Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

কেন বিজ্ঞানে খুব বেশী নারী নেতৃত্ব দেখা যায় না

উন্নত দেশের তুলনায় আমাদের দেশ বিজ্ঞানে অনেক পিছিয়ে। তবে আশার কথা হচ্ছে, বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তি নিয়ে সুধী সমাজ এমন কিছু কাজ করছে যে কারণে একটু একটু করে বিজ্ঞানের দিক দিয়ে আমাদের দেশ এগিয়ে যাচ্ছে। প্রতিবছর বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষার সময় দেখা যায় প্রচুর ছাত্রী উচ্চশিক্ষার জন্য ভর্তি পরীক্ষা দিতে আসছে। স্নাতক পাশ করার পরিসংখ্যান ঘাঁটলে দেখা যাবে, পাশ করে মেয়েরা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডি পেরিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু আমাদের দেশে বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে নারী নেতৃত্ব প্রায় নেই বললেই চলে। কোথায় যাচ্ছে পাশ করে যাওয়া সেই মেয়েরা? কেন চাকরির ক্ষেত্রে মেয়েদের এগিয়ে আসার প্রবণতা কম, কেন নেতৃত্বদানে মেয়েরা বাঁধা পাচ্ছে, কোন বিষয়গুলো তাদের সামনে বাঁধা হয়ে আসছে সেগুলো সূক্ষ্মভাবে খতিয়ে দেখাটা কিন্তু জরুরী। এই সমস্যা কিন্তু শুধু আমাদের দেশেই নয়, সারা বিশ্বে এই সমস্যা দেখা যাচ্ছে। অথচ বিজ্ঞানে মেয়েদের অবদানের ইতিহাস কিন্তু চোখ এড়িয়ে যাওয়ার মতো নয়।

কোথায় যাচ্ছে পাশ করে যাওয়া সেই মেয়েরা? কেন চাকরির ক্ষেত্রে মেয়েদের এগিয়ে আসার প্রবণতা কম? কেন নেতৃত্ব দানে মেয়েরা বাঁধা পাচ্ছে?; Source: scientificamerican.com/getty images

মেরি কুরির বিজ্ঞানের অবদানের কথা কে না জানে? দুটি ভিন্ন ভিন্ন বিষয়ে নোবেল পুরস্কার পাবার উদাহরণ সেই একটিই। যে প্রোগ্রামিং নিয়ে আমাদের এত কথা, যে প্রোগ্রামিং দিয়ে এখন কঠিন কঠিন কাজ খুব কম সময়ে করে ফেলা যাচ্ছে সেই প্রোগ্রামিং প্রথম করেছিল একজন নারী, এডা লাভলেস। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মানদের জটিল কোড ভেদ করার জন্য যে টিম গঠন করা হয় তার বেশীরভাগ ছিল মেয়ে, আকাশে তারাদের শুধু দেখে সেখান থেকে আসা আলোক তরঙ্গ বিশ্লেষণ করে তারাগুলোর রাসায়নিক গঠন বের করে মেয়েরা, এপোলো ১১ যেটা চাঁদে গিয়েছিলো সেটার নেভিগেশন সফটওয়্যার তৈরি করে একজন নারী কম্পিউটার বিজ্ঞানী মারগারেট হ্যমিলটন। বাংলাদেশের স্বনামধন্য প্রাণ-রসায়নবিদ অধ্যাপিকা হাসিনা খান একজন আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন বিজ্ঞানী।

এখন পর্যন্ত আলোচনা থেকে বোঝা যাচ্ছে যে, পৃথিবীতে ঘটে যাওয়া বড় বড় আবিষ্কারে নারীদের অবদান অপরিসীম। শুধুমাত্র সংখ্যা লঘিষ্ঠতার কারণে তাদের অবদান পুরুষদের তুলনায় খাটো করে দেখা হয়। সমাজের কিছু নির্দিষ্ট বাঁধাধরা নিয়মের কারণে নারীরা চাকরির ক্ষেত্রে বিজ্ঞানের দিকে খুব বেশী এগিয়ে যেতে পারে না, কিন্তু যারা পারে তারা ইতিহাস তৈরি করে।

শুধু মাত্র সংখ্যালঘিষ্ঠতার কারণে তাদের অবদান পুরুষদের তুলনায় খাটো করে দেখা হয়; Source: The conversation

বাংলাদেশে মেডিকেল পড়াশোনায় মেয়েদের সংখ্যা তুলনামূলক বেশী। কিন্তু যতজন মেয়ে সেখানে ভর্তি হয় এবং প্রফেশনাল পরীক্ষা পাশ করে বের হয়, তাদের মধ্যে ঠিক কতজন পেশাজীবী চিকিৎসক হয়ে কর্মজীবন শুরু করে সেটার কোনো নির্ভুল উপাত্ত আছে কিনা জানা নেই। কিন্তু যারা চিকিৎসাবিজ্ঞানে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করে সেবাদান শুরু করে তাদের কাজ অসম্ভব প্রশংসার দাবি রাখে।

আশির দশকে কিন্তু চিত্র একই রকম ছিল। তবে তখন মেয়েদের এসব পেশায় নিয়োজিত হবার পরিমাণ কম ছিল, এসব বিষয়ে পড়াশোনা করার জন্য ভর্তি হওয়ার সংখ্যা কম ছিল। এখন প্রচুর ভর্তি হচ্ছে, কিন্তু নিজ পেশাতে নেতৃত্বদানের চিত্র সেই আগের মতোই থেকে গিয়েছে- এমনটি বলছিলেন The Leukemia & Lymphoma Society (LLS) এর মেডিকেল অফিসার গোয়েন নিকলস।

তিনি আরও বলছিলেন, তাদের এই গোষ্ঠী, LLS সেখানে অনেক বেশী মেয়েদের চাকরির সুযোগ তৈরি করতে সবসময় সচেষ্ট থাকে। তারা তাদের এই প্রতিষ্ঠানে ক্যান্সার চিকিৎসক এবং ক্যান্সার গবেষক হিসেবে মেয়েদের কাজ করার সুযোগ তৈরি করে দেয়।

বৈজ্ঞানিক নেতৃত্ব প্রদানে ছেলে-মেয়েদের মধ্যেকার তুলনা; Source: scientificamerican.com

মেয়েদের নেতৃত্ব নিয়ে এই প্রতিষ্ঠান প্রায় এক হাজার আমেরিকান নাগরিকের উপর একটি সমীক্ষা চালায়। তাদের কাছে এই সমীক্ষায় ক্যান্সার চিকিৎসায় মেয়েদের অবদান নিয়ে নিজ নিজ মতামত জানতে চাওয়া হয়। সমীক্ষার ফলাফল আসার পর দেখা যায় প্রায় সবার মতামত হচ্ছে মেয়েদের বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে অবদান রাখার জন্য এগিয়ে আসতে হবে এবং নেতৃত্ব দানের ক্ষেত্রে তাদের অগ্রাধিকার ছেলেদের ন্যায় দেয়া উচিত। তাদের এই সমীক্ষায় উঠে আসে, প্রতি দশজন প্রাপ্তবয়স্ক আমেরিকানদের মত, মেয়েদেরকে বিজ্ঞানভিত্তিক নেতৃত্বে এগিয়ে আসতে হবে। প্রায় ৮০% নারীরা মনে করে যে, মেয়েদেরকে এখন এই প্রথা ভাঙতে হবে। LLS-এ নারীদের মধ্যে যারা উঁচু শ্রেণীর বিজ্ঞানী তাদের অবদান আরও শক্ত করতে তাদের ক্যান্সার নিয়ে গবেষণার জন্য প্রচুর অর্থ খরচ করা হয়।

এন মুলালি একজন মেডিসিনের প্রফেসর। তিনি হার্ভার্ড মেডিকেল স্কুলে ব্লাড ক্যান্সার নিয়ে গবেষণা করেন। সেখানকার ক্যান্সার গবেষণার যে রিসার্চ ল্যাবরেটরি সেটার প্রধান হচ্ছে এই এন মুলালি, যিনি কিনা একজন নারী। তিনি নারীদের নেতৃত্বদানের ক্ষেত্রে যে বাঁধাগুলো আসে সে সম্পর্কে নিজের মতামত দিয়েছেন। তার মতে, এক্ষেত্রে মেয়েদের সবচেয়ে বড় বাঁধা উপরিমহলে পুরুষদের একচ্ছত্র আধিপত্য।

তাদের কাছ থেকে বিভিন্ন সময় ফান্ডিংয়ের জন্য নানা রকমের বাঁধা আসে। তাদের কথাবার্তায় মনে হয়, এতগুলো অর্থ একটি নারী নেতৃত্বাধীন রিসার্চ টিমের কাছে দিলে সেই টিমের কাজ কেমন হবে সেটা নিয়ে তারা একটু দোনোমনায় থাকে। যদিও গবেষণার ফান্ডিং দেয়ার পর সেখানে নানারকম শর্ত সেখানে বেঁধে দেয়া হয়। একধরনের চাপ নিয়ে তখন নির্দিষ্ট কাজগুলো শেষ করতে হয়। তার মত হচ্ছে, বিজ্ঞান নেতৃত্ব বিষয়ে যেখান থেকে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়, তাদের বিশ্বস্ততা অর্জন করতে একটি বড় ধরনের প্রতিদ্বন্দ্বিতার মধ্য দিয়ে যেতে হয় একজন নারী বিজ্ঞানীকে। এই ধরনের পক্ষপাতিত্ব কমাতে পারলেই কেবল নারী নেতৃত্ব বহুগুণে বৃদ্ধি পেয়ে যাবে বলে মনে করেন তিনি।

বৈজ্ঞানিক গবেষণায় ছেলে-মেয়েদের মধ্যকার তুলনা (বৈশ্বিক উপাত্ত); Source: scientificamerican.com

আসলে একটি বিজ্ঞান গবেষণা প্রতিষ্ঠানে এবং বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে চাকরির প্রবেশনের সময় থেকে নারীদের পদোন্নতি এবং কোনো প্রতিষ্ঠানে ধারণ করা পর্যন্ত সর্বক্ষণ নারী-পুরুষের পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়। যেকোনো বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা বিজ্ঞান গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোতে লক্ষ্য করলে দেখা যায়, শিক্ষকদের তুলনায় শিক্ষিকাদের হার অনেক কম। অথচ যখন পড়াশোনা করার জন্য তারা যখন কোনো প্রতিষ্ঠানে ঢুকেছিল, তখন কিন্তু প্রায় সমান সংখ্যক সেখানে প্রবেশ করেছিলো এবং ফলাফলের দিক দিয়েও অনেক ক্ষেত্রে মেয়েদের অবস্থান ছেলেদের তুলনায় নিচে ছিল না। এর থেকে স্পষ্ট বোঝা যায় যে, নিশ্চয়ই কোথাও কোনো সমস্যা আছে।

পুরুষতান্ত্রিক সমাজে যেখানে ছেলেদের আধিপত্য বেশী থাকে, সেখানে মেয়েদের অবদানগুলো সবার সামনে তুলে আনা কঠিন। মেয়েদের ক্ষেত্রে আরও কিছু বাঁধা আসে। তাহলে এসব থেকে বের হওয়ার উপায় কী?

এরকম অবস্থার উন্নয়নের জন্য কিছু বিষয় দিয়ে শুরু করা যায়। যেমন, নারী বিজ্ঞানীদেরকে নেতৃত্ব প্রদানে তাদের মেধার পরিচয়ের সুযোগ করে দেয়া, বিভিন্ন কনফারেন্স কিংবা সেমিনারে তাদের বক্তব্য উপস্থাপনের সুযোগ করে দেয়া। এরকম করলে তাদের মধ্যে আত্মনির্ভরশীলতা বাড়বে এবং তাদের পর্যালোচনা করার পর পুরুষ সমাজেও বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে নারীরা যে সমান অবদান রাখতে পারে এই ধারণা প্রকাশ পাবে।

ছেলেদের থেকে মেয়েরা বিজ্ঞান গবেষণায় কোনো অংশে কম নয়; Source: wired.com

এছাড়া নারীদের পিছিয়ে পড়ার আরেকটি কারণ হচ্ছে পড়াশোনা এবং গবেষণার একদম গুরুত্বপূর্ণ সময়ে অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়া। বিভিন্ন সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে যে, নারীরা উচ্চশিক্ষার ট্রেনিং নেয়ার পর এবং ক্যারিয়ার শুরু করার মাঝের সময়ে অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়েন, যে কারণে বাচ্চা একটু বড় না হওয়া পর্যন্ত কাজে পুনরায় যোগ দেয়াও যায় না। সেজন্য কিছুদিন পর আবার নতুন করে প্রথম থেকে সব শুরু করতে হয়। যদিও এখন এই বিষয়টির পরিবর্তন হয়েছে।

এখানে একটি বিষয় উল্লেখ্য যে, এই লেখায় অন্তঃসত্ত্বা হবার বিষয়টি নারীদের বিজ্ঞানী হওয়ার পথে একটি বাঁধা হিসেবে কাজ করে সেটা কিন্তু বলা হয়নি। এই লেখার একদম প্রথমদিকে যেসব নারীর নাম উল্লেখ করা হয়েছে তারা সবাই কিন্তু একেকজন মা। তাই অন্তঃসত্ত্বা হওয়া কখনই বিজ্ঞানী হওয়ার পথে বাঁধা নয়। এই বিষয়টি এখানে এজন্য উল্লেখ করা হয়েছে যে গবেষণার জগতে যোগ দেয়ার পর কেউ অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়লে সেই নারীর সহ-কর্মচারীদের মধ্যে একটি ধারণা চলে আসে যে এই বিজ্ঞানী তার নিজের বৈজ্ঞানিক জীবন নিয়ে মোটেও চিন্তাশীল নয়। বরং অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, একটি নতুন শিশুর আগমন মায়ের কর্মজীবনকে আরও আনন্দময় করে তুলে।

নিজের কাজ এবং নিজের ব্যক্তিগত জীবন- দুইয়ের সমন্বয় সাধন করতে পারা কিন্তু যেনতেন কথা না। নারী-পুরুষ উভয়কেই এই বিষয়ের দিকে নজর দিতে হবে। এছাড়া নারীদেরকে নিজ উদ্যোগেই আরও বেশী সামনে আসতে হবে এবং নিজেদেরকে প্রকাশ করতে হবে। কেবলমাত্র নিজেদের মানসিকতার পরিবর্তন এবং দৃঢ় মানসিকতা ধরে রাখতে পারলেই ভবিষ্যতে পৃথিবীতে বিজ্ঞান জগতে নারী নেতৃত্বের কাঙ্ক্ষিত সুফল বয়ে আসবে।

ফিচার ইমেজ সোর্স: American Academy of Physicians and Surgeons

Related Articles