করোনাভাইরাস ডিজিজ বা কোভিড-১৯ কী, সেই সম্পর্কে নতুন করে জানানোর কিছু নেই। গত কয়েকমাস ধরে বিশ্বজুড়ে এই ভাইরাসের প্রকোপ সকলের কাছেই একে অতি পরিচিত করে তুলেছে। পুরো পৃথিবী থমকে গেছে এই ভাইরাসের কারণে। দেশের মাঝে, মানুষের মাঝে তৈরি করেছে এক অস্পষ্ট দেয়াল। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা যাকে মহামারি হিসেবে ঘোষণা করেছে, সেই মারাত্মক প্রাণঘাতী ভাইরাস সম্পর্কে জানে না এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া যাবে না আজ।
বিগত কয়েকমাসে এই করোনা ভাইরাসের বিরূপ প্রভাব পড়েছে প্রায় প্রতিটি দেশের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে, এবং জনজীবনে। দেশে দেশে লকডাউন বা কোয়ারেন্টিনে একদিকে যেমন দেশের অর্থনৈতিক কাঠামো ভেঙে পড়ছে, তেমনই প্রতিদিন বেকার হচ্ছে অসংখ্য মানুষ। উন্নত দেশের অর্থনৈতিক অবস্থাই যেখানে নাজুক হয়ে পড়েছে, সেখানে উন্নয়নশীল কিংবা স্বল্পোন্নত দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা সম্পর্কে ধারণা করে নিতে কোনো অসুবিধা হওয়ার কথা না।
করোনাভাইরাসের বিরূপ প্রভাব পড়েনি এমন ক্ষেত্র বা প্রতিষ্ঠান নেই। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, শিল্প-কলকারখানা, যাতায়াত, স্বাস্থ্যখাতসহ প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই করোনা তার করাল থাবা বসিয়েছে। যেকোনো দেশ এবং সেই দেশের মানুষের জন্য যার পরিণাম হবে সুদূরপ্রসারী। বাংলাদেশও তার ব্যতিক্রম নয়। বরং সদ্য উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে করোনাভাইরাসের সমূহ প্রভাব পড়বে দেশের অর্থনৈতিক নানা ক্ষেত্রে।
বাংলাদেশের অর্থনীতির একটি বিশাল অংশ জুড়ে আছে দেশের টেক্সটাইল সেক্টর। এ দেশের অর্থনীতির মেরুদণ্ড বলা হয়ে থাকে এই সেক্টরকে। বিশেষ করে তৈরি পোশাক বা রেডি-মেড গার্মেন্টস (RMG) রপ্তানির দিক থেকে বাংলাদেশ বিশ্বের মধ্যে ২য় অবস্থানে আছে। প্রথম অবস্থানে আছে চীন।
ফলে বোঝা যাচ্ছে, সারাবিশ্বে ‘Made in Bangladesh’ ট্যাগের গুরুত্ব নেহায়েৎ কম নয়। দেশের অর্থনীতির পাশাপাশি এই টেক্সটাইল সেক্টরের উপর নির্ভর করে আছে লক্ষ লক্ষ শ্রমিকের জীবন। ফলে পোশাক রপ্তানির উপর ভিত্তি করে একদিকে যেমন দেশ এগিয়ে যাচ্ছিল, তেমনি লক্ষ লক্ষ শ্রমিকের জীবিকারও নির্বাহ হচ্ছিল। এমন সময়ে হঠাৎ এই মহামারির আবির্ভাব।
এটি ঠিক যে, বস্ত্র বা পোশাক মানুষের পাঁচটি প্রাথমিক চাহিদার মধ্যে দ্বিতীয়। কাজেই আধুনিক সমাজে বস্ত্র বা পোশাকের কোনো বিকল্প নেই। অর্থাৎ খেয়ে বাঁচার পরেই আসে পরে বাঁচা। খেয়ে-পরে বাঁচার এই শর্ত পূরণ করতে খাদ্য ও বস্ত্রের উৎপাদন বন্ধ করার কোনো উপায় নেই।
করোনাভাইরাস কীভাবে বাংলাদেশ এবং বিশ্বের টেক্সটাইল সেক্টরে প্রভাব ফেলছে বা এর প্রভাব কতটা সুদূরপ্রসারী সেই সম্পর্কে চলুন জানা যাক।
দেশের মোট উৎপাদন আয়ের শতকরা প্রায় ৮০ ভাগই আসে তৈরি পোশাক খাত থেকে। কেবল পোশাক রপ্তানি করে বৈদেশিক মুদ্রা আয় করাই নয়, দেশের শ্রমজীবী মানুষের একটি বিরাট অংশের কর্মসংস্থানও হয়েছে এসব টেক্সটাইল ইন্ডাস্ট্রিতে। প্রায় চার মিলিয়ন শ্রমজীবী মানুষের ভাগ্য জুড়ে আছে এসব টেক্সটাইল ইন্ডাস্ট্রির সাথে।
আগেই বলা হয়েছে, তৈরি পোশাক রপ্তানিতে বাংলাদেশ বিশ্বে এখন দ্বিতীয় অবস্থানে আছে। কিন্তু করোনাভাইরাসের কারণে সম্ভাবনাময় এই ক্ষেত্রটি এখন হুমকির মুখে। যদিও স্বাভাবিক হিসেবে দক্ষিণ এশীয় অঞ্চলে কোভিড-১৯ এর প্রাদুর্ভাব তুলনামূলক কম, তবুও এর বিরূপ প্রভাব এড়ানো অতটা সহজও নয়।
বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের চাহিদার ক্ষেত্রে শীর্ষে আছে ইউরোপ ও আমেরিকা। করোনার প্রাদুর্ভাবও এই দুই দেশে তুলনামূলকভাবে বেশি। এসব দেশে লকডাউনে পড়ে বন্ধ হয়ে আছে ফ্যাশন আউটলেটগুলো। আউটলেট বন্ধ থাকার ফলে এসব দেশের ক্রেতা প্রতিষ্ঠানগুলো পুরাতন অর্ডার বাতিল করে দিচ্ছে কিংবা শিপমেন্টের সময় বর্ধিত করছে। আবার নতুন করে তেমন কোনো অর্ডারও আসছে না। ফলে আদতে বাংলাদেশের টেক্সটাইল ইন্ডাস্ট্রিগুলোই ভোগ করছে বিড়ম্বনা।
ইন্ডাস্ট্রিগুলো একদিকে পুরাতন অর্ডারের পোশাক রপ্তানি করতে পারছে না, যার ফলে প্রোডাকশন লস তো আছেই। অন্যদিকে নতুন অর্ডার না আসায় বিপদটা আরো বেশি। কারণ পুরাতন অর্ডারের পণ্য তৈরি হয়ে গেছে, কিন্তু রপ্তানি না করতে পারলে কোম্পানিকে লোকসান গুনতে হবে। কাঁচামালের মূল্য পরিশোধ করতে হবে, দিতে হবে শ্রমিকদের বেতন। আবার নতুন করে অর্ডার না আসলে সেই লোকসান বেড়ে হবে বহু গুণ। ইন্ডাস্ট্রিগুলোর অর্থনৈতিক লোকসান মানে দেশেরও অর্থনৈতিক লোকসান।
ইন্ডাস্ট্রিগুলোর লোকসানের ফলে দেশের অর্থনীতি যেমন ভেঙে পড়বে, তেমনি অবস্থার অবনতি হবে পোশাক শ্রমিকদের। করোনার প্রাদুর্ভাবে এই শ্রমিকেরা পড়েছে উভয় সংকটে। ইন্ডাস্ট্রি যদি উৎপাদন বন্ধ করে দেয় তাহলে পোশাক শ্রমিকদের মরতে হবে না খেয়ে। আবার ইন্ডাস্ট্রি যদি উৎপাদন বন্ধ না করে তাহলে এই শ্রমিকদের কর্মক্ষেত্রে করোনায় আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনাও কম নয়।
করোনাভাইরাসের কারণে বিদেশী ক্রেতা প্রতিষ্ঠানও এই মুহুর্তে পোশাকের অর্ডার দিতে বা পুরাতন অর্ডারের মূল্য পরিশোধ করতে পারছে না। সর্বশেষ জুন মাসে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে জানা যায় যে, বিদেশী ক্রেতা প্রতিষ্ঠানগুলো প্রায় ৩.১৫-৬ বিলিয়ন ডলারের মতো অর্ডার বাতিল করেছে। এই অর্ডার বাতিলের কারণে প্রায় এক মিলিয়নেরও অধিক শ্রমিক ছাটাই করা হয়েছে ইন্ডাস্ট্রি থেকে। যাদের ছাটাই করা হয়নি তারা পাচ্ছে কম বেতন।
৮ মার্চ বাংলাদেশে সরকারি হিসেবে প্রথম করোনার আবির্ভাব ঘটে। এটি একটি ছোঁয়াচে রোগ এবং বাতাসের মাধ্যমেও ছড়াতে পারে। সাধারণত যেখানে অনেক লোকসমাগম হয়, সেখানে এই ভাইরাস সহজে ছড়িয়ে পড়তে পারে, এটি আমরা সবাই-ই জানি। টেক্সটাইল ইন্ডাস্ট্রি বা গার্মেন্টসগুলোতে যেহেতু অনেক লোক একসাথে কাজ করে, কাজেই সেখানে করোনাভাইরাস দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে পারে সহজেই।
এতসব চিন্তা-ভাবনার পর সরকার ২৪ মার্চ ১০ দিনের বন্ধ ঘোষণা করে, যা ২৬ মার্চ থেকে কার্যকর হয়। বন্ধে অধিকাংশ শ্রমিক গ্রামে পাড়ি জমায়। কিন্তু ১০ দিন পরে আবার কাজ শুরু হবে ভেবে অনেকেই আবার ফিরে আসে রাজধানীতে। কিন্তু আসার পর জানা যায় যে, বন্ধ ১২ মার্চ পর্যন্ত বর্ধিত করা হয়েছে। এরূপ সঠিক দিকনির্দেশনার অভাবে শ্রমিকরা পড়ে যায় আরো বিপাকে। যাতায়াতের সমস্যা, থাকা-খাওয়ার সমস্যা, আবার সেই সাথে করোনায় আক্রান্ত হওয়ার আশংকা– সব মিলিয়ে নাজেহাল অবস্থা।
পরবর্তীতে বিজিএমইএ এবং বিকেএমইএ এই বন্ধ ২৫ এপ্রিল পর্যন্ত বর্ধিত করে। কিন্তু জানা যায়, এরই মধ্যে চীন এবং ভিয়েতনাম তাদের টেক্সটাইল ইন্ডাস্ট্রি খুলে দিয়েছে। চীন এবং ভিয়েতনাম তৈরি পোশাক রপ্তানিতে বাংলাদেশের নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী। এরা যদি ইন্ডাস্ট্রি খুলে দেয় এবং বাংলাদেশ যদি না খোলে, তাহলে অর্ডার সব চলে যাবে চীন বা ভিয়েতনামের কাছে। ফলে বিশ্ববাজারে পিছিয়ে পড়বে বাংলাদেশ।
বিজিএমইএ অর্ডার হাতছাড়া এবং লোকসানের আশংকায় ২৬ এপ্রিল থেকে আবার ফ্যাক্টরিগুলো আংশিকভাবে খোলার সিদ্ধান্ত নেয়। যদিও সিদ্ধান্তের এই অস্বচ্ছতার কারণে প্রায় অর্ধেক ফ্যাক্টরি খোলা সম্ভব হয়নি। বাকি যেগুলো খোলা হয়েছে, সেখানে সঠিক নিয়ম-কানুন অর্থাৎ, মাস্ক পরিধান, নিরাপদ দূরত্বে অবস্থান ইত্যাদি কতটা মেনে চলা হচ্ছে সেটি নিয়ে সন্দেহ থেকেই যায়।
মিডিয়া রিপোর্ট থেকে জানা যায়, ফ্যাক্টরি বন্ধের আগে প্রায় ৯৭ জন শ্রমিক করোনায় আক্রান্ত হয়েছিলো। ফ্যাক্টরি পুনরায় চালু করার পর আক্রান্তের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৫২% এ। একদিকে ফ্যাক্টরি না খুললে মালিক এবং সরকারকে গুনতে হবে প্রচুর লোকসান, অন্যদিকে ফ্যাক্টরিতে কাজ না করলে শ্রমিকদেরও জীবন হবে দুর্বিষহ। তাই জীবনের ঝুঁকি নিয়ে হলেও তারা কাজ করে যাচ্ছে।
যদিও সরকার প্রতিটি ইন্ডাস্ট্রিকে নির্দেশ দিয়েছিল তাদের শ্রমিকদের বেতন পরিশোধ করতে, তবুও প্রায় ১৬৯টি ইন্ডাস্ট্রি ছাড়া বাকি ইন্ডাস্ট্রিগুলো শ্রমিকদের বেতন পরিশোধ করতে সক্ষম হয়নি। এই সংখ্যা বিজিএমইএ-এর প্রতিবেদনের সাথে যদিও এক হয় না। বিজিএমইএ-র হিসেব মতে ৯২টি ইন্ডাস্ট্রির ৪৮,২০০ জন শ্রমিকের মার্চ মাসের বেতন আটকে আছে।
টেক্সটাইল ইন্ডাস্ট্রিগুলোর এরূপ অবস্থা বিবেচনা করে সরকার শ্রমিকদের বেতন পরিশোধের জন্য প্রায় ৫৮৮ মিলিয়ন ডলারের ঋণ প্রকল্প হাতে নিয়েছে। ইন্ডাস্ট্রিগুলো ২% ইন্টারেস্টে এই প্যাকেজের আওতায় ঋণ নিতে পারবে। তবে দেশের সব ফ্যাক্টরির শ্রমিকদের মধ্যে বন্টন করা হলে এটি কেবল একমাসের বেতনই পূরণ করতে পারবে।
এদিকে ইন্ডাস্ট্রি খোলার সিদ্ধান্ত নেয়া হলেও সব ইন্ডাস্ট্রি খোলা সম্ভব হয়নি। বড় কিছু ইন্ডাস্ট্রির পক্ষে এই মহামারিতে লোকসানের চ্যালেঞ্জ নিয়ে কাজ করা সম্ভব হলেও ছোট ইন্ডাস্ট্রিগুলোর পক্ষে সেটি সম্ভব নয়। যেখানে বড় ইন্ডাস্ট্রিগুলোই অর্ডার, প্রোডাকশন, শ্রমিকদের বেতন আর লাভ-লোকসান নিয়ে নাজেহাল অবস্থায় আছে, সেখানে ছোট ইন্ডাস্ট্রিগুলোর পক্ষে টিকে থাকা খুবই দুরূহ।
তৈরি পোশাকের মূল্যের ক্ষেত্রেও পড়বে করোনার বিরূপ প্রভাব। আমদানি-রপ্তানি পণ্যের ক্রেতা-বিক্রেতা সবাই করোনার শিকার। পোশাক খাতে দেখা যায়, বিদেশী যেসব বায়ার অর্ডার বাতিল করেছে, তাদের ৯৮.১ শতাংশ এই পণ্য বাতিলের ক্ষতিপূরণ দিতে নারাজ। ৭২ শতাংশ বায়ার সাপ্লাইয়ারের ক্রয় করা কাঁচামালের মূল্য দিতে এবং ৯১ শতাংশ বায়ার উৎপাদন খরচ দিতে নারাজ।
সমস্যাটি মূলত সবার হওয়ার কারণে বায়ার সবসময় চাইবে কম দামে মূল্য কিনতে। কারণ মহামারিতে তারও অর্থনৈতিক অবস্থা ভঙ্গুর। আবার সাপ্লাইয়ার চাইবে বেশি দামে বিক্রি করতে, কারণ তা না হলে লোকসান গুণতে হবে।
চীন এবং ভিয়েতনাম রেডি-মেড গার্মেন্টস সেক্টরে বাংলাদেশের প্রধান দুই প্রতিদ্বন্দ্বী। কাজেই এই মহামারির কারণে বাংলাদেশের টেক্সটাইল সেক্টর যে কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এতসব সমস্যা কীভাবে কাটিয়ে উঠে টেক্সটাইলকে এগিয়ে নেয়া যায়, সেই পদক্ষেপগুলোই নেয়া দরকার এখন। তা না হলে হয়তো ‘Made in Bangladesh’ ট্যাগের গর্ব হারিয়ে যেতে পারে।
This article is in Bengali language. In this article, the impacts of COVID-19 pandemic on the textile sector of bangladesh are described. Necessary references are enlisted here.
1) Coronavirus: Bangladesh's garment industry risks collapse
2) The Effect of COVID-19 on Bangladesh’s Apparel Industry
3) Bangladesh: COVID-19 badly impacts garment industry
4) Sakamoto M., Begum S., Ahmed T., Vulnerabilities to COVID-19 in Bangladesh and a Reconsideration of Sustainable Development Goals, Sustainability 2020, doi:10.3390/su12135296
5) Coronavirus disruptions deal severe blow to Bangladesh's garment industry
6) Live-blog: How the Coronavirus affects garment workers in supply chains
Feature Image: bbc.com