Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

দেশে দেশে ঈদ পালনের যত রীতিনীতি

ঈদ মানে খুশি, ঈদ মানে আনন্দ। এই আনন্দ আর খুশি উদযাপনের ব্যাপারটা যেন একেবারেই নিজের পছন্দমতো হতে হয়। কেউ এক কাপ চা পেয়ে খুশি, তো কেউ খুশি গাড়ি-বাড়ি পেয়ে; কেউ খুশিতে কেঁদেকেটে অস্থির হয়ে যায়, তো কেউ আবেগের আতিশায্যে একদম চুপ করে বসে থাকে। যে যেভাবেই আবেগ প্রকাশ করুক না কেন, খুশির ছটা লেগে থাকে সবার চোখে-মুখে। এই অনুভূতি কখনোই চেপে রাখা যায় না। আর খুশির উৎস যদি হয় ঈদের মতো কোনো মহিমান্বিত উৎসব, তবে আবেগ-অনুভূতি প্রকাশের যেন কোনো কমতি থাকে না।

মাসব্যাপী সিয়াম সাধনার পরে মুসলিম উম্মাহর সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব হলো পবিত্র ঈদ-উল-ফিতর। পৃথিবীর সব মুসলিম কিংবা অমুসলিম দেশেও বেশ ঘটা করে পালন করা হয় ঈদের এ খুশির দিনটি। তবে যেকোনো উৎসবের সাথেই মিশে থাকে প্রতিটি দেশের নিজস্ব সংস্কৃতি, আচার-অনুষ্ঠান। ঈদও তার ব্যতিক্রম নয়। সেমাই ছাড়া যেমন বাঙালির ঈদ জমেই না, ঠিক তেমনি সোমালিয়াতে হালভো ছাড়া ঈদের আমেজই যেন আসে না। চলুন তবে দেখে আসা যাক বিশ্ব মানচিত্রের কোথায় কিভাবে ঈদ উদযাপন করা হয়।

দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া

দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে, বিশেষত ব্রুনেই, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া এবং সিঙ্গাপুরে ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনার সাথে পালন করা হয় ঈদের দিনটি। মূলত যেকোনো অনুষ্ঠানের প্রধান আকর্ষণ হলো মজাদার সব খাবার। কোন দেশের খাবারের মেন্যু কি তা জেনেই অনেক সময় সেখানকার উৎসব পালনের ঘটা টের পাওয়া যায়। আর এদিক থেকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলো বেশ খানিকটা এগিয়ে আছে। এখানকার খাবারের মেন্যুতে মাংসের উপস্থিতি বেশ লক্ষ্যণীয়। কয়েক ধরণের মাংসের তরকারি, ডামপ্লিং, কেটুপাত বা ডোডোল জাতীয় মিষ্টান্ন, বাঁশে রান্না করা ভাত লেমাং- এই সবকিছুর মধ্যেই মিশে আছে দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় দেশগুলোর ঈদ।

মিশর

মিশরীয়দের ঈদ প্রস্তুতি, ibtimes.co.uk

ঈদ উদযাপনে মিশর যেন অন্যদের চেয়ে এক কাঠি উপরে রয়েছে। এখানে ঈদ পালন করা হয় টানা চার দিন ব্যাপী। আর এই পুরো সময়টা জুড়ে উৎসবের প্রাণ হয়ে থাকে মজাদার সব মাছের আয়োজন। পিরামিডের শহর মিশরের অন্যতম একটি ঐতিহ্যবাহী খাবার হলো ফাতা যা ভাত, মাংস, পেঁয়াজ, ভিনেগার সবকিছুর মিশ্রণে রান্না করা হয়। ফাতার পাশাপাশি কাহক নামের আরেকটি দারুণ জনপ্রিয় কুকি বা বিস্কুট ছাড়াও মিশরীয়দের ঈদ একেবারেই জমে না।

ইরাক

রমজান এবং ঈদের সাথে সম্পর্কিত প্রতিটি উৎসবে ইরাকিরা বেশি গুরুত্ব দেয় খেজুরের উপর। ক্লাইচা নামের একটি ঐতিহ্যবাহী খাবার ইরাকে খুব প্রচলিত যা না থাকলে ইরাকিদের যেকোনো অনুষ্ঠান অসম্পূর্ণ রয়ে যায়। ক্লাইচা মূলত এক ধরণের কুকি যা বাদাম, খেজুর এবং গুলকন্দ দিয়ে বানানো হয়। যেহেতু এতে খেজুর রয়েছে, ঈদ-উল-ফিতরে ইরাকিদের কাছে এর মহিমা কতোটা বেশি হতে পারে তা বলাই বাহুল্য।

আফগানিস্তান

ডিম যুদ্ধের প্রস্তুতি, alrifai.com

আপনি জানেন কি, আফগানিস্তানে ঈদ উৎসব পালনের জন্য ডিম যুদ্ধের আয়োজন করা হয়? পুরুষদের জন্য খোলা কোনো ময়দানে তখম-জাঙ্গির আয়োজন করা হয় যেখানে তারা পরস্পরের দিকে সেদ্ধ করা ডিম ছুড়ে মারে। সিএনএনের খবর অনুযায়ী, আফগানিস্তানে যখন তালেবানরা ব্যাপক আক্রমণ শুরু করেছিল, তখনো আফগানিরা ঈদের দিন ঠিকই ডিম যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে নিজেদের ঐতিহ্য বজায় রেখেছে।

বার্মা বা মায়ানমার

যেমনটা বলছিলাম, উৎসবের সাথে মিলেমিশে একাকার হয়ে যায় দারুণ স্বাদের মজাদার সব খাবার দাবার। বার্মিজদের মধ্যে সুজি দিয়ে তৈরি বিভিন্ন ডেজার্টের চাহিদা ব্যাপক। ঈদের দিন তাই বার্মার প্রতি ঘরে ঘরে অত্যাবশ্যক হয়ে দাঁড়ায় দুটি পদ। একটি তো অবশ্যই সুজির ডেজার্ট, অপরটি হলো বার্মার বিশেষ বিরিয়ানি যা ঈদ উপলক্ষে মাংসের সাথে বাদাম মিশিয়ে অন্যরকম করে রান্না করা হয়।

তুরস্ক

সেকের বায়রামি’, আমরা যাকে ঈদ বলি তুর্কিরা তাকে এই নামেই চেনে। দিনটিকে তারা উৎসর্গ করে বহুবিধ ঐতিহ্যবাহী মিষ্টান্নর নামে। বাচ্চারা প্রতিবেশি, বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়-স্বজনের বাসায় বেড়াতে যায় আর ভালোবাসা ও আশীর্বাদের নিদর্শন স্বরুপ তাদের পাতে তুলে দেয়া হয় টার্কিশ ডিলাইট এবং বাকলাভার মতো মজাদার সব খাবার।

ইন্দোনেশিয়া

ইন্দোনেশিয়ার মসজিদ, huffpost.com

দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশের মতো করেই ইন্দোনেশিয়ায় ঈদ উদযাপন করা হয়। এখানকার অধিবাসীরা বেশ জমজমাট আয়োজন করে ‘কুয়ে লাপিস লেগিত’ নামের একটি মিষ্টি জাতীয় খাবার তৈরি করে। এই খাবারটি হাজার লেয়ারের কেক নামে বেশি পরিচিত। ধারণা করা হয়, ডাচদের কাছ থেকে এই রেসিপিটি ইন্দোনেশিয়ায় জনপ্রিয় হয়েছে। মাখন, মসলা ও ময়দার সমন্বয়ে তৈরি এই ডেজার্টটি ইন্দোনেশীয়দের ঈদের আনন্দ বাড়িয়ে তুলেছে বহুগুণে।

সৌদি আরব

শতভাগ মুসলিম অধ্যুষিত দেশ সৌদি আরবে খুব আন্তরিক উপায়ে ঈদ-উল-ফিতর পালন করা হয়। বাড়ির সামনে কম্বল বিছিয়ে বসে সবাই তাদের রান্না করা খাবার প্রতিবেশি কিংবা পথচারীদের সাথে ভাগাভাগি করে নেয়। শিশুদের বিনোদনের জন্য শহর জুড়ে আতশবাজির খেলা দেখানোর ব্যবস্থা করা হয়। খুব একটা খরচাপাতি না করেও যে একটি উৎসব সবার মন ছুঁয়ে যেতে পারে তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ মেলে সৌদি আরবে।

সোমালিয়া

সোমালিয়ানদের কাছে ঈদ মানেই লোভনীয় সব মনোহর খাবারের আয়োজন। শুরুতেই বলছিলাম সোমালিয়ার ঐতিহ্যবাহী মিষ্টি হালভোর কথা। হালভো বানানো হয় তেল, চিনি, কর্নস্টার্চ এবং হরেক রকমের মসলা মিশিয়ে। সোমালিয়ানরা ঈদের অনুষ্ঠানে আর যা-ই হোক হালভো বানাতে কখনো ভুল করে না।

আজারবাইজান

আজারবাইজানে ঈদ উৎসব, dawn.com

মুসলিম অধ্যুষিত দেশ আজারবাইজানে মাহে রমজান এবং রমজান পরবর্তী ঈদ-উল-ফিতর খুবই সম্মান এবং শ্রদ্ধার সাথে পালিত হয়। পরিবারগুলো পরস্পর মিষ্টি এবং অন্যান্য উপহার সামগ্রী বিনিময় করে। এই দিনে সবাই কোলাকুলি করে ঈদের খুশি ভাগ করে নেয়। ঈদের নামাজের পর পরিবারের মৃত সদস্যদের কবর যিয়ারত করে তাদের বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা করে তারা। আজারবাইজানের দুই দিন ব্যাপী আয়োজিত ঈদ উৎসবের প্রায় পুরোটাকেই ঘিরে থাকে সেখানকার মসজিদগুলো।

সংযুক্ত আরব আমিরাত

সংযুক্ত আরব আমিরাতে ঈদ মানে হাজারো সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, চমৎকার সব নাটক বা শো এবং অভাবনীয় অফারের ছড়াছড়ি। রণ-পা, নৃত্যশিল্পী, ভাঁড়, জাদুকর, বেলুনওয়ালা দিয়ে ভরে যায় এখানকার রাস্তাগুলো। লোকে লোকারণ্য থিম পার্ক আর সার্কাস দেখে বোঝা যায় জাঁকজমকপূর্ণ ঈদ আয়োজন কাকে বলে! সংযুক্ত আরব আমিরাতের প্রতিটি রাস্তা তার সৌন্দর্যের পসরা খুলে বসে পরিবারে প্রতিটি সদস্যের জন্য।

চীন

চায়নায় ঈদ উদযাপন, ibtimes.co.in

ঈদ উপলক্ষে চীনের মুসলিম এবং অমুসলিম উভয়ের জন্যই ২-৩ দিনের সরকারি ছুটির ব্যবস্থা করা হয়। সকালবেলা ঈদের নামাজ শেষে চাইনিজ মুসলিমরা পূর্বপুরুষদের স্মৃতি রোমন্থন করে দরিদ্রদের মধ্যে খাবার বিলি করে। তাছাড়া সাংস্কৃতিক বিপ্লবের সময় নিহতদের জন্য বিশেষ প্রার্থনার ব্যবস্থাও করা হয় এই দিনটিতে।

মালয়েশিয়া

রাজনীতিবিদ, চাকরিজীবী, ব্যবসায়ী, বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজন এবং পরিবারবর্গ- ঈদের দিন সবাই ঘরের দুয়ার খুলে অভ্যর্থনা জানায় মালয়েশিয়ার প্রতিটি মানুষকে। নামাজ শেষে কেটুপাত, লেমাং, রেন্ডাঙ্গের মতো মিষ্টান্ন খেয়ে ঘরের সামনে পেলিতা নামক মোম জ্বালিয়ে ঈদের শোভা বাড়িয়ে তোলে মালয়েশিয়ানরা। আতশবাজির মনোমুগ্ধকর খেলার সাথে প্রায় ২-৩ দিন ধরে ঈদ আয়োজন চলতে থাকে মালয়েশিয়ায়।

মরিশাস

মরিশাসে ঈদ উদযাপিত হয় একেবারে সাদামাটাভাবে। দিনটির প্রধান আকর্ষণ থাকে বিরিয়ানি। নামাজ শেষে পরস্পর ‘ঈদ মোবারক’ বলে কোলাকুলি করে বাটিভর্তি বিরিয়ানি বিনিময় করে মরিশাসের মুসলিমরা। বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজন সবাই একসাথে বসে দুপুরের খাবার খায়। একদিনের সরকারি ছুটিতে ঈদ উপলক্ষ্যে পারিবারিক বন্ধনের দৃঢ়তা বেড়ে যায় বহুগুণে।

যুক্তরাষ্ট্র/কানাডা

এখানে ঈদের নামাজ আদায় করা হয় ইসলামি কেন্দ্র, খোলা মাঠ বা কনভেনশন হল অথবা মসজিদে। বিভিন্ন দেশের লাখ লাখ মুসলিম তাদের নিজস্ব সংস্কৃতি অনুযায়ী পোশাক পরিধান করে ঈদগাহে একত্রিত হয়। বাচ্চাদের মধ্যে উপহার বিতরণ করা হয় এবং শুধুমাত্র এই দিনটিকে মাথায় রেখে বেশ কিছু দারুণ স্পাইসি খাবার রান্না করা হয়। মুসলিমরা স্থানীয় দরিদ্র লোকজনদের মাঝে খাবার বা অর্থ বিলি করে ঈদের খুশিতে তাদেরও সামিল করে নেয়।

ভারত

ভারতীয়দের ঈদ উদযাপন, pagalparrot.com

দূর-দূরান্ত ঘুরে এবার তাকানো যাক ঘরের পাশে, মানে আমাদের প্রতিবেশি দেশ ভারতের দিকে। আমাদের মতোই ঈদের আগের রাতকে তারাও ‘চাঁদ রাত’ হিসেবে পালন করে। মেয়েরা দুই হাত ভরে মেহেদি লাগিয়ে বরণ করে নেয় ঈদের চাঁদকে। ঈদের নামাজের পর সালামি নিয়ে কাড়াকাড়ি পড়ে যায় বাচ্চাদের মধ্যে। ভারতীয়দের কাছে ঈদ মানে যেন সেভিয়া খাওয়ার বাহানা, এই মিষ্টিটি ছাড়াও নানা পদের কাবাব, নেহারি, হালিম সহ হরেক রকমের মুখরোচক খাবারে সরগরম হয়ে থাকে ভারতের প্রতিটি ঘর।

আরেকটি কথা এখানে উল্লেখ না করলেই নয়। নতুন সিনেমা মুক্তি না পেলে ভারতীয়দের কাছে ঈদই যেন পানসে মনে হয়। তাই তো প্রতি বছর কয়েকশ কোটি টাকার বলিউড সিনেমা নির্মিত হয় শুধুমাত্র ঈদকে সামনে রেখে।

যে দেশে ঈদ যেভাবেই পালিত হোক না কেন, ঈদের খুশির কিন্তু তাতে মোটেই কমবেশি হয় না। সবাইকে পবিত্র ঈদ-উল-ফিতরের শুভেচ্ছা।

ফিচার ইমেজঃ utsavpedia.com

Related Articles