অনেকেই জানেন না যে ভিনসেন্ট ভ্যান গখ (১৮৫৩-১৮৯০) চিত্রশিল্পীর ক্যারিয়ার বেছে নিয়েছিলেন যখন তার আটাশ বছর বয়স। আবার তিনি মারাও গেলেন কম বয়সে। তবু দশ বছরের মধ্যে প্রায় নয়শো ছবি এবং এগারোশ স্কেচ ও লিথোগ্রাফ এঁকেছিলেন তিনি। সমস্যা জর্জরিত গখ বারবার একই বিষয়বস্তুতে ফিরে গেছেন, প্রায় একইরকম সানফ্লাওয়ারের ছবি বারবার এঁকেছেন। কিন্তু তিনি পোস্ট-ইমপ্রেশনিজমকে এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিলেন। জীবিত অবস্থায় বলতে গেলে তেমন কোনো স্বীকৃতিই পাননি, অথচ এখন কোটি কোটি টাকায় তার ছবি বিক্রি হয়; পোস্টার, নোটবুক, টি-শার্ট, মগ এমনকি দিয়াশলাই বাক্সেও তার আঁকা ছবি থাকে। তার জীবন নিয়ে চলচ্চিত্রও হয়েছে।
ভিনসেন্ট ভ্যান গখের সেরা কয়েকটি চিত্রকর্ম নিয়ে এই আয়োজন। উল্লেখ্য, তালিকাটি গখের 'মাস্ট-সি' এর একটি ছোট্ট অংশ মাত্র। তবে তালিকাটি বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ কারণ গখের শিল্পীসত্তাকে আলাদাভাবে বুঝতে সাহায্য করবে এটি। তালিকায় গখের শুরুর দিকে আঁকা পটেটো ইটার্স থেকে শুরু করে তার মৃত্যুর মাত্র তিন মাস আগে আঁকা পোর্ট্রেইট অভ ড. গ্যাশেও রয়েছে।
দ্য স্টারি নাইট, ১৮৮৯
কিছু কিছু সৃষ্টি এমন থাকে যা কখনো কখনো স্রষ্টাকেও ছাড়িয়ে যায়। তাতে অবশ্য স্রষ্টারই সার্থকতা। ভিনসেন্ট ভ্যান গখের স্টারি নাইট অনেকটা এমনই। ১৮৮৮ সালে নিজের কান নিজেই কেটে ফেলেছিলেন তিনি। এরপর মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে স্বেচ্ছায় ফ্রান্সের সেইন্ট রেমি-ডি প্রদেশের একটি আশ্রমে ভর্তি হন। সেখানে ১৮৮৯ সালে তার ঘরের পুবমুখী জানালা থেকে দেখে এঁকেছিলেন এটি। শুনে অবাক লাগলেও, তিনি তেলরঙে আঁকা এই রাতের আকাশটি এঁকেছিলেন ভোরবেলায়, ঠিক সূর্য ওঠার একটু আগে। দিনের বিভিন্ন সময়, বিভিন্ন আবহাওয়াকে কেন্দ্র করে দৃশ্যটিকে তিনি এঁকেছিলেন ২১ বার।
অদ্ভুত হলেও সত্য, ২১টি স্কেচের একটিতেও তার ঘরের জানালার লোহার গরাদগুলো নেই। আর ভ্যান গখের অন্যতম সেরা সৃষ্টি হলেও তিনি তার ভাই, থিওকে লেখা চিঠিতে এই ছবিটির কথা বিশেষভাবে বলেননি। ছবিটি ছিল তার কাছে ব্যর্থ একটি সৃষ্টি। গ্রিফিথ পার্ক অবজারভেটরির এক গবেষণায় দেখা গেছে, গখ বসন্তের সেই রাতে চাঁদ, শুকতারা আর অন্যান্য তারার অবস্থান একদম ঠিকমতো দেখিয়েছিলেন ছবিটিতে।
তিনি সবসময় চোখের সামনে যা দেখতেন তার পূঙ্খানুপুঙ্খ ছবি আঁকলেও, এখানে এসে তিনি তার ধারা পাল্টান। ছবিটিতে তিনি যে গ্রামের দৃশ্যটি এঁকেছেন, তা পুরোপুরিভাবে তার কল্পনাপ্রসূত ছিল। চোখের সামনে সেটি ছিল না। 'চিরাচরিত ভ্যান গখ' থেকে হয়তো এটি সাময়িক সময়ের বিরতিই বটে। ছবিটিতে নীল রঙের আধিক্য লক্ষ্যণীয়। তা কিছুটা অপার্থিব আর স্বপ্নের মতো মনে হয়। তার মানসিক স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটছিল। হতাশা আর মনের ভেতরকার দ্বন্দ্বকে তুলির আঁচড়ে তিনি ক্যানভাসে তুলে ধরেছিলেন বলে বিশেষজ্ঞদের মতামত। গাঢ় রঙের ব্যবহার এমনভাবে করেছেন যে তা সহজেই মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। মাত্র এক বছর আগেই আঁকা 'স্টারি নাইট ওভার দ্য রোন' এর তুলনায় 'স্টারি নাইট' কিছুটা অস্থির। এটি ১৯৪১ সাল থেকে নিউ ইয়র্কের মিউজিয়াম অভ মডার্ন আর্টে সংরক্ষিত আছে। নিঃসন্দেহে এটি সবচেয়ে জনপ্রিয় চিত্রকর্মের মধ্যে একটি।
দ্য পটেটো ইটার্স, ১৮৮৫
এটি গখের আঁকা প্রথম ছবি না হলেও তার প্রথম মাস্টারপিস। ১৮৮৫ সালে আঁকা এ ছবিটি এখন আমস্টারডামের ভ্যান গখ মিউজিয়ামে আছে। র্যামব্র্যান্ডের অনুসরণ করতে গিয়েই হয়তো গখ এখানে বেছে নিয়েছিলেন একরঙা অন্ধকার পরিবেশ। শ্রমজীবী, খেটে-খাওয়া মানুষ আর তাদের সাদামাটা জীবনের প্রতি ভালোবাসা থেকেই গখ এঁকেছিলেন ছবিটি।
ছবিটিকে বাস্তবসম্মত করার সর্বাত্মক চেষ্টা করেছিলেন তিনি। ইচ্ছাকৃতভাবেই অমার্জিত মানুষদের বেছে নিয়েছিলেন। যে হাত দিয়ে চাষীরা মাটি চাষ করেন সে হাত তো এবড়োখেবড়ো হওয়ারই কথা। ছবিতে শীতের রাতে জীর্ণ কুটিরে পাঁচজন মানুষের দেখা মেলে যাদের মধ্যে চারজন নারী আর একজন পুরুষ। অন্ধকারে আঁকা সত্ত্বেও তাদের মিশ্র অভিব্যক্তির বাস্তব চিত্র এঁকেছেন গখ। দেখলে মনে হবে একটু কান পাতলেই তাদের কথা শোনা সম্ভব। নেদারল্যান্ডসের কৃষক পরিবার দ্য গ্রুটসকে মডেল ধরে ছবিটি আঁকা। ছবিটি এসব পরিশ্রমী মানুষের প্রতি গখের মমত্ববোধ আর অনুরাগেরই পরিচয় বহন করে। তিনি চেয়েছিলেন মানুষ যেন এসব খেটে-খাওয়া শ্রমিকদের হাড়ভাঙা পরিশ্রমের মূল্য দিতে শেখে।
ছবিটি দু'বার চুরি গিয়েছিল। ছবিটি গখের শিল্পীজীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল। এত সব ছবি আঁকার পরও ১৮৮৭ সালে তার বোনকে লেখা চিঠিতে বলেন, নিউয়েনেন/নেনেন- এ আঁকা সেরা ছবি ছিল এটি।
ভাস উইথ ফিফটিন সানফ্লাওয়ারস, ১৮৮৮
জড়বস্তুর ছবি আঁকায় ভিনসেন্ট ভ্যান গখের জুড়ি মেলা ভার। এ যাবৎ আঁকা সবচেয়ে জনপ্রিয় চিত্রকর্মের মধ্যে 'সানফ্লাওয়ার' সিরিজের ছবিগুলো অনেক উপরে থাকবে। দুটি সিরিজে আছে মোট ১২টি ছবি, যেগুলো তিনি এঁকেছিলেন ১৮৮৭-১৮৮৯ সালের মাঝামাঝিতে। এগুলো এখন টোকিও, লন্ডন, আমস্টারডাম, মিউনিখ ইত্যাদি বিভিন্ন জাদুঘরে সংরক্ষিত। তবে তিনি কখনো 'সানফ্লাওয়ার' নামে ছবিগুলো আঁকেননি। এই ছবিটিতে ফুলগুলোর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আর রঙের ব্যবহার লক্ষ্যণীয়।
ভ্যান গখ যখন ছবিগুলো এঁকেছেন তখন তিনি ভাবাবিষ্ট ছিলেন। খেয়াল করলে দেখা যায় যে ছবিটিতে রেখা, রঙ, অনুপাতের ব্যবহার সবকিছুই খানিকটা নিয়মের বাইরে। গখের ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যেরই প্রতিকৃতি এই সূর্যমুখী ফুলগুলো। ছবিটিতে উনি নিজেকেই বহিঃপ্রকাশ করেছেন সাবলীলভাবে; কিংবা নিজেকে তুলনা করেছেন এই সূর্যমুখীর সাথে। সোনালি রঙে পূর্ণ ছবিটি হয়তো তাকে ক্ষণিকের জন্য হলেও প্রশান্তি দিয়েছিল। তিনি ছবিটি আঁকতে গিয়ে হয়তো উদ্দীপনা আর গূঢ়ার্থের উপরই বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন।
গখ তার দৃষ্টিভঙ্গি জানাতে সূর্যমুখীকে প্রায়শই ব্যবহার করেছেন। গ্রীষ্মকালটা ক্ষণস্থায়ী আর সূর্যমুখীও খুব কম সময়ের জন্য আসে। এই ক্ষণকালীন সূর্যমুখীর মতোই তিনিও খুব কম বয়সেই চলে যান পৃথিবী ছেড়ে। কিন্তু আমাদের মনের মধ্যে তিনি সবসময়ের জন্য আসন পেয়ে গেছেন 'সূর্যমুখীর পটুয়া' হিসেবে। উনবিংশ শতাব্দীর শুরুতে আসা সোনালি হলুদাভ রঙকে তিনি লুফে নিয়েছিলেন আর সফলও হয়েছেন। গখের মতো উইলিয়াম ব্লেক, ক্লদ মনে, অ্যালেন গিন্সবার্গসহ অনেকেই সূর্যমুখীর প্রতি বিশেষ অনুরাগী ছিলেন। ১৯৮৭ সালের মার্চে এক জাপানি বিনিয়োগকারী নিলামে এই সূর্যমুখীর ছবিটি কিনেছিলেন ৪০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার দিয়ে। সে সময়ে এটি রেকর্ড ছিল।
আইরিসেস, ১৮৮৯
ভ্যান গখের আঁকা সবচেয়ে জনপ্রিয় ছবিগুলোর মধ্যে আইরিসেস একটি। মৃত্যুর মাত্র এক বছর আগে ১৮৮৯ সালে সেইন্ট রেমির সেই আশ্রমে তিনি এটি এঁকেছিলেন। আশ্রমে ভর্তি হয়ে প্রথম সপ্তাহেই এটি এঁকেছিলেন। ছবি আঁকতে সমর্থ হওয়ায় মানসিক ভারসাম্য হারাননি বলে মনে করেছিলেন তিনি। তাই তিনি অনেকটা আশ্বস্ত হয়েই ছবি আঁকা চালিয়ে যান। মোট ১৩০টি ছবি এঁকেছিলেন আশ্রমে।
প্রথমদিকে আঁকা ছবি বলে এতে অস্থিরতার ছাপ নেই। দিন যত গিয়েছে তার ছবিগুলো বিশৃঙ্খল হয়ে পড়ছিলো। তিনি অনেক উৎফুল্ল হয়ে অনুরাগ নিয়ে ছবিটি এঁকেছিলেন। আশ্রমের বাইরে তাকে ঘুরতে যাওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়েছিল। সেখান থেকেই তিনি এর অনুপ্রেরণা পান। আইরিসের প্রতিটি পাপড়ি এখানে মৌলিক। সূক্ষ্মভাবে তিনি ফুলের সৌন্দর্য বুঝে গেছিলেন। জাপানি 'উকিও-এ' (কাঠের ব্লকপ্রিন্ট) - এর বিশেষ অনুরাগী ছিলেন আর এ ছবিতে এর প্রভাব স্পষ্ট। গখ এ ছবিকে তার সেরা শিল্পকর্ম ভাবেননি। বরং তিনি একে নিয়েছিলেন স্রেফ অনুসন্ধান হিসেবে। কিন্তু তার ভাই, থিও প্যারিসে এ ছবিটির প্রদর্শনী করিয়েছিলেন গখের মৃত্যুর আগেই। ছবিটি ১৯৮৭ সালে বিক্রি হয়েছিল ৫৩.৯ মিলিয়ন মার্কিন ডলারে (আজকের দিনে এর সমপরিমাণ মূল্য ১০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার)। সর্বকালের সবচেয়ে দামি চিত্রকর্মের মধ্যে এটি ১৫ তম। লস অ্যাঞ্জেলেসের গেটি মিউজিয়ামে এটি এখন সংরক্ষিত আছে।
পোর্ট্রেইট অব ড. গ্যাশে, ১৮৯০
ফরাসি চিকিৎসক পল-ফার্দিনান্দ গ্যাশে ভ্যান গখের জীবন সায়াহ্নে তার চিকিৎসা করেছিলেন। গখের কাছে এই ছবিটি অনেক বেশি প্রিয় আর পূজনীয় ছিল। এর দুটি সংস্করণ পাওয়া গেছে। প্রায় সবকিছু মিলে গেলেও রঙ আর ধরনে পার্থক্য সহজেই চোখে পড়ে। সেইন্ট রেমির সেই আশ্রম থেকে আসার পর গখের জন্য তার ভাই থিও জায়গা খুঁজছিলেন। তখন অভ্যাঁরের চিকিৎসক গ্যাশের খোঁজ পান আর গখ এখানেই থাকা শুরু করলেন।
গখ প্রথমে গ্যাশেকে একদমই পছন্দ করেননি; থিওকে তা চিঠিতে বলেছিলেনও। কিন্তু খুব দ্রুতই গখের ধারণার পরিবর্তন হয়। দুদিন পর তিনি তার বোনকে আরেক চিঠিতে লেখেন যে, গ্যাশের সাথে তার বন্ধুত্ব ভালোই জমে উঠেছে। গ্যাশে তার কাছে ভাইয়ের মতো।
গখ প্রতিকৃতিটি এঁকেছিলেন ১৮৯০ সালের জুনে। গ্যাশেকে এতে গালে হাত দিয়ে বসে থাকতে দেখা যাচ্ছে। তাকে কিছুটা মনমরা, বিষাদগ্রস্ত মনে হচ্ছে। মুখ খিচে রেখেছেন এরকমও মনে হতে পারে কারো কারো। একইসাথে চাহনিটা স্পষ্ট আর বুদ্ধিদীপ্ত। ১৯৯০ সালে ছবিটি নিলামে মাত্র ৩ মিনিটের মধ্যে ৮২.৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলারে বিক্রি হয়। তখনকার সময়ে এটি একটি রেকর্ড ছিল। এখন পর্যন্ত সর্বকালের সবচেয়ে দামি চিত্রকর্মে এটি ৬ষ্ঠ অবস্থানে আছে। যা-ই হোক, এখন পর্যন্ত সরকারি নিলামে বিক্রি হওয়া সবচেয়ে দামি শিল্পকর্ম এটি। তবে অনেক ঐতিহাসিকের দাবি যে গখের মৃত্যুর কারণ ছিলেন এই গ্যাশে।
ক্যাফে ট্যারেস অ্যাট নাইট, ১৮৮৮
এর আরেক নাম দ্য ক্যাফে ট্যারেস অন দ্য প্লেস ড্যু ফোরাম। এটি গখ এঁকেছিলেন ১৮৮৮ এর সেপ্টেম্বরে। এই ছবিতেই তিনি প্রথম নেপথ্যে 'তারাভরা আকাশ' আঁকেন। এখনও দর্শনার্থীরা এই ক্যাফের উত্তর-পূর্বাঞ্চল দিক থেকে এরকম দৃশ্য দেখতে পাবেন। জায়গাটি এখনও আছে, তবে এখন এর নাম পরিবর্তন করে রাখা হয়েছে 'ক্যাফে ভ্যান গখ'। গখের এই ছবিটি নিয়ে সবচেয়ে বেশি গবেষণা করা হয়েছে। অনেক তর্কবিতর্কও হয়েছে যে এই ছবি কি আসলে লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির আঁকা লাস্ট সাপার-এর সৃষ্টিশীল নবরূপায়ন? যথেষ্ট যুক্তিও দিয়েছেন এর সমর্থকেরা। তবে এই চিত্রকর্ম এখন পপুলার কালচারের অংশ হয়ে গেছে।
ছবিতে ক্যাফের বাইরের দিকটি দেখা যাচ্ছে। দেখলে মনে হবে যেন কোনো নিশ্চিন্ত দর্শকের স্বচ্ছন্দ কল্পনা। যেন কেউ কোনো বিশেষ উদ্দেশ্য ছাড়াই চোখের সামনে থাকা সৌন্দর্যকে উপভোগ করছেন। গখ তাই বলেছিলেন যে, দিনের থেকে রাত আরো বেশি জীবন্ত, আরো বর্ণিল। উষ্ণ হলুদ, সবুজ আর কমলা রঙের তীক্ষ্ণ বৈসাদৃশ্য সহজেই দৃষ্টি আকর্ষণ করে। রাতের ছবি হওয়া সত্ত্বেও এতে কালো রঙটি অনুপস্থিত। মূলত এই ছবি দিয়েই গখ তার আইকনিক 'তারাভরা আকাশ' আঁকা শুরু করেন। ট্রিলজিই বলা চলে যা পূর্ণতা পায় স্টারি নাইট ওভার দ্য রোন আর স্টারি নাইটের মাধ্যমে।
ছবিটি তিনি স্মৃতি থেকে নয়, বরং সামনে বসে-দেখে-উপভোগ করে আঁকেন তিনি। ছবিটির কোথাও তার স্বাক্ষর নেই, তবে তার চিঠিগুলো থেকে গবেষকেরা নিশ্চিত হয়েছেন এটি তারই আঁকা। অবাক করার মতো ব্যাপারটি হলো, এই চিত্রকর্মটিতেও তারার অবস্থানগুলো একদম ঠিক। সবচেয়ে বেশি পুনরুৎপন্ন চিত্রকর্মের মধ্যে এটি দ্বিতীয় অবস্থানে আছে, স্টারি নাইটের ঠিক পরেই। এটি এখন সংরক্ষিত আছে নেদারল্যান্ডসের ক্রোলার ম্যুলার জাদুঘরে।
সেল্ফ পোর্ট্রেইট উইথ ব্যান্ডেজড ইয়ার, ১৮৮৯
ভ্যান গখ তার আত্মপ্রতিকৃতির জন্য জনপ্রিয় ছিলেন। জীবদ্দশায় ত্রিশের বেশি আত্মপ্রতিকৃতি এঁকেছিলেন তিনি। পল গগ্যাঁনের সাথে একটি ঘটনার সূত্র ধরে তিনি ক্ষুর দিয়ে নিজের বাম কানের অংশ কেটে ফেলেছিলেন। তারপর তিনি পতিতালয়ে গিয়ে র্যাচেলকে এই কাটা অংশ উপহার দেন আর সারাজীবন এটিকে আগলে রাখতে বলেন। এই ঘটনার পরই তিনি দুটো প্রতিকৃতি আঁকেন। উল্লেখ্য, ভ্যান গখের বাম কানে ব্যান্ডেজ থাকলেও আত্মপ্রতিকৃতি আঁকতে গিয়ে আয়না ব্যবহার করায় ডান কান বলে মনে হচ্ছে।
ছবিতে ভ্যান গখকে একটি টুপি আর ওভারকোট পরে থাকতে দেখা যাচ্ছে। মুখের অভিব্যক্তিতে কিছুটা বিষণ্নতার ছাপ। পেছনে জাপানী ব্লকপ্রিন্ট থেকে বোঝা যায় যে, তিনি 'উকিও-য়ে' এর বিশেষ অনুরাগী ছিলেন। লম্বা তুলির আঁচড় আর দ্বান্দ্বিক রঙের মিশেলে তিনি নিজের মনের অশান্তি আর টালমাটাল অবস্থাকেই তুলে ধরেছিলেন এই ছবিটিতে। ১৮৮৯ সালে আঁকা এ ছবিটি এখন লন্ডনের কোর্টল্ড গ্যালারিতে সংরক্ষিত আছে।
আমন্ড ব্লোজমস, ১৮৯০
ফ্রান্সের দক্ষিণাঞ্চলে (সেইন্ট রেমি আর আর্লস) থাকার সময় (১৮৮৮-৯০) আঁকা কয়েকটি ছবির মধ্যে এটি একটি। ভ্যান গখের বিশেষ দুর্বলতা ছিল ফুল গাছের প্রতি। এরা ছিল তার কাছে আশার প্রতীক। তিনি খুব কাছ থেকে দেখে এসব আঁকতে পছন্দ করতেন। আমন্ড ব্লোজমস তিনি এঁকেছিলেন তার ভ্রাতুষ্পুত্রের জন্মের উপলক্ষে। তার ভাই থিও আর ভাইয়ের স্ত্রী জো এর কোলজুড়ে আসে এক সন্তান। থিও সাধ করে তার ভাইয়ের সাথে নাম মিলিয়ে ছেলের নাম রাখলেন ভিনসেন্ট উইলেম। থিও তার ভাইকে চিঠিতে লিখেছিলেন, "আমি মন থেকে চাইছি আমার সন্তান যেন তোমার (গখ) মতোই সাহসী আর দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়।"
গখ খুশি হয়ে তার ভ্রাতুষ্পুত্রকে উপহারস্বরূপ এই ছবিটি এঁকে দিয়েছিলেন। ভ্যান গখের পরিবার এ ছবিটিকে আগলেই রেখেছিল বলা চলে। ফুলের কুঁড়ি সবসময়ই গখের প্রিয় বিষয়বস্তু ছিল। বসন্তের শুরুতে আমন্ড গাছের ফুল নবজীবনের প্রতীক বহন করে। জাপানী প্রিন্ট, বিশেষত 'উকিও-য়ে' এর বিশেষ অনুরাগী ছিলেন গখ। উজ্জ্বল রঙ, গাঢ় আউটলাইনের ব্যবহারের বিষয়টি তিনি সেখান থেকেই ধার নিয়েছিলেন। তবে একইসাথে এটি 'আধুনিক ভ্যান গখ' রূপ লাভ করেছে। থিওরা এটি তাদের সন্তানের বিছানার উপর টাঙিয়েছিলেন। থিওয়ের স্ত্রী গখকে লিখেছিলেন যে, ছোট্ট ভিনসেন্টের এই ছবিটি খুব পছন্দ হয়েছে। ভাগ্যের নির্মম পরিহাস, যে ছবিটি নবজীবনের প্রতীক ছিল, সেটি আঁকার কয়েক মাস পরেই গখ আত্মহত্যা করেন।
সর্বকালের সেরা একজন চিত্রশিল্পী ভিনসেন্ট ভ্যান গখ। বিংশ শতাব্দীর শিল্পকলায় তার অবদান অনস্বীকার্য। তার আরও অনেক কালজয়ী ছবির মধ্যে অ্যাট এটারনিটিস গেইট, স্টারি নাইট ওভার দ্য রোন, বেডরুম ইন আর্লস, হুইটফিল্ড উইথ ক্রোওস, হুইটফিল্ড উইথ সাইপ্রেসেস, দ্য রেড ভিনেয়ার্ড, দ্য নাইট ক্যাফে অন্যতম।
এই চিত্রকর সম্বন্ধে আরো বিস্তারিত জানতে পড়তে পারেন বই। অনলাইনে কিনতে চাইলে ক্লিক করুন নিচের লিংকে-
This article is in Bangla language. It is about Vincent van Gogh's famous and beautiful paintings. He was one of the most famous post-impressionist painters in the Western art history.
Necessary sources have been hyperlinked inside the article.
Feature Image Credit: Edited by Author