Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

ডিমেনশিয়া: কেন ভুলে যাচ্ছি সবকিছু?

মোহাম্মদ জুনায়েদ (ছদ্মনাম) ৪০ বছর বয়সী একজন ইন্টেরিয়র ডিজাইনার। তুখোড় একজন ছাত্র ছিলেন। একটা পড়া একবার দেখলেই মনে থাকতো। কিন্তু গত ১ মাস যাবৎ কিছুই মনে রাখতে পারছেন না। অফিসের দরকারি ই-মেইল করতে ভুলে যাওয়া, বাচ্চাদের জন্মদিন ভুলে যাওয়ার মতো ব্যাপার হয়েই চলেছে। কাউকে বুঝাতেও পারছেন না তার এ সমস্যার কথা, উল্টে সকলে তাকে ভুল বুঝছে। একদিন সকালে অফিসে যাবার জন্য বের হলেন কিন্তু অফিসের ঠিকানাই মনে করতে পারলেন না। এমনকি বাসায় ফিরবেন সে উপায়ও ছিল না কারণ তিনি সেই ঠিকানাও ভুলে গিয়েছেন। অনেক খোঁজাখুঁজির পর তার স্ত্রী তাকে খুঁজে পান এবং দ্রুত ডাক্তারের কাছে নিয়ে যান। ডায়াগনোসিস করে ডাক্তার জানান, মোহাম্মদ জুনায়েদ ‘ডিমেনশিয়া’ নামক রোগে আক্রান্ত।

কিন্তু কী এই ডিমেনশিয়া?

ডিমেনশিয়া হলো মস্তিস্কের এমন একটি বিকৃত অবস্থা যখন আক্রান্ত ব্যক্তির কিছু মনে রাখা কঠিন হয়ে যায়, চিন্তাশক্তি লোপ পায় ইত্যাদি এবং ক্রমান্বয়ে এ সমস্যা বাড়তেই থাকে। প্রধানত বয়স্ক ব্যক্তিদের মধ্যে দেখা গেলেও বার্ধক্য মানে ডিমেনশিয়া নয়। বার্ধক্যজনিত কারণে স্মৃতিশক্তি লোপ পাওয়াকে ডিমেনশিয়া বলা হয় না। বরং বয়সের সাথে সাথে যদি শরীরের কোনো রোগব্যাধি মস্তিষ্কের ক্ষতি করে স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় সমস্যার সৃষ্টি করে তবেই আমরা ডিমেনশিয়া বলতে পারি।

কাদের হয় এই ডিমেনশিয়া?

সাধারণত বয়স ৬৫ বা তার উপরে এমন ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে ডিমেনশিয়ায় আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা বেশি। তবে কমবয়সীরা যে ঝুঁকিমুক্ত তা কিন্তু নয়। যেকোনো বয়সেই এটা হতে পারে। বাবা বা মায়ের ডিমেনশিয়া থাকলেও সন্তানের ডিমেনশিয়া হতে পারে কম বয়সেই।

ক্রোনিক ডিমেনশিয়ায় আক্রান্ত একজন মহিলার ছবি। ছবিসূত্রঃ wellcomeimages.org

১৯ শতকের শেষেও ডিমেনশিয়াকে অনেক বড় একটা ক্লিনিক্যাল কনসেপ্ট হিসেবে দেখা হতো যাতে মানসিক অসুস্থতা, মনোসামাজিক অক্ষমতা, বা সিফিলিসের মতো রোগগুলোকেও অন্তর্ভুক্ত করা হতো। পূর্বে ডিমেনশিয়াকে বলা হতো ‘বার্ধক্যজনিত ডিমেনশিয়া’ বা ‘সেনেলিটি’। বিংশ শতাব্দিতে এসে গবেষণায় দেখা যায় যে এ রোগের সম্ভাবনা বয়সের সাথে বাড়ে, তবে কোন বয়স থেকে শুরু হয় তার কোনো নির্দিষ্ট তথ্য নেই। তাই বয়স বাড়াকে এর একমাত্র কারণ হিসেবে বলা যাবে না।

সেনাইল ডিমেনশিয়া আক্রান্ত বৃদ্ধ। ছবিসূত্রঃ wellcomeimages.org

ডিমেনশিয়ার লক্ষণ

ডিমেনশিয়ার ধরন অনুযায়ী এর লক্ষণ বিভিন্ন হতে পারে। তবে সাধারণভাবে যে লক্ষণগুলো দেখা যায় সেগুলো হলো-

  • স্মৃতিশক্তি হ্রাস পাওয়া
  • কথা বলার সময় সঠিক শব্দ খুঁজে না পাওয়া
  • অন্যের কথা বুঝতে অসুবিধা হওয়া
  • দৈনন্দিন কাজকর্ম করতে না পারা বা ভুলে যাওয়া
  • ব্যক্তিত্ব ও মেজাজের পরিবর্তন
  •  মনোযোগ দিতে না পারা ও যুক্তি দানে অক্ষমতা
  • ভিজ্যুয়াল হ্যালুসিনেশন
  • ইমোশনকে সঠিকভাবে প্রকাশ করতে না পারা
  • আচরণে অস্বাভাবিকতা উদ্বিগ্নতা
  • ডিপ্রেশন
  • ঘুমের সমস্যা।

ছবিসূত্রঃ http://forgetusnot.sg/

কেন হয় এই ডিমেনশিয়া?

ডিমেনশিয়ার ৪টি প্রধান কারণ হলো-

  • হাইপো-থাইরয়েডিজম
  • ভিটামিন বি-১২ এর অভাব
  • লাইম(Lyme disease) বা এক ধরণের ব্যাক্টেরিয়ার দ্বারা সংক্রামক রোগ
  • নিউরোসিফিলিস ।

এছাড়াও ডিমেনশিয়ার কিছু কারণ রয়েছে। যেমন-

  • ডিপ্রেশন
  • ওষুধের পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া
  • অতিরিক্ত মদ্যপান।

তবে ডিমেনশিয়ার সর্বপ্রধান কারণ হিসেবে বলা হয় ব্রেইন ড্যামেজ।

মস্তিষ্কের কোষ নষ্ট হয়ে যাওয়া ডিমেনশিয়ার একটি কারণ। ছবিসূত্রঃ http://blog.bdnews24.com/wp-content/uploads/2015/05/dementia1.jpg

ডিমেনশিয়ার প্রকারভেদ

বেশ কয়েক ধরনের ডিমেনশিয়া দেখা যায়। যেমন-

অ্যালঝেইমার (Alzheimer’s disease) – সবচাইতে কমন ডিমেনশিয়া এটি। প্রায় ৬০-৮০ শতাংশ ক্ষেত্রে এটি দেখা যায়। এ রোগের শুরুর দিকে আক্রান্ত ব্যক্তি নাম মনে রাখতে পারে না, সাম্প্রতিক ঘটনাসমূহ মনে রাখতে পারে না। ধীরে ধীরে আরো কিছু সমস্যা দেখা দিতে থাকে, যেমন- চিন্তাধারায় সমস্যা, আচরণে অসামঞ্জস্য, কনফিউশন, কথা বলতে গেলে শব্দ খুঁজে না পাওয়া, বিড়বিড় করা ইত্যাদি। মূলতঃ মস্তিষ্কের স্নায়ুকোষ নষ্ট হয়ে যাওয়া এবং স্নায়ুকোষের মৃত্যু এর প্রধান কারণ।

অ্যালঝাইমারে ব্রেইনের মাইক্রোটিউবিউলসে অসামঞ্জস্যতা। http://www.nia.nih.gov/NR/rdonlyres/A01D12CE-17E3-4D3D-BCEF-9ABC4FF91900/0/TANGLES_HIGH.JPG

সুস্থ মস্তিষ্ক এবং অ্যালঝাইমার আক্রান্ত মস্তিষ্কের তুলনা। ছবিসূত্রঃ docjana.com

ভাস্কুলার ডিমেনশিয়া (Vascular Dementia) – যুক্তি ও বিচারক্ষমতা হ্রাস পাওয়া, কোনো একটা কাজ সম্পন্ন করতে প্রয়োজনীয় ধাপ অনুসরণ করতে না পারা ইত্যাদি এ রোগের প্রাথমিক লক্ষণ। মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ বা আঘাতের কারণে এ সমস্যার সৃষ্টি হয়ে থাকে। এ ধরণের ডিমেনশিয়া অনেকক্ষেত্রে অন্য ডিমেনশিয়াও সৃষ্টি করে মিশ্র ডিমেনশিয়াতে রূপ নিতে পারে।

ছবিসূত্রঃ www.slideshare.net/

হৃদপিন্ডের রক্তনালির রোগের ভেতর ভাস্কুলার ডিমেনশিয়াতেও প্রতি বছর অনেকেই মৃত্যুবরণ করেন। currentnews.com.bd

লিউয়ি বডি ডিমেনশিয়া (Lewy Body Dementia) – স্মৃতি লোপ পাওয়া, চিন্তাভাবনায় সমস্যা, ভিজুয়্যাল হ্যালুসিনেশন, ঘুমের সমস্যা, ধীরগতির হয়ে পড়া, মাংসপেশির সচলতা কমে যাওয়া ইত্যাদি এ রোগের লক্ষণ। ব্রেইন করটেক্সে যখন প্রোটিন-আলফা-সাইনুক্লেইন এর অস্বাভাবিক বৃদ্ধি ঘটে তখন ডিমেনশিয়া হয়ে থাকে।

লিউয়ি বডি ডিমেনশিয়াতে অ্যালঝাইমার এবং পারকিন্সন রোগের উপসর্গ দেখা দিতে পারে। ছবিসূত্রঃ Lewy body dementia Video – YouTube

ফ্রন্টোটেম্পোরাল ডিমেনশিয়া (Frontotemporal Dementia) – মস্তিষ্কের সামনের দিকের (ফ্রন্টাল লোব) এবং সাইডের (টেমপোরাল লোব) এর নিউরন সংখ্যা হ্রাস পেতে থাকে যার ফলে পারসোনালিটি এবং আচরণে পরিবর্তন এবং ভাষা ব্যবহারে জটিলতা দেখা দেয়।

ছবিসূত্রঃ hubaisms.com

হান্টিংটন ( Huntington’s disease) – ক্রোমোজোমের ৪নং জোড়ার একটিতে ত্রুটির কারণে ধীরে ধীরে মস্তিষ্কের ডিসঅর্ডার সৃষ্টি হতে থাকে। এ রোগে আক্রান্ত ব্যক্তির মধ্যে অনিয়ন্ত্রিত গতিবিধি, চিন্তায় অসামঞ্জস্য, ডিপ্রেশন এবং মুড চেঞ্জ হতে দেখা যায়।

হান্টিংটন রোগ। ছবিসূত্রঃmedicalxpress.com

ডিমেনশিয়ার চিকিৎসা

কী কারণে ডিমেনশিয়া হয়েছে তার উপর নির্ভর করছে এর চিকিৎসা। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এখন পর্যন্ত এ রোগের কোনো চিকিৎসা নেই। তবে প্রাথমিক স্টেজে ধরা পড়লে ওষুধের মাধ্যমে রোগের লক্ষণগুলোকে কিছুটা ইম্প্রুভ করা সম্ভম। যেমন-অ্যালঝেইমার এর ক্ষেত্রে ‘ডোনেপেযিল’ কিছুটা কাজ করতে পারে। ডিপ্রেশন থাকলে ‘বেনজোডায়াফিন’ যেমন ‘ডায়াযেপাম’ জাতীয় ওষুধ দেয়া যেতে পারে কিন্তু এতে হিতে বিপরীত হবার সম্ভাবনাই বেশি।

পরিবারের সদস্যদের ভূমিকা এ রোগে আক্রান্ত রোগীর জন্য সবচেয়ে দরকারি। কেননা একটা সময়ে গিয়ে রোগী খাওয়া, ঘুম বা শারীরিক যত্ন নিতেও ভুলে যায়। তখন অন্যের সাহায্য ও সহযোগিতা প্রয়োজন পড়ে। তাদেরকে পরিচর্যা করতে হবে একেবারে শিশুদের মতো।

ডিমেনশিয়া প্রতিরোধ

রিস্ক ফ্যাক্টরগুলোকে পরিবর্তন করা সম্ভম নয়। তবে বিজ্ঞানীরা গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন কীভাবে এই রিস্ককে কমিয়ে আনা যায় এবং প্রতিরোধ করা যায়। ডিমেনশিয়া প্রতিরোধে শুরুতেই খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন প্রয়োজন। রক্তচাপ, কোলেস্টেরল এবং সুগ্যারের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। প্রতিদিন শারীরিক ব্যায়াম করা মস্তিষ্কের কোষগুলোকে সতেজ রাখতে সাহায্য করে।

ডিমেনশিয়া প্রতিরোধ। ছবিসূত্রঃ alzheimersresearchuk.org

ডিমেনশিয়ার পরিসংখ্যান

বিশ্বে প্রতি ৩ সেকেন্ডে একজন করে এবং প্রতি বছরে ৭৭ লক্ষ মানুষ নতুনভাবে ডিমেনশিয়ায় আক্রান্ত হচ্ছে। ২০১৩ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী বিশ্বে এ জাতীয় রোগীর সংখ্যা ৪ কোটি ৮০ লক্ষ। বর্তমান বিশ্বের মোট ডিমেনশিয়া আক্রান্ত রোগীর ৬২ শতাংশই হলো নিম্ন এবং মধ্যম আয়ের দেশগুলোতে বাস করেন।

যুক্তরাষ্ট্রে ডিমেনশিয়ার পরিসংখ্যান। ছবিসূত্রঃ www.cdc.gov

ফিচারড ইমেজ – নিউরা ডট কম

Related Articles