Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website. The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

হাইপোকন্ড্রিয়াসিস: প্রাণঘাতী রোগের অদ্ভুত এক ভয়

রাশেদ সাহেব ( ছদ্মনাম) গত ৩/৪ দিন ধরে মাথাব্যথায় ভুগছেন। মনে হচ্ছে মাথার বামদিকটায় ব্যথাটা একটু বেশি। এর আগেও এরকম মাথাব্যথা মাঝেমাঝেই হয়েছে। আর এই ভাবনা আসার পর তার মনে আসে এক ভয়, ভয় কোনো এক ভয়ঙ্কর রোগের। তিনি ভাবতে থাকেন, মাথাব্যথা যেহেতু প্রবল সেহেতু নিশ্চয়ই মাথায় টিউমার হয়েছে। শুনেছিলেন ব্রেইন টিউমার খুব ধীরে ধীরে বিস্তার লাভ করে ক্যান্সারে রূপ নেয়। তাহলে কি ব্রেইন ক্যান্সারই হয়ে গেল! তার মানে কিছুদিনের মধ্যেই ইতি ঘটতে চলেছে তার জীবনের। মৃত্যুভয়ে কুঁকড়ে যেতে থাকেন রাশেদ সাহেব। পরিবারের সবাই তাকে জোর করে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যান। নানা টেস্ট করান ডাক্তার। কিন্তু কোনো রোগই ধরা পড়ল না। ইতোমধ্যে ৫ জন ডাক্তার পরিবর্তন করে ফেলেছেন তিনি।

ডাক্তার রোগ খুঁজে না পেলেও রোগী বলবে তার মারাত্মক কোনো রোগ হয়েছে; Source: বিবিসি

সামান্য মাথাব্যথা থেকে মৃত্যু পর্যন্ত কল্পনা করে ফেলাকে নিশ্চয়ই স্বাভাবিক মনে হচ্ছে না। ঠিক তাই। এটি স্বাভাবিক নয়। রাশেদ সাহেব ভুগছেন ‘হাইপোকন্ড্রিয়াসিস’  নামক এক মানসিক অসুস্থতায়।

 হাইপোকন্ড্রিয়াসিস বা হাইপোকন্ড্রিয়া কী?

মারাত্মক কোনো শারীরিক রোগ সম্পর্কে মাত্রাতিরিক্ত ভীতিই হলো হাইপোকন্ড্রিয়াসিস। এ ধরনের রোগীরা শারীরিক সমস্যার জন্য ডাক্তারের কাছে যান, কিন্তু ডাক্তার তেমন কোনো শারীরিক জটিলতাই খুঁজে পান না। তবুও রোগী বলেই যাবেন যে, তার নিশ্চয়ই মারাত্মক কোনো রোগ হয়েছে। বর্তমানে এই রোগকে নাম দেয়া হয়েছে ‘ইলনেস এংজাইটি ডিজঅর্ডার’।

সামান্য শারীরিক সমস্যাকে বড় করে দেখা হাইপোকন্ড্রাসিসের লক্ষ্মণ; Source: Anxietyboss

এক্ষেত্রে রোগী নিজের শারীরিক সেনসেশন বা অনুভূতিগুলোকে আসলে ভুলভাবে ব্যাখ্যা করে থাকেন, যেমনটা রাশেদ সাহেব করেছেন। চলতি কোনো স্ট্রেসের কারণে হওয়া মাথাব্যথা থেকে এই ভুল ভাবনা তার ভেতরে এতটাই প্রবল আকার ধারণ করে যে তিনি ধীরে ধীরে দুর্বল হয়ে পড়েন এবং স্বাভাবিক জীবন-যাপন থেকে দূরে সরে যান। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায়, হাইপোকন্ড্রিয়াসিসে আক্রান্ত ব্যক্তি সত্যিকার শারীরিক জটিলতায় আক্রান্ত রোগীদের চেয়েও বেশি অসুস্থতা প্রকাশ করেন। আসলে রোগ থাকা বা না থাকাটা এখানে বিষয়  নয়, এটি এক ধরনের মানসিক প্রতিক্রিয়া।

হাইপোকন্ড্রিয়াসিসের লক্ষ্মণ

নিম্নের লক্ষণগুলো যদি একজন ব্যক্তির ভেতর ৬ মাসের বেশি স্থায়ী থাকে তাহলে তিনি হাইপোকন্ড্রিয়াসিসে আক্রান্ত বলে নিশ্চিত হওয়া যাবে-

  • সামান্য শারীরিক সমস্যা, যেমন- ব্যথা, পেট খারাপ করা ইত্যাদিকে মারাত্মক কোনো রোগের লক্ষণ মনে করা।
  • সুস্থ থাকলেও সারাক্ষণ অসুস্থ হবার ভয়ে ভীত হয়ে পড়া।
  • শরীরকেন্দ্রিক উদ্বিগ্নতা, যেমন- “হাতটা মনে হয় ফুলে গেছে”, “দিন দিন কেমন শুকিয়ে যাচ্ছি” ইত্যাদি সবসময় ভেতরে কাজ করা।
  • সামান্য কোনো সমস্যা হলেই গুগলে সার্চ দিয়ে খুঁজতে থাকা এর ফলে কী কী কঠিন রোগ হতে পারে এবং যদি কোনো একটির সাথে মিলে যায় সেটা নিয়ে মানসিক উৎকণ্ঠায় থাকা।
  • ডাক্তার যদি বলেও সব ঠিকঠাক, তারপরেও উদ্বিগ্ন থাকা।
  • সেকেন্ড অপিনিয়নের জন্য বারংবার ডাক্তার পরিবর্তন করা। শুধু তা-ই নয়, অনেকক্ষেত্রে ডাক্তারই দেখাতে না চাওয়া।
  • নিজের ভেতর বড় কোনো রোগ বেড়ে উঠছে এমন বিশ্বাস নিজের ভেতরে ধারণ করা।

গুগল করে নিজের সমস্যাগুলোকে দেখে ভীত হয়ে পড়েন;Source; Pinterest

একজন হাইপোকন্ড্রিয়াটিক রোগীর ক্ষেত্রে এই লক্ষণগুলো বাড়তেই থাকে। প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলো হলো স্বাস্থ্য নিয়ে প্রবল দুশ্চিন্তা, অসুস্থ হবার ভয়ে মাত্রাতিরিক্ত উদ্বিগ্ন থাকা এবং অসুস্থতার লক্ষণ খুঁজে পেতে নিজের শরীর বারবার চেক করা।

কেন হয়?

একজন মানুষ কেনই বা ভাববে সে কঠিন রোগে আক্রান্ত? কেনই বা ভয় পাবে তিলকে তাল ভেবে? এর পেছনে রয়েছে সুনির্দিষ্ট কিছু কারণ। যেমন-

  • উপলব্ধিতে সমস্যা (Disturbance in perception), যেমন- সাধারণ সেন্সেশনগুলোকে বড় করে দেখার প্রবণতা।
  • অতীতের কোনো দুর্ঘটনা বা স্বপ্নে দেখা কোনো দুর্ঘটনা থেকে নিজের ভেতর ধারণা সৃষ্টি হওয়া- “আমার এজন্য বড় কোনো রোগ হবে”।
  • অন্যের মনোযোগ আকর্ষণের চেষ্টা। ছোটবেলায় অসুস্থ হয়ে বা ভাই-বোনকে বা অন্য কাউকে অসুস্থ হতে দেখে বুঝতে পেরে অন্যের মনোযোগ এবং যত্ন পাবার জন্য এমনটা ভাবা।
  • বড় কোনো স্ট্রেসের মধ্য দিয়ে দীর্ঘদিন দিনাতিপাত করলে, যেমন-অফিসে কাজের চাপ, পরিবারে অভাব-অনটন, নিকটাত্মীয়ের মৃত্যু বা এ জাতীয় কিছু।
  • এংজাইটি বা ওসিডি (শুচিবায়ু)-এর মতো মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা থেকেও হাইপোকন্ড্রিয়াসিসের সূচনা হতে পারে।

হাইপোকন্ড্রিয়াসিসের ক্ষেত্রে এই সবগুলো মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যাই ট্রিগার হিসেবে কাজ করতে পারে; Source: MBL consultancy

কাদের রয়েছে এই ঝুঁকি?

  • যাদের পরিবারে হাইপোকন্ড্রিয়াটিক রোগী রয়েছে বা ছিল (যদিও জিনগত কারণে এ রোগ হতে পারে এমন তথ্য গবেষণায় প্রমাণিত হয় নি)।
  • সম্প্রতি স্ট্রেসের সম্মুখীন হয়ে থাকলে।
  • বাল্যকালে দীর্ঘদিন অসুখে থেকে থাকলে।
  • এংজাইটি, ওসিডি, পারসোনালিটি ডিজঅর্ডার, ডিপ্রেশন ইত্যাদি মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা থেকে থাকলে।

পুরুষ নাকি মহিলা?

পুরুষ এবং মহিলা উভয়ের মধ্যে সমান হারে হাইপোকন্ড্রিয়াসিস হবার প্রবণতা দেখা যায়।

কোন বয়সে হতে পারে?

গবেষণায় হাইপোকন্ড্রিয়াসিসে আক্রান্ত হবার কোনো নির্দিষ্ট বয়স পাওয়া যায় নি। তবে এর শুরুটা মোটামুটি ২৫ থেকে ৩৫ বছর বয়সের মধ্যেই হয়ে থাকে। ধীরে ধীরে মাত্রায় বাড়তে থাকে। শুরু হয়ে আপনা-আপনি একেবারে কমে গিয়েছে এমন ক্ষেত্র খুবই কম।

চিকিৎসা

রোগী যেহেতু শারীরিক জটিলতার কথা বলে থাকেন, তাই শুরুতেই শরণাপন্ন হন একজন ফিজিশিয়ান বা মেডিসিন ডাক্তারের নিকট। প্রাথমিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে তিনি হয়তো প্রয়োজনীয় কিছু টেস্ট করাতে বলবেন। রোগীর উল্লিখিত লক্ষণের সাথে যদি প্রাপ্ত টেস্ট রিপোর্টে কোনো মিল পাওয়া না যায় তবে হয়তো আরও নির্দিষ্ট কিছু প্রশ্ন করবেন। এরপর তার কাছে যদি মনে হয় রোগী হাইপোকন্ড্রিয়াসিসে আক্রান্ত হতে পারেন তাহলে একজন অভিজ্ঞ সাইকোলজিস্ট বা সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে রেফার করে দেবেন।

একজন সাইকোলজিস্ট এক্ষেত্রে যা করে থাকেন

সাইকোলজিস্ট প্রথমেই বৃত্তান্ত শুনবেন এবং কিছু সাইকোলজিক্যাল টেস্ট করবেন। এরপর তিনি যদি নিশ্চিত হতে পারেন যে তার ক্লায়েন্ট হাইপোকন্ড্রিয়াসিসে আক্রান্ত, তাহলে তিনটি লক্ষ্য নির্ধারণ করে থাকেন-

  1. ক্লায়েন্টের জীবনের গতিকে যতটা সম্ভব স্বাভাবিক পর্যায়ে নিয়ে আসা।
  2. ক্লায়েন্টের মানসিক উৎকণ্ঠা হ্রাস করা।
  3. ওষুধের ওপর নির্ভরতা কমানো।

এই লক্ষ্যগুলো অর্জনে সবচেয়ে কার্যকর হলো সাইকোথেরাপি। যেমন-

  • কোগনিটিভ বিহ্যাভিয়রাল থেরাপি (সিবিটি): এই থেরাপি ব্যবহারে ব্যক্তি তার চিন্তা এবং ভয়ের কারণ খুঁজে পেতে সক্ষম হবেন এবং শারীরিক অনুভূতিগুলোর সঠিক ব্যাখ্যা দিতে পারবেন। রিল্যাক্সেশন প্র্যাকটিসও করানো হয় সিবিটিতে।

সিবিটি তে ব্যক্তির চিন্তা, অনুভূতি এবং আচরণ নিয়ে কাজ করা হয়; Source:ashgrove clinic

  • বিহ্যাভিয়রাল স্ট্রেস ম্যানেজমেন্ট থেরাপি: স্ট্রেস ম্যানেজমেন্ট এবং রিল্যাক্সেশন টেকনিক শেখানো হয়। সিবিটি এবং এই থেরাপিটি সাধারণত একসাথে ব্যবহার করে সুফল পাওয়া যায়।
  • মাইন্ডফুলনেস প্র্যাকটিস: বর্তমানে থাকার প্রচেষ্টাই হলো মাইন্ডফুলনেস। তবে কোনো জাজমেন্টে না গিয়ে বর্তমানে থাকার চেষ্টা। যেমন ধরুন, যখন খাবেন, তখন খাবারের প্রতিটি স্বাদ অনুভব করা, কীভাবে চিবোচ্ছেন, গিলছেন প্রতিটা বিষয় খেয়াল করা, তবে জাজমেন্টে না গিয়ে যেরকম সেভাবেই সেটাকে নেয়া। হাইপোকন্ড্রিয়াসিস রোগী এই মাইন্ডফুলনেস প্র্যাকটিস করলে অবস্থার উন্নতি করতে পারবেন।

বর্তমানে থাকার চেষ্টাই হলো মাইন্ডফুলনেস;SOurce: zenosorium

পরিসংখ্যান

বাংলাদেশে হাইপোকন্ড্রিয়াসিসের রোগীর সংখ্যা বা প্রবণতা কোনোটি নিয়েই তেমন কোনো পরিসংখ্যান পাওয়া যায় নি। যুক্তরাষ্ট্রের সুস্থ জনসংখ্যার প্রায় ১০-২০% এবং সাধারণ মানসিক সমস্যা রয়েছে এমন জনসংখ্যার ৪৫% বিনা অসুখে অসুস্থতায় ভোগেন!

জেনে রাখুন

এতকিছু জেনে মনে হতে পারে, আপনি নিজেই হয়তো হাইপোকন্ড্রিয়ায় আক্রান্ত। তাই গুগল করে, সাইকোথেরাপির ভিডিও খুঁজে নানবিধ চেষ্টা চালাতেই পারেন। তবে এতে হিতে বিপরীত হবে বৈকি! গুগল করেই যদি সব জেনে ফেলা যেত, তাহলে হয়তো সাইকোলজিস্টের প্রয়োজনই থাকতো না। তাই উল্লেখিত লক্ষণগুলো যদি আপনার বা আপনার পরিবারের কাউকে দেখতে পান, ডাক্তারের বা সাইকোলজিস্টের কাছে যান। তবে এমন যেন না হয়, কষ্টের সঞ্চয় বৃথায় একের পর এক ডাক্তার দেখিয়ে, টেস্ট করে শেষ করছেন। চেষ্টা করুন বর্তমানে থাকার, ভালো থাকার।

ফিচার ইমেজ- THINKLINK

Related Articles