“এক হারিয়ে যাওয়া বন্ধুর সাথে সকাল বিকেল বেলা
কত পুরনো নতুন পরিচিত গান গাইতাম খুলে গলা
কত এলোমেলো পথ হেঁটেছি দু’জনে হাত ছিল না তো হাতে
ছিল যে যার জীবনে দু’টো মন ছিল জড়াজড়ি একসাথে”
কথাগুলোতে না আছে শব্দের নতুনত্ব, আর না আছে বাক্যের জটিলতা। খুব সহজ ভাষায় সরলভাবে হৃদয় স্পর্শ করা এমনই অনেক গানের স্রষ্টা ফারজানা ওয়াহিদ সায়ান। তবে গান দিয়ে পরিচিতি পাওয়া মানুষটি সবখানে সায়ান নামেই পরিচিত। জন্ম ১৯৭৬ সালের ২রা সেপ্টেম্বর কানাডার মন্ট্রিলে। মাত্র সাতমাস বয়সেই বাবা-মায়ের সাথে ফিরে আসেন বাংলাদেশে। তারপর বেড়ে ওঠা ঢাকাতেই। সায়ানের বাবা মো: খসরু ওয়াহিদ আধুনিক বাংলা গানের সাথে যুক্ত ছিলেন। অন্যদিকে মা নাজমা বানু সঙ্গীত ভুবনের সাথে সরাসরি জড়িত না থাকলেও ছিলেন আত্মিকভাবে। মাত্র পাঁচ বছর বয়সে বাবা-মায়ের বিবাহবিচ্ছেদ দেখা জীবনের অভিজ্ঞতাকে ভিন্নদিকে প্রবাহিত করলেও মায়ের একান্ত প্রচেষ্টা এবং স্নেহময় ভালোবাসা জীবনকে ইতিবাচকভাবে দেখার ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে।
সঙ্গীতের ওপর প্রাতিষ্ঠানিক কোনো শিক্ষা না থাকলেও ছোটবেলা থেকেই ঘরোয়াভাবে সাংস্কৃতিক পরিবেশের মাঝে বেড়ে ওঠা সায়ানের জীবন ও মনোজগতকে অনেকটা প্রভাবিত করে। দাদা ওয়াহিদ উদ্দিন আহমদ ছিলেন শিল্প, কলা ও সংস্কৃতির একজন নিবেদিত প্রাণ এবং তারই ছত্রছায়ায় ১০/১২ বছর বয়স থেকেই গানের সাথে পথচলার শুরু তার। তবে গান লেখার শুরুটা বেশ মজার ঘটনা দিয়ে। ১৪ বছর বয়স তখন সায়ানের। সবচেয়ে কাছের বান্ধবী যার প্রেমে পড়েছিল, সে গান লিখতে পারতো। মনে ধারণা জন্ম নিলো, বান্ধবীটি দূরে চলে যাচ্ছে। তাই নিজেও শুরু করলো গান লেখা। ঐ থেকেই শুরু। পরবর্তী পাঁচ/ছয় বছর কেটেছে প্রেমের গান লিখেই।
১৯৯৭ সালে ২১ বছর বয়সে মনোবিজ্ঞান বিষয়ে উচ্চশিক্ষা গ্রহণের জন্যে পাড়ি জমান কানাডার টরেন্টোতে। কিন্তু সেখানে কোর্স শেষ না করেই ২০০১ সালে ফিরে আসেন বাংলাদেশে। ২০০৪ সালে বিয়ে করেন মীর মুবাশ্বির আহমেদকে। ২০১২ সালে বিবাহবিচ্ছেদের মধ্য দিয়ে দীর্ঘ আট বছরের বৈবাহিক জীবনের সমাপ্তি ঘটে। সায়ানের কোনো সন্তান নেই।
আশির দশকে চাচা ফেরদৌস ওয়াহিদ এবং বর্তমান সময়ে চাচাতো ভাই হাবিব ওয়াহিদ দেশের সঙ্গীত জগতের অন্যতম প্রধান শিল্পী হলেও নিজের জন্যে সম্পূর্ণ ভিন্ন ধারার পথকেই বেছে নিয়েছেন তিনি। তথাকথিত গানের ধারা থেকে ভিন্ন বক্তব্যকেন্দ্রিক এ গানকে জীবনমুখী গান বলে আখ্যায়িত করতেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন সায়ান। প্রতিটি গানের রচনা থেকে শুরু করে তাতে সুর দেয়া এবং গায়কীতে নিজেই থাকেন সায়ান। সায়ানের মতে নিজের অভিজ্ঞতা থেকে দেখা পৃথিবীকেই গানে ফুটিয়ে তোলেন তিনি। এমনকি জীবনে কখনো একই গান হুবহু দ্বিতীয়বার গাননি বলেও দাবি তার। স্বতস্ফূর্তভাবেই সৃষ্টি তার লেখা গানগুলোর। মনোযোগী শ্রোতা মাত্রই বুঝতে পারবেন বক্তব্যের জটিলতা না, নয় কোনো গুরুগম্ভীর ভাষণ- শুধুই নিজের উপলব্ধিগুলোকে উপজীব্য করে রচনা তার গানের। সেখানে গভীর জীবনবোধ নেই বলাটা যেমন দুঃসাহসিক হবে, তেমনি হবে ভুল। তবে গভীরতাকে সহজে বলার ক্ষমতাই তাঁর গানকে করেছে অনন্য এবং গড়ে উঠেছে তার গান শোনার ভিন্ন এক শ্রোতাশ্রেণি।
২০০৮ সালে একুশে টিভিতে ফোনো লাইভ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে বাংলাদেশের মানুষ সায়ান সম্পর্কে প্রথম জানতে পারে। পরবর্তী সময়ে গানের অ্যালবাম প্রকাশের মধ্য দিয়ে সঙ্গীতে পথচলার শুরু সায়ানের। তবে সহজ ছিল না সে পথচলা। ১৯৯৭ থেকে ২০০১ পর্যন্ত কানাডায় থাকা অবস্থায় অনেকটা নিজের আনন্দেই গান করতেন তিনি। এ সময় সেখানে অবস্থানরত বাঙালিদের বিভিন্ন অনুষ্ঠানেও গান করেন তিনি। গানের প্রশংসার পাশাপাশি অ্যালবাম প্রকাশের জন্যে প্রেরণাও দেন অনেকে। বাংলাদেশে ফিরে সেই অনুপ্রেরণা অনেকটা সাহায্য করে নতুন জীবনে পাড়ি জমাতে। তবে সেখানেও ছিল বাধা। তথাকথিত বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলো নতুন ধারার এ গানকে বাংলাদেশে পরিচয় করাতে ব্যবসায়িক ঝুঁকি নেবার জন্যে রাজি ছিল না। এ সময় পরিবার ও বন্ধুরা পাশে দাঁড়ায় সায়ানের। তাদের উদ্যোগে গড়ে তোলা সঙ্গীত কোম্পানি ‘গানপোকা’ থেকে ২০০৮ সালে সায়ানের প্রথম গানের অ্যালবাম ‘সায়ানের গান’ প্রকাশিত হয়। তার দ্বিতীয় দ্বৈত অ্যালবাম ‘আবার তাকিয়ে দেখ’ এবং ‘স্বপ্ন আমার হাত ধরো’ ২০০৯ সালে প্রকাশিত হয়। কিন্তু পরবর্তী সময় বিভিন্ন মানবাধিকার কাজের সাথে যুক্ত হয়ে পড়ায় অ্যালবাম প্রকাশে উদাসিনতা দেখা যায়। এরপর ‘জাস্ট ওয়াহিদ’ নামে ভাই এরশাদ ওয়াহিদ ও হাবিব ওয়াহিদের সাথে একটি মিশ্র অ্যালবাম প্রকাশ করেন তিনি। ২০১৭ সালে ঈগল মিউজিক থেকে প্রকাশিত হয় তার সর্বশেষ গানের অ্যালবাম ‘কিছু বলো’।
জীবনকে প্রথম শিক্ষক মানা সায়ানের গানের জগতকে দেশী-বিদেশী অনেক খ্যাতিমান সংগীতজ্ঞ প্রভাবিত করেছেন। এদের মাঝে শাহনাজ রহমতউল্লাহ, লতা মুঙ্গেশকার, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, বব ডিলান, ট্রেসি চ্যাপম্যান এবং লিওনার্ড কোহেন বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
‘প্রতিবাদী গান’ কিংবা ‘জীবনমুখী গান’, যা-ই বলা হোক না কেন, তার সবটাতেই সায়ানের ব্যক্তিক দর্শন ফুটে ওঠে। ‘আমি তাজ্জব বনে যাই’, ‘এক হারিয়ে যাওয়া বন্ধুর সাথে’, ‘এখানেই সুখ ছিল একদিন’, ‘জনতার বেয়াদবী’, ‘ও নেতা ভাই’ ‘দু-চোখ দিয়েই দেখো’- সহ প্রতিটি গানে জীবনকে দেখা ও জীবন থেকে নেয়া প্রাত্যাহিক ঘটনা কিংবা অনুভূতিগুলোকে উপজীব্য করে গান রচনা করেছেন সায়ান। কখনো সেখানে থাকে এক সময়ের সংসারে হারিয়ে যাওয়া সুখের কথা, কখনো বা অপ্রয়োজনীয় তর্কে অযথা সময় নষ্ট করে প্রতিভা ও সৃজনশীলতাকে ভাগ করে অলস মস্তিষ্কের তীক্ষ্ণ সমালোচনা।
‘আমি তাজ্জব বনে যাই দেখি মানুষ পেল না ঠাঁই
দেখো মানুষের ঘরে বাসা বেঁধে নিলো ছোট্ট এক চড়াই’
মানুষ হয়েও মানুষ হিসেবে ন্যূনতম অধিকার না পাওয়া অবহেলিত মানুষের কথা যেমন আছে তার গানে, তেমনি আছে সংঘবদ্ধ হয়ে অধিকারের লড়াইয়ে নামার আহ্বান। শুধু বাস্তবতার নিরীখে আলাপ করেই ক্ষান্ত হননি সায়ান, একইসাথে কোনো একদিন সে বৈষম্যের বিনাশ হবে বলে আশাবাদও ব্যক্ত করেছেন। ব্যক্তিগত মনোজাগতিক যাতনা থেকে শুরু করে সমসাময়িক রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে নেতাদের অপ্রাসঙ্গিক ও অনর্থক গলাবাজির তীর্যক সমালোচনা সবই আছে সায়ানের গানে।
পরিধেয়তেও সায়ানের বিশেষত্ব তাকে আলাদা করে অন্যদের থেকে। সায়ানকে সবসময়ই দেখা যায় কালো শার্ট ও প্যান্টে। অবশ্য পাশ্চাত্য ঘরানার পোশাকের সাথে ছোট করে দেয়া চুলের ছাঁট অনেককেই ভাবায় বর্তমান সমাজ ব্যবস্থাকে চ্যালেঞ্জ করা কিংবা পুরুষের সমান হতে চাওয়ার সুপ্ত বাসনাই প্রকাশ পায় সায়ানের বাহ্যিকতায়। কিন্তু নিজের পরিধেয়ের ব্যাখ্যা নিজেই দিয়েছেন তিনি। কোনো একটি বিশেষ লিঙ্গের সমান হতে চাওয়া কিংবা পাশ্চাত্য ঘরানার পোশাকের প্রতি আসক্তি নয়, বরং নিজের স্বাচ্ছন্দ্য ও রুচির জায়গা থেকেই পোশাক পড়তে পছন্দ করেন সায়ান। এক্ষেত্রে তার বক্তব্য পোশাকের প্রথম ও প্রধান কাজ শরীর ঢাকা। আর তাই এ ব্যাপারে বিশেষ মনোযোগ দেয়াকে সময় অপচয় হিসেবে মনে করা সায়ান পোশাককে শুধু শালীনতা রক্ষার জন্যেই ব্যবহারকে পর্যাপ্ত মনে করেন।
ক্যারিয়ারের প্রথম থেকেই সায়ান বিভিন্ন ধরনের মানবাধিকার প্রতিষ্ঠানের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করে চলেছেন। সঙ্গীত ও আইনী অভিজ্ঞতার মাধ্যমে সমাজকে ইতিবাচকভাবে পরিবর্তনের জন্যে কাজ করে যাচ্ছেন তিনি। আর সায়ান জানেন, এ পথচলায় চড়াই-উৎরাই পার করে একদিন তাকে স্বাভাবিক সত্য মৃত্যুর নিকটবর্তী হতেই হবে। নশ্বর দেহ জীবনের সাথেই হারিয়ে গেলেও মানুষের জন্যে করে যাওয়া গান ও সে গানের মাঝে নিজ দর্শনই সায়ানকে বাঁচিয়ে রাখবে মৃত্যুর পরও।
This article is a about a Bangladesi singer named Farzana Wahid Shayan.
All necessary sources are hyperlinked below:
https://www.revolvy.com/page/Farzana-Wahid-Shayan
https://www.thedailystar.net/hello-i-am-nobody-52527
https://www.musophia.com/shayan-stories-of-life-become-her-songs/
https://www.last.fm/music/Shayan/+wiki
Featured Image Source: Youtube