Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

জোহরা সেহগাল: আনন্দে পরিপূর্ণ চিরসবুজ এক প্রাণ

মনিরত্নমের ‘দিল সে’ সিনেমার ‘জিয়া জ্বালে’ গানটি যারা দেখেছেন তাদের কি প্রীতি জিনতার সাথে নৃত্যরত সেই হাস্যময়ী বৃদ্ধার কথা মনে আছে? বলছি জোহরা সেহগালের কথা। পরে তার জীবন আর কাজ নিয়ে পড়তে গিয়ে জেনেছি শুধু একজন খ্যাতিমান অভিনেত্রী ও নৃত্যশিল্পীই নন, জোহরা ছিলেন সাহস, সংগ্রাম আর প্রাণবন্ততার উজ্জ্বল অনুপ্রেরণা। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে খ্যাতি পাওয়া জোহরা ১০২ বছর বয়সে মারা যাওয়ার আগপর্যন্ত ছিলেন প্রাণচাঞ্চল্য আর উদ্যমে ভরপুর।

জীবনের কাছে হার না মানা জোহরা; ছবিসূত্রঃ scoopwhoop.com

১৯১২ সালের ২৭ এপ্রিল, উত্তরপ্রদেশের এক অভিজাত মুসলিম পরিবারে জন্ম হয় জোহরার। পারিবারিকভাবে জোহরার নাম রাখা হয় সাহেবজাদি জোহরা বেগম মমতাজ উল্লাহ খান। অল্প বয়সেই মাকে হারান তিনি। মুসলিম পরিবারের কঠোর শাসনের মধ্য দিয়ে বড় হওয়া সত্ত্বেও তিনি ছিলেন টম বয়ের মতন দুরন্ত, আর ভালবাসতেন নাচ করতে। মায়ের শেষ ইচ্ছানুযায়ী ১৯২০ সালে পড়াশোনার উদ্দেশ্যে জোহরাকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় লাহোরের কুইন্স মেরি গার্লস কলেজে। এখানকার পড়াশোনা শেষ করেই বন্ধুত্ব গড়েন নাচের সাথে। যে যুগে তিনি জন্মেছিলেন, সে সময়কার ভারতবর্ষের মেয়েরা মুখের উপর থেকে ঘোমটা সরানো তো দূরের কথা, বাইরের কোনো পুরুষের সামনেও আসতো না। সেখানে জোহরা সাহস করেছিলেন, ভেঙেছিলেন প্রথা।

গুরু ও সহশিল্পী উদয়শংকরের সাথে; ছবিসূত্রঃ India Today

ভারতীয় নারী হিসেবে তিনিই প্রথম জার্মানির ড্রেসডেনের প্রখ্যাত নৃত্যশিল্পী ম্যারি উইগম্যানের ব্যালে স্কুল থেকে ব্যালে শেখেন। ইউরোপেই একদিন বিশ্বখ্যাত নৃত্যশিল্পী উদয়শংকরের ‘শিব-পার্বতী’ পরিবেশনায় মুগ্ধ হয়ে তার দলে যোগ দেওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। উদয়শংকরও তাকে সানন্দে অভ্যর্থনা জানান। পরবর্তীতে জোহরা এই দলের সাথে পারফর্ম করেছেন জাপান, মিসর, আমেরিকা ও ইউরোপে, পেয়েছেন অগণিত মানুষের ভালোবাসা।

স্বামী কামেশ্বর সেহগাল ও জোহরা সেহগাল; ছবিসূত্রঃ Times of India

হিমালয়ের পাদদেশে অবস্থিত উত্তরাখণ্ডের আলমোরায় অবস্থিত উদয়শংকর ইন্ডিয়া সাংস্কৃতিক কেন্দ্রে নাচের শিক্ষক হিসেবে যোগ দেওয়ার পর তার পরিচয় হয় কামেশ্বর সেহগালের সাথে। কামেশ্বর একাধারে নৃত্যশিল্পী, চিত্রকর ও বিজ্ঞানসাধক ছিলেন। ইন্দোরের হিন্দু ঘরের ছেলে কামেশ্বরের সাথে জোহরার পরিচয়ের সম্পর্ক গড়ায় পরিনয়ে। কামেশ্বর জোহরার চেয়ে ৮ বছরের (মতান্তরে ১০ বছরের) ছোট ছিলেন। দুই পরিবারের অমতেই ১৯৪২ সালের ১৪ আগস্ট তারা বিয়ে করেন। বিয়ের অনুষ্ঠানে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক জওহরলাল নেহেরুর উপস্থিত থাকার কথা ছিল। কিন্তু বিয়ের ক’দিন আগেই ব্রিটিশ সেনাবাহিনী কর্তৃক নেহেরু গ্রেফতার হওয়ায় সেটি আর হয়ে ওঠেনি। তখন উপমহাদেশে চলছে হিন্দু-মুসলিম আলাদা করে দেশভাগের প্রস্তুতি, হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা চরমে। অন্যদিকে জোহরা আর কামেশ্বর আবদ্ধ হচ্ছেন সারা জীবনের বাঁধনে।

সদা হাস্যময়ী জোহরা; ছবিসূত্রঃ Alechetron

লাহোরে জোহরা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন নিজের নাচ শেখানোর প্রতিষ্ঠান ‘জোহরা ড্যান্স ইন্সটিটিউট‘। কিন্তু সেখানকার দাঙ্গা-হাঙ্গামায় টিকতে না পেরে ১৯৪৫ সালে ফিরে আসেন ভারতে, কাজ শুরু করেন পৃথ্বী থিয়েটারে। পৃথ্বী থিয়েটারে তিনি মাসিক ৪০০ রুপি বেতনে কাজ নেন এবং পরবর্তী ১৪ বছর সমস্ত ভারতে থিয়েটার দলের সাথে পারফর্ম করার চুক্তিতে আবদ্ধ হন। ১৯৪৬ সালেই বলিউডে তার সর্বপ্রথম পদার্পণ ঘটে পরিচালক খাজা আহমেদ আব্বাসের হাত ধরে। সিনেমার নাম ‘ধারতি কে লাল’। একই বছর কাজ করেন চেতান আনান্দের ‘নিচা নগর’ সিনেমায়। এই ছবিতে সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে কাজ করেন ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের আরেক দিকপাল রবিশঙ্কর। সর্বপ্রথম ভারতীয় সিনেমা হিসেবে এটি ফ্রান্সের কান চলচ্চিত্র উৎসবে সেরা বিদেশি ভাষার ছবি ক্যাটাগরিতে জিতে নেয় পাম ডি অর পুরস্কার। অভিনয়ের পাশাপাশি বলিউডে কাজ করেছেন কোরিওগ্রাফার হিসেবে। গুরু দত্তের ‘বাজি’ এবং রাজ কাপুরের ‘আওয়ারা’ এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য।

মেয়ে কিরণ সেহগালের সাথে; ছবিসূত্রঃ Hindustan Times

তার জীবনের সবচেয়ে বড় আঘাতটি আসে ১৯৫৯ সালে। সেই বছর তার স্বামী কামেশ্বর মৃত্যুবরণ করেন। স্বামীর মৃত্যুর পর জোহরা মুম্বাই থেকে দিল্লীতে চলে আসেন এবং নব্য প্রতিষ্ঠিত নাট্য একাডেমীর পরিচালক হিসেবে যোগ দেন। ১৯৬২ সালে ড্রামা স্কলারশিপ পেয়ে দুই সন্তান সহ পাড়ি জমান লন্ডনে। তার মেয়ে কিরণ সেহগাল বর্তমানে একজন বিখ্যাত উড়িশি নৃত্যশিল্পী।

‘তান্দুরি নাইটস’ সিনেমায় সহকর্মীদের সাথে; ছবিসূত্রঃ বলিউড গুগলি

লন্ডনে থাকাকালীন ১৯৬৪-১৯৬৫ সালে তিনি কাজ করেন ‘ডক্টর হু’ সিরিজে। এছাড়াও বিবিসির টিভি সিরিজ ‘পাড়োসি’র ২৬টি এপিসোড উপস্থাপনাও করেন। জোহরা দ্য জুয়েল ইন ক্রাউন, তান্দুরি নাইটস এবং মাই বিউটিফুল লনড্রেট-এ বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকায় অভিনয় করেছেন। ১৯৯০ এর মাঝামাঝি সময়ে তিনি ভারতে ফিরে আসেন, শুরু করেন আবৃত্তি। বিভিন্ন জায়গায় আবৃত্তির স্টেজ শো করেছেন প্রচুর, করেছেন থিয়েটার। তখন বয়স ৮০ ছুঁই ছুঁই।

অমিতাভের সাথে ‘চিনি কম’ সিনেমার একটি দৃশ্যে; ছবিসূত্রঃ Mens world India

এরপর আবার কাজ শুরু করেন বলিউডে। কাজ করেছেন বলিউডের কয়েক প্রজন্মের নায়কদের সাথে। দেব আনন্দ, অশোক কুমার, অমিতাভ বচ্চন, পৃথ্বীরাজ কাপুরদের মতো প্রবীণ নায়ক থেকে শুরু করে নতুন গোবিন্দ, শাহরুখ, রণবীর কাপুরের সাথেও কাজ করেছেন। এছাড়াও ইংরেজি ভাষার বেশ কিছু ছবিতে অভিনয় প্রতিভার ছাপ রেখেছেন এই গুণী মানুষটি। এর মধ্যে ‘দ্য ভেনজান্স অফ শি’, ‘টেলস  দ্যাট উইটনেস ম্যাডনেস’, ‘নেভার সে ডাই’, ‘বেন্ড  ইট লাইক বেকহ্যাম’, ‘ভাজি অন দ্য বিচ’ অন্যতম। সর্বশেষ ২০০৭ সালে সঞ্জয় লীলা বানসালির ‘সাওয়ারিয়া’-তে কাজ করেছিলেন জোহরা।

সাওয়ারিয়া সিনেমাতে জোহরা সেহগাল ও রণবীর কাপুর; ছবিসূত্রঃ The New York Times

জোহরা ভালোবাসতেন জীবনকে। জানতেন কীভাবে রাখতে হয় হৃদয়ের দাবি। রক্ষণশীল পরিবার, তৎকালীন সমাজ, অর্থাভাব, স্বামীর মৃত্যু, বার্ধক্য, ক্যান্সার কোনো কিছুই তাকে দমাতে পারেনি। তিনি চলেছেন তার নিজের তৈরি রাস্তায়। স্বীকৃতি হিসেবে পেয়েছেন ভারতের রাষ্ট্রীয় সম্মান ‘পদ্মশ্রী’ ও ‘পদ্মবিভূষণ’ উপাধি।

কারিনা কাপুর ও জোহরা সেহগাল; ছবিসূত্রঃ Bollywood Bubble

বলিউডের ‘দ্য গ্র্যান্ড ওল্ড লেডি’ খ্যাত জোহরা ছিলেন সবার জন্য এক অনুপ্রেরণা। পরিচালক মহেশ ভাট বলেন “দশ বছর আগে একবার তাকে প্রশ্ন করেছিলাম, একটি শব্দে নিজের জীবনকে ব্যাখ্যা করুন। হাসিমুখে উত্তর দিয়েছিলেন ‘কৃতজ্ঞতা’।” অমিতাভ বচ্চনের মতে তাঁর প্রাণচাঞ্চল্য ছিল যেকোনো টিন এজারকে লজ্জা দেয়ার মতো। বলিউড অভিনেত্রী কারিনা কাপুর বলেনআমি তাঁর মতো ক্যারিয়ার চাই। ৮০ বছর বয়সেও থাকতে চাই ক্যামেরার সামনে।

জন্মদিনে জোহরা সেহগাল; ছবিসূত্রঃ AMP. Outlook India

২০১৪ সালের ১০ই জুলাই নয়াদিল্লীর ম্যাক্স হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন জোহরা। জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত তিনি ছিলেন একজন হার না মানা যোদ্ধা। ছোটবেলায় গ্লুকোমায় আক্রান্ত হওয়ায় বাঁ চোখে দেখতে পেতেন না। পরে অবশ্য বার্মিংহামের একটি হাসপাতালে এর চিকিৎসা করান। ১৯৯৪ এ ধরা পড়ে ক্যান্সার। জোহরা অতিক্রম করেছেন সকল বাধা-বিপত্তি। প্রমাণ করে গেছেন অদম্য প্রাণশক্তির কাছে কোনো কিছুই বাধা নয়। শুধু জীবনটাকে ভালোবাসতে জানতে হবে, একে জয় করে নিতে হবে।

ফিচার ছবিসূত্রঃ ichef.bbc.co.uk

Related Articles