Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ধর্ষণ ও তার শাস্তি

ধর্ষণ আমাদের সমাজে কোনো নতুন বিষয় নয়, কিন্তু সম্প্রতি বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ধর্ষণের সংখ্যা অস্বাভাবিক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। দিন দিন শিক্ষার হার বৃদ্ধির সাথে নৈতিক ও মানসিক মূল্যবোধের অবনতি ঘটছে। বাংলাদেশ বরাবরই বিশ্বের বুকে সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্যে সমৃদ্ধ একটি দেশ বলে পরিচিত। তবে বর্তমানে আমাদের দেশের মূল্যবোধের যে অবনতি ঘটছে, তাতে অদূর ভবিষ্যতে আমাদের দেশ যে ‘রেপ কান্ট্রি’ নামে পরিচিত হবে না, তা হলফ করে বলা যাচ্ছে না।

শুধু ধর্ষণ নয়, ধর্ষণ পরবর্তী যে সামাজিক অবস্থা আমরা তৈরি করছি, তা অন্যায়কারীর বিচার ব্যবস্থায় কোনো প্রভাব তো ফেলছেই না, বরং ভিক্টিমের স্বাভাবিক জীবনকে বাধাগ্রস্ত করছে। অনেক ভিক্টিমই আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে দ্বিতীয়বার ভাবছেন না। ভিক্টিমের পরিবার যখন বিচার চাইতে যাচ্ছেন, সমাজের কাছে তাদেরকে হেয় হতে হচ্ছে যা আমাদের বিচার ব্যবস্থাকে প্রশ্নের সম্মুখীন করছে, আর তার সাথে সাথে ভিক্টিমের পরবর্তী জীবন। আমরা যদি খুব দ্রুত এই পরিস্থিতিকে সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করে জনসচেতনতা তৈরি না করি, তবে ভবিষ্যতে হয়তো আমাদের জাতির জন্য খুব দুর্দিন অপেক্ষা করছে।

ধর্ষণ কী?

সাধারণভাবে ধর্ষণ হচ্ছে কোনো ব্যক্তির সাথে তার অনুমতি ব্যতীত কিংবা জোরপূর্বক যৌন সম্পর্কে যাওয়া ।

ভিক্টিমের অসহায়ত্ব

বাংলাদেশী দন্ডবিধির ১৮৬০ (১৮৬০ সালের আইন XLV) ধারা ৩৭৫  অনুসারে- একজন পুরুষকে ‘ধর্ষণকারী’ হিসেবে গণ্য করা হবে যদি নিচের যেকোনো একটি পরিস্থিতিতে তিনি যৌন সম্পর্কে যান-

প্রথমত, মেয়ের ইচ্ছার বিরুদ্ধে

দ্বিতীয়ত, মেয়ের অনুমতি ছাড়া

তৃতীয়ত, সম্মতির সাথে, কিন্তু মৃত্যুভয়ে বা আঘাত দেওয়ার কারণে সম্মতি নিয়ে

চতুর্থত,সম্মতিতে, যখন মেয়েটিকে বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে ছেলেটি সম্মতি আদায় করে ছেলেটি জানে ভবিষ্যতে সে মেয়েটিকে স্ত্রী রূপে গ্রহণ করবে না

পঞ্চমত, তার সম্মতি বা সম্মতি ছাড়া, যখন ভিক্টিমের বয়স চৌদ্দ বছরের নিচে হয়।

সচেতনতা তৈরি

যেকোনো সমস্যা খুব বড় রূপ নেওয়ার আগেই আমাদের সেটি নিয়ে চিন্তা করা ও সচেতনতা তৈরি করা উচিত। ধর্ষণের মতো খারাপ সমস্যাকে আমরা যেভাবে এড়াতে পারি-

১। পরিবারের বাবা-মায়ের উচিত কন্যাসন্তানের সাথে বন্ধুত্বসুলভ আচরণ করা। বাবা-মা যেন অবশ্যই জানে তার মেয়ের বন্ধু কারা বা সে কাদের সাথে বাইরে ঘোরাফেরা করে। ঠিক একইভাবে মেয়েদের উচিত বাবা-মায়ের সাথে সমস্যা যতই ক্ষুদ্র হোক না কেন, আলোচনা করে রাখা, তাদেরকে অবগত রাখা। নিজের বন্ধুর সাথে বাবা-মার পরিচয় করিয়ে দেওয়া। কর্মজীবী নারীদের উচিত তার অফিস এনভায়রনমেন্ট সম্পর্কে বাবা, মা, স্বামীকে অবহিত করা।

কন্যা সন্তানদের সমস্যা নিয়ে বা মায়ের বিশেষ যত্নশীল হওয়া উচিত

২। ধর্ষণ কখনই শুধু মেয়েদের ইস্যু নয়, এটি একটি সামাজিক সমস্যা এবং এই সমস্যা দূর করতে সমাজের পুরুষদের সবচেয়ে গঠনমূলক ভূমিকা রাখতে হবে। একটি মেয়ের দায়িত্ব শুধু তার পরিবারের নয়, বরং সমাজের।

পুরুষদের গঠনমূলক আচরনই পারে ধর্ষন প্রতিরোধ করতে

৩। বয়ঃসন্ধির কিছু সময় আগে থেকে ছেলে-মেয়েদের যৌনবিষয়ক শিক্ষা দিতে হবে যেন তারা যৌনতার অপব্যবহার না করে। ছোটবেলা থেকেই ছেলেমেয়েদের ভুলের ব্যাপারে অবহিত করতে হবে। ছেলে বাচ্চাদের যৌনতার ব্যাপারে মেয়েদের দোষ দেওয়ার মানসিকতা দূর করতে হবে।

ছেলে-মেয়েদের ভুল ধরিয়ে তাদের ঠিক ব্যাপারে অবহিত করা পরিবারের দায়িত্ব

৪। ছেলে সন্তানদের ছোটবেলা থেকেই “না” এর গুরুত্ব বোঝাতে হবে। যেকোনো সম্পর্কে একে অপরের সম্মতির প্রতি শ্রদ্ধা করা শেখাতে হবে ।

“কন্সেন্ট” যেকোনো সম্পর্কের জন্য প্রয়োজন

৫। পোশাক যার যার ব্যক্তিস্বাধীনতা। পোশাক কখনোই খারাপ অর্থ বহন করে না, খারাপ আমাদের চিন্তা-ভাবনায় প্রতিফলিত হয়।

পোশাক কখনই ধর্ষণের কারন হতে পারে না

পোশাককে যদি আমরা ধর্ষণের কারণ হিসেবে চিহ্নিত করি তবে, হয়তো আমরা শিক্ষিত হয়েছি কিন্তু স্বশিক্ষিত হইনি।

৬। ঘর থেকে যখনই কোনো মেয়ে বের হবে, তার নিজের দায়িত্ব নিয়ে বের হওয়া উচিত। কিছু প্রতিরক্ষা, কাছের মানুষদের কনটাক্ট নিজের কাছে রাখা উচিত।

যেকোনো সমস্যা সমাধানের সামর্থ্য আপনার আছে নিজের উপর বিশ্বাস রাখুন

আত্নবিশ্বাস যেকোনো প্রতিকূল সমস্যা সমাধান করে আর ভয় নিজেকে ভিক্টিমে রূপান্তর করে- এই কথাটা প্রতিটি মেয়ের মনে রাখা উচিত।

ধর্ষণের শাস্তি সম্পর্কে আমাদের দেশের প্রতিটি মানুষকে জানা উচিত

নারী ও শিশু নির্যাতন দমন বিশেষ আইন ২০০৩ সেকশন ৯ অনুসারে ধর্ষণের শাস্তি নিম্নে বর্ণিত-

১। কোনো নারী বা সন্তানের সাথে ধর্ষণকারী কঠোর কারাদণ্ড এবং জরিমানা দিয়ে শাস্তি দিতে হবে।

২। ধর্ষণের কারণে বা ধর্ষণের পর ভিক্টিমের যদি কোনো ক্ষতি হয় বা ভিক্টিম যদি র্ধষণের পর মারা যায়, তাহলে ধর্ষণকারীকে মৃত্যুদন্ড দিতে হবে এবং এক লাখ টাকা জরিমানাও করা হবে।

ন্যায়বিচার আবশ্যক

৩। যদি একাধিক ব্যক্তি মিলে ধর্ষণ করে কোনো  মহিলা বা শিশুকে এবং সেই মহিলা বা শিশু মারা যায় বা আহত হয়, তবে প্রত্যেক ব্যক্তির মৃত্যুদন্ড এবং এক লাখ টাকা জরিমানাও করা হবে।

৪। যেকোনো মহিলা বা সন্তানকে ধর্ষণের পর মৃত্যু বা আঘাত করার চেষ্টা করলে, তাকে কঠোর কারাদণ্ড এবং জরিমানা দিয়ে শাস্তি দেওয়া হবে। ধর্ষণের বর্ণনা যথাযথভাবে দিয়ে দোষ স্বীকার করলে দশ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হবে, যা কমে ৫ বছর পর্যন্ত হতে পারে, কিন্তু এর কম মেয়াদ নয় এবং জরিমানাও হতে পারে।

৫। যদি কোনো মহিলা পুলিশ হেফাজতে ধর্ষিত হয়, যারা ওই হেফাজতের দায়িত্বে থাকবে এবং নিরাপত্তার জন্য সরাসরি দায়ী, নিরাপত্তা প্রদানে ব্যর্থতার জন্য শাস্তি দেওয়া হবে। ধর্ষণের বর্ণনা যথাযথভাবে দিয়ে দোষ স্বীকার করলে  দশ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হবে, যা কমে ৫ বছর পর্যন্ত হতে পারে কিন্তু এর কম মেয়াদ নয় এবং জরিমানাও হতে পারে।

৩৭৬ ধারা দণ্ডবিধির অধীন অনুসারে ধর্ষণের শাস্তি:

যদি কেউ ধর্ষণ করে, তার অবশ্যই শাস্তি হবে যা দশ বছরের কারাদণ্ডের সমান হতে পারে এবং জরিমানাও করা হবে যদি না ধর্ষিত নারী তার নিজের স্ত্রী হয় এবং তার বয়স ১২ বছরের বেশী হয়।

ধর্ষণের পরবর্তী একজন ভিক্টিমের ও আমাদের  যা করণীয়

১। কথা বলুন

একজন ভিক্টিমের উচিত তার পরিবারের মানুষের সাথে খোলাখুলিভাবে সমস্যাটি শেয়ার করা। অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায় ভিক্টিম লজ্জায় ঘটনা চেপে যেতে চায়, কিন্তু এতে পরবর্তী সময়ে সমস্যা আরো প্রকট হয়। পরিবারের মানুষের সাথে কথাবার্তা বলে এবং আইন পরামর্শকের মাধ্যমে কেস ওপেন করা উচিত। সবচেয়ে ভালো হয় ভিকটিমকে কোনো মনোরোগ বিশেষজ্ঞের নিকট থেকে রেগুলার বেসিসে কাউন্সেলিং নেওয়ানো। কারণ বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায় ভিক্টিম তার মানসিক ভারসাম্য  হারিয়ে ফেলে। আর যেকোনো রকম আইনি লড়াই লড়তে গেলে ভিক্টিমের মানসিক সুস্থতা দরকার। লজ্জায় কিছু চেপে যাওয়া বা তাড়াহুড়া করে কেস ফাইল করবেন না, যেহেতু এই বিষয়টি অত্যন্ত সংবেদনশীল।

২। দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন আনুন

যেকোনো দুর্ঘটনা ঘটার পর আমরা কেউ তা পরিবর্তন করতে পারি না। কিন্তু একটু ভেবে দেখুন এজন্য আমরা আমাদের জীবনকে তো থামিয়ে দিতে পারি না। একজন ধর্ষিতার সবসময় মনে রাখা উচিত সে অন্যের অন্যায়ের শাস্তি কখনোই নিজেকে দেবে না ।

আট বছর বয়সে অ্যাঞ্জেলু ধর্ষিত হয়েছিল এবং ৭ বছর তিনি নিশ্চুপ ছিলেন। পরবর্তীতে তিনি আমেরিকার সবচেয়ে প্রিয় এবং সেলিব্রেটেড কবি এবং লেখক হিসেবে পরিচিতি পান। বহু পুরস্কার এবং ৫০ এর উর্ধ্বে তার সম্মানসূচক ডিগ্রী আছে

৩। সামাজিক দৃষ্টিকোণ থেকে আমাদের করণীয়

আমাদের সমাজের সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে আমরা সবাই বলতে চাই, কিন্তু শুনতে চাই না। একটা ধর্ষণ ঘটার জন্য আমাদের সমাজের সবার এটা মনে রাখা উচিত কখনোই একটা মেয়ে দোষী নয়। প্রথমেই আমরা যে ভুলটা করি, তা হলো আমরা ভুলে যাই আমরা একজন ভিক্টিমের অ্যাক্সিডেন্টের জন্য তাকেই দোষারোপ করছি, যা মোটেই যৌক্তিক নয়। আমাদের ভুলে গেলে চলবে না যে একজন মেয়ে বা কন্যা সন্তান তার জীবনের সবচেয়ে বাজে অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়েছে। সুতরাং তার বেঁচে থাকার জন্য আশেপাশের মানুষের একটু সহানুভূতির প্রয়োজন।

তার পড়াশোনা বা কর্মক্ষেত্রে সহকর্মীরা যেন তার সাথে দূরত্ব বজায় না রেখে একটা স্বাভাবিক পরিবেশ রাখে তা প্রতিষ্ঠান অথোরিটির নিশ্চিত করা উচিত। ঠিক একইভাবে ভিক্টিমের বাবা-মা, ভাই-বোন যেন সমাজে চলতে কুন্ঠাবোধ না করে সেজন্য আমাদের উচিত তদের নিয়ে কটুক্তি না করে বরং খারাপ সময়ে তাদের পাশে দাঁড়ানো। আমাদের উচিত অপরাধীকে লজ্জা দেওয়া, ভিক্টিমকে নয়।

আজকে যদি আমরা সমস্যার সমাধানে এগিয়ে না আসি, তাহলে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম হয়তো একটা কলুষিত জাতি পাবে। আর আমরা পাবো একটি কলুষিত দেশ, যা আমাদের কারোরই কাম্য নয়।

তথ্যসূত্র

১। ageofconsent.net/world/bangladesh

২। ageofconsent.net/world/bangladesh

৩। aclawresearch.blogspot.com/2012/12/punishment-for-rape-under-bangladeshi.html

৪। thedailystar.net/op-ed/%E2%80%9Crape-shield%E2%80%9D-law-bangladesh-97516

৫। thedailystar.net/law-our-rights/defining-rape-gender-neutral-1214752

৬। goalcast.com/2017/04/03/maya-angelou-quotes-to-inspire-your-life/

Related Articles