Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

গর্ভাবস্থায় সতর্কতা: গল্প আর উপকথা

মানবজীবনের চক্র পৃথিবীব্যাপী একই, একই পৃথিবীর প্রতিটি কোনায় জীবনের কিছু নির্দিষ্ট ধাপই অতিক্রম করতে হয়। সন্তান গর্ভধারণের সময়কালটা তেমনি পৃথিবীর প্রতিটি নারীর কাছে অনেকটা একইরকম অনুভূতির। আনন্দ আর ভয় মিশে এই সময়টা হয়ে ওঠে যেকোনো মেয়ের জীবনের সবচেয়ে বিশেষ একটি ধাপ। চিরকালই এই সময়টা নারীর জীবনের শ্রেষ্ঠ একটি সময় বলেই স্বীকৃত। আর শ্রেষ্ঠ তো হবেই, পৃথিবীতে নতুন একটি প্রাণের সঞ্চার করার চেয়ে বিশেষ, নতুন একটি জীবন আরম্ভ করার চেয়ে দারুণ আর কী-ই বা হতে পারে? তাই এই সময়টা ঘিরে সাবধানতা, কল্যাণের জন্য সাধনা আর নিরাপত্তার জন্য চেষ্টা থাকে অনেক বেশি। প্রাণের ঐশ্বর্যে পূর্ণ এই গ্রহের প্রতিটি প্রান্তে তা ভিন্ন। দেশে দেশে সম্ভাব্য মায়েদের গর্ভকালীন সময়ের ভিন্ন ভিন্ন গল্প নিয়ে সাজানো আমাদের আজকের লেখা।

গর্ভধারণের সময়কালটা তেমনি পৃথিবীর প্রতিটি নারীর কাছে অনেকটা একইরকম অনুভূতির; source: The Onion

যেখানে মানুষের ভয় বেশি, সেখানেই মানুষের মনে দানা বাঁধে নানা ধ্যান-ধারণা, মঙ্গলের আশায় মানুষ নিজেই খুঁজে বের করে নানা পথ। এই ভয় থেকেই বোধহয় লাতিন আমেরিকায় আসে বদ নজরের ধারণাটি। সেখানে মনে করা হয়, খারাপ মানুষের বদ নজর খুব সহজেই গর্ভবতী মা আর তার অনাগত সন্তানের ক্ষতি করতে পারে। একই ধারণা আর ভয় থেকেই কিউবাতে নতুন মায়েরা নিজেদের শরীরে অচেনা আর অবিশ্বস্ত মানুষের স্পর্শ এড়িয়ে চলেন। পানামাতেও হিংসা আর বদ নজরের ভয়ে যতদিন পর্যন্ত সম্ভব গর্ভধারণের খবর গোপন রাখা হয়। বদ নজরের এই ধারণা আর আতংকের প্রভাব অনেক বেশি দেখা যায় আমাদের এই এশিয়া মহাদেশেও। আর দক্ষিণ এশিয়ার চীন, ভারত, পাকিস্তান আর বাংলাদেশেও এমন মানুষ খুব কম পাওয়া যাবে, যারা বদ নজরে বিশ্বাস করে না, বিশেষ করে নতুন মা ও শিশুর ওপর।

সতর্কতারও কমতি নেই এ সময় হবু মায়েদের জন্য। চীনে এখন ব্যাপক হারে এই সতর্কতা গড়ে উঠেছে মোবাইল আর কম্পিউটারের ক্ষতিকর রশ্মির বিরুদ্ধে। সেখানে অধিকাংশ মানুষ এখন মনে করে যে, এ সময় মোবাইল, ইন্টারনেট আর কম্পিউটারের যথেচ্ছ ব্যবহার শিশুর জন্মের ত্রুটি থেকে গর্ভপাত পর্যন্ত ঘটাতে পারে। বর্তমানের চীনা ডাক্তার আর এই বিষয়ক বইগুলোও এ কথার সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। তাই চীনে এখন অনেক মেয়ে যখনই জানে তারা গর্ভবতী, তখন থেকে বাচ্চার জন্মদান পর্যন্ত মোবাইল আর কম্পিউটারকে বিদায় জানাচ্ছে।

গর্ভধারণ নিয়ে বিভিন্ন ভাবনা থাকে সব দেশের মেয়েদের; source: aliexpress.com

গর্ভবতী মায়ের ওপর অশুভ শক্তির আক্রমণের ভয়ও বিভিন্ন দেশের মানুষকে চিন্তিত করে তুলেছে সবসময়। এই ভয় থেকেই তৈরি হওয়া একটা প্রথা আস্তে আস্তে এখন জ্যামাইকান সংস্কৃতির অংশ হয়ে উঠেছে। জ্যামাইকাতে মনে করা হয়, যে ঘরে হবু মা থাকছে আর সন্তান জন্ম দিতে যাচ্ছে, সেই ঘরে সকল অশুভ শক্তিকে দূরে রাখার জন্য অবশ্যই একটি খোলা বাইবেল রাখা উচিত। এই অশুভ শক্তির ভয় থেকেই উত্তর স্কটল্যান্ডের ওর্কনি দ্বীপপুঞ্জের সন্তানসম্ভবা মায়েরা ঘুমানোর সময় তাদের বিছানার নিচে বাইবেল এবং ছুরি রেখে দেয়।

তাই বলে যদি এমন হয়, অশুভ শক্তির ভয়ে পুরো নয় মাসই গৃহে আবদ্ধ থাকতে হচ্ছে, তখন কেমন হবে ব্যাপারটা? গুয়েতেমালার মায়ান গোষ্ঠীর মানুষদের মধ্যে অনেকটা এরকমই হয়। সগর্ভা মেয়েরা সেখানে প্রায় নয় মাস পর্যন্ত ঘর থেকে বের হয় না অসুস্থতা, বিদ্বেষ আর অশুভ শক্তি দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার ভয়ে। সত্যি, ভয় মানুষকে কত দূর পর্যন্ত নিয়ে যেতে পারে!

গর্ভবতী মায়ের ওপর অশুভ শক্তির আক্রমণের ভয়ও বিভিন্ন দেশের মানুষকে চিন্তিত করে তুলেছে সবসময়; source: US News Health – US News & World Report

মায়ের গর্ভে থাকা সন্তানের স্বাস্থ্য নিয়েও চলে নানা জল্পনা-কল্পনা, আর এই চিন্তা থেকেই আইরিশ সংস্কৃতিতে অন্তঃসত্ত্বা মায়েদের কবরস্থানে না যাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়। মনে করা হয়, এ সময় মায়ের মৃতদের মধ্যে যাওয়া শিশুকে দুর্বল আর বিকৃত চরণযুক্ত করে, আর সেই সাথে ভবিষ্যতে শিশুর জন্য নিয়ে আসে অনাহার।

তবে শুধু স্বাস্থ্যের ওপর ক্ষতিকর প্রভাবের জন্য না, এ সময় মৃত্যুর সংস্পর্শ এড়িয়ে চলতে পরিবারের লোকজন বেশ ভালোই তৎপর থাকে আরো অনেকগুলো দেশ ও জাতিতে। কেনিয়ার ‘আকাম্বা’ জাতিগোষ্ঠীর মানুষের কথাই ধরা যাক না। তারা মনে করে গর্ভধারিণী মায়ের মৃত দর্শন নাকি মৃতের আত্মাকে অনাগত সন্তানের জীবন ঝুঁকিতে ফেলার সুযোগ করে দেয়। তাই ভবিষ্যত মায়েদের এই সময় অবশ্যই মৃতের মুখ দেখা এড়িয়ে চলা উচিত। মৃত্যুর ফেরেশতার যখন-তখন চলে আসার ভয় এ সময় সনাতন ইহুদিদেরও যেন আঁকড়ে ধরে। তাই অনেক বিশ্বাসী ইহুদি নারীই বাচ্চার জন্মের আগে গৃহে কোনো প্রস্তুতি বা শখের কোনো সজ্জার আয়োজন করে না, এমনকি বাচ্চার জন্য কোনো নাম পর্যন্ত উচ্চারণ করে না। তারা আশঙ্কা করে যে, তাদের এই আনন্দের প্রকাশ যদি কোনো শোকের বা মৃত্যুর ফেরেশতার নজরে পড়ে!

নতুন অনাগত সন্তান নিয়ে থাকে কতোই না জল্পনা-কল্পনা; source: familycareinc.com

ভয় আর সতর্কতা নিয়ে প্রচলিত প্রথাগুলোর কথা তো অনেক হলো। এবার চলুন জেনে নেয়া যাক গর্ভধারণের সময়টিতে বিভিন্ন দেশে চলে আসা সবচেয়ে মজার ধারণা আর প্রথাগুলো। সবার আগে বলা যাক সবচেয়ে মজার ধারণাটি সম্পর্কে। রাশিয়ায় মনে করা হয় যে, গর্ভধারণের সময়টা আর সন্তান জন্মদান সহজ হবে যদি স্বামী-স্ত্রী একে অপরের কাছে তাদের আগের প্রেমিক-প্রেমিকাদের নামগুলো বলে দেয়। এটা পড়ে অনেকে যদি ঈশ্বরকে ধন্যবাদ দেয় রাশিয়ায় না থাকার জন্য, তবে তাদের খুব দোষ দেওয়া যাবে কি?

কোরিয়াতে গর্ভধারণের খবর প্রথম অন্যদের জানানো নিয়ে প্রচলিত আছে আরেকটি মজার নিয়ম। অনেক ইতালিয়ান মনে করেন যে, খবরটি একটি নির্দিষ্ট ধারা মেনে অন্যদের জানানো উচিত। সবার আগে শাশুড়ি জানবে খবরটা, তারপর জানতে পারবে স্বামী এবং তারপর হবু মা তার নিজের মাকে জানাবে। অন্য সবার জানার অধিকার এই তিন জনের পরেই আসে। মঙ্গোলিয়ানদের অবশ্য এসব কোনো নিয়ম নেই। তারা সতর্ক থাকে যেন দুজন অন্তঃসত্ত্বা নারী নিজেদের স্পর্শ করে না ফেলে, তাতে নাকি শিশুদের নিজেদের মধ্যে লিঙ্গ অদল-বদল হয়ে যেতে পারে। মানুষের কল্পনাশক্তি সত্যিই বিচিত্র।

চীনে সন্তানের জন্য অগ্নিপরীক্ষা দিতে হয় মায়ের পাশাপাশি বাবাকেও; source: mamaclub.com

তবে চীনে গর্ভধারণের সময় একটা বড় অগ্নিপরীক্ষা স্বামীদেরও দিতে হয়। সেখানে বিশ্বাস প্রচলিত আছে যে, যদি স্বামী তার স্ত্রীকে কোলে নিয়ে জলন্ত কয়লার ওপর দিয়ে হেঁটে ঘরে নিয়ে যেতে পারে, তবে তাদের সন্তানের আশা পূরণ হবে। বাবা হওয়াটা তাহলে যথেষ্ট কঠিনই সেখানে! তাছাড়া সন্তানসম্ভবা মেয়েদের উচ্চস্বরে গল্প করা ও হাসা সেখানে খুবই অমঙ্গলসূচক মনে করা হয়।

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবশ্যই প্রসবের সময়টি। জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণ এই সময়টি নিয়ে ভারত সহ এশিয়ার অনেক জায়গায় প্রচলিত আছে এক প্রাচীন আধ্যাত্মিক আনুষ্ঠানিকতা। প্রসবকে সহজ করার জন্য আর হবু মাকে মানসিকভাবে শক্তি যোগানোর জন্য এটি পালন করা হয়। এতে ঘরের প্রতিটি দরজা জানালা খুলে দেওয়া হয়, তারপর প্রসূতিকে সেখানে নিয়ে যাওয়া হয়। এটি যেন সমস্ত সামাজিকতা বাদ দিয়ে প্রকৃতির কাছ থেকে শক্তি পাওয়ার এক চেষ্টা।

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবশ্যই প্রসবের সময়টি; source: Pregnancy & Baby

সন্তান জন্মের সময় সহজ প্রসবের জন্য পরিকল্পনাটি মাল্টাতে শুরু হয় বিয়ের দিন থেকেই। মাল্টাতে বিশ্বাস করা হয় যে, বিয়ের দিন বৃষ্টি হলে নাকি সন্তানের জন্মদান সহজ হয়। তাই বিয়ের দিন বৃষ্টির জন্য প্রার্থনা সেখানে মেয়েদের থাকবেই। আর এই কারণেই মাল্টাতে অধিকাংশ বিয়ে বৃষ্টির মৌসুমেই হয়ে থাকে।

গর্ভধারণের বিশেষ সময়টি নিয়ে এভাবেই হাজারো রকম রীতি, প্রথা আর বিশ্বাস গড়ে উঠেছে পৃথিবীর দেশে দেশে, জাতিতে জাতিতে। বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রার ফলে ব্যতিক্রমও এখন দেখা যাচ্ছে হরহামেশা, কিন্তু সেই সাথে এ সকল প্রথাও সংস্কৃতির অংশ হিসেবে টিকে থাকছে।

ফিচার ইমেজ- vix.com

Related Articles