Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

ভারতের গৃহদাসীদের অভিশপ্ত জীবনের গল্প

ভারত অধ্যুষিত তিস্তা তীরের দুয়ার নামক প্লাবন সমভূমি এলাকার অপার সৌন্দর্যে যে কারো চোখ জুড়িয়ে যেতে বাধ্য। হিমালয়ের কোল ঘেঁষে দাঁড়ানো চিরসবুজ সে দৃশ্য কঠিন থেকে কঠিনতর হৃদয়ের মানুষেরও মন গলিয়ে দেবে। কিন্তু এই সৌন্দর্যকে ছাপিয়ে দুয়ার হয়ে উঠেছে এক বিভীষিকার নাম। এক সময় যে অঞ্চলটি চা চাষের জন্য খুব বিখ্যাত ছিল, এখন সেখানে কেবল থমথমে এক পরিবেশে বিপদের হাতছানি ছাড়া আর কোনো কিছুর অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া মুশকিল। দুয়ারের নোংরা রাস্তায় নেই কোনো যথাযথ পরিবহন ব্যবস্থা। মাইলের পর মাইল দুর্গম পথ পাড়ি দিয়ে বিদ্যালয়ের মুখ দেখা এই এলাকার মেয়েরা তাই খুব সহজে পরিণত হয় নারী ও শিশু পাচারকারীদের প্রধান লক্ষ্যে। বাবা-মায়ের শান্তির নীড় থেকে কেড়ে নিয়ে তাদের হাজির করা হয় সাক্ষাৎ নরকের দুয়ারে। জীবন কী তা বুঝতে না বুঝতেই রক্ত-মাংসের মানুষ থেকে পুতুলসম দাসীতে পরিণত হওয়া সেই নারীদের গল্প শুনে আসা যাক।

“জেলেরা যেমন টোপ ফেলে মাছ ধরার জন্য অপেক্ষা করতে থাকে, পাচারকারীরাও তেমনি সারাক্ষণ তক্কে তক্কে থাকে কখন একটি বাচ্চামেয়েকে শিকার করতে পারবে,”

বলছিলেন স্মিতা শর্মা। পাচারকৃত মেয়েদের মধ্যে থেকে সৌভাগ্যবশত যারা বেঁচে ফিরতে পেরেছে, তাদের নিয়ে ডকুমেন্টারি বানানোর কাজে হাত দিয়েছেন এই ফটোসাংবাদিক। দুয়ার এলাকাটি পরিণত হয়েছে ঘরোয়া কাজের জন্য দাসী সরবরাহের চক্রকেন্দ্রে। শহরাঞ্চলে ঘরের কাজের জন্য ১০ বছরের কাছাকাছি বয়সের মেয়েদের চাহিদা খুব বেশি। আর দুর্গম এই অঞ্চল থেকে একবার কাউকে ধরে নিতে পারলে মেয়েটি যে নিখোঁজ হয়েছে তা টের পেতে পেতেই পেশাদার পাচারকারী চক্রের লোকজন অপহরণকৃত মেয়েদের নিয়ে চলে যায় ধরা-ছোঁয়ার বাইরে। পাহাড়ি এলাকাগুলোতে পাচারকারী সংঘের অস্তিত্ব রয়েছে- এ কথা কম-বেশি সবাই জানে। তবে আশ্চর্যজনক বিষয় হলো, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মেয়েদের অপহরণের সাথে জড়িত থাকে তাদের খুব কাছের কোনো আত্মীয় বা প্রতিবেশী বা জানাশোনা কেউ। মাত্র ৫০০ থেকে ৩,০০০ হাজার টাকার বিনিময়ে শিশুগুলোকে বিক্রি করে দেয় তারা।

২০০৯ সালে ১০ বছর বয়সী কন্যাকে হারানো বাবা-মা; Source: nyt.com

গত প্রায় তিন বছর ধরে ভারতের যৌন সহিংসতা থেকে সৌভাগ্যক্রমে বেঁচে ফেরা নারীদের নিয়ে ডকুমেন্টারি বানানোর কাজ করছেন স্মিতা শর্মা। যৌন দাসীদের নিয়ে প্রচুর লেখালেখি হলেও গৃহস্থ দাসীদের নিয়ে মিডিয়ার আগ্রহ তুলনামূলক কম হওয়ায় অবাধে কাজ করে চলেছে পাচারকারী সংঘ। কাজেই সবার সামনে তাদের অজানা গল্পগুলো তুলে ধরার এই প্রয়াসে স্মিতা পাশে পেয়েছেন নিউ ইয়র্ক টাইমসকে। কেন এই মেয়েদের যৌন ব্যবসার মতো লাভজনক ব্যবসায় কাজে লাগানো হয় না এই প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে স্মিতা বলেন,

“হাড় জিরজিরে গড়ন আর কালো গায়ের রঙের জন্য সেক্স ইন্ডাস্ট্রিতে তাদের তেমন একটা চাহিদা নেইকাজেই অল্পবয়সী মেয়েগুলোকে পাচার করে ঘরের কাজেই ব্যবহার করা হয়”

স্মিতার ভাষ্যমতে, “মেয়েগুলো যদি আরেকটু মোটাসোটা হতো, ইন্দ্রিয় সুখের কাজে লাগানোর জন্য উপযুক্ত হতো তাহলে যৌন দাসী হিসেবেই তাদের চালান করে দেয়া হতো”

মুম্বাই শহরের সাজানো-গোছান, এয়ার কন্ডিশন্ড, বিলাসবহুল ফ্ল্যাটে বিশ্রামরত অতিথির সামনে দামী দামী খাবারের ট্রে নিয়ে হাজির হওয়া মেয়েটি এই পর্যন্ত কীভাবে পৌঁছাল, তা জানলে নিঃসন্দেহে তিনি চমকে উঠবেন। প্রথমে তাদের অপহরণ করে আনা হয় শহরাঞ্চলে, তারপর সংশ্লিষ্ট এজেন্সির সাথে যোগাযোগ করে ঠিক করা হয় তাদের দরদাম। এজেন্সিগুলো তখন শহরের আরামপ্রিয় পরিবারগুলোর সাথে যোগাযোগ করে জানিয়ে দেয় সুসংবাদ, তাদের চাহিদামতো ‘কাজের মেয়ে’ পাওয়া গেছে। অপহরণকারী থেকে শুরু করে এজেন্সির যে লোকটি মেয়েটিকে তার মনিবের বাড়িতে পৌঁছে দেয়- প্রত্যেকের পকেটে ঢোকে কমিশনের টাকা। শুধু যাকে নিয়ে এত টানাটানি চলছে, সে-ই পড়ে থাকে লেনদেনের এই বাণিজ্যিক জগতের ঊর্ধ্বে।

২০১৫ সালে মাত্র ৩ হাজার রূপির বিনিময়ে বিক্রি হয়ে যাওয়া এই নারী পুলিশের সহযোগিতায় বাড়ি ফিরে আসেন গত বছর; Source: nyt.com

কিছু ‘সহৃদয়বান ব্যক্তি’ আবার তরুণ এই ভিক্টিমরা এখানে কীভাবে উপকৃত হচ্ছে তা নিয়ে পারলে স্তুতি গাইতে গাইতে মুখ দিয়ে ফেনা উঠিয়ে ফেলার জোগাড় করে। তাদের কথা হলো,

“দারিদ্রসীমার নিচে বসবাসরত এই মেয়েগুলো শহরে এসে অন্তত তিন বেলা তিন মুঠো খেতে পারছে, থাকার একটা জায়গা পাচ্ছে, নিরাপদ আশ্রয় পাচ্ছে। এই সুখ কী ওরা পাহাড়ি এলাকায় জীবনেও উপভোগ করতে পারত!”

‘নিরাপদ আশ্রয়ের’ নামে মেয়েগুলোকে কী কী ভোগ করতে হচ্ছে সে ব্যাপারে যাওয়ার আগে স্মিতা বলেন,

“খাওয়া, পরা আর নিঃশ্বাস নেয়ার নামই জীবন নয়। মানবাধিকার লঙ্ঘনের চূড়ান্ত উদাহরণ এই গৃহদাসীরা। আপনার ছোট্ট শিশুটিকে যদি বাবা-মার কোল ছেড়ে বিশাল অট্টালিকায় রাজার হালে রাখা হয়, কেমন লাগবে আপনার? কেমন লাগবে আপনার শিশুটির? গৃহদাস প্রথা কোনো অবস্থাতেই সমর্থনযোগ্য নয়।”

স্মিতা শর্মা ভারতে এসে বেশিরভাগ সময় কাটিয়েছেন দিল্লী এবং কলকাতায়, এরই মধ্যে অন্তত প্রায় ৩০ জন বেঁচে ফেরা ভিক্টিমের সাথে কথা বলেছেন তিনি। ‘শক্তি বাহিনী’ নামক একটি অ্যান্টি-ট্র্যাফিকিং সংস্থার সাথে কাজ করছেন তিনি। নিখোঁজ মেয়েদের পরিবার ও স্থানীয় পুলিশদের সার্বিক সহযোগিতায় রয়েছে শক্তি বাহিনী।

“অনেক সময় দেখা যায় বাড়িতে কাজ করতে আসা মেয়েদের সাথে খুব বাজে ব্যবহার করছে তাদের মনিবরা। শারীরিক নির্যাতন থেকে শুরু করে যৌন নিপীড়নের শিকার মেয়েদের কথা শুনেছি আমরা। তাদের কাছ থেকে কথা আদায় করার জন্য আগে তাদের বিশ্বস্ততা অর্জন করতে হয়। এজন্য আমার কাজে বেশ কিছুটা সময় লেগে যাচ্ছে,” জানান স্মিতা।

মাত্র ১১ বছর বয়সে খালার মাধ্যমে পাচার হয়ে যায় মেয়েটি; Source: nyt.com

দুয়ার এলাকার লোকজন প্রতিদিন সর্বসাকুল্যে ১০০ রূপীর মতো আয় করে। তাও যদি ঠিকমতো কাজ পায় তাহলেই এই উপার্জনের টাকাটা তাদের ঘরে আসে, কাজ না পেলে খাওয়ার টাকাটাও জোটে না দিনের পর দিন। একসময় স্থানীয় অর্থনীতির একমাত্র ভরসা ছিল চা বাগান। চায়ের পাশাপাশি স্কুল, হাসপাতাল এসব থেকেও কিছুটা আয়-রোজগার হতো তাদের। কিন্তু ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশরা দেশ ছেড়ে চলে যাওয়ার পর এসব এলাকার শিক্ষিত লোকজনও তল্পিতল্পা গুটিয়ে অন্যত্র স্থানান্তরিত হয়ে যায়। কাজেই দরিদ্র জনগোষ্ঠী তখন জীবিকা নির্বাহের জন্য বেছে নেয় নদী তীর থেকে বালি আর পাথর কুড়ানোর কাজ। কাজেই এই জনপদের কোনো মেয়ের কাছে যখন শহরাঞ্চলে গিয়ে কাজ করার প্রস্তাব আসে, বিষয়টি তাদের জন্য আনন্দেরই হওয়ার কথা। তবে সম্ভাব্যতা ও বাস্তবতার মধ্যে রয়েছে আকাশ-পাতাল ফারাক।

ত্রয়োদশী এক মেয়েকে শহরে কাজের কথা বলে ট্রেনে তোলা হলো। কাছের একটি স্টেশনে পৌঁছে গণধর্ষণের শিকার হলো মেয়েটি। কোনোমতে সেখান থেকে জীবিত ফিরে এসে সোজা থানায় চলে যায় সে। পুলিশের সাহায্য নিয়ে অপরাধীচক্রের একজনকে গ্রেপ্তার করে তারা। কিন্তু সংঘবদ্ধচক্রের চাপে পড়ে মেয়েটি ও তার পরিবার বাধ্য হয় অপরাধীর নামে করা মামলা উঠিয়ে নিতে। মেয়েটি আবারও অপহরণ করে নিয়ে যায় চক্রের লোকজন। চোখের পানিতে বুক ভাসাতে থাকা পরিবারের হাতে তাকে তুলে দেয়া হয় অপরাধী মুক্ত হওয়ার পরে। স্মিতা শর্মা তাই দুয়ার এলাকার প্রতিটি পরিবারকে এই অপহরণকারী চক্রের ব্যাপারে সচেতন করার উদ্যোগ নিয়েছেন।

ভয়ঙ্কর সুন্দর দুয়ার এলাকাটি মেয়েদের জন্য আক্ষরিক অর্থেই ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছে; Source: nyt.com

সোনার হরিণ রূপী কাজের মেয়ের চাকরি যে আসলে লোভনীয় তো দূরে পড়ে মরুক, জীবন বাঁচানোর মতো কোনো কাজও নয়- সবাইকে তা জানাতে চান স্মিতা। তিন সন্তানের জননী এক নারী স্বামীর কাছে নির্যাতিত হওয়ার পর মায়ের বাড়িতে চলে আসে। তার মায়ের পক্ষে এই বাড়তি চারজনের দায়িত্ব নেয়ার মতো অর্থনৈতিক সঙ্গতি ছিল না। তখনই এক লোক তাকে শহরে নিয়ে গিয়ে ভালো চাকরি দেয়ার প্রলোভন দেখায়। চাকরির সন্ধানে শহরে যাওয়া নারীটি শেষ পর্যন্ত ঠাঁই পায় উচ্চবিত্ত এক পরিবারে। সৌভাগ্যবশত তার মনিব মানুষ হিসেবে খুব একটা খারাপ ছিল না। বছরখানেক নীরবে সেখানে কাজ করে একসময় বাড়ির কথা, নিজের পরিণতির কথা মনিবকে জানায় সে। পরবর্তীতে পুলিশের সাহায্য নিয়ে বাড়িতে, নিজের সন্তানদের কাছে ফিরে যেতে পারে সে।

ভুক্তভোগী এই মেয়েদের গল্প শুনতে শুনতে আর অন্যদেরকে তা জানাতে জানাতে স্মিতা নিজেও যেন তাদেরই কাছের একজন হয়ে উঠেছেন। ১৮ বছর বয়সে স্মিতা নিজেও একবার এক অধ্যাপকের কাছে যৌন নিপীড়নের শিকার হন। এ ব্যাপারে তিনি অভিযোগ করতে গেলে উল্টো তাকে ‘ওভার স্মার্ট’ এবং ‘বড়দের সাথে কীভাবে কথা বলতে হয় তা জানে না’ বলে বের করে দেয়া হয়। সেই জেদ থেকেই একপ্রকার রোখ চেপে যায় তার মধ্যে। পেশা হিসেবে বেছে নেন ফটোসাংবাদিকতাকে, ছবির মাধ্যমে প্রতিবাদ জানাতে থাকেন ভারতের নিপীড়িত জনগোষ্ঠীর উপর চালিত অত্যাচারের। নিউ ইয়র্কে পড়াশোনা শেষ করে ভারতে যৌন নিপীড়ন বিরোধী কাজে অংশ নিয়েছেন তিনি।

বয়স ১০ হওয়ার আগেই বাবা-মার কোলে থেকে ছিনিয়ে আনা হয়েছিল মেয়েটিকে; Source: nyt.com

তবে একের পর এক এত দুঃখ-দুর্দশা দেখে ভেঙে পড়েছেন অনেকটাই।

“পুরোপুরি আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলছি আমি। ভেবেছিলাম গৃহদাসীদের গল্প সবাইকে জানিয়ে তাদের কষ্টের দিন শেষ করব, তাদের জন্য আন্তর্জাতিক সাহায্য আদায় করব। কিন্তু এখানে কেউ কাউকে সাহায্য করতে প্রস্তুত না, অভিভাবকরাও তাদের মেয়েদের সাহায্য করতে আন্তরিক নন। এভাবে চলতে থাকলে একজন স্মিতা আর এক শক্তি বাহিনী কিছুই করতে পারবে না।”

স্মিতারা তাদের আশা হারিয়ে ফেলার আগেই গৃহদাসীরা দাসী থেকে মানুষে পরিণত হোক। আমাদের দেশেও এমন অনেক গৃহদাসী রয়েছে, আপনার-আমার ঘরেই হয়তো এমন অভাবী পরিবারের ভাগ্যহত কোনো মেয়ে কাজ করছে। চলুন না, সবাই মিলে তাদের পাশে দাঁড়াই।

ফিচার ইমেজ- nyt.com

Related Articles