Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

স্ট্রিট আর্ট: দেয়াল যখন হয়ে ওঠে গণমানুষের কণ্ঠস্বর

২০১৭ সালের শেষের দিকে ঢাকার রাস্তার পাশের দেয়ালে আঁকা কিছু গ্রাফিতি বেশ সাড়া ফেলে সকলের মাঝে। ‘সুবোধ’ নামের একটি চরিত্রকে কেন্দ্র করে আঁকা গ্রাফিতিগুলোতে একটি পাগলাটে মানুষের ছবির সাথে কিছু কথা লেখা হয়েছিল, যেগুলো পরবর্তী সময়ে মানুষকে প্রচুর ভাবিয়েছে। ‘সুবোধ তুই পালিয়ে যা, তোর ভাগ্যে কিছু নেই’ কিংবা ‘সুবোধ তুই পালিয়ে যা, সময় তোর পক্ষে না’– এ ধরনের দার্শনিক ঘরানার কথা ব্যস্ত সড়কের পাশের দেয়ালে দেখতে পেলে যেকোনো মানুষই ভাবতে বাধ্য হবে। এসব গ্রাফিতির আঁকিয়ে কে?– সেটা নিয়ে আবার বিভিন্ন ষড়যন্ত্র তত্ত্বের অবতারণাও হয়েছিল সেসময়।

গ্রাফিতির কিংবা বিভিন্ন স্ট্রিট আর্টের ধারণা বাংলাদেশে নতুন নয়। অনেক আগে থেকেই বিভিন্ন শহরের দেয়ালে গ্রাফিতি আঁকা হচ্ছে, যেগুলো বেশিরভাগই বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে আঁকা হয়ে থাকে। বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসের ভেতরে বিভিন্ন ভবনের দেয়ালে প্রতিনিয়তই গ্রাফিতি আঁকা হয় ক্রিয়াশীল ছাত্র সংগঠনগুলোর মাধ্যমে। শহরের ব্যস্ত সড়কের পাশে যেসব দেয়াল অসংখ্য মানুষের দৃষ্টিগোচর হয়, সেসব দেয়ালকে গ্রাফিতি আঁকার উপযুক্ত হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

আআগহ
বাংলাদেশের রাস্তায় আলোড়ন সৃষ্টি করা ‘সুবোধ’; Image source: nprojonmo.wordpress.com

একটা বিষয় শুরুতেই পরিষ্কার করা দরকার। শুধু গ্রাফিতিই যে স্ট্রিট আর্ট, এটা ভাবলে ভুল হবে। পোস্টার, বর্ণিল ম্যুরাল কিংবা ভাস্কর্যও স্ট্রিট আর্টের তালিকায় পড়ে। কিন্তু সবচেয়ে প্রভাবশালী স্ট্রিট আর্ট হিসেবে গ্রাফিতি সবসময়ই প্রথমদিকে থাকবে। গ্রাফিতি যতটা রাজনৈতিক কিংবা আর্থ-সামাজিক বাস্তবতার ধারক হয়ে উঠতে পেরেছে, অন্যগুলো ততটা পারেনি। আরেকটি বিষয় হচ্ছে, শিল্প যে অভিজাত মানুষের বিলাসিতার জায়গা কিংবা সাধারণ মানুষ থেকে দূরে থেকে বিত্তশালীদের হাতে মুঠোবন্দী হওয়া সৃজনশীল কাজকর্ম, এসব ধারণাকে দুমড়ে-মুচড়ে দিতে গ্রাফিতি একেবারে সামনে থেকে ভূমিকা পালন করেছে। শিল্পকর্মের ক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষের অনুমতি নেয়া কিংবা দর্শককে বার্তা দেয়ার ক্ষেত্রে গ্রাফিতি ও স্ট্রিট আর্টের মধ্যেও বিভাজনের রেখা টানতে চান কেউ কেউ। গ্রাফিতি স্ট্রিট আর্টের বাইরে নয়, কিন্তু স্ট্রিট আর্টের পরিসর গ্রাফিতির মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়; তার চেয়ে অনেক বড়।

আধুনিক সময়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে সত্তর ও আশির দশকে আমেরিকাতে মূলত একটি আন্দোলন হিসেবে স্ট্রিট আর্টের যাত্রা শুরু হয়। কিন্তু এর আগেও নানাভাবে অনেকে এর অস্তিত্ব প্রমাণ করেছেন। এমনকি প্রাচীনকালের অনেক সভ্যতায়ও বেশ কিছু স্ট্রিট আর্টের দেখা মেলে। প্রাচীন রোমে এবং মিশরের ফারাওদের সময় দেয়ালে বিভিন্ন চিত্র আঁকা থাকত। আবার আধুনিক সময়ে সত্তরের দশককে স্ট্রিট আর্টের সূচনাকাল হিসেবে ধরা হলেও ত্রিশের দশকেই প্যারিসে গ্রাফিতির দেখা মিলত বলে এক সাংবাদিকের ভাষ্যে জানা যায়।

আমেরিকার নিউ ইয়র্কে পাতালরেল সড়কের পাশের দেয়ালে আঁকাআঁকির মাধ্যমে স্ট্রিট আর্টের শুরু হয় আমেরিকান শিল্পীদের হাত ধরে। কেইথ হ্যারিং প্রথমদিকের সবচেয়ে উদ্যমী ও প্রতিভাবান গ্রাফিতি আর্টিস্টদের একজন। এজন্য তাকে ঝামেলাও পোহাতে হয়েছে অনেক। বেশ কয়েকবার পুলিশ তাকে গ্রেফতার করেছে, কিন্তু গ্রাফিতির মায়া তাকে ছাড়তে পারেনি কখনও। আধুনিক সময়ে স্ট্রিট আর্টের আন্দোলন শুধু আমেরিকায় আটকে থাকেনি, ছড়িয়ে পড়েছে পুরো বিশ্বে।

ডহহসহস
আধুনিক সময়ে এসে নিউ ইয়র্কের পাতাল রেললাইনে শুরু হয় গ্রাফিতির পদচারণা, ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ে পুরো বিশ্বে; Image source: nl.pinterest.com

গ্রাফিতির মাধ্যমে সবসময় শিল্পীরা সাধারণ মানুষের প্রতিনিধি হয়ে হয়ে কথা বলেন। অনেক দেশের সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীন গণমাধ্যম বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সমাজের নিচুতলার মানুষের খবর তুলে আনতে ব্যর্থ হয়। এক্ষেত্রে সরকার যেসব নীতি গ্রহণ করে, সেসবে সাধারণ মানুষেরা যেন অবহেলিত থাকে। গ্রাফিতি শিল্পীরা সাধারণ মানুষকে সরকারি বৈষম্য সম্পর্কে সচেতন করে তোলার জন্য গ্রাফিতিকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেন। গ্রাফিতির ইঙ্গিতপূর্ণ বার্তায় সাধারণ মানুষেরা তাদেরকে কী করা উচিত, সে সম্পর্কে একটা ধারণা লাভ করে এবং অন্যদিকে ক্ষমতালোভী শাসকগোষ্ঠীও নিজেদের ভুল সম্পর্কে সতর্কবার্তা পায়।

আরব বসন্তে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের যে বিশাল ভূমিকা আছে, তা আমরা সবাই জানি। শুধু আরব বসন্তই নয়, ২০১০ সালের পর থেকে পৃথিবীতে যত আন্দোলন-সংগ্রাম হয়েছে, তার সবগুলোতেই ফেসবুক কিংবা টুইটারের মতো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোর বিশাল ভূমিকা আছে। কিন্তু এই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলো সবার কাছে পৌঁছে যাবার আগে পৃথিবীর সবখানেই গ্রাফিতিগুলো সাধারণ মানুষকে জাগিয়ে তোলার কাজ করেছে। ফেসবুক কিংবা টুইটার খুব বেশি দিন আগের ঘটনা নয়, কিন্তু মানুষের আন্দোলন-সংগ্রাম অনেক আগে থেকেই দুনিয়ায় জারি আছে।

সত্তরের দশকের পর থেকে সব আন্দোলনে মানুষকে উজ্জীবিত করতে, নিজেদের দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন করতে দেয়ালে আঁকা গ্রাফিতি কিংবা ম্যুরাল সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করেছে। আরব বসন্তের সময় স্ট্রিট আর্টিস্টরাও বসে ছিলেন না। আরব বসন্তের পর টালমাটাল হওয়া দেশগুলোর বিভিন্ন শহরের দেয়ালগুলোতে আঁকা গ্রাফিতিগুলো এখনও প্রতিনিয়ত বার্তা দিয়ে যাচ্ছে– গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রাম শেষ হয়ে যায়নি।

আববন
রাজনৈতিক নেতারা যখন জনগণের কণ্ঠ চেপে ধরেন, তখন গ্রাফিতি হয়ে ওঠে প্রতিবাদের অস্ত্র; Image source: m.huffingtonpost.com.au

স্ট্রিট আর্টের জগতে একজন কিংবদন্তির নাম ‘ব্যাঙ্কসি’। ব্যাঙ্কসি আসলে ছদ্মনাম। যে ব্যক্তি ‘ব্যাঙ্কসি’ নামে পরিচিত, তার আসল নাম কেউ জানে না। তাকে কখনও কেউ দেখেনি, কিংবা দেখে থাকলেও কেউ তাকে চিনতে পারেনি, তিনিই বিখ্যাত ‘ব্যাঙ্কসি’। ইংল্যান্ডে জন্ম নেয়া এই ব্যক্তি বর্তমান পৃথিবীর সবচেয়ে প্রতিভাবান গ্রাফিতি আর্টিস্ট, যিনি স্ট্রিট আর্টের জগতে রীতিমতো বিপ্লব ঘটিয়ে দিয়েছেন। পৃথিবীতে বলতে গেলে ৯০ শতাংশ গ্রাফিতি শিল্পীই তাদের কাজের জন্য কোনো বিনিময় মূল্য পান না, আড়ালে থাকেন বলে তাদের নিয়ে কেউ উচ্চবাচ্যও করে না। সবসময় পাদপ্রদীপের আড়ালে থাকতে হয় তাদের। সেখানে ব্যাঙ্কসির গ্রাফিতিগুলো লাখ লাখ ডলারে বিভিন্ন প্রদর্শনীতে বিক্রি হয়। যে দেয়ালে ব্যাঙ্কসি তার প্রতিভার পরিচয় দেন, সেই দেয়ালের মূল্য বেড়ে যায় শতগুণ।

প্রতিটি গ্রাফিতি শুধু রাজনৈতিক, সামাজিক কিংবা অর্থনৈতিক সমস্যাকেই যে প্রশ্নের সম্মুখীন করে আঁকা হয়, এমনটা নয়। অনেক সময় সমাজে বছরের পর বছর ধরে চলে আসা নির্মম রীতিকেও নৈতিকতার কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হয়। ব্যাঙ্গাত্মক ভঙ্গিতে সমাজের রীতিনীতিকে প্রশ্ন করায় গ্রাফিতির আর্টিস্টদের জুড়ি মেলা ভার। একটি সমাজে সিংহভাগ মানুষ কোনো নির্মম প্রথাকে আঁকড়ে ধরে রাখতে পারে, দলগতভাবে অন্যায়কে প্রতিনিয়ত সমর্থন দিয়ে যেতে পারে। গ্রাফিতি আর্টিস্টরা এক্ষেত্রে তীক্ষ্ণ ভাষায় সেসবকে আক্রমণ করেন।

স্ট্রিট আর্টের ভাষা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। গ্রাফিতিগুলো সরাসরি ভাষায় কিছু লেখা হয় না সাধারণত। যেভাবে লিখলে সাধারণ মানুষ মাথা খাটিয়ে লুকানো বার্তাটি ধরে ফেলতে পারবে, সেভাবেই লেখার চেষ্টা করেন গ্রাফিতি আর্টিস্টরা। এমন কঠিন ভাষাতেও লেখা হয় না, যেন সাধারণ বুদ্ধিমত্তার মানুষেরা শত চেষ্টা করেও গ্রাফিতির বার্তা ধরতে না পারেন। সব মিলিয়ে গ্রাফিতি আর্টিস্টদের কৌশলী হতে হয়।

চতগগ
বিনিময়মূল্য শুধু প্রশংসা এবং জনমনের অনুভূতির আন্দোলন; Image source: paintthetownmurals.com.au

সৌন্দর্যের দিক থেকে দেখলে গ্রাফিতি কিংবা স্ট্রিট আর্ট একটি শতভাগ সফল প্রকল্প। সাদা-কালো দেয়ালগুলো যখন রঙের স্প্রে-ক্যানের বদৌলতে বর্ণিলরূপে রূপান্তরিত হয়, তখন তা আসলেই দৃষ্টিনন্দন হয়ে ওঠে। এসব রঙিন দেয়াল পর্যটকদেরও আকর্ষণ করে। গ্রাফিতি আর্টিস্টদের কল্যাণে দেয়াল যেন প্রাণ ফিরে পায়, শহর হয়ে ওঠে আরও রঙিন।

প্রতিটি স্ট্রিট আর্ট সমকালীন জীবনবোধ থেকে উৎসারিত হয়ে থাকে। প্রতিটি গ্রাফিতি সমকালীন বিভিন্ন সংকট ও সমস্যাকে তুলে ধরে। সময়ের পরিবর্তনে পুরনো গ্রাফিতিকে সরিয়ে জায়গা করে নেয় নতুন গ্রাফিতি। অতীতকে বর্তমানের আতশকাঁচে দেখার অন্যতম প্রধান উপায় অতীতের স্ট্রিট আর্টের দিকে চোখ বোলানো। বিশ্ব জুড়ে স্ট্রিট আর্ট যেভাবে সাধারণ মানুষের প্রতিনিধি হয়ে যেভাবে শাসকগোষ্ঠীর অন্যায়নীতিকে প্রশ্নবিদ্ধ করে চলেছে, তা আমাদের আশাবাদী চোখের দৃষ্টিসীমাকে আরও প্রসারিত করে।

Related Articles