Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

তাণ্ডবলীলা থেকে নৃত্যের উদ্ভব

তিনি স্বয়ম্ভূ, তার প্রধান অস্ত্র ত্রিশূল। বাঘের ছাল নিম্নাংশে ধারণ করেন, ঊর্ধ্বাংশ নগ্ন। মাথায় জটা, কপালের নিম্নাংশে তৃতীয় নেত্র, ঊর্ধ্বাংশে অর্ধচন্দ্র, কণ্ঠে সাপ আর কঙ্কাল মালা। কঠোর তপস্যার মাধ্যমে অসীম ক্ষমতার অধিকারী হয়েছেন তিনি। তিনি ধ্বংসের অধিকর্তা, বিশ্বধ্বংসকারী পশুপাত অস্ত্রের অধিকর্তা। মহাপ্রলয়কালে তিনি বিষাণ ও ডমরু বাজিয়ে ধ্বংসের সূচনা করবেন। তিনি যখন ভয়ানক তখন রুদ্র, আর যখন কল্যাণকর তখন শঙ্কর। এতক্ষণ যার বর্ণনা দিলাম তিনি হিন্দু পৌরাণিক কাহিনী অনুযায়ী প্রধান তিন দেবতার অন্যতম, শিব।

দক্ষ কন্যা সতীর সাথে শিবের বিবাহ হয়। এক মহাযজ্ঞে দক্ষ স্বামীর নিন্দা করলে সতী সহ্য করতে না পেরে দেহত্যাগ করেন। স্ত্রীর মৃত্যু সংবাদে ক্রুদ্ধ মহাদেব নিজের জটা ছিন্ন করেন। তার চোখ থেকে বিপুল পরিমাণ জলরাশি নির্গত হতে থাকে। স্ত্রীর শোকে তার মৃতদেহ কাঁধে নিয়ে তাণ্ডবনৃত্য শুরু করেন মহাদেব।

স্ত্রীর দেহ কাঁধে শিব; Source: wikipedia.org

কথিত আছে, শিবের এই তাণ্ডব থেকেই নৃত্যের সৃষ্টি হয়েছে। পৌরাণিক যুগ থেকেই নৃত্য ও সঙ্গীতের সঙ্গে শিবের যোগ পাওয়া যায়। শিবের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত দুটি নৃত্যের নাম হল তাণ্ডব ও লাস্য

তাণ্ডবনৃত্য; Source: Eibela

তাণ্ডব ধ্বংসাত্মক ও পুরুষালী নৃত্য। লাস্যকে তাণ্ডবের নারীসুলভ বিকল্প নৃত্য মনে করা হয়। তাণ্ডব ও লাস্য নৃত্য যথাক্রমে ধ্বংস ও সৃষ্টির সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত।

লাস্য নৃত্য; Source: Notun Somoy

নৃত্যের ধারণা সৃষ্টির পর থেকেই বিভিন্ন কৌশল ও অনুশীলনের ফলে এর অভূতপূর্ব বিকাশ ঘটে। মিশরীয়রা তাদের ধর্মীয় অনুষ্ঠানের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসাবে নাচের প্রচলন শুরু করে। প্রাচীন গ্রিসে নাচ ছিল অপরিহার্য, যার ঐতিহ্য সংরক্ষণে পরবর্তীতে গ্রীক থিয়েটার নির্মিত হয়। ‘রেনেসাঁ’ যুগের শুরুর পর নৃত্যের অনেক নতুন শৈলী প্রবর্তিত হয় যা আধুনিক নৃত্যের প্রচলন ঘটায়।

নৃত্য

মানুষের মনের ভাব বিভিন্ন অঙ্গভঙ্গির মাধ্যমে প্রকাশ করাকে নৃত্য বলে। নৃত্য ও ভাষা কাজ করে একসূত্রে। প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনে, আচার-অনুষ্ঠানে, যুদ্ধরীতিতে এমনকি আত্মরক্ষায়ও নাচের বহুবিধ ব্যবহার পাওয়া যায়। খ্রিস্টপূর্ব ৩৩০০ সালের মিশরীয় দেয়াল চিত্রে এবং ৯০০০ বছরের প্রাচীনতম ভারতীয় গুহা চিত্রে নৃত্যকলার বিভিন্ন ভঙ্গি প্রদর্শিত রয়েছে। দেয়াল চিত্রে খোদিত সেসব ভঙ্গি থেকে এটা স্পষ্টভাবে বোঝা যায় যে, ভূতপূর্ব কিংবদন্তি কাহিনী পরিবেশনের জন্যই ঐ চিত্রগুলো খোদাই করা হয়েছিল।

প্রাচীন স্থপত্যে নৃত্যের নিদর্শন; Source: WordPress.com

লিখিত বর্ণমালা প্রচলনের আগে নৃত্যকলার মাধ্যমেই ঐতিহাসিক গল্পসমগ্র বংশ পরম্পরায় চলে আসতো। এখনও নৃত্যকলার এই ব্যবহার ব্রাজিলীয় চিরহরিৎ বনাঞ্চলের সংস্কৃতি হতে কালাহারি মরুভূমির সংস্কৃতি পর্যন্ত বিস্তৃত। ভারতীয় নৃত্যকলা হচ্ছে প্রাচীন নৃত্যকলার মধ্যে অন্যতম। খ্রিস্টপূ্র্ব প্রথম সহস্রাব্দের বহু ভারতীয় গ্রন্থে ভারতীয় নৃত্যকলার বিষয়ে বর্ণনা পাওয়া যায় যেগুলোর ভেতর নৃত্যকলার প্রধান ৮টি শৈলী উল্লেখযোগ্য।

ওড়িশি

৮টি ধ্রপদী নৃত্যশৈলীর মধ্যে অন্যতম হলো ওড়িশা রাজ্যের একটি শাস্ত্রীয় নৃত্যশৈলী, ওড়িশি। ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য উড়িষ্যার একটি হিন্দু মন্দির থেকে এই নৃত্যের উৎপত্তি বলে ধারণা পাওয়া যায়। এছাড়া খ্রিস্টপূর্ব প্রথম শতকে ‘উদয়গিরির‘ পর্বতে নির্মিত বিভিন্ন খোদাইচিত্র থেকে এই নৃত্যের প্রাচীনত্ব প্রমাণিত হয়। বিভিন্ন ধর্মীয় উপাখ্যান, আধ্যাত্মিক গল্প ও দেবদেবীর শক্তির ঐতিহ্য এ নৃত্যের মাধ্যমে প্রকাশ করা হতো। ঐতিহ্যগতভাবে ওড়িশি একটি বর্ণনামূলক নৃত্য, যেখানে শিল্পীরা পৌরাণিক কাহিনী বা প্রাচীন সংস্কৃত সাহিত্য অভিনয় ও নৃত্যের বিভিন্ন মুদ্রার মাধ্যমে প্রদর্শন করতো।

ওড়িশি নৃত্যশৈলী; Source: Kaler Kantho

কত্থক

স্বর্গের অপ্সরাদের নৃত্য হিসেবে পরিচিত কত্থক নৃত্য প্রাচীন উত্তর ভারতের যাযাবর সম্প্রদায় থেকে উদ্ভুত। কত্থক শব্দটি এসেছে বৈদিক শব্দ ‘কথা‘ থেকে, যার অর্থ গল্প। গল্পের বর্ণনায় দেবদেবীর মাহাত্ম্যাবলী পরিবেশন হলো এই নৃত্যের বিশেষত্ব। প্রধানত কৃষ্ণের জন্ম, শৈশব ও রাধা কৃষ্ণের লীলা কাহিনীই রূপায়িত হতো এই নাচের মাধ্যমে। ব্রিটিশ আমলে রাজদরবারে এই নৃত্যের অবমাননার ফলে বেশ কিছুকাল কত্থক নৃত্যের চর্চা হ্রাস পেলেও পরবর্তীতে লখনৌ এর আসাফুদ্দৌলা ও ওয়াজীদ আলী শাহ এর দরবারে কত্থক নৃত্যের পুনরায় বিকাশ ঘটে।

কত্থক নৃত্য প্রদর্শন; Source: exportersindia.com

কথাকলি

মূকাভিনয় কথাকলি নৃত্যের প্রধান বৈশিষ্ট্য। ১৭ শতকে কেরলা রাজ্যে এই নৃত্যের উদ্ভব হয়েছে বলে ধারণা পাওয়া যায়। ৩০০ বছরের প্রাচীন শাস্ত্রীয় এই কথাকলি নৃত্য গীতিনাট্য এবং মূকাভিনয়ের বিভিন্ন দিকগুলো ধারণ করে প্রদর্শিত হয়। কথাকলি নৃত্যের মধ্যে দিয়ে মহাকাব্য ও পুরাণের গাঁথা বর্ণনা করা হয় এবং ঐতিহ্যগতভাবে পুরুষেরাই এই নৃত্যশৈলী পরিবেশনা করেন। রং, প্রকাশভঙ্গীমা, মুখোশ, পোষাক, সঙ্গীত, নাটক এবং নৃত্য এই সমস্ত কলার ঐশ্বর্য সংমিশ্রণই একে অন্য নৃত্যের থেকে অতুলনীয় করে তুলেছে।

মুখোশ বেশে কথাকলি নৃত্যের প্রদর্শন; Source:Priyo.com

কুচিপুড়ি

ছন্দময় অঙ্গভঙ্গির মাধ্যমে বিশেষ মুদ্রার প্রদর্শনে মূকাভিনয় কুচিপুড়ি নৃত্যের প্রধান বৈশিষ্ট্য। ভারতের অন্ধ্র প্রদেশের কৃষ্ণা জেলায় কুচিপুড়ি ধ্রুপদী নৃত্যের উৎপত্তি হয়েছে। এছাড়া কুচিপুড়ি নৃত্যের বিকাশ সম্পর্কে উল্লেখ পাওয়া যায় যে, ১৭ শতকের  দিকে তীর্থ নারায়ণ জাতী ও তার শিষ্য সিদ্ধেন্দ্র যোগী কুচিপুড়ি নৃত্যশৈলীর মুদ্রা নিয়মাবদ্ধ করেন। অন্যান্য নৃত্যের মতো এটিও সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, মন্দির ও আধ্যাত্মিক বিশ্বাস সম্পর্কিত ধর্মীয় কলা হিসেবে বিকশিত হয়েছে। এ নৃত্যের ইতিহাসে কুচিপুড়ি নৃত্যশিল্পীরা ছিল সব পুরুষ। সাধারণত ব্রাহ্মণ, যারা উপযুক্তভাবে চরিত্র অনুযায়ী পোষাক পরে গল্পের নারী ও পুরুষ উভয়ের ভূমিকা পালন করতো। বর্তমানে নারী-পুরুষ সবাই এই নৃত্য পরিবেশন করেন।

ভরতনাট্যম

অনেকে মনে করেন, ভরত নামক মুনি এই নৃত্যের প্রবর্তন করেছিলেন বলে এই নৃত্যশৈলী ভরতনাট্যম নামে পরিচিত। তবে এই মতবাদে দ্বিমত রয়েছে। ভরতনাট্যম নৃত্য পরিবেশন করতো দেবসাদীরা। পরবর্তীতে এই নাচই দাসীআট্যম, চিন্নমেলন, ভোগমেলম, তাঞ্জোরী নামে ভারতবর্ষের বিভিন্ন এলাকায় চর্চা হয়ে এসেছে। ধীরে ধীরে ভারতবর্ষে প্রথাগত ক্রমবিবর্তনের ধারায় অভূতপূর্ব সমৃদ্ধি লাভ করেছে এই নৃত্যকলা। ভরতনাট্যম তামিলনাড়ু রাজ্যের সম্ভূতা শাস্ত্রীয় নৃত্য।

ভরতনাট্যম নৃত্যভঙ্গিমা; Source: ajkerbd24.com

মণিপুরী

ভারতের পূর্বাঞ্চলের ভারত-মায়ানমার সীমান্তে অবস্থিত মণিপুর রাজ্যের একটি ঐতিহ্যবাহী নৃত্যশৈলী মণিপুরী নৃত্য। কথিত আছে, রাজা ভাগ্যচন্দ্র স্বপ্নাদেশে এই নৃত্যের পোশাকের নির্দেশ পেয়েছিলেন। এই পোশাকের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো জড়ি জড়ানো মাথার চূড়া এবং মুখের উপর পাতলা জালের মতো সাদা কাপড়ের আবরণ, একে মাইখুম বলে। ঘাঘরার নিম্নভাগে কাপড়ের ভিতর বেত দিয়ে শক্ত করা থাকে। ঘাঘরার এই পরিবেশনকে ‘কুমিন‘ বলে। ১৯১৯ সালে সিলেটের মাছিমপুর গ্রামে মণিপুরদের পরিবেশিত এই রাসনৃত্য দেখে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বিমোহিত হন এবং ঐতিহ্যবাহী এই নৃত্যকে তিনি বিশ্ব দরবারে তুলে আনেন শান্তিনিকেতনে মণিপুর নৃত্য প্রবর্তনের মাধ্যমে।

মণিপুর রাজ্যের ঐতিহ্যবাহী নৃত্যশৈলী; Source: WordPress.com

মোহিনীঅট্টম

মোহিনীঅট্টম দক্ষিণ ভারতের কেরলা রাজ্যের একটি নৃত্যশৈলী। ‘মোহিনীঅট্টম‘  শব্দটি বিশ্লেষণ করলে মোহিনী ও অট্টম শব্দ দুটি পাওয়া যায়। মোহিনী অর্থ ‘মোহনীয় নারী’ আর অট্টম অর্থ ‘কামনীয় দেহ ভঙ্গিমা’, অর্থাৎ মোহিনীঅট্টম নৃত্যের আক্ষরিক অর্থ ‘মুগ্ধকারিনীর নৃত্য’। মোহিনীঅট্টম নৃত্যের চর্চা ও বিকাশ হয়েছিল তাঞ্জাভুর চতুষ্টকের ভাদিভেলুর রাজা স্বাতী তিরুনলের রাজসভায়। মোহিনীঅট্টমে চল্লিশটি পৃথক মৌলিক ভঙ্গিমা রয়েছে। এগুলোকে একত্রে ‘অটভুকল’ বলা হয়।

মোহিনীঅট্টম নৃত্যের একটি অঙ্গভঙ্গি; Source: WordPress.com

সত্ৰীয়া

সত্ৰীয়া নৃত্যের ‘সত্ৰীয়া’ শব্দটি ‘সত্ৰ’ থেকে এসেছে। আনুমানিক প্রায় ১৫ শতকে মহাপুরুষ শ্রীমন্ত শংকরদেব প্রতিষ্ঠিত এই নৃত্য আসামে খ্যাতি লাভ করে। পরম্পরাগতভাবে এ নৃত্য শুধুমাত্র পুরুষের উপবেশনায় সীমিত ছিল। তবে বর্তমানে এ নৃত্যে নারীশিল্পীর দক্ষতারও প্রমাণ মেলে। ২০০০ সালের ১৫ই নভেম্বর সত্রীয়া নৃত্যকে ভারতবর্ষের অন্যতম নৃত্যশৈলীর মর্যাদা দেওয়া হয়।

সত্রীয়া নৃত্য পরিবেশনে পুরুষ শিল্পী; Source: printerest

সময়ের ক্রমবিবর্তনে নৃত্যশিল্প অভূতপূর্ব বিকাশ লাভ করেছে। বর্তমানে নৃত্য গুটিকয়েক শ্রেণীতে সীমাবদ্ধ নেই। আধুনিক নৃত্যে ব্যালে, মোশিং, সাম্বা প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য অবদান রাখে আমাদের সংস্কৃতি ও বিনোদনে। এর মাঝে উপজাতীয় নৃত্যও নিজ মহিমায় জায়গা করে নিয়েছে এখনকার মানুষের হৃদয়ে। নৃত্য এমন একটি শিল্প যার নির্দিষ্ট ভাষার প্রয়োজন হয় না। মানব ইতিহাসের প্রাচীনতম মূহুর্ত থেকে নৃত্য সামাজিক মিলানায়তন, ধর্মানুষ্ঠান, আনন্দ, কর্মদক্ষতা এবং বিনোদনের অভিব্যক্তি প্রকাশের মাধ্যম হিসেবে আমাদের অস্তিত্বে মিশে রয়েছে।

ফিচার ইমেজ- blogger

Related Articles