Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

স্বস্তিকা: একটি প্রতীকের জীবনচরিত

ভার্সাই চুক্তির মধ্য দিয়ে যেভাবে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে সমাপ্তি টানা হলো, তাতে অনেকেই ভেবেছে- গল্পের শেষ হচ্ছে না এখানেই, জার্মানির গলায় এই অপমানের বোঝা চাপিয়ে দেওয়ার অশুভ পরিণাম প্রত্যক্ষ হতে পারে আসন্নকালে। সন্দেহটা শীঘ্রই সত্য প্রমাণিত হলো।

প্রতিশোধে ক্রোধান্ধ জার্মানি জন্ম দিলো একজন দেবতা, মতান্তরে একজন অসুরের। তার তাণ্ডবেই আরো একবারের জন্য দুমড়ে মুচড়ে গেল ইউরোপ। তিনি অ্যাডলফ হিটলার। ছিপছিপে দেহ, সরু গোঁফ আর অদ্ভুত এক প্রতীক খঁচিত টুপি। প্রতীকটা প্রতিপক্ষের জন্য রীতিমত দুঃস্বপ্ন। নাম স্বস্তিকা। 

একজন হিটলার এবং হাতে স্বস্তিকা চিহ্ন; image source: independent.ie

হাল আমলে স্বস্তিকা চিহ্নের মানেই ফ্যাসিবাদ। আর গণহত্যা মানেই নাৎসিবাহিনীর পতাকা। লাল জমিনের মধ্যে সাদা বৃত্ত, মাঝখানে কালো রঙে বাহু মেলে রাখা যোগ চিহ্ন, পতাকার ঠিক মাঝখানে স্থিত এই চিহ্নই স্বস্তিকা।

বিশ শতকের সবচেয়ে ঘৃণিত প্রতীকও বটে। ইহুদিদের কাছে তা অত্যাচার, নির্যাতন আর দুর্ভাগ্যের প্রতিশব্দ। হলোকাস্ট থেকে ফিরে আসার পর ফ্রেডি নোলারের স্বীকারোক্তি ছিল-

অন্তত স্বস্তিকা আমাদের স্মৃতি থেকে কোনোদিন ম্লান হবে না। সত্যিকারের অশুভ আর দুর্ভাগ্যের প্রতীক হিসেবে বয়ে বেড়াতে হবে গোটা জীবন।

আদতে শুধু ইহুদি নয়। মানব ইতিহাসের নৃশংসতম ঘটনার স্বাক্ষর এই চিহ্ন। যেন স্বয়ং হিটলার। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরেই জার্মানি নিষিদ্ধ করে দেয় প্রতীকটিকে। অথচ মানুষের সাথে তার সম্পর্কের গল্প অন্যরকম।

প্রায় প্রতিটি সংস্কৃতিতে তার ঠাঁই ছিল ভালোবাসায়। পরিগণিত হতো সৌভাগ্যের রূপায়ণ হিসেবে। চীনা সংস্কৃতিতে এর নাম ওয়ান। ব্রিটিশদের কাছে পরিচিত ছিল ফাইলফোট হিসেবে। জার্মান সাংস্কৃতিতে হাকানক্রাজ এবং গ্রীসে গাম্যাডিয়ন বলে সমাদৃত।

স্বস্তিকা

সংস্কৃত শব্দ স্বস্তিকা। সাধারণ অর্থে কল্যাণ বা মঙ্গল। তাৎপর্য উদ্ধার করতে গিয়ে হাবুডুবু খান পণ্ডিতেরা। কারণ শব্দ থেকে শব্দ অনুবাদ করা গেলেও ভাব থেকে শব্দে, কিংবা ভাব থেকে ভাবে অনুবাদ করা কঠিন। যেহেতু সূর্য নিজেই সৌভাগ্য, সৃষ্টি এবং জীবনের প্রতীক, তাই সূর্যদেবতার সাথে স্বস্তিকার একধরনের সম্পর্ক টানতে চেয়েছেন অনেকেই। তবে সকল দিক এবং মত অনুসারেই স্বস্তিকা শুভের চিহ্ন। হাজার বছর ধরে হিন্দু, বৌদ্ধ এবং জৈন ধর্মের অনুসারীদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে রেখেছে প্রতীকটি। 

বিভিন্ন প্রকার স্বস্তিকার দেখা মেলে বিভিন্ন সংস্কৃতিতে; Image source: Wikipedia

সনাতনমতে দাবি করা হয়, এর চার বাহু মূলত চারদিকে পর্যবেক্ষণরত  চার মস্তকধারী পরমস্রষ্টা ব্রহ্মাকে নির্দেশ করে। কেন্দ্রে মিলিত হওয়া চারটি বাহু দ্বারা বোঝায়- সৃষ্টিজগত এভাবেই পরম স্রষ্টার সাথে সংযুক্ত।

আবার বাহুগুলো ঘড়ির কাঁটা অভিমুখে থাকলে ধনাত্মক স্বস্তিকা এবং বিপরীতে থাকলে ঋণাত্মক স্বস্তিকা হিসেবে মানা হয়। সেক্ষেত্রে ধনাত্মক স্বস্তিকা বিষ্ণু এবং সূর্যকে প্রকাশ করে। ঋণাত্মক স্বস্তিকা প্রতিনিধিত্ব করে কালী এবং অলৌকিকতার।

ভারত ছাপিয়ে গোটা এশিয়ার প্রাচীন সংস্কৃতিতেই প্রতীকটি প্রবলভাবে অস্তিমান। পশ্চিমের পর্যটকেরা প্রাচ্য ভ্রমণে এসে অনেক কিছু নিয়ে ফিরেছে ঘরে। ধারণা করা হয়, সেই ‘অনেক কিছু’র তালিকায় ছিল স্বস্তিকাও। 

প্রস্তর যুগে

ইউক্রেনের কিয়েভের জাতীয় জাদুঘরে সংরক্ষিত আছে হাতির দাঁত দিয়ে নির্মিত একটি পাখিমূর্তি। স্বস্তিকা চিহ্ন খোদাইকৃত রয়েছে এর গায়ে। বিস্ময়কর ব্যাপার হলো, রাশিয়ার সীমান্তবর্তী এলাকায় প্রাপ্ত এই পাখিমূর্তির বয়স পাঁচশ’ কিংবা এক হাজার বছর নয়, অন্তত ১৫ হাজার বছর! 

মানুষ ততদিনে শিকার ছেড়ে কৃষিতে থিতু হয়েছিল, ভূমির উর্বরতার প্রতি বেড়েছিল দুর্বলতা। ফলে সে সময়ে স্বস্তিকাকে উর্বরতার প্রতীক হিসাবে গণ্য করা হতো- এমনটা দাবি খুব একটা অমূলক নয়।

খ্রিষ্টের জন্মের সাত হাজার বছর আগেরও এই চিহ্নের নিদর্শন পাওয়া গেছে। কিয়েভের জাদুঘরেই স্বস্তিকা চিহ্ন সম্বলিত একটি চার হাজার বছরের পুরনো মাটির পাত্রও আছে।

স্বস্তিকার আদি নিদর্শন ইউক্রেনের জাদুঘরে রক্ষিত; Image Source: bbc.com

প্রাচীন গ্রীসে

খ্রিষ্টপূর্ব ৭০০ সালের গ্রীস। অদ্ভুতভাবে তারাও স্বস্তিকার ব্যাপারে বেশ ভালোই জানতো। পিথাগোরাস স্বস্তিকাকে সনাক্ত করেছেন আসমান ও জমিনের যুক্তকারী হিসাবে। গ্রীসের পাত্র এবং বাসনাদিতে এই চিহ্ন প্রমাণ করে তার জনপ্রিয়তা। ঘর কিংবা বিভিন্ন স্থাপনাতেও দেখা যায় এর আধিপত্য। সম্প্রতি আনাতোলিয়ার ঐতিহাসিক ট্রয়ে খননকার্য চালানোর সময়ও কিছু প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন পাওয়া গেছে স্বস্তিকার স্বাক্ষর সহকারে। 

ফিনিশীয় সংস্কৃতিতে প্রতীকটি ব্যবহার করতো ধর্মীয় প্রধানেরা; Image source: ancient-origins.net

ফিনিশীয়রা স্বস্তিকাকে গণ্য করেছে সূর্যের প্রতিনিধি হিসেবে। শুধুমাত্র ধর্মীয় যাজকেরাই এর ব্যবহার করতো। ভূমধ্যসাগরকে কেন্দ্র করে তারা গড়ে তুলেছিল প্রাচীন পৃথিবীর অর্থনৈতিক উপনিবেশবাদী সাম্রাজ্য। ফিনিশীয় ও গ্রীকদের সাথে লিডীয়, হিব্রু এবং মিশরীয়দের যোগাযোগ ছিল নিত্যদিনের। তাই সেসব সভ্যতার সাথেও প্রতীকটির পরিচিতি থাকা স্বাভাবিক।

মধ্যযুগের ইউরোপে

সাম্প্রতিক সময়ে আবিষ্কৃত হয়েছে দ্বাদশ শতকের কোনো এক স্লাভ রাজকন্যার পোশাক। স্বর্ণখচিত ও নিখাঁদ কারুকাজের সাথে আরো একটি বিষয়ের দেখা মেলে- সেই পুরাতন স্বস্তিকা। পোশাক ছাড়াও বিভিন্ন স্থাপনা এমনকি মাটির পাত্র অলঙ্করণে ব্যবহৃত হয়েছে প্রতীকটি। কখনো নিছক নান্দনিকতায়, কখনো ধর্মীয় আবেগে।

দ্বাদশ শতকের কাপড়ে স্বস্তিকা; Image source: bbc.com

পূর্ব ইউরোপ ও রাশিয়ার সংস্কৃতিতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অনেক আগে থেকেই প্রবেশ করে আছে স্বস্তিকা। সভ্যতায় ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাসমূহের আন্তঃসম্পর্কের কথা আমরা সবাই কমবেশি জানি। যদি ইন্দো-ইউরোপীয় সংস্কৃতিকে সেই ভাষার স্থলে বসিয়ে ভাবা যায়, তাহলে বিষয়টা আরো স্পষ্ট হবে। স্বস্তিকা হয়তো সেভাবেই প্রবাহিত হয়েছে সংস্কৃতি থেকে সংস্কৃতিতে।

পশ্চিম ইউরোপে, বিশেষ করে ইংল্যান্ডে প্রতীকটি প্রভাব ফেলেছিল সবচেয়ে বেশি। ইয়র্কশায়ারে প্রাপ্ত খোদাইচিত্রই তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ। অন্তত দুই হাজার খ্রিষ্টপূর্বাব্দে নির্মিত এই শিল্পকর্ম নিজেই আসলে বলে দেয়, কতটা দক্ষতায় আর যত্নে তা সৃজিত।

ইয়র্কশায়ারে অঙ্কিত স্বস্তিকা; Image Source: bbc.com

বৌদ্ধ ও জৈনধর্মে

বৌদ্ধধর্মে স্বস্তিকার অর্থ সৌভাগ্য এবং নির্বাণ। বুদ্ধের বুকে, হাতে কিংবা পায়ে হামেশাই মেলে এই চিহ্নের সাক্ষাৎ। স্বস্তিকাকে মনে করা হয়, বুদ্ধের হৃদয়। এইখানেই শেষ না। তিব্বতে দালাই লামার সিংহাসন চারটি স্বস্তিকা দ্বারা সজ্জিত। চীনে ওয়ান এবং জাপানে মান নামে পরিচিত প্রতীকটি। বিশ্বাস করা হয়-
১. নীল স্বস্তিকার মানে অনন্ত মহাজাগতিক গুণসমূহ,
২. লাল স্বস্তিকা বুদ্ধের হৃদয়ের পবিত্রতম গুণাবলি,
৩. হলুদ স্বস্তিকা অনন্ত সমৃদ্ধি, এবং
৪. সবুজ স্বস্তিকা কৃষির শুদ্ধ স্বচ্ছলতা।

স্বস্তিকাকে মনে করা হতো বুদ্ধের হৃদয়; Image Source: ancient-origins.net

হিন্দু ধর্মের মতো বৌদ্ধধর্মেও স্বস্তিকার অভিমুখ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। ঘড়ির কাঁটা অভিমুখী স্বস্তিকার অর্থ অহিংসা। বিপরীত দিকটা কিন্তু গ্রহণযোগ্যতা পায়নি।

অন্যদিকে জৈনধর্মে স্বস্তিকা তীর্থঙ্কর পার্শ্বনাথকে বুঝাতে ব্যবহৃত হয়। আগেই বলা হয়েছে শব্দটির অর্থ মঙ্গল। আর জৈনধর্মের মঙ্গলময়তার ধারণা মূলত চক্রাকার পুনর্জন্ম-কেন্দ্রিক। এই ‘ফিরে আসার মঙ্গল’ বোঝানোর পাশাপাশি চার প্রকারের সারসত্তাকে বোঝাতেও চিহ্নটি ব্যবহৃত হয়। স্বস্তিকার সাথে তিনটি বিন্দুর মানে হলো তিন নৈতিক নির্দেশনা- শুদ্ধ বিশ্বাস, সৎ জ্ঞান এবং সৎ আচরণ। জৈন আদর্শে সকল কিছুর শুরুতে বা শেষে, উৎসবে বা নিভৃতে, পবিত্র গ্রন্থ বা প্রতিমাতে স্বস্তিকাকে প্রাধান্য দেওয়া হয়।

বিবিধ

উত্তর আমেরিকার স্থানীয় নাভাহোদের মধ্যে স্বস্তিকাকে কেন্দ্র করে উপকথা জন্ম নিয়েছে। নর্স উপকথা অনুযায়ী, পরম পিতা ওডিন স্বস্তিকার মধ্য দিয়ে সকল জগতের দিকে চোখ রাখতেন। খ্রিস্টধর্মের পুণ্যভূমি রোম এবং ইথিওপিয়ার চার্চেও বহুদিন ধরে চলে এসেছে এর ব্যবহার। এমনকি ক্রুশের উপরও স্বস্তিকার প্রভাব আছে বলে মনে করা হয়। মেসোপটেমিয়া এবং বাইজেন্টাইন চিত্রকলায় বিভিন্নভাবে উঠে এসেছে স্বস্তিকা।  

বাইজ্যান্টাইন মোজাইকে স্বস্তিকার প্রকাশ; Image Source: ancient-origins.net

হিটলারের হাতে স্বস্তিকা

উনিশ শতকের দিকে জার্মান পণ্ডিতদের মাঝে ভারত নিয়ে আগ্রহ তুঙ্গে ওঠে। এক্ষেত্রে ম্যাক্স মুলারের নামটি না নিলে আসলে অন্যায় হবে। জার্মানিতে জন্ম নেওয়া এই ভদ্রলোক জ্ঞানের স্বতন্ত্র শাখা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে যান ‘ভারতপাঠ এবং ধর্ম’। সেইক্রেড বুকস্‌ অব দ্য ইস্ট নামে ৫০ খণ্ডে অনূদিত ভারতীয় সংকলন তারই তত্ত্বাবধানে সৃষ্ট।

অজস্র জার্মান পণ্ডিতের হাতে বেশুমার প্রাচীন ভারতীয় বই অনূদিত হতে থাকে। নিজেদের ভাষা ও ভারতীয় সংস্কৃত ভাষার মধ্যে তারা খুঁজে পায় বিস্ময়কর মিল। ভারত ও জার্মানির একটি নৃতাত্ত্বিক শেকড় হিসেবে উঠে আসে আর্য জাতির কথা।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নাৎসিবাহিনীর পতাকা; Image Source: ww2resourse.wordpress.com

জার্মান জাতীয়তাবাদীরা এই ধারণাকে ব্যাপকভাবে গ্রহণ করলো। শুধু গ্রহণ না, প্রচণ্ড জাত্যাভিমানে নিজেদের পুরোনো ঐতিহ্য প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে সচেষ্ট হলো। নিজেদের প্রতীক হিসেবে পতাকায় স্থাপন করলো স্বস্তিকা। তাদের এই উপলব্ধিতে বেকায়দায় পড়লো অনার্য সেমেটিক ইহুদিরা।

আর হ্যাঁ, হিটলারের ব্যবহৃত স্বস্তিকা ছিল ঘড়ির কাঁটার বিপরীতমুখী। বুদ্ধের অহিংসা স্বস্তিকার ঠিক বিপরীত।

Related Articles