Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

মন ও মানবিকতায় শিল্প-সাহিত্যের স্বরূপ

আজ সৃষ্টি সুখের উল্লাসে–
মোর মুখ হাসে মোর চোখ হাসে
মোর টগবগিয়ে খুন হাসে
আজ সৃষ্টি- সুখের উল্লাসে।

– কাজী নজরুল ইসলাম

প্লেটো বলেছিলেন, “জগত হলো স্বর্গের কপি, আর জগতের কপি হচ্ছে শিল্প।” আমাদের আজকের সাহিত্য, যা শিল্পেরই একটি শাখা। যার আদি উৎস দর্শন। তাই দর্শনবোধ ব্যতীত কোনো মহৎ সাহিত্য রচিত হয় না। আমরা ওরহান পামুক, জন কিটস, লোরকা অথবা কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ; যেকোনো একজন মহান সাহিত্যিককেই সাবজেক্ট হিসেবে নিয়ে সামনের দিকে এগোতে পারি। কখনও প্রেম, কখনও বিপ্লব, কখনও জীবনের রূঢ় দর্শনবোধ খুঁজে পাব এই মহান সাহিত্যিকদের রচনায়।

শিল্পের শিল্পবোধ কখনও শিল্পীর ব্যক্তি জীবনে প্রকাশ পায়, আবার কখনও প্রকাশ পায় না। কখনও কখনও শিল্পী তার সৃষ্ট শিল্পের মধ্যে বাস করা শুরু করেন। কবি নজরুলের সমাধির পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় আমাদের এটা ভেবে আশ্চর্যবোধ হতে পারে যে- কবি নজরুল এমন একজন বিপ্লবী, যিনি গান লিখেছেন, সেই গান নিজে সুর করে ঢোল বাজিয়ে পথে পথে গেয়ে চলেছেন; আবার এই গান গেয়ে চলবার কারণে কারাভোগ করেছেন!

ফেদেরিকো গার্সিয়া লোরকা কবিতায় লিখেছিলেন, “আমাকে ওরা নিয়ে যাবে, অতঃপর মেরে ফেলবে; কিন্তু তোমরা কোনোদিনও আমাকে আর খুঁজে পাবে না।” লোরকার ভাগ্যে কিন্তু এমনটাই ঘটেছিল, যা পূর্বেই তিনি অনুধাবন করেন। তবে এর ভিন্নতাও দেখা যায়। যেমন- অস্তিত্ববাদী দর্শনের সাহিত্য রচনা করেছেন আলবেয়ার ক্যামু এবং মানুষ হিসেবেও তিনি এমনটাই ছিলেন। কিন্তু কখনোই অস্তিত্ববাদী দর্শনের মানুষ হিসেবে নিজেকে স্বীকার করেননি। যারা শিল্পী, তারা কখনও কখনও নিজের সৃষ্টির ভেতরে প্রবেশ করেন আর এসব সত্যিকারের শিল্পীকে নিয়েই নীৎসে মন্তব্য করেছিলেন, “No artist can tolerate reality.” অর্থাৎ, কোনো শিল্পীই এই বাস্তব জগতকে সহ্য করতে পারেন না।

শিল্পী সৃষ্টি করেন শিল্প, তিনি তার শিল্পকে ভালোবাসেন, অতঃপর মিশে যান। শিল্পকে আরো বিস্তৃত করে সংজ্ঞায়িত করলে বলা যায়, মহাবিশ্বে কোনো ভাবরূপ শিল্পীর চিত্তের মধ্য দিয়ে রূপায়িত হয়ে যে সুস্থির রূপপ্রকাশ করে, তা-ই শিল্প। সাহিত্য হচ্ছে শিল্পের একটি শক্তিশালী প্রকাশ; লিখনশিল্প। মানুষের অনুভূতি, বোধ, সম্মুখ এবং কল্পচিন্তার বিভিন্ন বিষয়াবলির লিখিত প্রকাশ। আমরা এই লিখিত বিষয়কে যখন শৈল্পিকভাবে শব্দের মূর্চ্ছনায় প্রকাশ করি তখন তা হয় কবিতা; কখন ঠিক প্রথম কবিতাটি লেখা হয়েছিল, আমরা তা জানি না। তবু হিন্দুধর্মের বেদ কিংবা গিলগামেশের মহাকাব্যে আমরা অতি প্রাচীন সভ্যতার সাহিত্যকে খুঁজে পাই। পাই যীশুর জন্মের সাতশো বছর পূর্বে রচিত হোমারের ইলিয়াড ও ওডিসি। [1] পোড়ামাটির ফলকে প্রায় দুই হাজার বছর পূর্বের ভালোবাসার কবিতা পাওয়া গেছে ইরাকের নিপ্পুরে।

চিত্রঃ প্রাচীন পোড়ামাটির ফলকে লেখা কবিতা।
প্রাচীন পোড়ামাটির ফলকে লেখা কবিতা; Image Source: ancient.eu

এই কবিতাটি সম্ভবত একজন নারী লিখেছিলেন। আমাদের জানামতে, এই কবিতাটি পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে প্রাচীন ভালোবাসার কবিতা। [2] হয়তো ভাষার সৃষ্টির পরপরই মানুষ ঢঙে প্রেম নিবেদন শুরু করেছিল, মানুষ তার মনের সৌন্দর্যকে নিংড়ে বের করেছে শিল্প সৃষ্টির মাধ্যমে।

শিল্প মানুষে মানুষে সম্মিলন ঘটায় এবং একজন মানুষকে অনন্য উচ্চতার স্তরে পৌঁছে দেয়। সত্যিকার অর্থে শুধু যোগাযোগ নয়, বরং বোধের সংযোগ ঘটায়। গভীর অর্থে তাই প্রয়োজন আমাদের সমাজে, পরিবার এবং প্রতিষ্ঠানের মানুষদের মধ্যে; কেননা আমরা শুধু পাশাপাশি বসে থাকি, যোগাযোগ হয়, কিন্তু সংযোগ ঘটে না। সাহিত্যে শুধু নিছক কিছু শব্দ আর ছন্দ নয়, তুলির ছোঁয়া অপ্রয়োজনীয় আঁকিবুঁকি নয়; সবকিছুর আগে বোধের প্রয়োজন। ছবি, গান,কবিতা,গল্পে শিল্পীর মন থেকে বোধের সঞ্চার ছড়িয়ে পড়ে তাদের প্রতি- যারা সাহিত্যকে পাঠ করছে কিংবা দেয়ালে সাঁটা ছবিকে উপলব্ধি করতে পারছে। যেমনটা প্লেটো বলেছিলেন,

“At the touch of a lover, everyone becomes a poet.”

প্রেমিকা বিয়েত্রিচের শহর ছেড়ে চলে যাচ্ছেন মহাকবি দান্তে। দান্তের মনের ভেতর বেদনাবোধ, কে জানত এই বেদনাবোধই পরবর্তীকালে জন্ম দেবে মহাকাব্যের? [৩] নাট্যকার সেলিম আল দীন লিখেছেন বাঙালি জীবনের গল্প। তিনি বলে গিয়েছেন, বাঙালি জীবনে নাকি ট্র্যাজেডি নেই, তাই বাংলা সাহিত্যেও ট্র্যাজেডির উপর তেমন কোনো সাহিত্যকর্ম লক্ষ্য করা যায় না। তার ‘স্বর্ণবোয়াল’ নাটকে নাট্যকার হয়ে তিনি দেখালেন, জেলে নদীতে গেছে স্বর্ণবোয়ালের খোঁজে। সারারাত ধরে মাছের খোঁজে থাকতে থাকতে অবশেষে তার ছিপে স্বর্ণবোয়াল আটকাল। কিন্তু দুঃখের বিষয়, জেলে বোয়াল রাখতে পারল না। জেলে কষ্ট নিয়ে বাড়ি ফেরার সময় তবু মনে মনে একধরনের সুখ অনুভব করল। কেননা, তার দাদা এই স্বর্ণবোয়াল ধরতে গিয়ে মারা গিয়েছিলেন, তার বাবা খলিশা মাঝি শুধুমাত্র একবার স্বর্ণবোয়ালের দেখা পেয়েছিলেন। কিন্তু, আমাদের এই জেলে স্বর্ণবোয়ালকে তার ছিপে আটকাতে পেরেছে। এই যে ছোট ছোট পাওয়া, যা কেবল বাঙালি মনেই সম্ভব।

এখানে প্রেমে ব্যর্থতা বলতে কিছু নেই, বরং ভালোবাসাটাই মুখ্য। তাই পাশ্চাত্যের ‘পেতেই হবে’ এবং ‘না পেলে সবকিছু বৃথা’ বোধ আমাদের বাঙালি জীবনে, সাহিত্যে পাওয়া যায় না। [৪] আর এ কারণেই ট্রয় নগরীর ধ্বংসযজ্ঞ দেখতে পাই আমরা। জাতিগতভাবে বোধের ভিন্নতা থাকলেও শেষ পর্যন্ত সব সাহিত্যই কিন্তু মানুষের কথা বলে, মানুষের বেদনায় চরিত্রগুলোও ব্যথিত হয়। তাই আমাদের সকল প্রাণের এক মেলবন্ধন রচিত হয় সাহিত্যচর্চার মাধ্যমে।

এরপর আমাদের এই জীবনের রূপকে মানুষের কাছে আরোও পৌঁছে দিতে আসে চলচ্চিত্র। Amores perros, পথের পাঁচালি, মাটির ময়না- মানুষের বোধ এবং জীবনের কথা বলে। আমরা পাই ‘দ্য বার্ডম্যান’ এর মতো চলচ্চিত্র, যা আবার শিল্পীর শিল্পবোধকে মানুষের কাছে পৌঁছে দেয়।

জার্মান মিউজিক ব্যান্ড স্করপিয়ন-এর একটি বিখ্যাত গান উইন্ড অব চেইঞ্জ, যা হাওয়ার এক বদলকে নির্দেশ করে-

”I follow the Moskva
Down to Gorky Park
Listening to the wind of change”

অর্থাৎ,

”বাতাসে পরিবর্তনের কণ্ঠ শুনতে শুনতে গোর্কি পার্কের ঢাল থেকে আমি মস্কোভাকে অনুসরণ করি।”

গানটি মূলত গাওয়া হয়েছিল রাশিয়া আর যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘ সময় ধরে বয়ে চলা স্নায়ুযুদ্ধের পরিসমাপ্তি হিসেবে; যুদ্ধ আর প্রতিহিংসার গরলের বিরুদ্ধে। তাই আমাদের কবি আবুল হাসান লিখতেই পারেন, ‘সুধীবৃন্দ ক্ষান্ত হোন, গোলাপ ফুলের মতো শান্ত হোন।”

আমাদের মহীনের ঘোড়াগুলি গাইলেন, “যে ছেলে গেছে বনে, বনমাঝে বনবীথিতলে চৈত্র বিকেলে।” মহীনের ঘোড়াগুলি-র এই গান গাওয়া ছিল মূলত পশ্চিমবঙ্গের নক্সালদের নিয়ে, সেসব তরুণের দল, যারা সশস্ত্র বিপ্লবের পথ বেছে নিয়েছিল। তারা কখনও মৃত্যুর কাছাকাছি গিয়েছিল, কখনোবা মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেছিল। এখানে আদর্শিক বেড়াজাল থাকতেই পারে। কিন্তু, তবু সবকিছুর শেষে আমরা মানুষ। একজন মানুষের ব্যথায় ব্যথিত হওয়া আমাদের মানবিক গুণাবলীর প্রকাশ। মানুষের পরিচয় মানুষ নিজেই দেয় তার কর্মে। মানুষ, মানুষ হিসেবে প্রকাশ পায় তার শিল্পবোধে, দর্শনে; যা পৃথিবীর অন্য কোনো প্রাণীর মধ্যে সচেতনভাবে দেখা যায় না। কেননা বাবুই পাখির শিল্পকর্ম মানুষের মনে শিল্পবোধ জাগালেও বাবুই পাখির কাছে তার সৃষ্ট বাসা কেবলই থাকবার জায়গা, ডিম থেকে ছানাগুলোকে বড় করবার আশ্রয়।

যে বোধের প্রকাশ আমাদেরকে মানুষের কাছে নিয়ে যায়, তা-ই শিল্প; যেমনটা রবীন্দ্রনাথের গান, যা মানুষকে মানুষ করে তোলার পথে রাখে অনেক অবদান। “আলো হাতে চলিয়াছে আঁধারের যাত্রী”; এখানে ‘আঁধারের যাত্রী’ বলতে রবীন্দ্রনাথ মানুষকে বুঝিয়েছেন। এই মহাবিশ্বের একাকিত্বে অজানাকে সীমাহীনভাবে খুঁজে বেরোবার কথা বর্ণনা করেছেন কবি। এখানে মানুষের প্রতি কবির ভালোবাসা এবং ভরসা ফুটে উঠেছে। আর এই মানুষটিই শিল্পকে ভালোবেসে, শিল্পচর্চাকে মানুষের মাঝে ছড়িয়ে দেবার নিমিত্তে শান্তিনিকেতন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। মানুষের প্রতি মানুষের ভালোবাসা আর মানবিক বোধই মানুষকে অনন্য উঁচুতম আসনে আসীন করেছে।

”মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি।”
– লালন ফকির

চিত্রশিল্পী ভ্যান গগ পাদ্রী হিসেবে চার্চে যোগ দেন। তারপর বেলজিয়ামের কয়লাখনিতে শ্রমিকদের কাছে গিয়ে দেখলেন তাদের দুঃখ-দুর্দশা, অমানুষিক শ্রমে মৃত্যুর দিকে ধাবিত হওয়া মানুষদের। তিনি কোথায় ধর্ম প্রচার করবেন? কখনও নিজের গায়ের কাপড়, নিজের জিনিসপত্র বিলি করে দিলেন শ্রমিকদের। শ্রমিকদের বেদনায় ব্যথিত হয়ে ছবি আঁকার কথা ভাবলেন। কিন্তু এখানে ছবি আঁকার রং আর ক্যানভাস কোথায়? শিল্পী কয়লাখনির কয়লাকে রঙ হিসেবে বেছে নিলেন। ভ্যান গগ মানুষের ছবি আঁকলেন।

ভ্যান গগের হাতে কয়লা দিয়ে আঁকা নারী কয়লা শ্রমিকদের ছবি; Image Source: vincentvangogh.org

এরকমটা আমাদের জয়নুল আবেদীনও এঁকেছিলেন। দুর্ভিক্ষপীড়িত কঙ্কালসার মানুষের ছবি, পশুর খাদ্য হতে চলা মানুষের ছবি। পাবলো পিকাসো ছবি আঁকছেন। নাৎসি জেনারেল প্রশ্ন করলেন, “এ কী ছবি আঁকছেন আপনি? পিকাসো উত্তর দিলেন, “এ ছবি আমি আঁকিনি, আপনারা এঁকেছেন।”

স্পেনে তখন গৃহযুদ্ধ চলছে। বাস্ক শহরে বোমা বর্ষণ করছে নাৎসী বাহিনী। মানুষ মরছে, আর সেই জরাগ্রস্ত, মৃত মানুষকে ছবিতে তুলে আনলেন পিকাসো। [4]

Guernica, ১৯৩৭; Image Source: pablopicasso.org

আমরা পড়ছি এলেন গিন্সবার্গের September on Jessore Road কবিতাটি,

“Millions of daughters walk in the mud
Millions of children wash in the flood
A Million girls vomit & groan
Millions of families hopeless alone”

বাংলায় যার অর্থ দাঁড়ায়,

”লক্ষ লক্ষ কন্যারা হেঁটে চলেছে কর্দমাক্ত রাস্তায়
লক্ষ লক্ষ শিশুরা ভেসে যাচ্ছে বন্যায়
লক্ষ মেয়ের বমি এবং গোঙানির শব্দে
আশাহত লক্ষ লক্ষ পরিবার।”

একাত্তরে মানুষের দুঃখ-কষ্টে কবি স্থির থাকতে পারেননি, তাই কবিতায় বিদ্রোহ করেছেন।

যশোর রোডের ‘৭১; Image Source: Pacifist Journal

আমাদের ভেতরকারের মানুষটাকে জাগিয়ে তুলতে শিল্প-সাহিত্যের অনেক বেশি প্রয়োজন। আমাদের ক্রোধকে ভালোবাসায় রূপান্তরিত করতে, মানবিক বোধের বিকাশে মানুষের সৃষ্টিশীলতার চর্চা প্রয়োজন। সাহিত্য শুধুমাত্র জাতির দর্পণ হিসেবে নয়, বরং সাহিত্য হলো, আমরা কোথায় যাচ্ছি তার রূপকল্পে, আমাদের প্রতিবাদের ভাষায়, আমাদের বেঁচে থাকবার উল্লাসে, আমাদের নতুন সূর্যে, প্রাণের স্পন্দনে গতিময়তায় বিস্তৃত। যেমন করে একজন মৃৎশিল্পের কারিগর তার ভেতরকার মানবিক সত্ত্বার বিকাশ ঘটিয়ে কারিগর থেকে একদিন কলাকার হয়ে ওঠেন, তেমনি অঙ্কুরিত হবার শুরুতে একটি শিশুর জন্য চাই মানুষ হবার শিক্ষা।

শিল্প-সাহিত্যের বোধ, মানুষের প্রতি ভালোবাসা আমাদেরকে মানুষ হিসেবে আরো সুন্দর করে তুলতে পারে। যুদ্ধ, বেদনা আর প্রতিহিংসার পৃথিবীতে একটু শান্তি আর মানবিক পৃথিবী গড়ে তুলবার প্রত্যয়ে আমাদের মুক্তবুদ্ধি, মানুষের মৌলিক জ্ঞান এবং সৃষ্টির চর্চার উপর আরো মনোযোগী হওয়া প্রয়োজন। আমরা স্বপ্ন দেখি, 

”মানুষের পৃথিবীতে কোনো যুদ্ধ থাকবে না একদিন, 
থাকবে না সীমান্তের কাঁটাতার,
থাকবে না অনাহারে কোন শিশু-
মানুষের মৃত হৃদয়!”

Related Articles