১৯৭১ সালে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের রক্তঝরা দিনগুলোতে বহির্বিশ্বের বিভিন্ন প্রচার মাধ্যম নিরীহ বাঙালিদের উপর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর নির্মম নির্যাতন ও গণহত্যা, বাঙালিদের সংগ্রাম-প্রতিরোধ, ভারতে আশ্রয় নেওয়া শরণার্থীদের করুণ অবস্থা এবং মুক্তিযুদ্ধের অগ্রগতি সম্পর্কে প্রতিবেদন প্রকাশ করে বিশ্ব জনমতকে জাগ্রত করে তোলে। এই সময়ে জ্যঁ ক্যুয়ে নামে এক ফরাসি নাগরিক পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারওয়েজ (পিআইএ) এর একটি বিমানের আরোহীদের জিম্মি করে ফ্রান্স সরকারের কাছে ভারতে অবস্থান করা বাঙালি শরণার্থীদের জন্য ২০ টন ঔষুধ ও ত্রাণসামগ্রী পাঠানোর দাবি করেন।
জ্যঁ ইউজিন পল ক্যুয়ে ১৯৪৩ সালের ৫ জানুয়ারি উত্তর আফ্রিকার দেশ আলজেরিয়ার মিলিয়ানা নামক স্থানে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা ছিলেন একজন সামরিক কর্মকর্তা। জ্যঁ কুয়ে এবং তার একজন ভাইও ফরাসি সামরিক বাহিনীতে কর্মরত ছিলেন। তিনি ইয়েমেন এবং নাইজেরিয়ার বায়াফ্রা অঞ্চলের রক্তক্ষয়ী সংঘাত খুব কাছ থেকে প্রত্যক্ষ করেন। ফলে যুদ্ধের ভয়াবহতা এবং নিরীহ মানুষের সীমাহীন দুর্ভোগ সম্পর্কে তার সম্যক ধারণা ছিল। সামরিক বাহিনীর চাকরি ছেড়ে দিয়ে এরপর তিনি দরিদ্র মানুষের সেবায় নিয়োজিত থেকে বিভিন্ন সামাজিক কাজে আত্মনিয়োগ করেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ভারতে আশ্রয় নেওয়া বিপুল সংখ্যক বাঙালি শরণার্থীর করুণ অবস্থার ঘটনা শুনে তিনি তাদেরকে সাহায্য করার পরিকল্পনা করেন।
১৯৭১ সালের ৩ ডিসেম্বর ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসের অর্লি বিমানবন্দরের রানওয়েতে অপেক্ষমাণ পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারওয়েজ (পিআইএ) বোয়িং ৭২০ মডেলের ফ্লাইট ৭১২ বিমানটিতে মোট ২৮ জন আরোহী অবস্থান করছিল, যাদের মধ্যে ছিলেন ৬ জন বৈমানিক ক্রু এবং ২২ জন যাত্রী। তৎকালীন ফরাসি প্রেসিডেন্ট পম্পিডুর সাথে দ্বিপক্ষীয় বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা করতে সেই দিন প্যারিসের অর্লি বিমানবন্দরে এসেছিলেন তদানীন্তন পশ্চিম জার্মানির চ্যান্সেলর উইলি ব্র্যান্ডিট।
স্বাভাবিকভাবে এই দুই গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির প্রটোকল নিয়ে বিমানবন্দরের নিরাপত্তারক্ষী ও অন্যান্য কর্মীরা ব্যস্ত হয়ে পড়েন। আর সেই সুযোগ কাজে লাগিয়ে দুপুর ১১টা ৫০ মিনিটে মাত্র ২৮ বছর বয়সী যুবক জ্যঁ ক্যুয়ে একটি ৯ মি.মি এর রিভলবার হাতে নিয়ে সেই বিমানবন্দরে অবস্থান করা পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারওয়েজের একটি বোয়িং ৭২০ বিমানের ককপিটে প্রবেশ করে তৎক্ষনাৎ পাইলটসহ বিমানটির ক্রুদের জিম্মি করে ফেলেন।
বিমানের বেশিরভাগ যাত্রীই ছিলেন পাকিস্তানের নাগরিক। জ্যঁ কুয়ে তার এর হাতে থাকা একটি বাক্সকে 'বোমা' হিসেবে উপস্থাপন করে ভারতে অবস্থান করা প্রায় এক কোটি বাঙালি শরণার্থীর সাহায্যার্থে ওষুধ ও ত্রাণসামগ্রী না পাঠানো হলে বিমানটিকে উড়িয়ে দেওয়ার হুমকি দেন। জিম্মি ঘটনা শুরুর সাথে সাথে ফরাসি পুলিশ সেই বিমান সংলগ্ন টার্মিনাল এলাকা বন্ধ করে দেয়। পাকিস্তানি বিমানে জিম্মি সংকটের ঘটনার কারণে সেদিন তৎকালীন ফরাসি প্রেসিডেন্ট পম্পিডু এবং তদানীন্তন পশ্চিম জার্মানির চ্যান্সেলর উইলি ব্র্যান্ডিটের সকল আনুষ্ঠানিক কর্মসূচি স্থগিত করা হয়।
এরপর ফরাসি সরকার জিম্মিকারী জ্যঁ ক্যুয়ের সাথে আলোচনা করে জিম্মি দশার শান্তিপূর্ণ পরিসমাপ্তির জন্য কাজ শুরু করে। তবে জ্যঁ ক্যুয়ে জিম্মি ঘটনায় তার কোনো ব্যক্তিগত দাবি-দাওয়া নেই জানিয়ে ফরাসি মধ্যস্থতাকারীদের কাছে ফরাসি সরকার কর্তৃক ২০ টন ওষুধ ও ত্রাণসামগ্রীর মানবিক সহায়তা ভারতে অবস্থান করা বাঙালি শরণার্থীদের জন্য প্রেরণ কারার দাবি করেন। তিনি জিম্মি হওয়া পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারওয়েজের সেই বিমানে ঔষুধ ও ত্রাণসামগ্রী পাঠিয়ে দেওয়ার জন্য দাবি জানান।
ফরাসি সরকার একদিকে জ্যঁ ক্যুয়ের সাথে আলোচনা চালিয়ে নিতে থাকে, অন্যদিকে অর্লি বিমানবন্দর ঘিরে কমান্ডো বাহিনী মোতায়েন করে সামরিক অভিযানের পরিকল্পনা করতে থাকে। ৩রা ডিসেম্বর বিকাল ৫টা ১৫ মিনিটের সময় ফরাসি রেডক্রসের সহায়তায় দ্রুত ১ টন ঔষধ সংগ্রহ করে অর্লি বিমানবন্দরে পৌঁছে। এরপর জিম্মিকারী জ্যঁ ক্যুয়ের দাবি অনুযায়ী বিমানে সেই ১ টন ঔষধ ওঠানো হয়।
ফরাসি সরকার বাকি ত্রাণসামগ্রী দ্রুততম সময়ের মধ্যে যুদ্ধের কারণে ভারতে আশ্রয় নেওয়া বাঙালি শরণার্থীদের নিকটে পৌঁছে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেয় এবং বিমানের ভেতরে অবস্থান করা ক্রু ও যাত্রীদের জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে জিম্মিকারীর উপর চাপ প্রয়োগ করতে থাকে। ক্যুয়ে প্রায় ছয় ঘণ্টা পর্যন্ত বিমানটি নিজের আয়ত্তে রেখে নিয়ন্ত্রণ কক্ষের সাথে আলোচনা চালিয়ে যান।
এই পর্যায়ে এসে ফরাসি সরকার জিম্মি সংকট নিরসনে একটি পরিকল্পনা করে। ঔষধ সামগ্রী বোঝাই দ্বিতীয় ট্রাক এসে বিমানটির কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছিল ততক্ষণে। সেই ট্রাকের চালকসহ সংশ্লিষ্ট অন্যরা ছিলেন প্রকৃতপক্ষে ফরাসি পুলিশের ছদ্মবেশী সদস্য। সেই ছদ্মবেশী পুলিশ সদস্যরা কৌশলে বিমানটির ভেতরে প্রবেশের চেষ্টা করে। তারা জিম্মিকারীকে পেনিসিলিনসহ কয়েকটি ওষধ ওঠানোর কথা বলে, যেগুলো বিমানটির কার্গোতে পরিবহন করা কিছুটা ঝুঁকিপূর্ণ। তাই ছদ্মবেশী ফরাসি পুলিশ সদস্যরা বিমানটির ককপিটে পেনিসিলিন রাখার জন্য জ্যঁ ক্যুয়ের কাছে অনুরোধ জানায়। এই অজুহাতে ছদ্মবেশী ফরাসি পুলিশের সদস্যরা বিমানটিতে প্রবেশ করে জ্যঁ ক্যুয়ের সাথে ধস্তাধস্তির একপর্যায়ে তাকে আক্রমণ করে কাবু করে ফেলে। এভাবে একটি কৌশলী অভিযান পরিচালনা করে ফরাসি পুলিশ জ্যঁ ক্যুয়েকে আটক করতে সক্ষম হয়।
এবার পুলিশ সদস্যরা বিমানটির আরোহীদের দ্রুত নামিয়ে নিয়ে আসেন। এরপর পুলিশ জ্যঁ ক্যুয়েকে বিমান থেকে নামিয়ে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করতে শুরু করেন। তিনি তদন্তকারী কর্মকর্তাদের কাছে শুধুমাত্র মানবিক কারণে ভারতে অবস্থান করা বাঙালি শরণার্থীদের সাহায্য করার জন্য এই ঘটনা ঘটিয়েছেন বলে জানান। তার কাছ থেকে উদ্ধার করা বাক্সটি থেকে কোনো বিস্ফোরক দ্রব্য পাওয়া যায়নি, সেখানে কিছু বৈদ্যুতিক তার এবং এক কপি বাইবেল ছিল। তদন্তকারী কর্মকর্তারা উদ্ধার হওয়া বিমানটির আরোহীদের সাথে কথা বলেন। সেই যাত্রীরাও তাদের সাথে ক্যুয়ের আচরণ ভালো ছিল বলে জানান। বিমানটিতে নিরাপত্তা তল্লাশি চালানোর পর সেটি করাচির উদ্দেশ্যে প্যারিস ছেড়েছিল।
তবে ফরাসি সরকার জ্যঁ ক্যুয়ের আহবানে সাড়া দিয়ে রেডক্রসের মাধ্যমে ২০ টন ঔষুধ ও ত্রাণসামগ্রীর মানবিক সহায়তা ভারতে অবস্থান করা বাঙালি শরণার্থীদের জন্য প্রেরণ করে। পরে অবশ্য বিমান আরোহীদের জিম্মি করার ঘটনায় অভিযোগ গঠন করে ফরাসি আদালতে ক্যুয়ের বিচার হয়। সেই বিচারে তাকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ডে প্রদান করা হয়। কিন্তু মানবাধিকার কর্মীদের দাবির মুখে তাকে ১৯৭৩ সালে মুক্তি প্রদান করা হয়। কারাগার থেকে মুক্তি পাওয়ার পর তিনি বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষের জন্য তার মানবিক কার্যক্রম অব্যহত রাখেন।
আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের বন্ধু জ্যঁ ক্যুয়ে ২০১২ সালের ২৩ ডিসেম্বরে প্রায় ৬৯ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন। তিনি তার মহৎ কাজের মাধ্যমে বিশ্বের সকল নিপীড়িত মানুষের কাছে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন।
This Bengali article details the incident of plane hijacking by Jean Kay who wanted the French govt to send medicines as help for the Bangladeshi refugees living in India in 1971.
Reference:
1. Salute to Jean Kay, the friend of the distressed