিরভাগ মানুষ হাস্যকর বামন জাতি হিসেবে চিনবে। অনেক সময় পিগমীদের উপস্থাপন করা হয়েছে বর্বর, অসভ্য এবং ভয়ংকর বনমানুষ হিসেবেও। আসলে কি পিগমীরা তা-ই?

‘পিগমী’ নামের ইতিহাস

পিগমী মূলত কোনো আদিবাসী গোষ্ঠীর নাম নয়। গ্রিক ভাষা থেকে উদ্ভূত এই শব্দের অর্থ ‘ক্ষুদ্র’। আর এই হিসাব অনুযায়ী, আকৃতিতে ছোট সকলকেই পিগমী ডাকা সম্ভব। আকারে ছোট আদিবাসীদেরকে পিগমী নামটা রসিকতা হিসেবেই দেয়া হয়েছিলো। এবং এই নামেই তারা পরিচিত হয়ে যায়। নৃতত্ত্ব অনুযায়ী, পরবর্তীতে শারীরিক দিক দিয়ে আকারে ছোট জনগোষ্ঠীকে এই নামে চিহ্নিত করা হয়। এই খর্বকায় গোষ্ঠী ছড়িয়ে আছে পৃথিবীর নানান জঙ্গলে। কেননা নাতিশীতোষ্ণ বনাঞ্চলই পিগমীদের আবাসস্থল। 

শান্তিপ্রিয় পিগমী জাতি
শান্তিপ্রিয় পিগমী জাতি; Image source: Youtube

পিগমীদের আবাস

পিগমী একটি ‘আমব্রেলা টার্ম’। অর্থাৎ, অনেক শাখার সাধারণ নাম হিসেবে এ শব্দটি ব্যবহৃত হয়। অনেকগুলো খর্বকায় গোষ্ঠীর সম্মিলিত পরিচয় পিগমী। এসব গোষ্ঠীর রয়েছে আলাদা আলাদা নিজস্ব নাম। অনেকে মনে করেন, তাদের আবাস আফ্রিকাতে। কিন্তু শুধু আফ্রিকা নয়, এশিয়া, এমনকি অস্ট্রেলিয়াতেও এদের অস্তিত্ব আছে। কঙ্গোর বেসিন ছাড়াও মালয়েশিয়া, ফিলিপাইন, পাপুয়া নিউগিনি এবং আন্দামান দ্বীপপুঞ্জের বিভিন্ন স্থানে পিগমীদের দেখা পাওয়া যায়। কিছু উল্লেখযোগ্য পিগমী আদিবাসী গোষ্ঠীর নাম হলো আকা, বাকা (আফ্রিকা), ব্যুটি, নেগ্রিতো (দক্ষিণ এশিয়া) প্রভৃতি।

বলা হয়ে থাকে, তারা পৃথিবীর আদিমতম জনগোষ্ঠী। ত্রিশ হাজার বছরের পুরোনো এদের অস্তিত্ব। নতুন প্রস্তর যুগের শুরু থেকেই তাদের অস্তিত্বের প্রমাণ পাওয়া যায় বলে ঐতিহাসিকরা মনে করেন। এবং অস্তিত্বের শুরু থেকেই তারা জঙ্গলে বাস করে। পিগমীরা পেশায় শিকারী হয়। বনের নির্ঝঞ্ঝাট শান্তিপ্রিয় জীবন তাদের একমাত্র কাম্য। তারা জঙ্গল ছেড়ে সমতলে আসতে চায় না এবং নিজেদের জীবন দিয়ে তারা বন রক্ষা করতে চায়। 

বনেই এদের স্বস্তি
সবুজের মাঝে জীবন তাদের একমাত্র কাম্য; Image Source : National Geographic

পিগমীদের উচ্চতা

পূর্ণবয়স্ক পিগমীদের গড় উচ্চতা ৪’১১” হয়ে থাকে। অনেক গবেষক মনে করেন, পিগমীদের শরীরে গ্রোথ হরমোন কম থাকে। এ কারণেই তেরো বছর বয়সের পর তারা আর লম্বায় বেড়ে ওঠে না। আবার অনেকে মনে করেন, যেহেতু তারা বরাবর বনে জংগলে বাস করেছে, নিজেদের মানিয়ে নেয়ার তাগিদেই তাদের শারীরিক আকৃতি ছোট হয়ে থাকে। কেননা এতে জঙ্গলে খাপ খাইয়ে নেয়া সহজ হয়।  

এদের গড় উচ্চতা ৪'১১
তাদের গড় উচ্চতা ৪’১১”, Image source : Konbini.com

পিগমীদের প্রকৃতি

স্থান নির্বিশেষে পিগমীদের বৈশিষ্ট্য হলো- তারা যাযাবর, শিকারী এবং শান্তিপ্রিয়। সঙ্গীত বা সুর তাদের জীবনের বিশাল অংশ জুড়ে রয়েছে। তাদের গানের এবং উৎসবের আছে আদিম অনন্য এক রূপ । যেহেতু পিগমী বলতে অনেক ধরনের আদিবাসীকে বোঝায়, তাই তাদের সাধারণ ভাষা নেই। সমাজ ও স্থান ভেদে পিগমীদের ভাষা ভিন্ন হয়ে থাকে। যেমন- বাকা পিগমীরা বাকা ভাষায় কথা বলে। সংস্কৃতি ভেদে কিছু পিগমী আদিবাসীর কথা জেনে নেয়া যাক এখন।

বাকা পিগমী

সবধরনের পিগমী আদিবাসীর বাস বনের সবুজে। বাকাদেরও বাসস্থান নাতিশীতোষ্ণ জঙ্গল। তাদের দেখা মেলে আফ্রিকা মহাদেশের কঙ্গো বা ক্যামেরুনের জঙ্গলে। এছাড়াও জঙ্গলের নিকটবর্তী নদীর ধারেকাছে তাদের দেখা যায়। উচ্চতায় তারা ১২০-১৫০ সেন্টিমিটার পর্যন্ত হয়ে থাকে

পাতা দিয়ে তৈরি তাঁবুর মতো ঘরের নাম মংগুলু। এরকম তাঁবুর মতো ঘর তারা বানায় বিভিন্ন গাছের পাতা এবং ডালের সমন্বয়ে। তাদের মাঝে বিয়ের প্রচলন অতটা নেই, আবার ঠিক বহুগামিতারও প্রচলন নেই।

বাকারা আফ্রিকান বেশিরভাগ আদিবাসীর মতোই যাযাবর জীবন যাপন করে। তাদের আসল কাজ শিকার করা। এছাড়া নারীদের মাঝে মাছ ধরার প্রচলন আছে। বেশিরভাগ সময় তারা বনের মধ্যে কাটায়। এবং আশেপাশের অঞ্চলের মানুষের সাথে প্রয়োজন ছাড়া কথা বলে না

বাকাদের ভাষা পার্শ্ববর্তী আদিবাসী গোষ্ঠী বান্টুদের মতো। তবে তাদের নিজস্বতা হলো গান এবং অনুষ্ঠানে। বাকা অত্যন্ত আমোদপ্রিয় একটি সম্প্রদায়। নিজেদের মাঝে সবসময়ই গান-বাজনা চলতে থাকে। শিক্ষা বলতে শিকারের পাশাপাশি বাকা শিশুরা তাদের বাবা-মায়ের কাছ থেকে সুর বা গান বাঁধা শিখে যায়।

তারা আধ্যাত্মবাদে বিশ্বাসী। তাদের আধ্যাত্মিক ঈশ্বরের নাম ‘জেংগি’। জেংগি একজন বনদেবতা। এই বনদেবতাকে খুশি করতে বাকারা নাচ-গান করে থাকে। তাদের সর্বপ্রধান ঈশ্বরকে ‘কম্বা’ বলে সম্বোধন করা হয়।

বাকা সম্প্রদায়ের দুঃখ হলো, দীর্ঘদিন ধরে এ গোষ্ঠীকে পার্শ্ববর্তী এবং অপেক্ষাকৃত লম্বা বান্টু গোষ্ঠী অত্যাচার করে আসছে। তাদের মাঝে সৌহার্দ্য কখনো ছিলো কি না, তা পরিষ্কার নয়। আকৃতির জন্য বাকাদেরকে দ্বিতীয় শ্রেণীর মানুষ বিবেচনা করে অনেক অত্যাচার চালানো হয়। অনেক বান্টু পুরুষ বাকা নারীকে বিয়ে করে, কিন্তু সেই বিয়েও টেকে না উচ্চতার কারণে। শেষপর্যন্ত বাকা নারী সন্তানসহ আবার বনে এসেই বাস করেন।

baka tribe
Image Source: myafricantribe.weebly

বাকাদের প্রাকৃতিক শত্রু হলো জংলী উকুন। এই উকুন পরিষ্কার করা না হলে অনেক সময় পঙ্গুত্বও বরণ করতে হয়।

নির্বিচারে বন কেটে ফেলার কারণে এই বাকাদের অস্তিত্ব আজ সংকটের মুখে। তাদের সাহায্য করার মতো পর্যাপ্ত সংস্থা এবং উদ্যোগ নেই বললেই চলে। বাকা আদিবাসীরা মানুষ আর প্রকৃতির বিরুদ্ধে নিজেরাই লড়াই করে চলেছে।

বুট্যি বা এমব্যুটি

ব্যুটিরা বাস করে কংগোর উত্তরপূর্ব অঞ্চলে ইতুরী নামে এক বনে। বলা হয়ে থাকে, বিগত ২,০০০ বছর ধরে তারা এই অঞ্চলেই বাস করছে।

ব্যুটি সম্প্রদায়ের লোকেরা পারস্পরিক সহযোগিতায় বিশ্বাস করে। তারা পার্শ্ববর্তী গ্রামের মানুষদের সাথে মিলেমিশে বাস করে। তাদের সাথে কিছুটা লেনদেনের সম্পর্কও গড়ে তোলে। যেহেতু বেশিরভাগ সময় বনে বাস করা হয়, তাই তারা বনের ভেতর থেকেই পাশের গ্রামের মানুষকে সাহায্য করে।  তাদের জন্য মধু সংগ্রহ করে বা মাংস দিয়ে তার বিনিময়ে নিজেদের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নেয়। যেকোনো মূল্যে ব্যুটিরা কলহ থেকে দূরে থাকতে চায়।

জানা গেছে, তারা যখন বিবাদে জড়িয়ে পড়ে, সেই বিবাদের মীমাংসা হয় হাসির মাধ্যমে। বিবাদ শেষ করার জন্য তারা ততক্ষণ পর্যন্ত  মূকাভিনয় করে, যতক্ষণ না তাদের হাসি পায়! তারা দলবদ্ধ হয়ে থাকে। নিজেদের অস্তিত্বের খাতিরে নিজেদের মাঝে যেকোনো কলহ এড়িয়ে চলে। এমনকি নিজেদের ভিতরের অন্তর্দ্বন্দ্ব আমলে নেয় না শুধু এই ঝামেলা থেকে দূরে থাকবার জন্য।

ব্যুটিদের জীবনযাপন শিকারের ওপর নির্ভরশীল। নামকরা সেই বিষ মাখানো তীরের ব্যবহার তাদের মাঝে দেখা যায়। তীর-ধনুক তাদের প্রিয় অস্ত্র। তারা বানর শিকার করে। এমনকি নিজেদের থেকে আকারে অনেক বড় হাতি শিকারের কৌশলও তাদের জানা আছে।

এই গোষ্ঠীর সবচেয়ে চমৎকার দিক হলো- তাদের মাঝে কোনো শ্রেণীবিভেদ নেই, নেই কোনো লিঙ্গভেদ। সত্যিকারের সমতার সমাজে তারা বাস করে, যেখানে নারীদের ছোট করে দেখার কোনো সুযোগ নেই। নারীরাও পুরুষের সাথে সমানভাবে শিকারে অংশগ্রহণ করে। তাদের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে নারী-পুরুষ আলাদা আলাদা দলে অংশ নেয়। এক্ষেত্রে পুরুষেরা যখন এগিয়ে থাকে, তখন যেকোনো একজন তাদের দল থেকে নিজ দায়িত্বে নারীদলে চলে যায়। নারীরাও একই কাজ করে। এভাবে তারা সবসময় সমতা বজায় রাখে।

ব্যুটিরাও আধ্যাত্মবাদে বিশ্বাসী। বন এবং বন্য প্রকৃতি তাদের কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ। তাদের এই আধ্যাত্মিক জীবনকে বলে ‘মলিমো’, যার অর্থ জঙ্গলের গান। সঙ্গীত তাদের বিশাল অংশ জুড়ে আছে। সঙ্গীত সাধনার জন্য তাদের আছে বিশেষ ধরনের ধনুক, ড্রাম, বাঁশি ইত্যাদি বাদ্যযন্ত্র।

পরপর কয়েকটি যুদ্ধ এই গোষ্ঠীর অস্তিত্বের জন্য খুব বিপদজনক হয়ে উঠেছে।

নেগ্রিত

নেগ্রিত দক্ষিণ এশিয়ার একটি পিগমী জাতিকে বলা হয়। তারা ফিলিপাইন, মালয়েশিয়া ছাড়াও আন্দামান দ্বীপপুঞ্জে বাস করে। খর্বকায় আকৃতি, চুল, কৃষ্ণবর্ণ দেখে তাদেরকে পিগমী হিসেবে  চিহ্নিত করা হয়। বলা হয়, ঘটনাচক্রে বহু বছর আগে তারা আফ্রিকা থেকে এই অঞ্চলে এসে বাস করা শুরু করে। এক্ষেত্রে মালয়েশিয়ান এবং ফিলিপিনো পিগমীতে পার্থক্য আছে বলে ধরে নেয়া হয়। এটাও বলা হয়ে থাকে, মালয়েশিয়ান পিগমী আন্দামান দ্বীপপুঞ্জের গোষ্ঠীর সাথে বেশি ঘনিষ্ঠ। অপরদিকে ফিলিপিনোরা পূর্বের কোনো গোষ্ঠী থেকে এসেছে।

Philipino Negrit
 ফিলিপাইনের নেগ্রিত,Image Source: Youtube

তারা সংখ্যায় খুবই কম, সবমিলিয়ে হয়তো ১৫,০০০ হবে। পানায়, মিনাদাও, নিগ্রো ইত্যাদি বিভিন্ন দ্বীপে তাদের বাস।

ফিলিপাইনের জাতীয় ভাষাই তাদের মুখের ভাষা। অর্থাৎ তারা কথা বলে অস্ট্রোনেশিয়ান ভাষায়।  অন্যান্য পিগমীদের মতো নেগ্রিতরাও আধ্যাত্মবাদে বিশ্বাসী। তবে কালের হাওয়া লেগে এখন অনেকেই খ্রিস্টধর্মের দিকে ঝুঁকে গেছে।

পিগমীদের প্রতি বর্ণবাদ 

পিগমীদের বর্ণনা সাহিত্য থেকে শুরু করে কোথাও খুব একটা ইতিবাচকভাবে আসেনি। অ্যারিস্টটল-হোমার থেকে শুরু করে শত বছরের পুরনো ইউরোপীয় পর্যটক হারকুফ সবার বর্ণনাতে পিগমীরা এসেছে শুধুই খর্বকায় গোষ্ঠী হিসেবে। 

Genocide
গণহত্যার শিকার পিগমী, Image Source: Pygmy Genocide WordPress.com

নিজেদের এমন আকৃতির এবং গায়ের রঙের জন্য সবসময়ই বর্ণবাদের শিকার হয়েছে এই জাতি। এমনকি তাদের নিয়ে ভিডিও গেমও তৈরি হয়েছে, যেখানে সবাই পিগমী হত্যার মাঝে আনন্দ লাভ করে।

১৯০০ সালেও বেলজিয়ামে পিগমীদের ধরে নিয়ে গিয়ে প্রদর্শনীতে দেয়া হতো। নারী পিগমীদের যৌনদাসী রাখার ইতিহাসও বেশ প্রচলিত এবং পুরনো। রোয়ান্ডা গণহত্যার সময় এক-তৃতীয়াংশ  পিগমীকে হত্যা করা হয় বলে প্রমাণ পাওয়া যায়। 

পিগমীরা পৃথিবীর আদিম অস্তিত্ব। কিন্তু আজ তাদের অস্ত্বিত্ব বিপন্নপ্রায়। শান্তিপ্রিয় পিগমীরা এখনো বনের মাঝে নিজেদের নির্ঝঞ্ঝাট জীবনেই থাকতে চায়,  কিন্তু বাহ্যিক সমস্যা তাদের এ জীবনযাপনে ব্যাঘাত ঘটাচ্ছে। বনের শান্তিপ্রিয় এ আদিবাসী গোষ্ঠী প্রতিনিয়ত অন্যায়, জুলুম, অনাচারের শিকার। এই মুহূর্তে যদি তাদের অধিকার সংরক্ষণে ব্যবস্থা নেয়া না হয়, তাদের প্রতি সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়া না হয়, তবে অতিসত্ত্বর হয়তো বিলুপ্ত হয়ে যাবে পৃথিবীর আদিমতম একটি গোষ্ঠী।

This article is in Bangla. This is about a tribal clan named 'Pygmy'. This is about their culture, lifestyle and also about how they are treated worldwide.

Sources are hyperlinked inside the article.

Featured Image Source: Geography.net

Related Articles