সমরে আমরা, শান্তিতে আমরা, সর্বত্র আমরা দেশের তরে- নীতিবাক্যকে আশ্রয় করে বীরদর্পে কাজ করে যাচ্ছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। ’৭১ এর মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য অবদান রাখার জন্য সেনাবাহিনী সর্বমহলে প্রশংসিত হয়। স্বাধীনতার পরে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী এবং পাকিস্তানফেরত সেনা সদস্যদের নিয়ে পাকাপাকিভাবে যাত্রা শুরু করে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী।
কালের প্রবাহে এই বাহিনীতে অনেক নিয়ম-কানুন, শস্ত্র-সজ্জার সংযোজন-বিয়োজন ও বিবর্তন হয়। স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীতে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী যে পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে, আজ থেকে কয়েক যুগ আগে সেনাবাহিনী ঠিক এ রকম ছিল না। অস্ত্র-শস্ত্রের আধুনিকায়ন ছাড়াও বাহিনী পরিচালনার কমান্ড-প্রটোকলেও ছিল বিস্তর ফারাক।
মহাভারতের যুগে, সেনাবাহিনীকে মোটা দাগে চারটি ভাগে ভাগ করা হতো– হস্তীবাহিনী, অশ্ববাহিনী, রথ এবং পদাতিক সেনা। চারটি শাখাকে একসাথে বলা হতো ‘চতুরঙ্গ সেনা'। রাজা সবসময় বাহিনী পরিচালনার দ্বায়িত্বে না থাকলেও ছিলেন সর্বাধিনায়ক। ঠিক এযুগের রাষ্ট্রপতির ন্যায়।
এ যুগেও সেনাবাহিনীকে সঠিক ও সূচারুভাবে পরিচালনার লক্ষ্যে কয়েকটি সুনির্দিষ্ট ভাগে বিভক্ত করা হয়। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী সশস্ত্র বাহিনীর একটি প্রতিষ্ঠান। ১৯৭১ সালের ২১ নভেম্বরে বাংলাদেশ সেনা, নৌ এবং বিমানবাহিনী একসাথে পাকিস্তানী হানাদারদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়েছিল। স্বাধীনতা লাভের পরে থেকে দিনটি তাই সশস্ত্র বাহিনী দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে প্রধানত তিনটি শাখায় ভাগ করা হয়। সেগুলো হচ্ছে–
- যুদ্ধ শাখা (Combat Arms)
- যুদ্ধ সহায়ক শাখা (Combat Service)
- সেবা সংক্রান্ত শাখা (Combat Support Service)
যুদ্ধ শাখা বা কমব্যাট আর্মসে যারা রয়েছে তারা সরাসরি যুদ্ধে বা সম্মুখযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। যুদ্ধ সহায়ক শাখায় যারা সার্ভিস দেয় তারা মূলত গোয়েন্দা তৎপরতা, আকাশ প্রতিরক্ষা এবং যোগাযোগের কাজটি করে। আর, বাকি যারা আছেন সবাই সেবা শাখা বা কমব্যাট সার্ভিস সাপোর্টের অন্তর্ভুক্ত।
যুদ্ধ শাখা বা কমব্যাট আর্মস
যুদ্ধ শাখায় যে সৈনিকেরা সেবা প্রদান করে তারা যুদ্ধকালীন সরাসরি সম্মুখ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। কমব্যাট আর্মসে সার্ভিস প্রদানকারীদের আবার চারটি ভাগে ভাগ করা হয়। সেগুলো হচ্ছে-
- ইনফ্যান্ট্রি বা পদাতিক সেনা: শত্রুর সঙ্গে সম্মুখ যুদ্ধে যে সৈনিকেরা পায়ে হেঁটে যুদ্ধ করে তারা ইনফ্যান্ট্রি বা পদাতিক সেনা। জেনারেল ওসমানীর গড়া ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট বা বেঙ্গল রেজিমেন্ট (তৎকালীন ইস্ট পাকিস্তান রেজিমেন্ট বা ইপিআর), বাংলাদেশ ইনফ্যান্ট্রি রেজিমেন্ট (বিআইআর), প্যারা ইনফ্যান্ট্রি ব্যাটেলিয়ন ইনফ্যান্ট্রির অন্তর্ভুক্ত।
- আরমার্ড বা সাজোয়া কোর: যুদ্ধকালে এ কোরের অন্তর্গত সেনা সদস্যবৃন্দ ট্যাঙ্ক ও ভারী সামরিক সরঞ্জামাদি পরিচালনা করে থাকে। এটি আর্মির গুরুত্বপূর্ণ ইউনিটগুলোর একটি।
- আর্টিলারি বা গোলন্দাজ কোর: এ শাখার সেনাদের কামান বা তোপ পরিচালনার দ্বায়িত্ব দেওয়া হয়। স্থলযুদ্ধে এ ইউনিটের ওপর বিজয় অনেকাংশে নির্ভর করে।
- প্যারা-কমান্ডো ব্রিগেড : কমান্ডো হচ্ছে তারা যারা সব ধরনের ঝুঁকিপূর্ণ অপারেশনের জন্য দক্ষ এবং চৌকস। বলা হয়ে থাকে, হাজারজন তরুণের ভেতর একজনকে যোগ্যতম পাওয়া যায় আর্মি অফিসারের জন্য; আর, হাজারজন অফিসারের ভেতর একজনকে পাওয়া যায় কমান্ডো ইউনিটের জন্য। প্যারা-কমান্ডো ইউনিট একটি স্বাধীন ইউনিট।
যুদ্ধ সহায়ক শাখা বা কমব্যাট সাপোর্ট
এ শাখা সম্মুখ যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী কমব্যাট সেনাদের যুদ্ধে পেছন থেকে সাহায্য প্রদান করে থাকে। বিমান যোগাযোগ, দ্রুততম সময়ের মধ্যে পরিবহন, গোয়েন্দা কার্যক্রম পরিচালনা এবং প্রকৌশলগত কাজগুলোর ভার থাকে এ শাখার ওপর। এ শাখাকে পাঁচটি ভাগে বিভক্ত করা হয়েছে–
- আর্মি এভিয়েশন ইউনিট: এ ইউনিট যুদ্ধকালে বিমানযোগে পরিবহন ও অভিযানের কাজ করে থাকে। সেনাসদস্যদের দ্রুত সময়ের ভেতর ঝুঁকিপূর্ণ স্থান থেকে বিমানযোগে বের করে নিয়ে আসা, হাসপাতালে পৌঁছানো ইত্যাদি দায়িত্ব এদের ওপর ন্যস্ত থাকে।
- এয়ার ডিফেন্স আর্টিলারি বা আকাশ প্রতিরক্ষাকারী গোলন্দাজ: আকাশপথে আক্রমণকে প্রতিহত করার দায়িত্ব থাকে এদের ওপর। এদের কাছে অ্যান্টি-এয়ারক্রাফট মিসাইলগুলো থাকে।
- কোর অফ ইঞ্জিনিয়ার্স বা প্রকৌশলী শাখা: সেনাবাহিনীর কোর অফ ইঞ্জিনিয়ার্স শাখাটি প্রকৌশলগতভাবে বিশেষ করে পুরকৌশলগতভাবে সেনাবাহিনীকে মজবুত করে তোলে। ভেহিকল মেরামত, অবকাঠামোর নকশা নির্মাণ ও সংস্করণ, সামরিক যানগুলোর জন্য রাস্তা নির্মাণ এবং রুট নির্ধারণ ইত্যাদি দায়িত্ব এই কোরের ওপর ন্যস্ত থাকে।
- কোর অফ সিগন্যালস: সেনাসদর ও সেনানিবাস থেকে শুরু করে সেনাবাহিনীর মধ্যকার যোগাযোগের কাজটি করে থাকে সিগন্যাল কোর। যুগান্তরে সিগন্যাল কোরটি আধুনিকায়িত হয়েছে। একসময় হাতে লেখা চিঠি, মোর্স কোড, কুরিয়ার, টেলিগ্রাফ ব্যবহার করা হলেও এখন ওয়াকি-টকি, মাইক্রোওয়েভ, স্যাটালাইট কমিউনিকেশন ব্যবহার করা হয়।
- মিলিটারি ইনটেলিজেন্ট বা সামরিক গোয়েন্দা শাখা: এ শাখা সামরিক বাহিনীর গোয়েন্দা কার্যক্রম পরিচালনা করে। ডিরেক্টরেট জেনারেল অফ ফোর্সেস ইনটেলিজেন্স (ডিজিএফআই) বাংলাদেশে মিলিটারি ইনটেলিজেন্স পরিচালনাকারী সবচেয়ে শক্তিশালী সংস্থা। তিন বাহিনীতেই এর শাখা রয়েছে। ডিজিএফআই থেকে কাউন্টার টেরোরিজম এন্ড ইনটেলিজেন্স ব্যুরো (সিটিআইবি), ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টার (এনটিএমসি) নামক আরো দুটো মিলিটারি ইনটেলিজেন্স এজেন্সি গড়ে তোলা হয়েছে।
সেবা শাখা বা কমব্যাট সার্ভিস সাপোর্ট
সম্মুখ যুদ্ধে সরাসরি অংশগ্রহণ ছাড়া সেনাবাহিনীর এ শাখার ইউনিটগুলো বাকি কাজগুলো সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করে থাকে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষা থেকে সামরিক আদালত পরিচালনা, শিক্ষা কার্যক্রম থেকে স্বাস্থ্যসেবার বিষয়গুলো ছাড়াও সকল সেবামূলক কাজ পরিচালনার দায়িত্ব এ ইউনিটের ওপর ন্যস্ত থাকে। এ শাখাকে মোট এগারোটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে–
- মিলিটারি পুলিশ বা এমপি: সেনানিবাস এবং তার অন্তর্গত এলাকার সকল সামরিক ও বেসামরিক নাগরিকদের মধ্যে পুলিশিং কার্যক্রম পরিচালনা করে এ ইউনিট। আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব পালনকারী ইউনিটটি ল এন্ড অর্ডার অনুযায়ী এরা শৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব পালন করে।
- আর্মি সার্ভিসেস কোর বা এএসসি: সেনাবাহিনীর যান চলাচল ও রসদ সরবরাহের কাজ করে এরা। বিপদকালে প্রয়োজনীয় রসদ অকুস্থলে সরবরাহের পুরো দ্বায়িত্ব এদের ওপর ন্যস্ত থাকে।
- অর্ডন্যান্স কোর: সামরিক সরঞ্জামাদি (যেমন : অস্ত্র, সাজ-সজ্জা, ভারী সামরিক যান ইত্যাদি) সরবরাহের কাজ করে থাকে অর্ডন্যান্স কোর।
- ইলেকট্রিক্যাল এন্ড মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার্স কোর: সংক্ষেপে এ ইউনিটকে ইএমই বলে ডাকা হয়। সেনাবাহিনীর বৈদ্যুতিক ও যন্ত্র প্রকৌশলের দিকটি ইএমই কোর পরিচালনা করে থাকে।
- আর্মি এডুকেশন কোর বা শিক্ষা কোর: সেনাসদস্যদের প্রশিক্ষণ এবং তাদের সন্তানদের শিক্ষার বিষয়কে মাথায় রেখে প্রতিটি সেনানিবাসেই বিভিন্ন স্তরীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হয়েছে। ক্যান্টনমেন্ট স্কুল ও কলেজ, মেডিকেল কলেজ, ন্যাশনাল ডিফেন্স কলেজ, বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অফ প্রোফেশনালস (বিইউপি) এডুকেশন কোরের অন্তর্ভুক্ত।
- আর্মি মেডিকেল কোর: আর্মি মেডিকেল কোর বা এএমসির ওপর সেনাবাহিনী ও তাদের পরিবারের সদস্যদের স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের দ্বায়িত্ব ন্যস্ত থাকে। সম্মিলিত সামরিক হাসপাতাল বা সিএমএইচগুলো এএমসির অন্তর্গত।
- আর্মি ডেন্টাল কোর: এটি সেনাবাহিনীর একটি বিশেষজ্ঞ ইউনিট। সেনাসদস্যদের সপরিবারে ডেন্টাল চিকিৎসা দেবার উদ্দেশ্যে ডেন্টাল কোর গঠিত হয়েছিল।
- আর্মড ফোর্সেস নার্সিং সার্ভিসেস বা এএফএনএস: সেনাবাহিনীতে প্রথম আনুষ্ঠানিক নার্সিং সেবার সূচনা করেছিলেন ফ্লোরেন্স নাইটেঙ্গল। তাকে লেডি উইথ দ্য ল্যাম্প অভিধায় সম্ভাষিত করা হয়। তার অগ্রগামী ভূমিকার পরে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে নার্সিং সার্ভিসেস কোর গঠন করা হয়েছিল এবং বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতেও গঠন করা হয়।
- আর্মি কোর অফ ক্লার্কস বা এসিসি: সেনাসদর থেকে শুরু করে সেনাবাহিনীর প্রতিটি শাখায় করণিক দ্বায়িত্ব পালন করে কোর অফ ক্লার্কস শাখাটি। বিদেশের মিশনগুলোতে প্রেষণে নিয়োগপ্রাপ্ত সেনা অফিসারগণও এ ইউনিটের অন্তর্গত।
- জাজ অ্যাডভোকেট জেনারেল’স ডিপার্টমেন্ট: সেনাবাহিনীর এ ইউনিটে যারা কাজ করেন তাদের জাজ অ্যাডভোকেট বলেও ডাকা হয়। মিলিটারি আইন অনুসারে অপরাধীর বিচার বা কোর্ট মার্শাল পরিচালনা করে এ ইউনিট। প্রতিটি ইউনিটের প্রধানকে বলা হয় জাজ অ্যাডভোকেট জেনারেল।
- রিমাউন্ট, ভেটেরিনারি এন্ড ফার্মস কোর: প্রতিটি সেনানিবাসেই পশুপালন ও রক্ষণাবেক্ষণ করা হয়। এটি সেনাবাহিনীর অনেক পুরোনো ইউনিট। যখন সামরিক বাহিনীতে অশ্ববাহিনীর গুরুত্ব ছিল তখন এ ইউনিটের ওপর সেনাবাহিনীতে ঘোড়া সরবরাহের দ্বায়িত্ব ন্যস্ত ছিল। বর্তমানে প্রাণিসম্পদের যথাযথ উৎপাদন এবং রক্ষণাবেক্ষণের কাজটি করে থাকে রিমাউন্ট, ভেটেরিনারি এন্ড ফার্মস কোর।
ব্রিটিশদের উপমহাদেশ ছাড়ার প্রায় সাত দশক পেরিয়ে গেলেও উপমহাদেশীয় আমলাতন্ত্র এবং সেনাবাহিনীতে এখনও ব্রিটিশ নিয়ম-নীতিকেই অনুসরণ করা হয়। যুগের সাথে তাল মিলিয়ে সেনাবাহিনীতে নতুন নতুন ইউনিট ও ব্রিগেডের জন্ম দেওয়া হলেও মৌলিক কাঠামো ব্রিটিশদের থেকেই নেওয়া। ইউনিটগুলোতে চেইন অব কমান্ডের উচ্চস্তরীয় সমন্বয়, সেনাসদস্যদের আধুনিক ও যুযোপযোগী প্রশিক্ষণ, অত্যাধুনিক অস্ত্র-শস্ত্রে সজ্জিতকরণের মাধ্যমে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী এখন পৃথিবীর একটি অন্যতম শক্তিশালী ও শৃঙ্খলিত সেনাবাহিনীতে পরিণত হচ্ছে।
This article is written in the Bengali language, it discusses the cores and divisions of Bangladesh Army. There are mainly three parts– Combat Arms, Combat Service and Combat Support Service. These parts are also divided into many sub-sections.
All the links of the helping websites are being hyperlinked in the text.
Feature Image Courtesy: army.mil.bd