Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

কুরবানি ও হজ: ত্যাগ আর সাম্যের বিশ্বায়ন

ওরে হত্যা নয় আজ ‘সত্যাগ্রহ’, শক্তির উদ্‌বোধন।

ওরে হত্যা নয় আজ ‘সত্যাগ্রহ’, শক্তির উদ্‌বোধন।

এই দিনই ‘মীনা’-ময়দানে

পুত্র-স্নেহের গর্দানে

ছুরি হেনে খুন ক্ষরিয়ে নে

রেখেছে আব্বা ইব্‌রাহিম্ সে আপনা রুদ্র পণ!

ছি ছি! কেঁপো না ক্ষুদ্র মন!

আজ জল্লাদ নয়, প্রহলাদ সম মোল্লা খুন-বদন!

ওরে হত্যা নয় আজ ‘সত্যাগ্রহ’, শক্তির উদ্‌বোধন।

-কাজী নজরুল ইসলাম

প্রেম, দ্রোহ ও সাম্যের কবি কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর ‘কোরবানি’ কবিতায় এভাবেই কুরবানির মাহাত্ম্য বর্ণনা করে গেছেন। বলে গেছেন কুরবানির ত্যাগ ও বীরত্বগাথার কথা। ঈদুল আজহায় পশু কুরবানি কেন দিতে হয়, এই কুরবানির প্রচলন কীভাবে, কেন হয়েছিল- এসব কথা সবাই জানেন। এসব আলোচনা মোটামুটি সব জায়গাতেই হয়। কুরবানির এসব দিক বাদ দিয়ে আজ অন্য আলোচনা করা যাক।

আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম কুরবানি নিয়ে লিখেছেন কবিতা ও গান; Image Credit: theindependentbd.com

সামর্থ্যবান মুসলমানেরা প্রতি বছর লাখ লাখ পশু কুরবানি করে থাকেন। মাংস বোঝাই করে ফ্রিজে ভরে রাখেন। কেউ কেউ রীতিমতো দামের প্রতিযোগিতা করে পশু কিনে থাকেন। কিন্তু প্রশ্ন হলো, কুরবানির শিক্ষা কয়জন ব্যক্তি কিংবা সমাজ-জীবনে বাস্তবায়ন করেন?

ত্যাগের মহিমায় ভাস্বর এই কুরবানি। হজরত ইবরাহিম তাঁর সবচেয়ে প্রিয় পুত্রকে স্রষ্টার সন্তুষ্টির জন্যে তার দ্বারা প্রত্যাদেশিত হয়েই কুরবানি দিতে চেয়েছিলেন। সেটি ছিল স্রষ্টার তরফে ইবরাহিমের জন্য ত্যাগের একটি পরীক্ষা।

কিন্তু আজকের সমাজ থেকে সেই ত্যাগের শিক্ষা, স্বার্থহীনতার অনুশীলন হারিয়ে যেতে বসেছে, ভোগবাদিতার জয়জয়কার সর্বত্র। আর যে ভোগকে নিরুৎসাহিত করে ত্যাগের শিক্ষা দেয় কুরবানি, সেই কুরবানিতেও দেখা যায় ভোগের আস্ফালন।

কুরবানি এলেই দেশের ইলেকট্রনিক্স শোরুমগুলোতে রেফ্রিজারেটর কেনার হিড়িক পড়ে। কে কার চেয়ে বেশি পশুর মাংস ফ্রিজে ভরে রাখতে পারে, সেই প্রতিযোগিতা চলে। গরিবের হক আদায় করার আগেই ফ্রিজ ভরে রেখে কীসের কুরবানি দেয়া হয় কে জানে!

সমাজের সর্বত্রই এখন দুর্নীতি গ্রাস করে ফেলেছে। এই যে লোকে প্রতিযোগিতা করে কুরবানির পশু কেনে, এসব পশু কেনার টাকাগুলো কি হালাল বা বৈধ উপার্জন থেকে আসে? ঘুষ-দুর্নীতির টাকায় যত বড় পশু কিংবা যত টাকামূল্যের পশুই কেনা হোক না কেন, এর কানাকড়িও মূল্য নেই। কারণ অবৈধ উপায়ে অর্জিত অর্থ খেলে যেখানে মানুষের কোনো ইবাদতই কবুল হয় না, সেখানে কুরবানি দিয়ে কী অর্জিত হবে?

কুরবানির পশু হিসেবে উট অনেকেরই পছন্দের; Image Credit: mtnews24.com

মসজিদের ইমাম-খতিবসহ যারা ধর্মীয় বক্তা আছে, তাদের উচিত যারা অবৈধ পথে উপার্জিত অর্থ দিয়ে কুরবানি করেন, তাদেরকে বর্জন করা। সামাজিক ও ধর্মীয়ভাবে দুর্নীতিবাজদের বর্জন শুরু হলে অবশ্যই সমাজ থেকে দুর্নীতি কমে আসতে বাধ্য। কুরবানিও মূলত এই দুর্নীতিমুক্ত সমাজেরই শিক্ষা দেয়।

কুরবানি উপলক্ষ্যে কিছু অসাধু ব্যবসায়ী কুরবানির পশুকে বিষাক্ত খাদ্য খাইয়ে মোটাতাজা করে বেশি দামে বিক্রি হওয়ার আশায়। কিছু টাকা বেশি লাভের জন্য মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর বিষ পশুর শরীরে মেশাতে যাদের হাত কাঁপে না, তারা কীভাবে নিজেদের মানুষ দাবি করে?

আবার কুরবানি উপলক্ষে পশু আনা-নেয়ায় নিয়োজিত যানবাহনগুলোতে চাঁদাবাজিও শুরু হয়। এসব চাঁদাবাজির কারণে পশুর দাম বাড়তে থাকে, অনেক মানুষের নাগালের বাইরেই চলে যায়। ন্যায়ভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠায় এই কাজগুলো বড় অন্তরায়।

কুরবানির নামে নির্বিচারে পশুহত্যা করা হচ্ছে- এমন দৃষ্টিভঙ্গী থেকে অনেকে সমালোচনা করেন এ ধর্মীয় আয়োজনের। অথচ সারা বছর তারা কিন্তু মাছ-মাংস খেতে মোটেও কার্পণ্য করেন না!

এদেশের সুবিশাল দরিদ্র জনগোষ্ঠীর আমিষের চাহিদা মেটাবার অন্যতম একটি বড় উপলক্ষ এটি, সেটি তো অস্বীকার করবার উপায় নেই। এই চালচুলোহীন লোকগুলোও বছরে কয়বার মাংস খেতে পারেন? যেখানে এক কেজি গরুর মাংসের দামই ৫০০-৭০০ টাকা, সেখানে কীভাবে একজন গরিব মানুষের দৈনন্দিন আহার তালিকায় সেটি থাকবে! এই মানুষগুলোর অনেকেই কুরবানির জন্য তীর্থের কাকের মত অপেক্ষা করে থাকে। বছরে একবার দু-চারদিন মাংস খেয়ে আমিষের অভাবটা কিছুটা হলেও পূরণ হয় তাদের।

তাছাড়া কুরবানিকে কেন্দ্র করে কৃষক, গরুর খামারিদের সংসারে বড় একটা আয় যেমন হয়, তেমনি রাষ্ট্রের বিশাল একটা অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডও পরিচালিত হয়। যা কৃষক আর খামারিদের স্বাবলম্বী হতে সহায়তা করে। তাছাড়া কুরবানির পশুর চামড়া রাষ্ট্রের চামড়াশিল্পের কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহৃত হয়, যা রফতানি করে দেশ অর্জন করে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা।

কুরবানির ত্যাগের শিক্ষাটা যদি সবাই ধারণ করে, পশুর সাথে পশুত্বটা যদি কুরবানি দেয়া হয়, তবে এই সমাজ, রাষ্ট্র কিংবা পৃথিবীটাতেই লোভ, হিংসা, বিদ্বেষ, হানাহানি, উগ্রতা, দুর্নীতি অনেকাংশেই হ্রাস পাবে নিশ্চিত। কুরবানি শুধু পশুহত্যা আর মাংস খাওয়ার নাম নয়। কুরবানি একটি আন্দোলন, আত্মত্যাগের এক মহাবিপ্লব।

কবি নজরুল তাঁর গানেই বলেছেন, “ঈদুজ্জোহার চাঁদ হাসে ঐ / এলো আবার দুসরা ঈদ / কোরবানি দে, কোরবানি দে / শোন খোদার ফরমান তাগিদ।”

খোদার ফরমান তাগিদ শুনতে হলে অবশ্যই ভোগভিত্তিক নয়, ত্যাগভিত্তিক বিশ্বব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার বিকল্প নেই।

পবিত্র কাবাঘর; Image Credit: middleeastmonitor.com

এবার হজের আলোচনায় আসা যাক। সারা পৃথিবী থেকে প্রতি বছর লাখ লাখ মানুষ হজব্রত পালন করতে পবিত্র নগরী মক্কায় যান। হজ করে ফিরেও আসেন। কিন্তু হজ যে শিক্ষাগুলো দেয়, সেগুলো এসে সমাজে বাস্তবায়ন করতে কার্যকর ভূমিকা তেমন দেখা যায় না।

হজ শিক্ষা দেয় শৃঙ্খলার, হজ শিক্ষা দেয় সমতার। মানুষে-মানুষে ভেদাভেদ ভুলিয়ে দেয় হজ। রাজা হোক কিংবা একদম হতদরিদ্র কোনো দাস- বর্ণ-পেশা নির্বিশেষে সকলে এক টুকরো সেলাইবিহীন সাদা কাপড় পরে, কাঁধে-কাঁধ মিলিয়ে একই সাথে হজ আদায় করার দৃশ্যটিও অদ্ভুত প্রশান্তিমাখা সুন্দর। 

সাম্যের মহানতম এক শিক্ষা-নিদর্শন এই হজ। শুধু তাই নয়, সু-শৃঙ্খলভাবে কাবাঘর প্রদক্ষিণ করা শিক্ষা দেয় জীবনে শৃঙ্খলার প্রয়োজন অনেক বেশি, প্রতীকী শয়তানকে পাথর মারা শিক্ষা দেয় অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করার, কালোপাথর চুমু খাওয়া শিক্ষা দেয় আনুগত্যের, সাফা-মারওয়ায় আরোহন শিক্ষা দেয় ধৈর্যের।

হজরে আসওয়াদ বা কালো পাথর; Image Credit: klimg.com

কুরবানির মতো হজও একটি ইবাদত। এটিও করতে হবে বৈধ উপার্জনের টাকা থেকে। অথচ দেখা যায়, সারাজীবন দুর্নীতি করে টাকার পাহাড় গড়ে শেষবয়সে অনেকে হজ করে ভাবে সে নিষ্পাপ হয়ে গেছে। কিন্তু এত সহজ নয় হিসাবখানা। দুর্নীতি হলো, মানুষের অধিকার হরণ করা। মানুষের অধিকার হরণ করা কাউকে আল্লাহ ততক্ষণ পর্যন্ত ক্ষমা করেন না, যতক্ষণ পর্যন্ত সংশ্লিষ্ট ভুক্তভোগী তাকে ক্ষমা না করে।

একদল আছেন, যারা হজ করেন সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধির জন্য। নামের আগে হাজি, আলহাজ্ব লাগিয়ে নিজেদের মর্যাদাবান মনে করেন তারা। অথচ হজ এমন একটি ইবাদত, যা শুধু আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যই করা হয়। আর আল্লাহর উদ্দেশে কোনো লোকদেখানো ইবাদত, আল্লাহ স্বয়ং কবুল করেন না।

হজের শিক্ষাগুলো, সাম্য ও প্রেমের মর্মবাণীগুলো পৃথিবীতে ছড়িয়ে দিতে হবে, শুরু করতে হবে তার বাস্তবায়ন। তবেই হজ হয়ে উঠবে আরও অর্থবহ, আরও তাৎপর্যময়।

Related Articles