Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website. The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

অ্যানোরেক্সিয়া নার্ভোসা: মুটিয়ে যাবার ভয় (১ম পর্ব)

এ যুগে ওজন কমিয়ে দৈহিক সৌন্দর্য প্রকাশ করার ট্রেন্ড অনেক বেশি। এক কেজি ওজন বাড়লেই মনে হয়, রূপ-লাবণ্য গেলো! আয়নায় বারবার নিজেকে পরখ করে দেখা, দৈনিক খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তন ইত্যাদি চলতেই থাকে। কিন্তু যদি এমন হয় যে, এই ভাবনা থেকে খাওয়া-দাওয়ার পরিমাণ কেউ অস্বাভাবিকভাবে কমিয়ে দিলো? এক কথায় বলতে গেলে খাওয়া ছেড়েই দিল এমন। তারপরেও চিন্তিত, “আমি মোটা হয়ে যাচ্ছি না তো!”

মোটা হয়ে যাবার ভয়ে খাদ্যাভ্যাসে আমূল পরিবর্তন আনা অর্থাৎ প্রয়োজনীয় ক্যালরিটুকুও গ্রহণ না করা এবং মাত্রাতিরিক্ত ব্যায়াম করা স্বাভাবিক কোনো ব্যাপার নয়। এটি এক প্রকার মানসিক রোগ যার নাম অ্যানোরেক্সিয়া নার্ভোসা।

ছবিসূত্রঃ litttlerockfamily

২০১৫ সালের কথা, মার্কিন অভিনেত্রী ও মডেল রাচায়েল ফারকে নিয়ে তোলপাড় শুরু হয়েছিল সারা পৃথিবীতে। ৩৭ বছর বয়সী রূপসী মডেল হয়ে উঠেছিলেন জীবন্ত কঙ্কাল! ডায়েট কন্ট্রোল করতে করতে এমন এক পর্যায়ে পৌঁছেছিলেন যে, তিনি আর খেতেই পারতেন না। ৩৭ বছর বয়সে ওজন মাত্র ১৮ কেজি। নিজে নিজে বসতে পারতেন না, দাঁড়াতে পারতেন না কারো সাহায্য ছাড়া। নিজের শরীরের হাড় বিঁধে ব্যথা পাবার জন্য শুয়ে থাকতে পারতেন না । তিনি ছিলেন এই অ্যানোরেক্সিয়ায় আক্রান্ত।

অ্যানোরেক্সিয়ায় আক্রান্ত রাচায়েল; ছবিসূত্রঃ anxietypanicattackhelps.co

রাচায়েলের পূর্বাবস্থা; ছবিসূত্রঃ namelistnet.co

হ্যাঁ, এটি এমনই এক রোগ যেখানে ব্যক্তির খাবার গ্রহণে অনীহা কাজ করবে, উচ্চতা এবং বয়স অনুযায়ী ওজন অনেক কম হবে এবং দেখা দেবে মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকি। দৈহিক অবয়ব নিয়ে চিন্তিত হবার প্রবণতা কৈশোরে সকলের মাঝেই দেখা দেয় এবং এই রোগ সাধারণত ঐ বয়সেই শুরু হয়। মেয়েদের ক্ষেত্রে এর প্রবণতা সর্বাধিক। দৈহিক সৌন্দর্য বাড়াতে গিয়ে কম খাওয়া শুরু করে এবং ধীরে ধীরে হাড্ডিসার হতে থাকে। মারাত্মক পর্যায়ে চলে গেলেও তাদের কাছে মনে হয় তারা মোটা এবং আরও হ্যাংলা-পাতলা হতে হবে। এই রোগীদের শেষ পরিণতি অবর্ণনীয়।

‘অ্যানোরেক্সিয়া নার্ভোসা’কে শুধু ‘অ্যানোরেক্সিয়া’ও বলা যায়। ‘অ্যানোরেক্সিয়া’ শব্দটি গ্রিক, আবার নিউ ল্যাটিনও বলা চলে, যার অর্থ খাবারে অরুচি বা ক্ষুধামন্দা বা না খেয়ে থাকা।

মোটা হবার ভয়ে খাবার খেতে অনীহা অ্যানোরেক্সিয়ার লক্ষণ। ছবিসূত্রঃ pure-herbal-aurved-clinic,co

অ্যানোরেক্সিয়ার নানা প্রকার

সাধারণত দু’ধরনের অ্যানোরেক্সিয়া দেখা যায়।

  • মদ্যপান বা ঔষধ-সেবন টাইপ – এ ধরনের রোগী যখন কিছু খায়, তখন নিজেকে প্রচন্ড দোষী মনে করতে থাকে। আর তাই তারা যখনই খায়, সাথে হয় অ্যালকোহল বা ওজন কমায় এমন ওষুধ গ্রহণ করে থাকে।
  • রেস্ট্রিক্টেড টাইপ – এ ধরনের রোগীরা অস্বাভাবিকভাবে খাদ্য গ্রহণ কমিয়ে দেয় এবং এতটাই কম খায় যে দেহের ক্যালরির চাহিদার সামান্যতমও পূরণ হয় না।

আলাদা দুটি ধরনের কথা উল্লেখ করা হলেও উপসর্গ দু’ক্ষেত্রে একই।

কেন হয়?

এ রোগের সুনির্দিষ্ট কোনো কারণ নির্ণয় করা সম্ভব হয় নি। তবে বেশ কিছু কারণকে একত্রে দায়ী করা হয় এর জন্য।

জিনগত কারণ

জিনের তথা ডিএনএ এই রোগের অন্যতম কারণ বলা চলে, যা টুইন স্টাডি থেকে প্রমাণিত। আরো কিছু প্রাসঙ্গিক গবেষণায়, যেমন-খাদ্যাভ্যাস, মোটিভেশন, পারসোনালিটি এবং ইমোশনের সাথে জড়িত ৪৩টি জিনের ১২৮টি বহুরূপতা নিয়ে গবেষণার ফলাফলে পাওয়া গিয়েছে ‘ডিএনএ মিথাইলেশন’ অ্যানোরেক্সিয়া নার্ভোসায় আক্রান্ত হবার ক্ষেত্রে অনেকাংশে দায়ী।

জন্মগত জটিলতা

মায়ের গর্ভে থাকাকালীন বা জন্মের সময় বিভিন্ন জটিলতা, যেমন- রক্তশূন্যতা, ডায়াবেটিস, প্লাসেন্টায় ইনফেকশন, ভ্রুণের হৃদযন্ত্রে অস্বাভাবিকতা ইত্যাদির সাথে এ রোগের সম্পর্ক পাওয়া গিয়েছে।

মানসিক কারণ

  • অতিরিক্ত উদ্বেগ এবং হতাশা,
  • একাকীত্ব
  • আত্মমর্যাদার অভাব

যতই পাতলা গড়ন হোক, নিজেকে মোটা ভাবতে থাকে অ্যানোরেক্সিয়ায় আক্রান্ত ব্যক্তি; ছবিসূত্র: benitolink

পরিবেশগত কারণ

অ্যানোরেক্সিয়া নার্ভোসার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি দায়ী আমাদের পরিবেশ, আমাদের সমাজ। এখানে পাতলা দেহ কাঠামোর কদর বেশি। মিডিয়াগুলোতে স্বাস্থ্য সচেতনতায় খাদ্যাভ্যাসের গুরুত্বকে এতোটাই বড় করে দেখানো হয় এবং কম খাওয়াকে উৎসাহিত করা হয় যে সকলেই রেস্ট্রিক্টেড ডায়েট গ্রহণ করতে চেষ্টা করেন। এছাড়াও পেশাগত ক্ষেত্রেও পাতলা গড়নের গ্রহণযোগ্যতা বেশি থাকে। আর স্কুল কলেজে বন্ধু-বান্ধবের প্রেশার তো আছেই। ছোটবেলায় পারবারিক নির্যাতন এবন যৌন নির্যাতনের শিকার হলেও এ রোগের সূচনা হতে পারে।

অ্যানোরেক্সিয়ায় আক্রান্ত এক মডেল; ছবিসূত্রঃ justsomething.co

এছাড়াও আরও কিছু কারণ থাকতে পারে, যেমন- হরমোন নিঃসরণ সংক্রান্ত জটিলতা, অপুষ্টি প্রভৃতি।

লক্ষণ

  • বেশি মাত্রায় ডায়েটিং
  • অস্বাভাবিক হারে ওজন কমে যাওয়া
  • শারীরিক গঠন বারবার পরীক্ষা করাটা অবসেশনে পরিণত হওয়া
  • অ্যামেনোরিয়া- মেয়েদের মিন্সট্রুয়েশন অনিয়মিত হওয়া, যেমন-একনাগাড়ে তিন মাস না হওয়া
  • খাবারকে খুব ছোট ছোট টুকরা করে খাওয়া
  • সবসময় ব্যায়ামের মধ্যে থাকা
  • দেহের বর্ণ ধীরে ধীরে ফ্যাকাশে বা হলুদাভ হয়ে যাওয়া
  • দেহের হাড় শুকিয়ে যাওয়া
  • ডিপ্রেশন
  • সবসময় শীত শীত লাগা
  • চুল পড়ে যাওয়া
  • সামাজিক অনুষ্ঠান এড়িয়ে চলা

প্রভাব

অ্যানোরেক্সিয়া নার্ভোসার বাহ্যিক প্রভাব সুস্পষ্ট। লিভারে যে গ্লাইকোজেন জমা থাকে, তা গ্লুকোজের অভাব পড়লে ভেঙে গ্লুকোজে পরিণত হয়। কিন্তু এই গ্লাইকোজেনও যদি শেষ হয়ে যায়, তাহলে শরীরের ফ্যাট ভেঙে গ্লুকোজ উৎপাদন করে। যদি এই পরিস্থিতি চলতে থাকে, তাহলে প্রচুর জটিলতা সৃষ্টি হবে, ঢলে পড়তে হবে নিশ্চিত মৃত্যুর কোলে।

ডায়েটিং বনাম অ্যানোরেক্সিয়া

অনেকে না খেয়ে থাকাকে ‘ডায়েটিং’ বলে থাকেন। কিন্তু তা সঠিক নয়। ডায়েটিংয়ের মাধ্যমে ওজন নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করা হয়, কিন্তু অ্যানোরেক্সিয়ায় নিজের জীবন এবং আবেগগুলোকেই নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা চলে। ডায়েটিং করে ওজন কমানোর মাধ্যমে দেহ সুস্থ রাখার চেষ্টা করা হয়, অপরদিকে অ্যানোরেক্সিয়ায় ওজন কমানোর চেষ্টা চলে আনন্দের জন্য। সর্বোপরি, ডায়েটিংয়ের উদ্দেশ্য স্বাস্থ্যকর উপায়ে ওজন কমানো, আর অ্যানোরেক্সিয়ার উদ্দেশ্য ওজন কমিয়ে শুকিয়ে যাওয়া, সুস্বাস্থ্যের জন্য নয়।

একটি অ্যানোরেক্সিয়া নার্ভোসা মডেল; ছবিসূত্রঃ ED-bites

চিকিৎসা

একেবারে শেষ পর্যায়ে না যাওয়া পর্যন্ত অ্যানোরেক্সিয়া রোগীরা ডাক্তারের শরণাপন্ন হন না, কেননা তারা নিজেদেরকে রোগী বলে মনেই করেন না। অস্বাভাবিকভাবে শুকিয়ে যাবার পরেও তাদের কাছে মনে হয় তারা মোটা। তাই অন্যরা বললেও কানে তোলেন না। আর শেষ পর্যায়ে রোগীকে বাঁচিয়ে রাখাটা চ্যালেঞ্জিং হয়ে পড়ে। মডেল রাচায়েলকে তার শেষ মুহূর্তে কোনো হাসপাতালই নিতে চায় নি!

ইটিং ডিসঅর্ডারের ক্ষেত্রে ডাক্তার, ডায়েটিশিয়ান, থেরাপিস্ট সকলের অংশগ্রহণ প্রয়োজন। অ্যানোরেক্সিয়ার ক্ষেত্রেও তাই। এক্ষেত্রে একেবারে প্রথম পদক্ষেপ হলো রোগীর দেহে ওজন হ্রাসের ফলে আর কী কী শারীরিক জটিলতার সৃষ্টি হয়েছে তা পরীক্ষা করা; যেমন- হার্টের সমস্যা বা অস্টিওপোরেসিস ইত্যাদি। এর পরবর্তী ধাপ হবে রোগীর শরীরে পুষ্টি প্রদান তথা ওজন বৃদ্ধি। এজন্য সঠিক খাদ্য গ্রহণের চার্ট তৈরি এবং সে অনুযায়ী খাদ্য প্রদান করতে হবে। এসব কিছুর সাথে সাথে সাইকোথেরাপি দেয়াটা খুব জরুরি। লাইফ-ট্রমা থেকে উঠে এসে স্বাভাবিক জীবন-যাপনের জন্য এবং আবেগের সঠিক ব্যবহার শেখানো হবে থেরাপির প্রধান উদ্দেশ্য।

সচেতন হন

নিজের আবেগ অনুভূতিগুলোকে বুঝতে শিখুন। বলা তো যায় না, হয়তো আপনিও এ রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়লেন! তাই আগেভাগেই সচেতন হন। সচেতন করুন অন্যদেরকেও। শুকিয়ে যাওয়া মানেই সৌন্দর্য নয়, বরং স্বাস্থ্যবান হওয়াই সৌন্দর্য। যদি মনে করেন আপনি মুটিয়ে যাচ্ছেন, তাহলে পুষ্টিবিদের সাথে কথা বলুন এবং আপনার জন্য সঠিক ডায়েট জেনে নিন। এছাড়াও কোপিং স্কিল বাড়ানো শিখুন, প্র্যাকটিস করুন মাইন্ডফুলনেস। ডায়েট করুন, তবে না খেয়ে থাকবেন না।

ফিচার ইমেজ- আপডেটেড ট্রেন্ডস

Related Articles