Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

ভিনসেন্ট: গানে গানে ভাগ্যাহত এক চিত্রকরের গল্প

বাইরে রাত নেমেছে।

বিশাল ভবনের হলঘরে হচ্ছে স্কুলের এক অনুষ্ঠান। ছাত্রছাত্রীরা নিজেদের মতো আনন্দ করছে। বিনোদনের অনুষঙ্গ হিসেবে গান-বাজনার ব্যবস্থাও রেখেছে কর্তৃপক্ষ। ঘরেরে একপ্রান্তে তৈরি করা হয়েছে মঞ্চ, সেখানে মাইক্রোফোন আর বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্র রাখা।

অনুষ্ঠানে গাইবার জন্য স্কুলের তরফ থেকে নিয়োগ পেয়েছেন উঠতি এক শিল্পী, ডন ম্যাকলীন। একটি অ্যালবাম প্রকাশিত হয়েছে তার, তবে পায়ের নিচে মাটি এখনো পুরোপুরি খুঁজে পাননি।

ম্যাকলীন প্রচলিত কিছু গান গাইলেন। কিন্তু ছাত্রছাত্রীদের কেউ ফিরেও তাকাচ্ছে না। একজন শিল্পীর জন্য বিষয়টা অপমানের। ম্যাকলীন চিন্তা করলেন- হয়তো এই গানগুলো এতবার শোনা হয়েছে যে নতুন করে তারা আর শুনতে আগ্রহ পাচ্ছে না। ম্যাকলীন সদ্য লেখা একটি গান ধরতে মনস্থির করলেন, যে গান এখনো প্রকাশিত হয়নি। কেবল গিটারে টুংটাং শব্দ তুলে গাইলেন,

Starry, starry night.
Paint your palette blue and grey,
Look out on a summer’s day,
With eyes that know the darkness in my soul.

গাইতে গাইতে তন্ময় হয়ে গেলেন ম্যাকলীন। সংবিৎ ফিরলে দেখতে পেলেন- পুরো হলঘর নিস্তব্ধ। মন্ত্রমুগ্ধের মতো তার গান শুনছে সবাই। ভিনসেন্ট ভ্যান গগ নামে এক হতভাগ্য চিত্রশিল্পীকে উপজীব্য করে এই গান পরবর্তীতে পরিণত হয় ডন ম্যাকলীনের অন্যতম কীর্তিতে। ম্যাকলীন নিজে গানের নাম দিয়েছিলেন ‘ভিনসেন্ট’। তবে প্রথম লাইনের কারণে starry night” নামেও পরিচিতি পায় গানটি। ম্যাকলীন নিজেও এই ছত্রের অনুপ্রেরণা নিয়েছিলেন ভ্যান গগের একই নামের চিত্রকর্ম থেকে।

ভিনসেন্ট ভ্যান গগ; Image Source: galerie-artagra.com

ভিনসেন্ট ভ্যান গগ

ম্যাকলীনের ‘ভিনসেন্ট’ শিল্পী ভ্যান গগের মানসিক যন্ত্রণা, তার প্রতি সমসাময়িক লোকদের অবহেলা এবং পরিণতিতে শিল্পীর আত্মাহুতির ঘটনাই সংক্ষেপে তুলে ধরেছে। কিন্তু কে ছিলেন এই ভ্যান গগ?

ভিনসেন্ট ভ্যান গগ ইতিহাসবিখ্যাত চিত্রকর। নেদারল্যান্ডসের দক্ষিণের ব্র্যাবান্ট অঞ্চলের যুন্ডের্ট (Zundert) গ্রামে তার জন্ম ১৮৫৩ খ্রিস্টাব্দের ৩০ মার্চ। অ্যানা আর পাদ্রি থিওডোরাস ভ্যান গগের ছয় সন্তানের প্রথমজন তিনি। এক বছর আগে অ্যানার গর্ভে মৃত এক সন্তানের জন্ম হয়েছিল, তার নাম রাখা হয়েছিল ভিনসেন্ট। সেই কথা মাথায় রেখেই সম্ভবত জীবিত সন্তানের নামকরণ করে ভ্যান গগ দম্পতি। 

তৎকালীন ছোট্ট এই যুন্ডের্টেই জন্ম নেন ইতিহাসের অন্যতম সেরা এক চিত্রকর; Image Source: vangoghroute.com

ছোটবেলা থেকেই কিছুটা অন্তর্মুখী স্বভাবের ভিনসেন্ট প্রকৃতির সান্নিধ্যে থাকতেই বেশি পছন্দ করতেন। ১৬ বছর বয়সে চাচার সাহায্যে হেগ শহরে কাজ পেলেন তিনি, গুপিল অ্যান্ড কো’র (Goupil and Co) দোকানে। চিত্রকর্ম বেচাবিক্রি নিয়ে কাজ করত তারা। হেগ ছাড়াও পৃথিবীর অন্যান্য শহরে তাদের শাখা ছিল। 

চিত্রকর্মের প্রতি এখানে আগ্রহ তৈরি হয় ভ্যান গগের। খ্যাতিমান ডাচ শিল্পী, যেমন- রেমব্র্যান্ড, ফ্রাঞ্জ হ্যালসের কাজ ভাল লাগলেও তার প্রধান অনুপ্রেরণা ছিলেন ফরাসি জাঁ ফ্রাঁসোয়া মিলেট আর ক্যামিল করোট।

১৮৭৩ সালে লন্ডনের দোকানে বদলি হন ভ্যান গগ। উঠলেন ৮৭ হ্যাকফোর্ড রোডের এক বাড়িতে ভাড়াটিয়া হিসেবে। পরের বছর প্রথম প্রেমে পড়লেন। নিজেকে নিবেদন করলেন বাড়িওয়ালির মেয়ে, ইউজেনি লয়ারের সামনে।

লন্ডনের এই বাড়িতেই বাস করতেন ভিনসেন্ট ভ্যান গগ © Sophie Rainbow

ইউজেনি এককথায় ভ্যান গগকে বাতিল করে দেয়। ভাঙা হৃদয়ের যন্ত্রণায় জর্জরিত ভ্যান গগ ১৮৭৫ সালের জুনে প্যারিসের দোকানে চলে এলেন। এখানে রইলেন পরের বছরের এপ্রিল পর্যন্ত।

এরপর কিছুদিন ভ্যান গগ ইংল্যান্ডে কাজ করেন। ১৮৭৭ সালে বইয়ের দোকানে কাজ করার সময় তার বাবার মতো ধর্মযাজকের পেশা বেছে নেয়ার ইচ্ছে হলো। ব্রাসেলসে ফিরে গিয়ে এজন্য এক বছর প্রশিক্ষণ নেন তিনি। কিন্তু চার্চের কর্তাব্যক্তিদের সাথে মতবিরোধ হওয়ায় তারা ভ্যান গগকে কোনো নিয়োগ দিচ্ছিল না। বাধ্য হয়ে তিনি বেছে নেন মিশনারির কাজ।  

১৮৭৯-৮০ সালে দক্ষিণ বেলজিয়ামে থাকার সময় ছিন্নমূল মানুষদের জন্য সর্বস্ব বিলিয়ে দেন ভ্যান গগ। এই ঘটনার জেরে চার্চের সাথে তার সম্পর্ক প্রায় তলানিতে ঠেকে। বিভিন্ন অভিযোগে তাকে ধর্মযাজকের পদ থেকে সরিয়ে দেয়া হয়। 

চার্চের এহেন আচরণ ভ্যান গগের বিশ্বাস চুরমার করে দেয়। মোটামুটিভাবে নিঃস্ব ভ্যান গগ এবার আঁকাআঁকির দিকে ঝুঁকতে মনস্থির করেন।১৮৮১ সালে তিনি যখন চিত্রশিল্পীর নতুন জীবন শুরু করেছেন, তখন আরেকবার বেদনায় নীল হতে হলো তাকে। কাজিন কি ভসকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে প্রত্যাখ্যাত হন তিনি।  

ভ্যান গগ এবার থাকতে শুরু করলেন বারবনিতা ক্লাসিনা সিয়েন হুর্নিকের সঙ্গে। সিয়েন নিজের ছোট মেয়েকে নিয়ে তার বাসায় উঠে এলেন। ১৮৮২ সালের জুনে উইলিয়াম নামে একটি ছেলের জন্ম হয় তার গর্ভে। সাধারণভাবে ভ্যান গগকে তার বাবা মনে করা হলেও উইলিয়ামের পিতৃপরিচয় নিয়ে প্রশ্ন থেকেই গেছে।

বছরখানেক পর সিয়েনের সাথে ছাড়াছাড়ি হয়ে যায় ভ্যান গগের। ১৯০৪ সালে পানিতে ডুবে মারা যান সিয়েন। সিয়েন ছেড়ে যবার পর ভ্যান গগের সঙ্গিনী হন মার্গট বিজম্যান। তিনি স্ট্রিকনিন খেলেও বেঁচে যান। 

এতসবের মাঝে আঁকাআঁকি চালিয়ে যান ভ্যান গগ। ১৮৮০ থেকে আরম্ভ করে পরের দশ বছরে অবিরাম এঁকে যান তিনি। এ সময় তার প্রধান পৃষ্ঠপোষক ছিল ছোট ভাই থিও ভ্যান গগ। শুরুর দিকে ভ্যান গগ চিত্রকর্ম নিয়ে কিছুদিন ব্রাসেলস একাডেমিতে পড়াশোনা করলেও তিনি ছিলেন অনেকটা স্বশিক্ষিত। ১৮৮১ সালে হেগ শহরে আরেক ডাচ চিত্রশিল্পী অ্যান্টন মভের সাথে অনেকদিন ছিলেন তিনি, ঘুরে বেড়ান বহু জাদুঘরে। দেখা করেন সমসাময়িক চিত্রকরদের সাথে। 

থিও ভ্যান গগ; Image Source: mymodernmet.com

তবে ভ্যান গগ কখনোই জীবনের প্রথমদিকে পাওয়া প্রত্যাখ্যানের জ্বালা ভুলতে পারেননি। প্রভেন্স শহরে থাকার সময় তিনি চিত্রকর পল গাগুইনের সঙ্গে একত্রে বাসা ভাড়া নেন। এখানে থাকাকালে থিওর সাথে জোয়ানা বঙ্গাররের বাগদান হয়। ছোট ভাইয়ের প্রেমের সাফল্যে ভ্যান গগ নিজের জীবন নিয়ে আরো হতাশ হয়ে পড়েন। অতিরিক্ত মদ্যপান আর স্বেচ্ছাচারী আচরণ করতে থাকেন তিনি।

পল বিরক্ত হয়ে জানিয়ে দেন তিনি আর ভ্যান গগের সাথে থাকবেন না। পরবর্তীতে পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল ভ্যান গগ নাকি পলের কথা শুনে তাকে ক্ষুর হাতে তাড়া করেন। এরপর এক পতিতালয়ে ঢুকে র‍্যাচেল নামে এক নারীর হাতে তুলে দেন নিজের কাটা কানের একাংশ, যা ক্ষুর দিয়ে নিজেই কেটে নেন তিনি।

তবে ঐতিহাসিক হান্স কফম্যান আর রিটা ওয়াইল্ডগ্যান্স কুখ্যাত এই ঘটনা নিয়ে বিস্তর গবেষণা করে ভিন্নমত দিয়েছেন। তারা তৎকালীন পুলিশ রেকর্ড আর ভ্যান গগের চিঠিপত্র ঘেঁটে দেখেছেন। তাদের বর্ণনামতে- ভ্যান গগ নন, পলই তরবারি দিয়ে তার কান কেটে ফেলেন। তবে ভ্যান গগ নিজেকে দায়ী করেন এবং পল চলে যান প্যারিসে।

পতিতালয়ের ঘটনা নিয়ে অবশ্য কফম্যান আর ওয়াইল্ডগ্যান্স একমত। ভ্যান গগের মানসিক সমস্যার সূচনার লক্ষণ হিসেবে এই ঘটনা চিহ্নিত করেন অনেক। যা-ই হোক, ভ্যান গগ এরপর দুই সপ্তাহ হাসপাতালে কাটান। ফিরে এসে বুঁদ হয়ে যান ছবি আঁকতে। কিন্তু মাসখানেক পর চিত্তবৈকল্যের লক্ষণ দেখা দিলে আবার হাসপাতালে যেতে হয় তাকে।

১৮৮৯ সালের এপ্রিলে থিওর বিয়ে হয়ে গেলে ভয়াবহভাবে বিষণ্ণ হয়ে পড়েন ভ্যান গগ। নিজেকে স্বেচ্ছায় আবদ্ধ করে ফেলেন সেইন্ট-রেমির মানসিক হাসপাতালে। তার ভয় ছিল- বিষণ্ণতায় ডুবে গেলে নিজের প্রিয় ছবিগুলো আঁকার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলবেন তিনি।

এক বছর সেইন্ট-রেমিতে ছিলেন ভ্যান গগ। এখানে তার মানসিক অবস্থা খারাপ আর ভালোর মধ্যে ঘন ঘন ওঠা-নামা করত, ফলশ্রুতিতে কাজ হয়ে পড়ে অনিয়মিত। বেশ কিছু ছবি অবশ্য এ সময় তিনি আঁকতে সক্ষম হন, যার একটি ‘Starry Night’।

ভ্যান গগের অসামান্য এক চিত্রকর্ম ‘Starry Night’ © Van Gogh Museum

ভ্যান গগ ‘Starry Night’ এঁকেছিলেন তৈলচিত্র হিসেবে। প্রাথমিক জীবনে উজ্জ্বল রঙ নিয়ে কাজ করতে ভালবাসতেন তিনি, সেই সময়ের চিত্রকর্মগুলোও ছিল তার তুলনামূলক চাঙ্গা মানসিকতার প্রকাশ। কিন্তু পরবর্তী জীবনে মানসিক সমস্যা ঘিরে ধরলে তার কাজেও বিষণ্নতার প্রকাশ ঘটে। উজ্জ্বলতার জায়গা নেয় অন্ধকার।

‘Starry Night’-ও তার ব্যতিক্রম ছিল না। রাতের প্রেক্ষাপটে নীল রঙের আধিক্য ছিল এই চিত্রকর্মে। ধূসর আর নীলের সন্নিবেশে আঁকা এক গ্রামের ছবির পেছনে ছিল আকাশ আর পাহাড়ের অবয়ব। ভ্যান গগ যত্ন করে হলুদ আর সাদা রঙে সাজিয়েছিলেন চাঁদ-তারাকে।

মজার কথা হলো- ‘Starry Night’ আঁকার পর ভ্যান গগ নিজেই সন্তুষ্ট ছিলেন না। থিওকে লেখা এক চিঠিতে তার এই কাজ অনর্থক হয়েছে বলে মন্তব্য করেন তিনি।

এরপর আর বেশি দিন জীবিত ছিলেননা ভ্যান গগ। সেইন্ট-রেমি থেকে বেরিয়ে তিনি বাসায় চলে গিয়েছিলেন। ৩৭ বছর বয়সে হাতে পিস্তল নিয়ে চলে যান কর্নের মাঠে। সেখানে বুকে গুলি চালিয়ে দেন। এরপর রক্তাক্ত অবস্থায় টলতে টলতে ফিরে আসেন বাসায়, সিঁড়ি বেয়ে উঠে শুয়ে পড়েন বিছানায়। পাইপ জ্বালিয়ে ধুমপান করতে থাকেন। এখানে দুদিন পর অজ্ঞাতেই মারা যান তিনি।

ভ্যান গগের জীবন ছিল হতাশায় ভরা। বর্তমান গবেষকরা একমত- তার বিষণ্নতার মূল কারণ প্রেমে ব্যর্থতা নয়, বরং তার পরিবারে মানসিক সমস্যার ইতিহাস। থিও নিজেও এই সমস্যায় ভুগতেন। ভ্যান গগের হতাশা তার রোগকে বহুগুণে বাড়িয়ে তুলেছিল মাত্র। চার্চের আচরণ, তার কাজ সম্পর্কে সমসাময়িকদের অবহেলা- সবকিছুই প্রচণ্ডভাবে আঘাত করেছিল শিল্পীকে।

১০ বছরে ভ্যান গগ হাজারের উপর কাজ করেছিলেন। মানুষ তা দেখে উপহাস করত, নাক সিঁটকাত তৎকালীন নামকরা চিত্রশিল্পীরা। হাতেগোণা কিছু ছবিই কেবল ভ্যান গগ জীবদ্দশায় বিক্রি করতে পেরেছিলেন, যার একটি ‘দ্য রেড ভিনিয়ার্ড’। ৪০০ ফ্রাঁর বিনিময়ে ১৮৯০ সালে বিক্রি হয় এটি।

ভ্যান গগের সমুদয় চিত্রকর্ম মৃত্যুর পর থিওর কাছে সংরক্ষিত ছিল। ছয় মাসের মাথায় থিও মারা গেলে তার বিধবা স্ত্রী জোয়ানা এর মালিক হন।থিও ও ভ্যান গগের ব্যক্তিগত চিঠিপত্রও তার কাছে জমা ছিল। জোয়ানাই ধীরে ধীরে ভ্যান গগের প্রতিভা তুলে ধরেন। তার ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় আজ আমরা যে ভ্যান গগকে জানি তার জন্ম হয়।

‘Starry Night’ জোয়ানা বিক্রি করে দিয়েছিলেন কবি জুলিয়েনের (Julien Leclercq) কাছে। তার কাছ থেকে হাতবদল হয় শিল্পী ক্লড-এমিল শুফনেকারের সংগ্রহে। জোয়ানা এখান থেকে পুনরায় ছবিটি কিনে নিয়ে রটারডামের এক গ্যালারিতে দিয়ে দেন। 

ডাচ এক মহিলা জর্জেট ভ্যান স্টক ১৯০৬ সালে গ্যালারি থেকে কিনে নেন ছবিটি। ৩২ বছর তার কাছে রয়ে যায় ‘Starry Night’। ১৯৩৮ সালে এক লাখ ডাচ গিল্ডার্সে (প্রায় ১,৮২,০০০ মার্কিন ডলার) তা কিনে নেয় পল রোসেনবার্গ গ্যালারি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে ১৯৪১ সালে নিউ ইয়র্কের মিউজিয়াম অফ মডার্ন আর্টস মালিক হয় ভ্যান গগের অসামান্য এই কীর্তির। আজও সেখানেই রয়ে গেছে ‘Starry Night’।

নিউ ইয়র্কের মিউজিয়ামে বর্তমানে সংরক্ষিত আছে “Starry Night”© CarlyGaebe/Steadfast Studio

ডন ম্যাকলীন

ভ্যান গগের গান গাওয়া সেই শিল্পী ডন ম্যাকলীনের জন্ম নিউ ইয়র্কে, ১৯৪৫ সালের ২রা অক্টোবর। শৈশব থেকেই সঙ্গীতের প্রতি বিপুল আকর্ষণ ছিল তার। অনেক সময় আত্মীয়স্বজন আর বন্ধুবান্ধবদের আসর জমিয়ে তুলতেন গান গেয়ে। 

পনের বছর বয়সে ম্যাকলীনের বাবা মারা যান। ততদিনে তিনি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছেন- গানই হবে তার জীবন। মার্কিন গায়ক ও গীতিকার এরিক ডার্লিংয়ের সাথে এ সময় সখ্য হয় তার। তার সহায়তায় স্টুডিওতে কাজ করার সুযোগ পান ম্যাকলীন।

গিটার হাতে ডন ম্যাকলীন; Image Source: donmclean.com

ভিনসেন্ট

১৯৬৯ সালে ম্যাকলীনের প্রথম অ্যালবাম ‘ট্যাপেস্ট্রি’ প্রকাশিত হয়। সমালোচকদের প্রশংসা পেলেও পেটের ভাত জোগানোর মতো যথেষ্ট ব্যবসা করতে পারেনি ট্যাপেস্ট্রি। ফলে ম্যাকলীন কাজ নেন ম্যাসাচুসেটসের স্টকব্রিজের স্কুল বোর্ডে। তাদের হয়ে গিটার বাজাতে যেতেন বিভিন্ন স্কুলে।

ম্যাকলীন জানিয়েছেন, স্টকব্রিজের এক স্কুলের বারান্দায় বসে থাকার সময়েই তিনি ভ্যান গগের জীবনী হাতে পান। শিল্পীর মর্মান্তিক জীবন তাকে দারুণভাবে প্রভাবিত করে। জীবনভর যে মানুষটি প্রতিভার দাম পাননি, তার প্রতি অদ্ভুত এক সহানুভূতি অনুভব করেন ম্যাকলীন। শিল্পীর মানসিক সমস্যাকে প্রেমে ব্যর্থতার মতো একটি রূপ দেয়ার সমসাময়িকদের চেষ্টাও তাকে ভ্যান গগের প্রতি অনুরক্ত করে তোলে।

ম্যাকলীন নিজেও সেই সময় বিপর্যস্ত। স্ত্রী ক্যারল সভিয়নের সাথে বনিবনা হচ্ছিল না তার। ফলে মানসিকভাবে ভাল অবস্থায় ছিলেন না তিনি। পরবর্তীতে সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, সম্ভবত এ কারণেই ভ্যান গগের সাথে আশ্চর্য একটি সংযোগ অনুভব করছিলেন তিনি। 

ম্যাকলীনের মাথায় ঘুরতে থাকে অনেক শব্দ। ‘Starry Night’ ছবিটি তার মনে গেঁথে গিয়েছিল। এর একটি প্রিন্ট নিয়ে বসে গেলেন তিনি, কাগজের ব্যাগের উপর দ্রুত নিজের ভাবনা সাজিয়ে ফেলেন। এটি দেখালেন সঙ্গীত প্রযোজক এড ফ্রিম্যানকে। এরপর সুর তুললেন তারা, তৈরি হলো বিখ্যাত সেই গান- ভিনসেন্ট।

ভিনসেন্ট’ ভ্যান গগের জীবনের সেই অংশের দিকে ইশারা করে, যখন শিল্পী ভুগছিলেন প্রবল মানসিক চাপে। বিষণ্নতা যখন পাথরের মতো তার উপর চেপে বসেছে, উত্তরণের কোনো পথ খুঁজে পাচ্ছেন না শিল্পী। তাকে উপহাস করছে সবাই। মানসিকভাবে পর্যুদস্ত একজন ব্যক্তির জন্য সবচেয়ে বেশি যা দরকার, আশেপাশের মানুষের ভালবাসা আর সমর্থন, সেটা না পেয়ে আত্মহননের পথ বেছে নিচ্ছেন তিনি। এটাই ছিল ভিনসেন্টের থিম। গানের মধ্যে ‘Starry Night’ ছাড়াও ভ্যান গগের আরো কিছু চিত্রকর্মের নাম ব্যবহার করা হয়েছে।

স্টকব্রিজের স্কুলের এক অনুষ্ঠানে ৫০ বা ১০০ ডলারের বিনিময়ে গাইতে গিয়ে প্রথম ভিনসেন্ট পারফর্ম করেন ম্যাকলীন। শ্রোতাদের প্রতিক্রিয়া দেখে বুঝতে পারলেন- হিট হতে চলেছে এই গান।

স্কুল ছাড়াও আরো অনেক জায়গাতে ভিনসেন্ট পারফর্ম করেছেন ডন ম্যাকলীন © Chris Walter/WireImage

১৯৭১ সালের নভেম্বরে ম্যাকলীনের সর্বাধিক বিখ্যাত গান ‘আমেরিকান পাই’ প্রকাশ পায়। এর সাথে সাথেই আন্তর্জাতিকভাবে তারকাখ্যাতি পেয়ে যান তিনি। একই নামে অ্যালবামের তোড়জোড় আরম্ভ হয়। এই ধারায় দ্বিতীয় গান হিসেবে বাজারে এসেছিল ভিনসেন্ট। ১৯৭১ সালের জুনে রেকর্ড করা হয় এই গান, তবে বাজারে ছাড়া হয় পরের বছর। যুক্তরাষ্ট্রের চার্টে দ্বাদশ আর যুক্তরাজ্যে এক নম্বরে উঠে আসে ভিনসেন্ট। যুক্তরাজ্যে সাত সপ্তাহ টানা এই অবস্থান ধরে রাখে গানটি। চার্টভুক্ত ছিল টানা ৫৩ সপ্তাহ। পাশাপাশি আয়ারল্যান্ডেও চার্টের প্রথমে উঠে আসে ভিনসেন্ট

ভিনসেন্টের প্রচারে ডন ম্যাকলীন; Image Source: countrythangdaily.com

ভিনসেন্ট নিয়ে আরেকটি কথা না বললেই নয়। ইতিহাসের অন্যতম প্রভাবশালী র‍্যাপার টুপাক শাকুরের প্রিয় গান ছিল ‘ভিনসেন্ট’। বলা হয়, তিনি যখন মৃত্যুশয্যায়, তখন তার ইচ্ছানুসারে বাজানো হয়েছিল এই গান। গিটারের মূর্ছনায় ‘ভিনসেন্ট’ শুনতে শুনতেই নাকি চিরঘুমে তলিয়ে যান শাকুর। 

Related Articles