Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

জলবায়ু সংকটে বাংলাদেশের কৃষকরা কীভাবে খাপ খাইয়ে নিচ্ছেন?

২৫ বছর আগেও আমরা সারা বছর ফসল উৎপাদন করতে পারতাম। এখন সেই জমিতেই বছরের সাত মাস পানি আটকে থাকে। আমরা বুঝে উঠতে পারি না কীভাবে টিকে থাকবো।” বলছিলেন আলতাফ মাহমুদ।  

জলবায়ু সংকট সারাবিশ্বের জন্যই চিন্তার কারণ হয়ে উঠেছে। প্রভাব পড়ছে বাংলাদেশের মতো নিচু ভূমির দেশেও। সমুদ্রের উচ্চতা বৃদ্ধি ও মরণ বন্যা এখানকার নিয়মিত ঘটনা এখন। এর ফলে কোটি মানুষের বেঁচে থাকা পড়েছে ঝুঁকিতে। কিন্তু তারা অন্য যে সমস্যায় আছেন সেটি হুমকি এবং একইসাথে ঝুঁকির কারণ হয়ে উঠছে পুরো বাংলাদেশের জন্যই। জমিতে পানি আটকে থাকা এবং পানিতে উচ্চ লবণাক্ততা জমির ফসল নষ্ট করে ফেলছে।

সংকট কতটা ভয়াবহ? 

বৈশ্বিক জলবায়ু ঝুঁকি সূচক বলছে, গত দুই দশকে চরম আবহাওয়ায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান সপ্তম।কৃষক আলতাফের কথা জানিয়েছিলাম আপনাদের। তিনি রাজধানী ঢাকা থেকে ২০০ কিলোমিটার দক্ষিণে পিরোজপুরের প্রত্যন্ত এলাকা মুগারঝোরের বাসিন্দা। আলতাফ যখন তার অসহায়ত্বের কথা বলছিলেন, পাশ থেকে প্রতিবেশী মোহাম্মদ মোস্তফা জানান, এখানকার বেশিরভাগ কৃষকই গরীব এবং জমিও দুষ্প্রাপ্য। উপরন্তু যদি সাত মাস তারা কোনো ফসলই ফলাতে না পারেন, তাহলে তাদের অনাহারে থাকতে হবে। 

কৃষক আলতাফের মতো হাজারও মানুষ জলবায়ু সংকটের ঝুঁকিতে পড়েছেন। Image Source : Munir uz Zaman/AFP

ক্রমাগত ঘন ঘন ঘূর্ণিঝড়, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, বন্যা, ক্ষয়, খরা, এবং বৃষ্টি ইতিমধ্যে লক্ষ লক্ষ মানুষকে শহরের বস্তিতে বা গ্রাম থেকে দূরে বাস্তুচ্যুত করেছে। তীব্র এবং ঘন ঘন বন্যা, ভারী বৃষ্টিপাত, জলোচ্ছ্বাস এবং পানির লবণাক্ততা গত কয়েক বছর ধরে ফসলের উৎপাদনকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে, যা খামারের শ্রমিকদের ভীষণভাবে প্রভাবিত করেছে, যারা দেশের শ্রমশক্তির প্রায় ৬০ শতাংশ এবং গ্রামীণ দরিদ্রদের ৭০ শতাংশ। কিন্তু যাদের গ্রাম ছেড়ে কোথাও যাওয়ার আর উপায় নেই, তাদের চিরচেনা জায়গাতেই কাজের বিকল্প ব্যবস্থা খুঁজে বের করতে হচ্ছে।  

বেঁচে থাকায় বিকল্প ভাবনা

টিকে থাকার লড়াইয়ে কৃষকরা এখন বিকল্প উপায়ে চাষাবাদ করার চেষ্টা করছেন। বৈশ্বিক উষ্ণায়নের ফলে সৃষ্ট আরও ধ্বংসাত্মক এবং অনাকাঙ্খিত পরিস্থিতির সাথে খাপ খাইয়ে নেওয়ার জন্য কৃষকরা ভাসমান বীজতলা ব্যবহার করা থেকে শুরু করে লবণ-প্রতিরোধী ধানের বীজ উন্নয়নের মতো চেষ্টায় মরিয়া হয়ে উঠছেন। 

পানির উপরে বীজতলা তৈরি করার একটি শতাব্দী প্রাচীন কৌশলকে ফিরিয়ে আনছেন কৃষকরা। এই প্রক্রিয়ায় মূলত কচুরিপানাসহ বিভিন্ন জলজ উদ্ভিদ ও বাঁশের সমন্বয়ে তৈরি ভেলার ওপর মাটি দিয়ে ভাসমান বীজতলা তৈরি করা হয়। এই বীজতলা সাধারণত মাটি থেকে ২-৪ ফুট (০.৬-১.২ মিটার) উঁচুতে তৈরি করা হয়। এই বীজতলার উপর বীজ রোপণ করা হয়। সার হিসেবে কাঠের গুঁড়ি এবং নারকেল ছোবড়া ব্যবহার করেন কৃষকরা। এই ধরনের বীজতলা তৈরিতে কৃষকের ব্যয় না হওয়ায় আলাদা খরচও গুণতে হয় না তাদের।  

জলবায়ু সংকট বিকল্প উপায় খুঁজে বের করেছেন গ্রামের কৃষকরা; Image Source: Munir uz Zaman/AFP

এই প্রক্রিয়ায় একটি হালকা, ভাসমান সবজির বাগান তৈরি করা সম্ভব– করলা, পালংশাক এবং ঢেঁড়শ সবই এভাবে জন্মাতে পারে– পানির স্তরের সাথে বেড়ে উঠতে এবং পরিণত হতেও সক্ষম।

চাষাবাদের এই পদ্ধতি পারিবারিক এক উদ্যোগে পরিণত হয়েছে গ্রামে গ্রামে। কিছু গ্রাম ঘুরে দেখা গেছে, বাড়ির মহিলারা মাসের পর মাস বীজতলা প্রস্তুতে ব্যস্ত থাকেন। এরপর বাড়ির পুরুষ তথা কৃষকরা সেই বীজতলা জলাবদ্ধ ক্ষেতে নিয়ে যান। 

অনেক কৃষক ফসল উৎপাদন থেকেই মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন। এর পরিবর্তে বিকল্প পেশায় নাম লিখিয়েছেন তারা। অনেকে নোনা পানিতে চিংড়ি চাষ বা কাঁকড়া মোটাতাজাকরণ- বন্য কাঁকড়া ধরে তাদের খাওয়ানো ও তারপর বিক্রি করা, এবং হাঁস পালনের মতো কাজে নেমেছেন। এই চিংড়ি,  কাকঁড়া এবং হাঁসের রাজধানী ঢাকার নানা হোটেল ও রেস্টুরেন্টগুলোয় উচ্চ চাহিদা রয়েছে।

সংকটে নারীরাও

বাংলাদেশে গ্রামের নারীদের বেশিরভাগই তাদের জীবিকার জন্য ছোট আকারের কৃষি, গবাদিপশু, হাঁস-মুরগি পালনের পাশাপাশি হস্তশিল্পের উপর নির্ভর করেন।

জলবায়ু-সম্পর্কিত সমস্যাগুলো কৃষিকে প্রভাবিত করেছে, দরিদ্র পরিবারের নারীরাও বিশেষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। জলবায়ু গবেষক মোহাম্মদ আবদুর রহমান বলছিলেন, ঐতিহ্যগত পদ্ধতির কৃষিকাজ এই অঞ্চলের নারীদের আয়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎস। কিন্তু জলাবদ্ধতা এবং লবণাক্ততার মতো প্রতিকূল জলবায়ু তাদের ঐতিহ্যগত চাষ পদ্ধতি ব্যবহার করে সবজি চাষে বাধা দিচ্ছে। জলবায়ু সংকট এবং এর প্রভাবে আয় হ্রাসের ফলে কাজের সন্ধানে পুরুষদের গ্রাম থেকে শহরমুখী হওয়ার ঘটনা বেড়েছে, কিন্তু পারিবারিক পিছুটানে নারীরা ছাড়তে পারছেন না ভিটেমাটি, পড়ছেন পিছিয়ে।  

বাংলাদেশের সমাজব্যবস্থায় পিতৃতান্ত্রিক নিয়মে নারীর গতিশীলতা এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ ব্যাপকভাবে সীমাবদ্ধ। তাদের জমি এবং অন্যান্য উৎপাদনশীল সম্পদের সীমিত প্রবেশাধিকার এবং মালিকানা রয়েছে। এর পাশাপাশি বাজার এবং পুঁজিতে তাদের প্রবেশাধিকারও সীমাবদ্ধ। আবার নারীদের মধ্যে অনেকেই পারিবারিক সহিংসতা এবং বাল্যবিবাহের মতো সমস্যার সম্মুখীন হয়ে থাকেন। জলবায়ু সংকটের চোখরাঙানিতে কৃষিকাজে স্বাবলম্বী হওয়ার পথেও তাই নারীরা দিশা হারিয়ে ফিরছেন। তবে অবস্থার পরিবর্তন ঘটছে। নারীদের কৃষিকাজে অচলাবস্থা কাটিয়ে তুলতে এগিয়ে এসেছে দেশী-বিদেশী বেশ কিছু এনজিও।

নারীরাও জলবায়ু সংকটে খাপ খাইয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছেন; Image source : Helvetas / Simon B. Opladen

সরকারের সাথে মিলে তারা গ্রামের মানুষ, বিশেষ করে নারীদের টেকসই কৃষি ও খামারের উৎপাদন পদ্ধতি শেখা এবং প্রয়োগে সহযোগিতা করছেন। সুইজারল্যান্ডভিত্তিক উন্নয়ন সংস্থা হেলভেটাস (Helvetas) তাদের বিভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যমে দেশের প্রায় ১৮ শতাধিক নারীকে স্বাবলম্বী করে তোলায় সহযোগিতা করেছেন। 

বাগেরহাটের সামাদ্দারখালী গ্রামের শ্যামলী রানী স্থানীয় একটি এনজিও থেকে ভার্টিক্যাল ফার্মিং বা স্তরীভূত চাষাবাদের প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। এরই সুবাদে তিনি ছোট্ট জমিতেই অধিক ফলন পাচ্ছেন। তিনি বলছিলেন, এই পদ্ধতিতে বিভিন্ন ধরনের সবজি উৎপাদন করে মাসে ৫-৭ হাজার টাকা আয় করতে পারছেন। 

ভার্টিক্যাল ফার্মিংয়ে মুখে হাসি নারী কৃষকদের; Image Source: Worldfish

জলবায়ু গবেষক আবদুর রহমান বলছেন, শুধু বাগেরহাট ও খুলনা জেলায় নয়, দেশের অন্যান্য উপকূলীয় এলাকাতেও জলবায়ু-সহনশীল জীবিকা অর্জনের পদ্ধতি সফল হয়েছে।

তার মতে, এই ধরনের পদ্ধতিগুলো নিম্ন-আয়ের মহিলাদের সম্পদ অর্জনের পথ খুলে দেয় এবং তাদের আর্থিকভাবে ক্ষমতাশীল করে তোলে।

ধানের নতুন জাতে আশার আলো?

বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিআরআরই) প্রধান ফসলের নতুন লবণ-প্রতিরোধী জাত তৈরি করেছে। বিজ্ঞানী আলমগীর হোসেন জানান, লবণাক্ত পানিতে সাধারণ ধান জন্মাতে পারে না। লবণাক্ততা ধানের ডাটার শক্তি নষ্ট করে।  বিআরআরই এমন একটি ধানের প্রকরণ আবিষ্কার করেছে, যা লবণাক্ততার মাত্রার তিনগুণ পানিতেও বেড়ে উঠতে পারে। 

বিজ্ঞানী আলমগীরের মতে, নতুন প্রকরণটি উপকূলীয় অঞ্চলের কৃষকদের জন্য নতুন আশার সঞ্চার করেছে, যেখানে সমুদ্রের পানি ক্রমবর্ধমানভাবে জমিকে দখল করছে। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) জলবায়ু বিশেষজ্ঞ সাইফুল ইসলাম অবশ্য দ্বিমত পোষণ করেছেন এ ব্যাপারে। তিনি বলছেন, এই ধরনের প্রচেষ্টা বিশাল সমুদ্রের মধ্যে এক  ফোঁটা পানির সমান। তার মতে,

আমাদের বৃহৎ উপকূলরেখা বরাবর বাঁধের সংখ্যা বাড়ানো ও সেগুলো শক্তিশালী করতে বিলিয়ন ডলার খরচ করতে হবে। ঘূর্ণিঝড়, তলিয়ে যাওয়া এবং সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধিতে প্রাকৃতিক বাধা হিসেবে কাজ করার জন্য আমাদের উপকূলীয় অঞ্চলে ম্যানগ্রোভ বন তৈরি করতে হবে।

নতুন রাস্তা তৈরি, বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ করা, এবং লাখ লাখ মানুষের জন্য বিকল্প জীবিকা তৈরির মতো উদ্যোগে মনোযোগী হওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন সাইফুল ইসলাম। তার মতে, শুধু ফসল উদ্ভাবন করলে হবে না। বাংলাদেশের একার পক্ষে এই ভয়াবহতা মোকাবিলা করা সম্ভবও নয়। 

বুয়েটের এই বিশেষজ্ঞ জানান, বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে খাপ খাওয়ানো, এবং প্রশমনের জন্য উন্নত দেশগুলোর দ্বারা বরাদ্দকৃত শত বিলিয়ন ডলারের ‘অল্পই’ পেয়েছে। পশ্চিমা দেশগুলো যেহেতু অধিকাংশ গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমনের জন্য দায়ী, তাই তাদের সাহায্য বাড়ানোয় জোর দিতে বলছেন তিনি। 

This article sheds light on how the farmers of Bangladesh are adapting to the climate crisis. References have been hyperlinked.

Feature Image: Munir uz Zaman/AFP

Related Articles