Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

যে লিপিগুলোর মর্মোদ্ধার হলে বদলে যেতে পারে ভাষার ইতিহাস

মানুষের অনুভূতি প্রকাশের সবচেয়ে জরুরি মাধ্যমগুলোর একটি হল ভাষা। ভাষার প্রাথমিক মৌখিক রূপ থেকে প্রাচীন পৃথিবীর সভ্যতাগুলোর ক্রমান্বয়ে পরিবর্তন সাধনের মধ্য দিয়ে এক সময় পাওয়া গেছে লিখিত ভাষা। খ্রিস্টপূর্ব ৩,৩০০ থেকে খ্রিস্টপূর্ব ৩,০০০ সালের মধ্যে গঠিত হওয়া সুমেরীয় ভাষাকে এখনও পর্যন্ত আবিস্কৃত পৃথিবীর প্রথম লিখিত ভাষার স্বীকৃতি দেয়া হয়। বিভিন্ন প্রত্নতাত্ত্বিক আবিস্কারে এমন অনেক লিপি উদ্ধার হয়েছে বিভিন্ন সময় যেগুলোর কোনো কোনোটি সুমেরীয় সভ্যতার অনেক আগের আমলের। কিন্তু এগুলোর মর্মোদ্ধার করা সম্ভব হয়নি আজ পর্যন্ত, তাই নিশ্চিত হওয়া যায় নি এই লিপির প্রতীকগুলো কি কোনো লিখিত ভাষার অংশ নাকি অন্য কোনো অর্থ বহন করছে। মানুষের ইতিহাসের অজানা কোনো গল্পও হয়ত জানা সম্ভব, যদি কেউ কখনো সমর্থ হয় এগুলোর অর্থ বুঝতে। এমন কিছু লিপি নিয়ে আজকের লেখা।

ডিসপিলো ট্যাবলেট

ট্যাবলেট মানে হল ফলক। ডিসপিলো ট্যাবলেট হল একটি কাঠের ফলক যেটি আবিস্কার করা হয় গ্রিসের ডিসপিলো নামক গ্রাম থেকে। ১৯৯৩ সালে এই জায়গাটিতে অবস্থিত ক্যাস্টোরিয়া নামক লেকের ধারের মাটি খুঁড়ে উদ্ধারের পর পরীক্ষা করে দেখা যায়, এই ফলকটি তৈরি হয়েছিল খ্রিস্টের জন্মের প্রায় ৫,৩০০ বছর আগে।

main-qimg-400c70b62944f2f610412f0332e2de36-c

ডিসপিলো ট্যাবলেট

১৯৩২ সালে এই লেকের পানি কমে যাওয়ার পর অনুসন্ধান করে জানা যায়, এখানে এককালে জনবসতি ছিল। ১৯৯২ সালে খনন কাজ শুরু হয়। ধারণা করা হয়, আজ থেকে প্রায় ছয় বা সাত হাজার বছর আগে প্রস্তর যুগেএখানে মানুষের বসবাস ছিল। সিরামিক ও কাঠের তৈরি বিভিন্ন জিনিস ছাড়াও এখান থেকে উদ্ধার করা হয় বীজ, হাড়, মূর্তি, অলংকার এবং বাঁশির মত নিদর্শন। তবে এই কাঠের ফলকটা ছিল এর মধ্যে সবচেয়ে মূল্যবান আবিস্কার।

ফলকটি কয়েক হাজার বছর ধরে পড়ে ছিল কাদা ও পানির ভেতরে। সেখান থেকে অক্সিজেন সমৃদ্ধ বাতাসে নিয়ে আসায় এটি কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ২০০৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে এই ফলকটি আবিস্কারের খবরটি ঘোষণা দেয়া হয়। অধাপক জর্জ হরমুজিয়াডি, যিনি এর উদ্ধারকাজে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, তিনি এক অদ্ভুত তথ্য জানান তখন। তিনি বলেন, পুরোপুরি গবেষণা না করে এই ফলকের চিহ্নগুলোর সবটাই জনসম্মুখে প্রকাশ করে দেয়া ঠিক হবে না। কারণ গ্রিক ভাষার বর্ণমালার ভিত্তিতে ভাষার যে ইতিহাস এযাবৎকালে রচিত হয়েছে তাকে সম্পূর্ণ পাল্টে দিতে পারে এই ফলকটি।

Dispilio_signs

ফলক থেকে উদ্ধার করা প্রতীক

ব্যাবিলনীয়, সুমেরীয় ইত্যাদি সভ্যতার কাছ থেকে প্রাচীন গ্রিক ভাষার বর্ণগুলো এসেছে এমন তত্ত্বই এখনো পর্যন্ত স্বীকৃত। কিন্তু অধ্যাপক হরমুজিয়াডির মতে, এই তত্ত্বটি ইতিহাসের প্রায় চার হাজার বছরের একটি দীর্ঘ শূন্যস্থান পূরণ করতে পারে না।

খ্রিস্টপূর্ব ৮০০ সালে গ্রিকরা লিখতে শিখেছে এমনটাই ধারণা করা হয়। কিন্তু অনেক গবেষক মনে করেন, গ্রিকদের সমৃদ্ধ শব্দভাণ্ডার, তাদের লিখতে শেখার শুরুর সময়েই হোমারের কাব্যের মত সাহিত্য চর্চা- ইত্যাদি বিষয় প্রমাণ করে গ্রিকদের লিখিত ভাষার ইতিহাস আরও আগের। কারও মতে এই শূন্যস্থানটা দশ হাজার বছরের। যদি গবেষকরা প্রমাণ করতে পারেন, এই ডিসপিলো ফলকের চিহ্নগুলো আসলে এই শূন্যস্থানের সময়ের মধ্যকার লেখা, তাহলে সত্যিই ভাষার ইতিহাস আবিস্কারের পথে এটা হবে এক অভাবনীয় অর্জন।

জাপোটেক রাইটিং

প্রাচীন পৃথিবীর মেসোআমেরিকা, মেসোপটেমিয়া ও চীন- সভ্যতার এই তিন পীঠস্থানেই পৃথকভাবে লিখিত ভাষা গড়ে উঠেছিল। আজকের মেক্সিকো, গুয়াতেমালা, এল সালভাদর, হন্ডুরাস, নিকারাগুয়া, কোস্টারিকার উত্তরাঞ্চল ইত্যাদি অংশ জুড়ে ছিল মেসোআমেরিকান সভ্যতা। এই অঞ্চলের সবচেয়ে বিখ্যাত ভাষালিপি হল মায়ানদের লিপি। মেসোআমেরিকায় মায়ানদের আগে গড়ে ওঠা আরেকটি বিখ্যাত সভ্যতা হল জাপোটেক। পৃথিবীর প্রাচীনতম লিখিত ভাষা পদ্ধতিগুলোর অন্যতম জাপোটেক এর পদ্ধতি।

za1

জাপোটেক রাইটিং এর একটি নিদর্শন

Monument_3,_San_Jose_Mogote

মনুমেন্ট থ্রি-তে আঁকা ছবি

জাপোটেক সভ্যতার অন্যতম শহর ‘মন্টে আলবন’ এর কিছু স্থাপনা থেকে উদ্ধার করা হয় প্রতীক সম্বলিত লিপি। এই লিপির কিছু প্রতীক দিয়ে দিন তারিখের তথ্য বোঝা গেলেও বাকিগুলোর মর্মোদ্ধার সম্ভব হয় নি। প্রথম যে পাথরের গায়ে এই লিপি উদ্ধার করা হয় তার নাম দেয়া হয়েছে ‘মনুমেন্ট থ্রি’। পাথরটির গায়ে খোদাই করা ছবি দেখে মনে হয় রক্তাক্ত ও মৃত এক বন্দী পড়ে আছে যার দুই পায়ের মাঝে অঙ্কিত আছে দুটো প্রতীক। ধারণা করা হয়, এগুলো দিয়ে ব্যক্তিটির নাম লেখা হয়েছে।

মেসোআমেরিকা অঞ্চলের প্রথম লিখিত ভাষার রূপ বলে ধারণা করা হয় এটিকে, যা লেখা হয়েছিল খ্রিস্টপূর্ব পাঁচশ থেকে ছয়শ সালের মধ্যে। জাপোটেক লেখার প্রতীক অঙ্কিত স্থাপনাগুলোর নির্মাণকালে নিয়ে অবশ্য গবেষকদের মধ্যে মতভেদ আছে।

জিয়াহু সিম্বলস

প্রাগৈতিহাসিক নিওলিথিক আমলের চীনের কিছু হাতে নির্মিত বস্তুর উপর অঙ্কিত ১৬টি প্রতীক হল জিয়াহু সিম্বলস। চীনের হেনান প্রদেশের জিয়াহু নামক স্থান থেকে এগুলো উদ্ধার করা হয়। প্রস্তরযুগের শেষের দিকের সময়কে বলা হয় নিওলিথিক আমল। জিয়াহুতে মাটি খুঁড়ে খুঁজে পাওয়া গিয়েছিল সে আমলের একটি ধ্বংসাবশেষ।

j1

জিয়াহু সিম্বলস এর কিছু প্রতীক

জানা যায়, এই নিদর্শনগুলো খ্রিস্টের জন্মের ৬,৬০০ বছর আগের সময়কার। আর চীনা ভাষার প্রাচীনতম নিদর্শন হাড় ও কচ্ছপের খোলের উপর লিখিত ‘ওরাকল বোন স্ক্রিপ্ট’ এর লেখার সময়কাল ছিল খ্রিস্টপূর্ব ১,২০০ সাল। জিয়াহু সিম্বলসের উদ্ধারকারী প্রত্নতত্ত্ববিদেরা মনে করেন, ওরাকল বোন স্ক্রিপ্টের কিছু চিহ্নের সাথে এগুলোর মিল আছে।

তবে অনেক গবেষকের মতে, জিয়াহু সিম্বল দিয়ে কোনো নিয়মমাফিক লেখা বোঝানো হয় নি। প্রত্নতাত্ত্বিক জার্নাল ‘Antiquity’র একটি গবেষণায় বলা হয়, এই চিহ্নগুলো কোনো লিখিত ভাষার প্রকাশ নয়। মানুষ যে দীর্ঘ দিন ধরে নানান রকমের প্রতীক ব্যবহারের মাধ্যমে একটি লিখিত ভাষা তৈরির দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল, এগুলো সে সময়েরই নিদর্শন।

ভিনকা সিম্বলস

ইউরোপের ভিনকা সংস্কৃতির লিপি থেকে উদ্ধার করা কতগুলো প্রতীক ভিনকা সিম্বলস হিসেবে পরিচিত। ১৮৭৫ সালে প্রথম রোমানিয়াতে খননকাজ চালিয়ে পাওয়া যায় ভিনকা সংস্কৃতির নিদর্শন। খ্রিস্টের জন্মের পাঁচ থেকে ছয় হাজার বছর আগে তৈরি বিভিন্ন দ্রব্য উদ্ধার করা হয় সেখান থেকে। এরপর আরও দেড়শটির বেশি এমন জায়গা পাওয়া গেছে এই সংস্কৃতির বিভিন্ন নিদর্শন।

ভিনকা সংস্কৃতির এই প্রতীকগুলো সুমেরীয়দেরও আগেকার আমলের বলে ধারণা করা হয়। তবে আদৌ প্রতীকগুলো কোনো লিখিত ভাষার অংশ কিনা তা এখনও গবেষকরা নিশ্চিত হতে পারেন নি।

vincatablets1

পোড়ামাটিতে এভাবেই আঁকা আছে ভিনকা সিম্বলসের প্রতীকগুলো

প্রতীক সম্বলিত লিপিগুলোর বেশিরভাগই পাওয়া যায় মাটির তৈরি বিভিন্ন দ্রব্যের উপরে। কিছু কিছু সিরামিকের জিনিসের উপরেও পাওয়া গেছে এই লিপি। এগুলোতে বিভিন্ন প্রাণী, দ্রব্যাদি যেমন চিরুনি, ব্রাশ ইত্যাদির চিহ্ন রয়েছে। আরও রয়েছে স্বস্তিকা ও ক্রুশের মত প্রতীক।

প্রথমবার অল্প কিছু নিদর্শন আবিস্কারের পর ভাবা হয়েছিল এই প্রতীকগুলো হয়ত জমির সীমানাসূচক চিহ্ন। কিন্তু এরপর যখন অনেকগুলো স্থানে এগুলো পাওয়া গেল তখন প্রতীকগুলোর অর্থোদ্ধার হয়ে পড়ল আরও জটিল। কারও মতে এগুলী ধর্মীয় প্রতীক হিসেবে ব্যবহৃত হত। কেই বলেন এগুলো সংখ্যাসূচক চিহ্ন। অনেকে মনে করেন, ব্রোঞ্জ যুগের শুরুর পর এই চিহ্নগুলোর ব্যবহার বন্ধ হয়ে যায়। তবে প্রস্তর যুগের এই প্রতীকগুলো লিখিত ভাষার অংশ বলে যে মত রয়েছে তার সত্যতা প্রমাণের জন্য পর্যাপ্ত গবেষণা এখনও সম্পন্ন হয় নি।

ফেইস্টোস ডিস্ক

ফেইস্টোস ডিস্ক হল পোড়ামাটির তৈরি এমন এক চাকতি যেটার নকশার পাঠোদ্ধার নিয়ে প্রত্নতাত্ত্বিক, ভাষাবিজ্ঞানী আর প্রতীক বিশেষজ্ঞদের মাঝে বিতর্ক চলছেই। খ্রিস্টপূর্ব ২০০০ থেকে খ্রিস্টপূর্ব ১০০০ এই সময়ের মধ্যকার কোনো এক সময়ে এই চাকতিটি তৈরি হয়েছে বলে ধারণা করা হয়। আধুনিক গ্রিস এর অন্তর্গত ক্রিট দ্বীপের ফেইস্টোস থেকে এটি উদ্ধার করা হয়।

১৯০৮ সালে ফেইস্টোসে অবস্থিত মিনোয়ান শাসনামলের প্রাসাদ থেকে ইতালিয়ান প্রত্নতত্ত্ববিদ লুইজি পার্নিয়ার ফেইস্টোস চাকতিটি উদ্ধার করেন। ক্রিটের হেরাক্লিয়ন প্রত্নতাত্ত্বিক যাদুঘরে সংরক্ষিত আছে এটি।

চাকতিটির উভয় পাশে কতগুলো প্রতীকের ছাপ দেয়া আছে। আশ্চর্যের বিষয় হল, প্রতীকগুলো কাদামাটির মধ্যে আঁকা হয় নি, বরং সিল বা ছাঁচ দিয়ে এগুলো কাদামাটির গায়ে ছাপ মারা হয়েছে। ১১ শতকে প্রাচীন চীনে চীনামাটির ছাঁচ এবং ১৫ শতকে গুটেনবার্গের তৈরি ধাতব ছাঁচ হল প্রিন্টিং এর ইতিহাসে প্রথম দিকের বহনযোগ্য বা স্থান পরিবর্তন করা যায় এমন ছাঁচ। যদি সত্যি এমন কিছু ব্যবহৃত হয়ে থাকে, তাহলে ফেইস্টোস চাকতি তৈরির জন্য ব্যবহৃত ছাঁচই হল এমন বহনযোগ্য ছাঁচের এর প্রথম নিদর্শন।

ফেইস্টোস ডিস্ক (side A); Image Source: Wikimedia Commons

৪৫টি প্রতীকের সমন্বয়ে ২৪১ ধরনের সংকেত পাওয়া যায় চাকতির গায়ে। প্রতীকগুলো ঘূর্ণির আকারে কেন্দ্রমুখী ভাবে সাজানো আছে। বিভিন্ন প্রাচীন ভাষায় ব্যবহৃত চিহ্নও এর মধ্যে আছে। আছে ঈগল, গাছ, মানুষ, তীর এমন ধরনের ছবিও।

এই প্রতীকগুলো সাজিয়ে এই গোটা চাকতি দিয়ে কী বোঝানো হয়েছে সেটা জানা সম্ভব হয় নি এখনও। চাকতির চিহ্নগুলোর অর্থ নিয়ে বিশেষজ্ঞরা আজ পর্যন্ত যা যা ধারণা করেছেন তা হল, কোনো একটা গল্প, প্রার্থনা, যুদ্ধের প্রস্তুতি কিংবা নিছকই সাপ-লুডু ধরনের একটা বোর্ড গেম।

ফেইস্টোস ডিস্ক(Side B); Image Source: Wikimedia Commons

অনেকে আবার মনে করেন, চাকতিটা আসলে ভুয়া। ১৯০৮ সালে আবিস্কারের সময়ই এটা বানানো হয়েছিল ধোঁকা দেয়ার জন্য। ‘থার্মো লুমিনিসেন্স’ পরীক্ষা দিয়ে বোঝা যায় কোনো প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের বয়স। এই চাকতির জন্য সে পরীক্ষা করতে দিতে রাজি নয় যাদুঘর কর্তৃপক্ষ। তবে প্রত্নতাত্ত্বিকেরা এখনও আস্থা হারান নি এর উপর, চালিয়ে যাচ্ছেন গবেষণা এর গোপন মর্মোদ্ধারের। আজ পর্যন্ত ২৬ জন বিশেষজ্ঞ চাকতির প্রতীকগুলোর নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন ব্যাখ্যা দিয়েছেন।

Related Articles