Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

সকুশিনবাতসু: বৌদ্ধ সন্ন্যাসীদের নিজেই নিজেকে মমিতে পরিণত করার অদ্ভুত এক প্রক্রিয়া

এশিয়া মহাদেশের নানা দেশে যখন ধীরে ধীরে বৌদ্ধ ধর্ম ছড়িয়ে পড়ছিল, ঠিক তখনই স্থানীয় নানা সংস্কৃতির সংস্পর্শে এসে বিভিন্ন স্থানে বৌদ্ধ ধর্মের নানা মতবাদ ও চর্চার শুরু হয়। কিছু কিছু মতবাদ অনুসারে, বৌদ্ধ সন্ন্যাসীরা গৌতম বুদ্ধের আদর্শ মেনে নানা আচার আচরণ পালন করতেন। আবার কিছু কিছু মতবাদ অনুসারী বৌদ্ধ সন্ন্যাসীরা নানা রকম বিচিত্র আচার আচরণের চর্চা করতেন।

এসব অদ্ভুত চর্চার মধ্যে সকুশিনবাতসু ছিল অন্যতম। সকুশিনবাতসু হলো কঠোর সংযমের মাধ্যমে নিজেই নিজেকে মমিতে পরিণত করে চূড়ান্ত মোক্ষলাভের এক অদ্ভুত প্রক্রিয়া। এ পদ্ধতির মাধ্যমে বৌদ্ধ সন্ন্যাসীরা নিজেরাই নিজেদের ধীরে ধীরে মমিতে পরিণত করতেন। তবে আমরা সাধারণত মমি বলতে মিশরীয় পিরামিডে নানা দ্রব্যাদি দিয়ে সংরক্ষিত যে মমি বুঝি, তা থেকে এটি কিছুটা আলাদা। চলুন আজকে এই অদ্ভুত প্রক্রিয়া সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে নিই।

নিজেই নিজেকে মমিতে পরিণত করার এই অদ্ভুত প্রক্রিয়া প্রথম দেখতে পাওয়া যায় জাপানের উত্তরের ইয়ামাগাটা অঞ্চলে। একাদশ শতাব্দীতে শুরু হওয়া এই প্রক্রিয়া চালু ছিল ঊনবিংশ শতাব্দী পর্যন্ত। এরপর জাপান সরকার এই প্রক্রিয়াকে একধরনের আত্মহত্যা হিসাবে ঘোষণা দেয় এবং এই চর্চা নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। তবে এখনো এই চর্চার বহু অনুসারী রয়েছে পৃথিবীর বহু স্থানে।

কোয়া পর্বতে ধ্যানরত অবস্থায় কুকাই; Source: smallbrushfetish.com

এ চর্চা সর্বপ্রথম শুরু করেন কুকাই নামের এক বৌদ্ধ সন্ন্যাসী। নানা গুণে গুণান্বিত ছিলেন এই কুকাই। একাধারে সরকারি চাকুরে, শিল্পী, কবি, বৌদ্ধ সন্ন্যাসী এবং শিনগন নামের ক্ষুদ্র এক বৌদ্ধ ধর্ম গোষ্ঠীর প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন তিনি। বৌদ্ধ ধর্ম, প্রাচীন শিন্তো ধর্ম, তাওবাদ সহ নানা ধর্মের মিশ্রণে তিনি শিনগন নামের ধর্মীয় মতবাদ প্রতিষ্ঠা করেন।

কুকাই ও তার শিষ্যগণ ‘শুগেন্ডো’ দর্শন মেনে চলতেন। এই দর্শনের মূল ভিত্তি হলো কঠিন নিয়মানুবর্তিতা ও আত্মত্যাগের মাধ্যমে আধ্যাত্মিক ক্ষমতা লাভ করা। জীবনের শেষের দিকে তিনি সকল খাদ্য ও পানীয় গ্রহণ করা বন্ধ করে দেন এবং গভীর ধ্যানে ধ্যানমগ্ন হন। ফলে ধীরে ধীরে স্বেচ্ছামৃত্যু হয় তার। এরপর তার মৃতদেহ ওয়াকায়ামা প্রদেশের কোয়া পর্বতের এক সমাধিতে সমাধিস্থ করা হয়। এর কিছুকাল পরে তার সমাধি খোলা হলে দেখা যায় তিনি যেন গভীর এক ঘুমে ঘুমিয়ে আছেন। তার চেহারার কোনো পরিবর্তন হয়নি, তার চুলগুলোও ছিল বহাল তবিয়তে। আর এই ঘটনার পর থেকেই সকুশিনবাতসু প্রক্রিয়া চালু হয় ও শিনগন ধর্মগোষ্ঠীর বহু অনুসারী এটির চর্চা শুরু করেন। তাদের কাছে পদ্ধতিটি আত্মহত্যা নয়, বরং আত্মতৃপ্তি ও মোক্ষলাভের উপায় হিসাবে প্রচলিত হয়।

জাপানের কোয়া পর্বত; Source: boutiquejapan.com

নিজেই নিজেকে মমিতে পরিণত করার জন্য একজন সন্ন্যাসীকে খুবই কঠিন ও যন্ত্রণাময় এক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হতো। এই প্রক্রিয়ার শুরুতে প্রথম ১,০০০ দিন একজন সন্ন্যাসী সকল স্বাভাবিক খাবার গ্রহণ বন্ধ করে দিতেন। এসময় তিনি শুধু আশেপাশের বন থেকে সংগ্রহ করা নানা প্রকার বীজ, বাদাম ও ক্ষুদ্র ফলমূল গ্রহণ করতেন। এই খাদ্যাভ্যাসকে বলা হতো ‘মকুজিকিগিও’। এই কঠিন খাদ্যাভ্যাসের ফলে দুটি কাজ হতো। প্রথমত, এই খাদ্যাভ্যাসের ফলে সন্ন্যাসীর দেহ থেকে চর্বি ও পেশী ক্ষয় হতে শুরু করতো ও দেহ মমিতে পরিণত হওয়ার প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করতো। দ্বিতীয়ত, এই খাদ্যাভ্যাসের ফলে ভবিষ্যতে দেহের পচন প্রক্রিয়া ঘটানো ব্যাকটেরিয়াদের খাদ্যের যোগান বন্ধ হয়ে যেত।

সকুশিনবাতসুর মাধ্যমে মমিতে পরিণত হওয়া এক সন্ন্যাসী; Source: amazonews.com

এই খাদ্যাভ্যাস চলতো ১,০০০ দিন পর্যন্ত। এ সময় সন্ন্যাসী নানা ব্যায়াম ও শারীরিক পরিশ্রমের মাধ্যমে দেহের মেদ যথাসম্ভব কমিয়ে ফেলতেন। এরপরও কোনো সন্ন্যাসী যদি মনে করতেন যে, তিনি সকুশিনবাতসুর পরবর্তী ধাপের জন্য এখনো প্রস্তুত নন, তবে তিনি পুনরায় ১,০০০ দিন এই একই খাদ্যাভ্যাস চালু রাখতেন। তবে এসময় তারা শুধু গাছের ছাল ও শেকড় খেতেন। এই ধাপের শেষ পর্যায়ে এসে তারা উরুশি গাছের রস দিয়ে তৈরি একধরনের চা পান করা শুরু করতেন। উরুশি গাছের রস খুবই বিষাক্ত। এই গাছের রস সেসময় আসবাবপত্রের বার্নিশ হিসেবে ব্যবহার করা হতো। বিষাক্ত এই চা পান করার ফলে সন্ন্যাসীরা ক্রমাগত বমি করতেন। ফলে তাদের দেহ থেকে দ্রুত দেহের জলীয় অংশ বেরিয়ে যেত। এছাড়াও এই বিষাক্ত চা দেহের ভেতরের সকল ব্যাকটেরিয়া ও পচনে সাহায্যকারী কীটদের মেরে ফেলতো। সেই সাথে এটি ভবিষ্যতে দেহের পচনরোধক হিসেবে কাজ করতো।

কানসুজি মন্দিরে সংরক্ষিত একটি মমি; Source: darksideofhistory.com

এই ধাপের শেষ পর্যায়ে সন্ন্যাসীকে তার দেহের থেকে সামান্য বড় এক পাথরের সমাধিতে ঢুকিয়ে মাটির প্রায় ১০ ফুট নিচে সমাধিস্থ করা হতো। সংকীর্ণ সেই পাথরের সমাধিতে সন্ন্যাসী পদ্মাসনে বসতেন, যাতে ভবিষ্যতে আর নড়াচড়া করা না যায়। মাটির নিচের এই সমাধিটিতে একটি বাঁশের নল বায়ুচলাচলের জন্য যুক্ত করে দেওয়া হতো যাতে সন্ন্যাসী শ্বাস নিতে পারেন। সেই সাথে তার কাছে ছোট্ট একটি ঘণ্টাও দিয়ে দেওয়া হতো। এরপর সমস্ত সমাধিটিকে ভালোভাবে বন্ধ করে করে দেওয়া হতো। এর পরবর্তী দিনগুলোতে সন্ন্যাসী মাটির নিচের অন্ধকার সমাধিতে ধ্যানমগ্ন থাকতেন ও প্রতিদিন হাতের ঘণ্টাটি বাজাতেন। এই ঘণ্টা বাজিয়ে তিনি জানান দিতেন, “তোমরা শুনছো? আমি এখনো বেঁচে আছি!” যতদিন সন্ন্যাসী বেঁচে থাকতেন, ততদিন ঘণ্টার আওয়াজ পাওয়া যেত। এরপর কোনো একদিন ঘণ্টার আওয়াজ আর শুনতে পাওয়া না গেলে ধরে নেওয়া হতো সন্ন্যাসী মারা গেছেন। তখন বায়ু চলাচলের সেই বাঁশের নলটি সরিয়ে নিয়ে সমাধিটি সম্পূর্ণ রূপে বন্ধ করে দেওয়া হতো এবং পরবর্তী ১,০০০ দিন এভাবে রেখে দেওয়া হতো।

মাটির নিচে সমাধিতে মৃত্যুর অপেক্ষায় থাকতেন সন্ন্যাসী; Source: damnintersting.com

১,০০০ দিন পর সমাধিটি খুলে দেখা হতো সন্ন্যাসী নিজেকে মমিতে পরিণত করতে সক্ষম হয়েছেন কিনা। সন্ন্যাসীর দেহটি যদি পচনহীন সংরক্ষিত অবস্থায় পাওয়া যেত, তবে ধরে নেওয়া হতো তিনি এই প্রক্রিয়ায় সফল হয়েছেন। তখন তাকে বুদ্ধের সমমর্যাদা দেওয়া হতো এবং তার দেহ সমাধি থেকে বের করে দামি আলখাল্লা পরিয়ে মন্দিরে নিয়ে যাওয়া হতো। মন্দিরে তাকে উচ্চস্থানে রাখা হতো এবং সেখানে তার অনুসারীরা তার পূজার্চনা করতেন।

সমাধির মধ্যে সন্ন্যাসীর দেহ পচে গেলে তার দৃঢ় সংযমের প্রতি শ্রদ্ধা জানানো হতো এবং তার সমাধির মুখ আবার বন্ধ করে দেওয়া হতো। তবে তাকে পূজা করা হতো না। বিভিন্ন সূত্রানুসারে জানা যায়, এ পর্যন্ত প্রায় ২৮ জন সন্ন্যাসী এই সকুশিনবাতসু প্রক্রিয়ায় সফল হয়েছেন। আবার কারো কারো মতে, আরো অনেকেই এ প্রক্রিয়ায় সফল হয়েছিলেন, তবে তাদের দেহ হারিয়ে গিয়েছে কালের গহ্বরে।

জাপানের নানা মন্দিরে এই সকুশিনবাতসু প্রক্রিয়ার নিজেই নিজেকে মমিতে পরিণত করা সন্ন্যাসীদের দেহ দেখতে পাওয়া যায়। সর্বশেষ ঊনবিংশ শতাব্দীতে যিনি সকুশিনবাতসু লাভ করেছিলেন তিনি সরকারি আইন অমান্য করে এই প্রক্রিয়ায় অংশ নেন। মোক্ষলাভের আশায় সর্বশেষ সকুশিনবাতসু পালন করা এই সন্ন্যাসীর নাম ছিল বুক্কাই। তিনি ১৯০৩ সালে মৃত্যুবরণ করেন। তার মৃত্যুর পর তাকে ‘পাগল’ ঘোষিত দেওয়া হয় এবং বহু বছর পর্যন্ত তার সমাধির খোঁজ করেনি কেউ। এরপর ১৯৬০ সালে একদল গবেষক তার সমাধি খুঁজে বের করেন এবং খুবই চমৎকারভাবে সংরক্ষিত অবস্থায় তার দেহটি দেখতে পান।

এক বৌদ্ধমন্দিরে সংরক্ষিত সন্ন্যাসীর মমি; Source: pinterest.com

বর্তমানে সকুশিনবাতসু চর্চা হারিয়ে গেছে পৃথিবী থেকে। তবে এখনও অসীম আগ্রহ নিয়ে দূরদূরান্ত থেকে মানুষ অদ্ভুত সেই সন্ন্যাসীদের মমি দেখতে আসেন জাপানে। প্রাচীন সেসব মন্দিরে রাখা কাচের বাক্সের ওপারের সন্ন্যাসীর দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে হয়তো তারা বুঝতে চেষ্টা করেন জীবনের মানে।

ফিচার ইমেজ – pinterest.com

Related Articles