ভাব প্রকাশের মাধ্যম হিসেবে উৎপত্তি ঘটে ভাষার৷ আলাদা আলাদা ভূখণ্ডের ভাষাগুলোকে প্রাচীর দিয়ে সীমাবদ্ধ করে রাখা সম্ভব হয়নি। ভাষা বিকশিত হয়েছে সাবলীলভাবে৷ আবার অবহেলায় অনেক ভাষা হারিয়েও গিয়েছে৷ ভাষাতাত্ত্বিকদের মতে এই পৃথিবীতে যত জটিল বিষয় রয়েছে তার মধ্যে মানুষের ভাষা একটি৷ পৃথিবীতে মানুষ অপরাপর প্রাণী থেকে আলাদা হয়েছে তার ভাষার জন্যই৷ ভাষার প্রভাব পড়েছে অর্থনীতি, রাজনীতিতে।
রাষ্ট্র এবং পরাশক্তিগুলো বিভিন্ন সময়ে তাদের ভাষা নিজস্ব উদ্দেশ্যে ব্যবহার করেছে৷ ফলে পৃথিবীতে কিছু ভাষা বাড়তি সুযোগ পেয়ে ফুলে ফেপে উঠেছে ৷ অফিস-আদালত এবং কাজকর্মের ভাষা হিসেবে ব্যবহৃত ভাষার কদর বেড়েছে৷ মানুষ তার জাতীর ভাষা ছেড়ে অন্য ভাষা গ্রহণ করেছে৷ আবার নতুন করে ভাষার উৎপত্তিও হয়েছে৷ নিয়মিতভাবেই পৃথিবীতে ভাষার বিবর্তন ঘটে যাচ্ছে ৷ বর্তমান পৃথিবীতে প্রায় ৬০০০ এর অধিক ভাষা প্রচলিত রয়েছে৷ হারিয়ে গিয়েছে প্রায় ২৩০ টির মতো ভাষা।
ভাষা কখন হারিয়ে যায়
ইউনেস্কোর মতে, ‘একটি ভাষা তখনই হারিয়ে যায়, যখন সেই ভাষায় কথা বলার লোক হারিয়ে যায় কিংবা তারা অন্য ভাষায় কথা বলতে শুরু করে— বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই একটি তুলনামূলক শক্তিশালী গোষ্ঠী দ্বারাই বৃহত্তর ভাষা ব্যবহার হয়ে থাকে।’ ভাষা বিজ্ঞানীদের মতে পৃথিবীতে প্রতি দুই সপ্তাহে হারিয়ে যাচ্ছে একটি ভাষা। ভাষা শুধু নিজেই হারিয়ে যাচ্ছেনা সাথে হারিয়ে যাচ্ছে মানুষের ইতিহাস ও সংস্কৃতির অংশগুলো। ২০১০ সালে ইউনেস্কো প্রকাশিত ‘অ্যাটলাস অব দ্য ওয়ার্ল্ডস ল্যাংগুয়েজ ইন ডেঞ্জার’ শীর্ষক বইয়ে প্রায় আড়াই হাজার বিপন্ন ভাষার একটি তালিকা প্রকাশ করা হয়। বিশেষজ্ঞদের মতে একটি ভাষায় কথা বলার লোকের সংখ্যা যদি ৫০০০ এরও কম হয়ে যায় তাহলে ওই ভাষাটিকে বিপদাপন্ন ভাষা হিসেবে ধরা হয়। পৃথিবীতে এরকম বিপদাপন্ন ভাষা বাড়ছে ৷ ২০১০ সালে ভারতের আন্দামান নিকোবর দ্বীপপুঞ্জে বোয়া সিনিয়র নামে এক নারীর মৃত্যুর মধ্যে দিয়ে পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছে ‘বো ভাষা’। ৬৫ হাজার বছর বয়সী ‘বো ভাষা’ ধারণ করার মতো এখন আর কেউ নেই।
বাংলাদেশে বিপদাপন্ন ভাষাসমূহ
বিশ্বের বুকে বাংলাদেশ একটি ক্ষুদ্র দেশ হলেও ভাষার দিক দিয়ে দেশটি অনেক সমৃদ্ধ৷ দেশটিতে বাংলার বাইরেও আরো প্রায় ৪১টি ভাষা রয়েছে৷ এতদিন ধরে প্রচলিত ধারণা ছিল যে এই ভূখণ্ডে মাতৃভাষা আছে ১৫ থেকে ২৫টি। গবেষকরা এতোদিন ধরে এমন ধারণাই দিয়ে এসেছিলেন৷ কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো এই ৪১ ভাষার মধ্যে প্রায় ১৪টি ভাষাই বিলুপ্তির পথে এগিয়ে যাচ্ছে৷ কোন কোন ভাষায় কথা বলে হাতে গোনা কয়েকজন লোক৷ কোন ভাষায় যদি একজন লোকও কথা বলে তাহলে তাকে মৃত ভাষা বলা যাবেনা৷ বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট (আইএমএলআই) ২০১৮ সালের শেষের দিকেে একটি জরিপ শেষ করে। সেখানে তারা ১৪টি ভাষাকে বিপদাপন্ন হিসেবে ঘোষণা করে। ভাষাগুলো হলো— কন্দ, খাড়িয়া, কোডা, সৌরা, মুণ্ডারি, কোল, মালতো, খুমি, পাংখোয়া, রেংমিটচ্য, চাক, খিয়াং, লুসাই ও লালেং (পাত্র)।
কন্দ
কন্দ বাংলাদেশের একটি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর নাম। এদের আদিনিবাস ভারতের উড়িষ্যা রাজ্যে। উনিশ শতকের মাঝামাঝিতে কন্দরা চা বাগান ও রেলওয়ের শ্রমিক হয়ে বাংলাদেশে আসে৷ নির্মাণ শেষে এদের একাংশ চা বাগানের শ্রমিক হিসেবে এদেশে স্থায়ীভাবে থেকে যায়। কন্দদের ভাষার কোন নিজস্ব বর্ণমালা নেই। নতুন প্রজন্ম বাংলা ভাষায় কথা বলে। কন্দ সমাজে শিক্ষার হার খুবই কম। মাতৃভাষা কুই অথবা কন্দ ভাষাতেই তারা গানও পরিবেশন করে। তাদের কোন লিখিত সাহিত্য চর্চা না হলেও এদের মৌখিক সাহিত্য অত্যন্ত সমৃদ্ধ৷ বাংলাদেশে কন্দদের সংখ্যা প্রায় ৫ হাজার। নিজস্ব কোন বর্ণমালা ও লিখিত কোন চর্চা না হওয়ার কারণে ভাষাটি এখন প্রায় বিপন্নের পথে৷
খাড়িয়া ভাষার অবস্থা খুবই শোচনীয়৷ এই ভাষায় এখন কথা বলেন মাত্র দুইজন মানুষ৷ আরও দু-চারজন ভাষাটি জানেন, তবে কথা বলার মতো লোক খুঁজে পান না। আর কয়েকজন তরুণ এই ভাষার কয়েকটি মাত্র শব্দ জানেন । কিন্তু কথা বলতে পারেন না। এক বৃদ্ধ নারীর নাম ভেরোনিকা কেরকেতা। বয়স ৭০ পেরিয়েছে। আর তার ছোট বোন ক্রিস্টিনা কেরকেতাই৷ এই দুই বোনই শুধু তাদের মাতৃভাষায় কথা বলেন ৷ বাংলাদেশে ভাষাটি বিপন্ন হলেও ভারতের ছত্তিসগড়, ওডিশা ও ঝাড়খন্ড রাজ্যে এখনও এ ভাষার প্রচলন রয়েছে।
মাত্র ছয়জন লোক রেংমিটচ্য ভাষাকে ধারণ করে রেখেছে। তাদের বসবাস বান্দরবানের আলীকদম ও নাইক্ষংছড়ির ম্রো পল্লীতে ৷ তারা একজন নারী ও পাঁচজন পুরুষ। ৬৯ বছরের নারী কুনরাও থাকেন আলীকদমে, ৭৫ বছরের মাংপুন ও ৪৫ বছরের সিংরা থাকেন ক্রাংসিপাড়ায়, ৫৮ বছরের থোয়াইংলক থাকেন মেনসিংপাড়ায়, ৭২ বছরের রেংপুন থাকেন নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ওয়াইবতপাড়ায়, ৬০ বছরের মাংওয়াই একই উপজেলায় কাইংওয়াইপাড়ায় বসবাস করে আসছেন। যোগাযোগ বিচ্ছিন্নতার কারণে তাদের মধ্যে ভাষার চর্চা করা হয়ে উঠেনা৷ ম্রো জনগোষ্ঠীর সাথে বসবাসের জন্য ওনারা এখন নিজেদের ম্রো হিসেবে পরিচয় দিয়ে থাকেন৷ তাদের মৃত্যু হলে রেংমিটচ্য নামের ভাষাটিরও মৃত্যু ঘটবে। পৃথিবীর বুক থেকে হারিয়ে যাবে আরো একটি ভাষা ও আরো একটি সংস্কৃতি।
কোড ভাষা
কোডা ভাষা ভারত ও বাংলাদেশের একটি বিপন্ন মুন্ডা ভাষা। ভাষাটি কোরা, কাওরা, কোরালি, কোরাটি, কোরে ইত্যাদি নামেও পরিচিত। এরা প্রধানত পশ্চিমবঙ্গ, পশ্চিম মেদিনীপুর এবং বাঁকুড়া জেলা, কিছু পার্শ্ববর্তী ওড়িশা এবং ঝাড়খণ্ডে বসবাস করে। কিন্তু বাংলাদেশে ভাষাটি খুবই বিপদাপন্ন অবস্থায় আছে। সর্বশেষ খবর অনুযায়ী রাজশাহী বিভাগে মাত্র ১৩০০ জন কোডা ভাষাভাষী মানুষ রয়েছে।
সৌরা ভাষা
দেশে বিপদাপন্ন ভাষাগুলোর মধ্যে সৌরা ভাষা অন্যতম। বাংলাদেশে মাত্র ৭০টি পরিবার বসবাস করে আসছে। বাংলাদেশের বাইরে ভারতের উড়িষ্যা, অন্ধ্র প্রদেশ, তামিলনাড়ু এবং বিহার রাজ্যেও এই ভাষার অস্তিত্ব পাওয়া যায়। বাংলাদেশের শ্রীমঙ্গল উপজেলায় তারা চা শ্রমিক হিসেবে কর্মরত আছেন। তাদের মধ্যে উচ্চশিক্ষিত অর্থাৎ ভাষাটি সংরক্ষণ ও চর্চার ব্যবস্থা করার মতো কেউ নেই। যার কারণে হারিয়ে যাচ্ছে তাদের ভাষা, সংস্কৃতি আর ইতিহাস। অতি সম্প্রতি বাংলাদেশে প্রথম সারির এক দৈনিকের প্রতিবেদন থেকে জানা যায় যে, ভাষাটিতে মাত্র ২ জন প্রবীণ কথা বলতে পারতেন। তাদের একজন দেড় মাস আগে মারা গেছেন। অন্যজন সবসময় অসুস্থ থাকেন এবং ঠিকমতো কথাও বলতে পারেন না। তাই সৌরা ভাষাটি খুব দ্রুতই হারিয়ে যাবে বলে আশংকা রয়েছে।
মুন্ডারী
মুন্ডা উপজাতীয় জনগোষ্ঠীর ভাষার নামই মুন্ডারী। বাংলাদেশের উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন অঞ্চল, সিলেট জেলার চা বাগান এবং বৃহত্তর যশোর এবং খুলনা জেলায় এদের বসবাস। মুন্ডারী ভাষা এবং সাঁওতালি ভাষার মধ্যে অনেক মিল রয়েছে। তাদের মধ্যে কেউ এই ভাষাকে খরটাই, কেউ আবার নাগরী ভাষা বলে থাকেন। ভারতে ভাষাটি নিয়ে কাজ হলেও বাংলাদেশে অবহেলিত হওয়ার কারণে ভাষাটি এখন বিলুপ্তির পথে হাটছে।
Prattayee Chakma