জার্মান ভাষায় 'বাওহাউস' শব্দের অর্থ 'বিল্ডিং হাউজ'। এর আরেক অর্থ 'স্কুল অব বিল্ডিং'। বিখ্যাত এই আর্ট স্কুলের এমন নামকরণের পেছনে ছিল প্রতিষ্ঠাতা ওয়াল্টার গ্রোপিয়াসের। গ্রোপিয়াস পেশায় একজন স্থাপত্যবিদ ছিলেন। ১৯১৯ সালে বাওহাউস প্রতিষ্ঠিত হলেও শুরুতে এখানে স্থাপত্যবিদ্যার কোনো শাখা ছিল না। তবে জার্মানির বিখ্যাত এই প্রতিষ্ঠানটির উদ্দেশ্য ছিল সকল ধরনের আর্ট ও ডিজাইন নিয়ে কাজ করা। সেই লক্ষ্যে বাওহাউস আর্ট বা বিভিন্ন ধরনের শিল্প, স্থাপত্য, গ্রাফিক্স ডিজাইন, ইন্টেরিয়র ডিজাইন, মুদ্রণশিল্প এবং বিভিন্ন পণ্যের ডিজাইন নিয়ে কাজ শুরু করে।
১৯১৯ সালে স্থাপত্যবিদ ওয়াল্টার গ্রোপিয়াস জার্মানির ওয়েইমার শহরে বাওহাউস চালু করেন। তবে শুরু ওয়েইমারে হলেও পরবর্তীতে দুইবার এর স্থান পরিবর্তন করে ডেসাসু ও বার্লিনে নিয়ে যাওয়া হয়। তিনটি স্থানে মোট তিনজন আলাদা আলাদা স্থাপত্যবিদ পরিচালক হিসেবে বাওহাউসের নেতৃত্ব দেন। প্রথমে ১৯১৯ সাল থেকে ১৯২৮ সাল পর্যন্ত বাওহাউসের প্রধান ছিলেন গ্রোপিয়াস।
এরপর যখন প্রতিষ্ঠানটি ওয়েইমার থেকে সরিয়ে ডেসাসুতে নিয়ে যাওয়া হয়, তখন এর প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন হ্যানেস মেয়ার। তিনি মাত্র দুই বছর নেতৃত্ব দেওয়ার সুযোগ পান। ১৯৩০ সালে বাওহাউসকে সরিয়ে বার্লিনে নেওয়া হলে পরিচালক হন লুডউইগ মাইজ ভ্যান ডার রোহ।
বাওহাউসের স্থান ও পরিচালক পরিবর্তনের সাথে সাথে এর লক্ষ্য, কৌশল, প্রশিক্ষক এবং রাজনৈতিক মতাদর্শের ব্যাপক পরিবর্তন ঘটতে থাকে। ওয়েইমার থেকে যখন এই প্রতিষ্ঠানটি ডেসাসুতে স্থানান্তর করা হয়, তখন এর আয়ের অন্যতম উৎস মৃৎশিল্প বিক্রি বন্ধ করে দেওয়া হয়। এরপর ১৯৩০ সালে ভ্যান ডার রোহ যখন দায়িত্ব গ্রহণ করেন, তখন তিনি বাওহাউসকে প্রায় ব্যক্তিগত প্রতিষ্ঠানে রূপদান করেন। এবং আগের পরিচালক হ্যানেস মেয়ারের সমর্থকদের নিষিদ্ধ করেন।
তবে ভ্যান ডার রোহ খুব বেশিদিন তার পদে থাকতে পারেননি। ১৯৩৩ সালে জার্মানির নাৎসি সরকার বাওহাউসকে কমিউনিস্টদের বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চাকেন্দ্র হিসেবে আখ্যায়িত করে বন্ধ করে দেয়। তবে প্রতিষ্ঠানটি বন্ধের পরও এর সাথে জড়িত বিভিন্ন কর্মকর্তা তাদের আদর্শকে ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেন।
বাওহাউসের শিল্প আন্দোলন
স্থাপত্যবিদ্যা থেকে শুরু করে অন্যান্য শিল্পক্ষেত্রের উন্নতি সাধনে একক প্রতিষ্ঠান হিসেবে বাওহাউসের অবদান অনেক বেশি। তাদের শুধুমাত্র বিভিন্ন শিল্প ও ডিজাইন নিয়ে কাজ করা মূল উদ্দেশ্য ছিল না। বরং তাদের মূলনীতি ছিল শিল্প, সমাজ ও প্রযুক্তির সাথে গভীর সম্পর্ক সৃষ্টি এবং চারুকলা ও ফলিত কলার মধ্যে প্রভেদ দূর করা। এটি ছিল বাওহাউসের শিল্প আন্দোলন, যা খুব দ্রুতই ইউরোপ ও আমেরিকায় ছড়িয়ে পড়ে। এমনকি মাত্র ১৪ বছরের মধ্যে তাদের প্রতিষ্ঠানটি বন্ধ হয়েও গেলেও তাদের সৃষ্টিকর্ম এবং আবিষ্কারসমূহ ছড়িয়ে পড়ে বিশ্বজুড়ে।
শিল্প বিপ্লবের পর থেকে শিল্প কারখানায় উৎপাদন অনেক বেড়ে যায়। এর সাথে সাথে অতি সাধারণ মানের পণ্য উৎপাদনের হার অনেক বাড়তে থাকে। এতে অনেকে সমাজে শিল্পের গুরুত্ব হারানোর সম্ভাবনা দেখেন। সেই শঙ্কাকে দূর করার জন্য ঊনিশ শতকের শুরুর দিকেই চারুকলা ও চলিত ডিজাইনকে ঐক্যবদ্ধ করার জন্য গ্রোপিয়াস বাওহাউস চালু করেন। জার্মান প্রতিষ্ঠানটি অমর হয়ে আছে তার স্থাপত্যকৌশল এবং তাদের আধুনিক বিল্ডিং ডিজাইনের কারণে। এছাড়া টেক্সটাইল খাতেও তারা ব্যাপক পরিবর্তন আনেন।
নারীদের সুযোগ প্রদান, তবে সম্মান নয়
নাৎসি সরকার বাওহাউসকে বন্ধ করে দেওয়ার অন্যতম কারণ ছিল প্রতিষ্ঠানটির প্রগতিশীল চিন্তাধারা। বাওহাউসের প্রতিষ্ঠাতা ওয়াল্টার গ্রোপিয়াস ব্যক্তি হিসেবে নিজেও একজন প্রগতিশীল মননের ছিলেন। তিনি যখন বাওহাউস চালু করেন, তখন তিনি নারী পুরুষকে উভয়কে তার প্রতিষ্ঠানে আসতে আহবান জানান। তিনি যেকোনো বয়সের নারী ও পুরুষকে তার প্রতিষ্ঠানে কাজ করার ও শেখার সুযোগ করে দেন। তার এই উদ্যোগের পর প্রথম বছরেই পুরুষের চেয়ে নারী প্রশিক্ষণার্থীর আবেদন বেশি পড়ে ।
নারীদের শেখার সুযোগ করে দিয়ে বাওহাউস প্রগতিশীল প্রতিষ্ঠান হিসেবে সুনাম কুড়ায়। তবে প্রগতিশীল এই প্রতিষ্ঠানটিও পুরোপুরি লিঙ্গ বৈষম্য কমাতে পারেনি। গ্রোপিয়াস তার প্রতিষ্ঠানকে নারীদের জন্য উন্মুক্ত ঘোষণা করলেও বাস্তবতা তেমন ছিল না। প্রতিষ্ঠা লাভের এক বছরের মধ্যে বাওহাউসে মোট ৪৫ জন প্রশিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়। এর মধ্যে নারী প্রশিক্ষক ছিলেন মাত্র ৬ জন।
তৎকালীন জার্মান সমাজে নারীরা পুরুষদের চেয়ে অনেক পিছিয়ে ছিলেন। সেখান থেকে তাদেরকে এগিয়ে আনার চেষ্টা করে বাওহাউস। কিন্তু তারাও নারীদের সঠিকভাবে মূল্যায়ন করেনি। বাওহাউসে অনেক প্রতিভাবান নারী ডিজাইনার ছিলেন। কিন্তু তাদের শিল্পকর্মকে কখনোই সঠিকভাবে প্রকাশ করা হয়নি।
পাদপ্রদীপের বাইরে ছিলেন যে সকল নারী ডিজাইনার
বাওহাউসে যতজন নারী কাজ করেছেন তার মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত অ্যানি আলবার্স। তবে তার মতো আরো অনেক নারী জার্মানির এই আর্ট স্কুলে নিজেদের শিল্প নিয়ে গবেষণা করেছেন। কিন্তু তারা কখনোই তাদের কাজের যথাযথ মর্যাদা পাননি। এমনকি অ্যানি আলবার্সও নন। বাওহাউসের পুরুষ প্রশিক্ষক অথবা প্রশিক্ষণার্থীদের কাজকে যেভাবে সবার সামনে প্রকাশ করা হতো, সেটা নারীদের ক্ষেত্রে ঘটেনি। এই কারণে জার্মান আর্ট স্কুলটির সাথে জড়িত অনেক নারীই থেকে গেছেন পাদপ্রদীপের বাইরে। তবে এরপরও বেশ কয়েকজন নারী দেরিতে হলেও নিজেদের প্রতিভা দিয়ে নামকে প্রজ্বলিত করেছেন।
বাওহাউসের বিখ্যাত নারী ডিজাইনার অ্যানি আলবার্স ১৮৯৯ সালে বার্লিনের এক ইহুদী পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। বনেদি পরিবার থেকে উঠে আসা এই অ্যানি ছিলেন স্বাধীনচেতা ও স্বপ্নবাজ। বাওহাউসে প্রথমে তিনি কাঁচশিল্পের সাথে যুক্ত হন। পরবর্তীতে তিনি নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে বুননশিল্পে যোগ দেন। কিন্তু তিনি বুননশিল্পে সাফল্য পান।
বাওহাউসে থাকাকালীন তিনি অসাধারণ কিছু ডিজাইন তৈরি করেন। কিন্তু জার্মানিতে নাৎসিদের উত্থানের কারণে তিনি স্বামী জোসেফ আলবার্সের হাত ধরে যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমান। যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত স্থাপত্যবিদ ফিলিপ জনসন নর্থ ক্যারোলাইনার ব্লাক মাউন্টেন আর্ট স্কুলে শিক্ষকতা করার জন্য অ্যানি আলবার্সকে আমন্ত্রণ জানান। তিনি সেই আমন্ত্রণ গ্রহণ করেন। ১৯৪৯ সালে প্রথম ডিজাইনার হিসেবে নিউইয়র্কের মিউজিয়াম অব মডার্ন আর্টে অ্যানি আলবার্সের বিভিন্ন ডিজাইনের একক প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়। ১৯৯৪ সালে তিনি মৃত্যুবরণ করেন এবং তার আগে বুননশিল্পে এক বিপ্লব ঘটিয়ে যান।
বাওহাউসের মেটাল ওয়ার্কশপে প্রথম নারী হিসেবে যোগদান করেন মারিন ব্র্যান্ড। পরবর্তীতে তিনি অঙ্কনে বেশ দক্ষ হয়ে উঠেন। বাওহাউসের বিখ্যাত নারী ডিজাইনার অ্যানি আলবার্সের শিক্ষক ছিলেন মারিন ব্র্যান্ড। তিনি মূলত বাসাবাড়ির বিভিন্ন আসবাবপত্র থেকে শুরু করে রান্নার কাজে ব্যবহৃত জিনিসপত্রের ডিজাইন করতেন। শিল্পক্ষেত্রে তার করা ডিজাইন থেকে এসব তৈজসপত্রের উৎপাদন হলেও তিনি থেকে গেছেন অনেকটাই আড়ালে।
বাওহাউসের নারীরা শুধুমাত্র হস্তশিল্প কিংবা ডিজাইনের মধ্যে নিজেদের আবদ্ধ রাখেননি। তারা গবেষণা করেছেন শব্দ, রং ও আন্দোলনের মধ্যে সম্পর্কের মতো জটিল বিষয়েও। আর এক্ষেত্রে নেতৃত্ব দিয়েছেন গার্টরুড গ্রুনো। তিনি নাচ ও গানের মধ্যে ব্যবহারিক সমন্বয় সাধন করার চেষ্টা করেন। শুরুতে তিনি বাওহাউসে সহকারি শিক্ষক হিসেবে কাজ করলেও পরবর্তীতে তিনি এখানকার নারী অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
গুনতা স্টোজল প্রথমে বাওহাউস বুননশিল্পে প্রশিক্ষণার্থী হিসেবে আসেন। কোর্স সম্পন্ন করার পর তিনি প্রশিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন এবং একমাত্র নারী হিসেবে বিভাগীয় প্রধানের দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ছিলেন বুননশিল্প বিভাগের প্রধান।
স্টোজলের ডিজাইন পোশাক খাতের বাণিজ্যিক ধারায় বেশ পরিবর্তন নিয়ে আসে। এদের বাইরে বাওহাউসে আরো বেশ কয়েকজন প্রতিভাবান নারী ডিজাইনার ছিলেন। যাদের মেধা ও কাজের স্বীকৃতি খুব কমই প্রকাশ্যে এসেছে। এদের মধ্যে রয়েছেন গ্রিট স্টার্ন, লু শিপার, লিলি রাইক, লুসিয়া মোহোলি ও ফ্লোরেন্স হেনরি।
This Bangla article is about famous German art school 'Bauhaus'. Necessary references have been hyperlinked.
Featured Image: Getty Images