বিশ্বজুড়ে করোনা ভাইরাসের মহামারী থেকে বাদ পরছেন না শিশু-বৃদ্ধ কেউই। প্রাথমিকভাবে কেবল বয়স্কদেরই করোনা ভাইরাসের ঝুঁকি আছে বলে ধারণা করা হলেও, সময়ের সাথে সাথে দেখা যায় শিশু থেকে বয়স্ক যে কেউই এই ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে। এমতাবস্থায় সকলেই কম-বেশি ঘাবড়ে রয়েছেন। বিশেষ করে শিশুরা এই ভাইরাসের ব্যাপারে কম জানে বিধায়, তাদের তুলনামূলক বেশি ভয় পেতে দেখা যায়।
শিশুরা যখন কোনো বিষয় নিয়ে ভয় পায় তখন তারা বিভিন্নভাবে তাদের মনের ভাব প্রকাশ করে। রাগ, কান্না, চিৎকার, কথা কম বলা এগুলো তাদের মনের ভয় প্রকাশের মাধ্যম। করোনা ভাইরাসের জন্য বাচ্চাদের স্কুল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় তাদেরও বাড়ির সকলের সাথে দীর্ঘদিন গৃহবন্দী হয়ে থাকতে হচ্ছে। একইসাথে বন্ধুদের সাথে মেলামেশাও এখন তাদের জন্য অনিরাপদ। তাই তারা নিজেদের এসময় একা ভাবতে পারে এবং চারপাশের পরিস্থিতি নিয়ে মানসিকভাবে ভেঙে পড়তে পারে। এজন্য এসময় বাড়ির বয়স্কদের উচিৎ তাদের মানসিক স্বাস্থ্যের ব্যাপারে আলাদা খেয়াল রাখা।
এরকম সময়ে শিশুদের সাথে কেমন ব্যবহার করা উচিৎ এবং কীভাবে তাদের মনোবল চাঙ্গা রাখা যায় সেই বিষয়ে কিছু মতামত দিয়েছেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চাইল্ড মাইন্ড ইনস্টিটিউটের পরিচালক ড. জেমি হাওয়ার্ড। চলুন জেনে নেয়া যাক সেই মতামতগুলো।
১. করোনা ভাইরাসের মহামারী নিয়ে না লুকিয়ে সরাসরি কথা বলুন
শিশুরা ইতোমধ্যে খেয়াল করেছে তাদের আশেপাশে মানুষ মাস্ক পরে রাস্তায় বের হচ্ছে এবং স্কুল-কলেজ, অফিস-আদালত সবকিছু বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। সেই সাথে সকলকে বাসা থেকে বের না হওয়ার জন্য বারবার বলা হচ্ছে। স্বাভাবিকভাবেই এগুলো শিশুদের মনে নানা কৌতূহলী প্রশ্নের সৃষ্টি করে। এজন্য তারা বড়দের এই ব্যাপারে বারবার প্রশ্ন করতে থাকে। তখন কোনোভাবেই তাদের থেকে করোনা ভাইরাসের কথা না লুকিয়ে তাদের সঠিক তথ্যটি জানানো উচিৎ। ভাইরাসের ভয়াবহতার ব্যাপারে তাদের নিশ্চিত করুন। কারণ, শিশুদের কাছ থেকে কোন তথ্য লুকানো হলে তারা আরও বেশি উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে। এই ব্যাপারে চাইল্ড মাইন্ড ইনস্টিটিউটের শিশু মনোবিজ্ঞানী ড. জেনিন ডোমিঙ্গেস বলেন, “শিশুদের কাছে আপনিই বার্তাবাহক এবং আপনিই ঠিক করতে পারেন তাদের কাছে কোন বার্তাটি পৌঁছাবেন।”
২. শিশুদের দরকারের বেশি তথ্য দেয়া থেকে বিরত থাকুন
শিশুদের যেমন বর্তমান পরিস্থিতির ব্যাপারে সঠিক ধারণা দেয়া জরুরি, একইসাথে আপনার এটাও বুঝতে হবে কোন তথ্যটি তাদের জন্য যথোপযুক্ত এবং কোনটি অনুপযুক্ত। আপনি শিশুদের করোনা ভাইরাসের ভয়াবহতা এবং এর থেকে সুরক্ষিত থাকার জন্য কী কী পদক্ষেপ নেয়া উচিৎ এসব বিষয়ে উপদেশ দিতে পারেন। কিন্তু তাদের প্রতিনিয়ত ঘটে যাওয়া বিভিন্ন মর্মান্তিক দুর্ঘটনা কিংবা খারাপ সংবাদ ঘন ঘন না জানানোই ভালো। এতে তারা আরও বিভ্রান্ত হয়ে পড়ে এবং ঘাবড়ে যেতে পারে।
৩. শিশুদের কথা বলার সুযোগ করে দিন
অধিকাংশ ক্ষেত্রেই শিশুরা ভয় পেলে কথা বলা বন্ধ করে দেয় কিংবা কমিয়ে দেয়। করোনা ভাইরাসের মহামারীর ক্ষেত্রেও পরিস্থিতি তার বিপরীত নয়। এক্ষেত্রে বড়দের নিজ থেকে শিশুদের কথা বলার সুযোগ করে দিতে হবে। করোনা ভাইরাসের ব্যাপারে তারা কী ভাবছে বা তাদের ধারণা কেমন এগুলো তাদের জিজ্ঞাসা করতে পারেন। সেই সাথে তাদের ধারণায় ভুল থাকলে তা অবশ্যই শুধরে দেবেন। এতে তারা অনেকটা স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করবে। লক্ষ্য রাখবেন, আপনার উদ্দেশ্য থাকবে শিশুদের মনের ভয় দূর করা এবং তারা যাতে নিজেদের নিয়ে চিন্তামুক্ত থাকে।
৪. আগে নিজের উদ্বেগ সামলে উঠুন
খুবই স্বাভাবিকভাবে চারপাশের পরিস্থিতি নিয়ে বড়রাও উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছেন। চারদিকে করোনা আক্রান্ত এবং মৃত্যুর মিছিল দেখে তারাও সহজে বাসা থেকে বের হচ্ছেন না। বড়দের যেকোনো মনোভাব অধিকাংশ ক্ষেত্রে শিশুদের মনেও প্রবাহিত হয়ে যায়। এরকম পরিস্থিতিতে উচিৎ আগে নিজেকে সামলানো। নিজে পরিস্থিতির সাথে মানিয়ে নিন। এরপর আপনার শিশুর দিকে নজর দিন। খেয়াল রাখবেন, উদ্বিগ্ন অবস্থায় কখনও শিশুদের সাথে কথা বলা উচিৎ না।
৫. শিশুদের করোনা ভাইরাসের ব্যাপারে আশ্বস্ত করুন
করোনা ভাইরাসের লক্ষণ সাধারণ জ্বর ও ঠাণ্ডা-কাশির মতো হওয়ায় শিশুরা এসব রোগে অল্পতেই ভয় পেয়ে যেতে পারে। এসময় তাদের এই ব্যাপারে আশ্বস্ত করা খুবই জরুরি যাতে তারা অল্পতেই ভেঙে না পড়ে। করোনা ভাইরাস কখন আক্রমণ করতে পারে এবং এই ভাইরাস প্রতিরোধে করণীয় কী এই বিষয়ে আপনার শিশুকে অবহিত করুন। ছোটরা সাধারণত বড়দের দেখেই শেখে। আপনি নিজে যদি সচেতন হয়ে থাকেন এবং নিয়মিত নিজেকে পরিষ্কার রাখেন, তাহলে ছোটরাও আপনার দেখাদেখি নিজেদের পরিষ্কার রাখবে।
৬. করোনা প্রতিরোধে করনীয়র ব্যাপারে শিশুদের সচেতন করুন
আগেই বলেছি শিশুরা সবচেয়ে বেশি শিখে বড়দের অনুকরণ করে। এক্ষেত্রে আপনার নিজের সচেতনতাই শিশুদের সচেতন করতে সাহায্য করবে। শিশুরা বাইরে থেকে আসলে তাদের হাত ধুতে বলা, ঘন ঘন মুখে হাত দিতে মানা করা, নিয়মিতভাবে কমপক্ষে ২০ সেকেন্ড ধরে সাবান দিয়ে হাত ধোয়া এগুলোর ব্যাপারে তাদের সচেতন করতে পারেন। এসব নিয়ম যদি আপনি নিজে মেনে চলেন, তাহলে শিশুরা আপনার দেখাদেখি নিজেরা সচেতন হবে। মাস্ক পরার ব্যাপারেও শিশুদের সচেতন করা উচিৎ। সুস্থ মানুষের মাস্ক পরার প্রয়োজন না হলেও, যারা ঠাণ্ডা ও কাশিতে ভুগছেন, তাদের অবশ্যই মাস্ক পরা উচিৎ। এক্ষেত্রে শিশুরা ঠাণ্ডা ও কাশিতে ভুগলে, তাদেরও মাস্ক পরতে উৎসাহ দেয়া উচিৎ। এতে তারা করোনার সংক্রমণ থেকে নিজেদের ও অন্যদেরও রক্ষা করতে পারবে।
৭. প্রতিদিনের রুটিন মেনে চলা
স্কুল-কলেজ কিংবা অফিস খোলা থাকলে আমরা প্রতিদিন একটি রুটিনের মধ্য দিয়ে যাই। দিনের বড় একটি অংশ তখন আমাদের কাজ কিংবা পড়ালেখার মধ্য দিয়ে চলে যায়। কিন্তু করোনা ভাইরাসের প্রকোপের কারণে সবকিছু প্রায় বন্ধ হয়ে যাওয়ায় এবং বাসা থেকে বের হওয়ার ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা থাকায় আমাদের প্রতিদিনের রুটিনে এসেছে একটি বড় পরিবর্তন। যেহেতু অনির্দিষ্টকালের জন্য সবাইকে গৃহবন্দী থাকতে হচ্ছে, তাই এই সময়ে আমাদের নতুন একটি রুটিন মেনে চলা জরুরি। সময়মতো খাওয়া, গোসল করা, ঘুমানো এগুলো খুবই জরুরি। কারণ এগুলোর হেরফের হলে আমাদের স্বাস্থ্য ভেঙে পড়বে এবং এই মহামারীর সময় কেউই চায় না নতুন কোনো রোগে আক্রান্ত হতে। তাই এই সময় বিশেষ করে শিশুদের প্রতি বিশেষ নজর রাখা জরুরি।
৮. শিশুদের সাথে নিয়মিত কথা বলুন
স্বাভাবিকভাবেই এই সময় শিশুদের মনে হাজারটি প্রশ্ন থাকবে এবং এর সবগুলো প্রশ্নই তারা আপনাকে করবে। কিন্তু আপনি সব প্রশ্নের উত্তর নাই জানতে পারেন। এজন্য তাদের প্রশ্ন করার ব্যাপারে নিরুৎসাহ করার চেয়ে বলুন আপনি যখনই এই প্রশ্নের উত্তর জানবেন, তাকে জানিয়ে দিবেন। তাদের প্রশ্ন করার ব্যাপারে নিরুৎসাহ করার মানে তাদের কথা বলার ব্যাপারেও নিরুৎসাহ করা। এই সময় তাদের সাথে যত বেশি সম্ভব কথা বলা উচিৎ।
বর্তমান পরিস্থিতিতে বাইরে যাওয়া আসা করার থেকে বাসায় থাকাই সবচেয়ে নিরাপদ। পরিবারকে সময় দিন, নিজের খেয়াল রাখুন এবং অন্যদেরও নিরাপদ রাখুন। যেকোনো প্রকার গণসমাবেশ এড়িয়ে চলাই এসময় বুদ্ধিমানের কাজ।
This is a Bengali article describing how to take care of kids during the time of Coronavirus.
Feature image: Harvard Gazette - Harvard University
All the references are hyperlinked.