Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

জৈন্তাপুর: বাংলাদেশের একমাত্র মেগালিথিক সৌধ

বহু দিন ধ’রে বহু ক্রোশ দূরে
বহু ব্যয় করি বহু দেশ ঘুরে
দেখিতে গিয়েছি পর্বতমালা,
দেখিতে গিয়েছি সিন্ধু।
দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া
ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া
একটি ধানের শিষের উপরে
একটি শিশিরবিন্দু।

স্ফুলিঙ্গ- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

উইল্টশায়ারের স্টোনহেঞ্জ, আয়ারল্যান্ডের ড্রোমবাগ স্টোন সার্কেল, ইজরায়েলের রুজম-আল-হিরি- নামগুলো কমবেশি আমাদের অনেকেরই পরিচিত। অন্তত স্টোনহেঞ্জের কথা জানেন না, এমন মানুষ খুব কমই আছেন। বিদেশের মেগালিথিক কাঠামোগুলো দেখে চোখ ছানাবড়া করে প্রশ্ন করে ফেলেন কৌতূহলীরা- বিশালাকৃতির কয়েক খণ্ড পাথর সোজা করে মাটিতে পুঁতে এই ধরনের সৌধ কেন এবং কীভাবে বানানো হয়েছিল? অথচ মজার বিষয় হলো, আমরা অনেকেই হয়তো জানি না যে বাংলাদেশেই রয়েছে মেগালিথিক সংস্কৃতির একটি প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান। আর সেটি অবস্থিত সিলেট জেলার জৈন্তাপুরে, জৈন্তিয়া পাহাড়ের পাদদেশে।

উইল্টশায়ারের স্টোনহেঞ্জ; Source: english-heritage.org.uk

জৈন্তাপুরের মেগালিথিক সৌধ সম্পর্কে কিছু বলার আগে মেগালিথিক সৌধ আসলে কী, সে সম্পর্কে কিছু জেনে নেয়া যাক। মেগালিথ বলতে বড় একটি প্রস্তর খণ্ডকে বোঝায়, যা কোনো স্থাপনা বা ভাস্কর্য নির্মাণে ব্যবহৃত হয়। এখানে একটি পাথরকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হলেও পাথরের সংখ্যা একাধিকও হতে পারে। মেগালিথিক শব্দটি দ্বারা বোঝানো হয় বিশাল আকৃতির সেই স্থাপনাগুলোকে, যার নির্মাণে মেগালিথ পাথর ছাড়া কোনো ধরনের ইট-কাঠ-পাথর ব্যবহার করা হয় না। মেগালিথ পাথরকে অনেকে প্রত্নতাত্ত্বিক মনোলিথও বলে থাকেন। নিউলিথিক এবং ব্রোঞ্জ যুগে এ ধরনের স্থাপনা বেশি চোখে পড়ত। সুনির্দিষ্ট কোনো উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে বিভিন্ন সময়ে ভিন্ন ভিন্ন আকৃতিতে নির্মিত মেগালিথিক সৌধগুলো এখনো গবেষক এবং প্রত্নতাত্ত্বিকদের জন্য রীতিমতো গবেষণার বিষয়।

মূলত প্রাচীনকালে সমাধি সৌধ বা স্মারক সৌধ হিসেবে মেগালিথিক স্থাপনাগুলো নির্মাণ করা হতো। অর্থাৎ কোনো গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির কবরকে চিহ্নিত করে রাখার জন্য বা কোনো গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য স্মারক চিহ্ন হিসেবে বানানো হতো একেকটি মেগালিথিক স্থাপনা। মেগালিথিক সৌধগুলো বিভিন্ন ধরনের হয়ে থাকে, যেমন- মেনহির, ডলমেন, স্টোন সার্কেল, মাল্টিপল হুডস্টোন ইত্যাদি। বাংলাদেশে দুই ধরনের মেগালিথিক সৌধ দেখা যায়। এগুলো হলো, ডলমেন ও মেনহির। ডলমেন মেগালিথিকের বৈশিষ্ট্য হলো মাঝখানে একটি ক্যাপস্টোনকে নেতা হিসেবে দাঁড় করিয়ে তাকে চারপাশ থেকে ঘিরে দাঁড়িয়ে থাকবে বেশ কয়েকটি মেগালিথ। সাধারণত গোরস্তানে বা বিশেষ ব্যক্তির কবরকে কেন্দ্র করে নির্মাণ করা হয় এই স্টাইলের মেগালিথিক স্থাপনা। আর মেনহির স্থাপনায় একটি মাত্র মেগালিথকে খাড়াখাড়ি দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়।

পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে নানা আকৃতির মেগালিথিক খুঁজে পাওয়া গেছে; Source: heritagedaily.com

বাংলাদেশে এখনো পর্যন্ত আবিষ্কৃত একমাত্র মেগালিথিক সংস্কৃতির দেখা পাওয়া যায় সিলেটের জৈন্তাপুর উপজেলায়। জৈন্তাপুর উপজেলায় তিনটি মেগালিথিক প্রত্নস্থান রয়েছে। এবার তবে জেনে নেওয়া যাক আমাদের দেশীয় মেগালিথিক প্রত্নস্থানগুলোর সম্পর্কে।

জৈন্তাপুরে বেঁচে থাকা মেগালিথিক স্থাপনাগুলো বাঁচিয়ে রেখেছে বাংলাদেশের প্রাচীন এক সময়কে। সিলেট জেলা থেকে প্রায় ৪০ কিলোমিটার উত্তরে জৈন্তিয়া পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত জৈন্তাপুর। অসংখ্য পাহাড় আর উপত্যকায় ঘেরা উত্তর-দক্ষিণাংশ, আবার সমতল ভূমি বিশিষ্ট পশ্চিম-দক্ষিণাংশ, অগণিত হাওড়- সব মিলিয়ে সিলেটে যেন দেখা পাওয়া যায় বাংলাদেশের অপরুপ সৌন্দর্যের সমাহারের। প্রাচীনকালে বর্তমান সমতল ভূমি পানির নিচে ছিল বলে মনে করেন ঐতিহাসিকরা। এ কারণে ধরে নেওয়া হয়, সিলেটের সাথে জৈন্তাপুরের খুব একটা যোগাযোগ ছিল না।

সব মিলিয়ে দীর্ঘদিন যাবৎ জৈন্তাপুর ছিল স্বাধীন একটি অঞ্চল এবং সে সময়ে এটি জৈন্তাপুর রাজ্য নামে পরিচিতি লাভ করে। এপিক, পৌরাণিক এবিং ট্যানট্রিক সাহিত্যে জৈন্তাপুরের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। স্থানীয় কিংবদন্তী, গল্পগাঁথা এবং বিভিন্ন শিলালিপি অনুযায়ী, সপ্তম শতাব্দীতে জৈন্তাপুর রাজ্য কামারুপা রাজ্যের অধীনে চলে আসে। এরপর চন্দ্র এবং বর্মণ শাসকদের সময়ে তারা পর্যায়ক্রমে জৈন্তাপুর দখল করে। বর্মণদের রাজত্ব শেষ হলে জৈন্তাপুর চলে আসে দেব সাম্রাজ্যের অধীনে।

দেব সাম্রাজ্যের শেষ রাজা জয়ন্ত রায়ের এক নাম কন্যা ছিল, নাম তার জয়ন্তী। ল্যান্দোয়ার নামের এক খাসিয়া প্রধানের সাথে বিয়ে হয় তার। বিয়ের শর্ত অনুযায়ী, জৈন্তাপুর রাজ্য ১৫০০ শতাব্দীতে খাসিয়াদের অধীনে চলে যায়। ১৮৩৫ সাল পর্যন্ত তারা শাসন করে জৈন্তাপুর। রাজবাড়ি, জয়ন্তশ্বরী মন্দির, মেগালিথিক সৌধ সব তাদেরই অবদান। গোটা জৈন্তাপুরের মেগালিথগুলোকে তিনটি অঞ্চলে ভাগ করা হয়েছে।

অরক্ষিত অবস্থায় পড়ে থাকা জৈন্তাপুরের একটি মেগালিথিক; Source: sightbywalk.blogspot.com

জয়ন্তশ্বরী মন্দির অঞ্চল

জয়ন্তশ্বরী মন্দির অঞ্চলে বর্তমানে ২০টি মেনহির ও ২৬টি ডলমেন রয়েছে। জৈন্তাপুর বাসস্ট্যান্ডে নেমে উপজেলা হেডকোয়ার্টারের দিকে মিনিট দুয়েক হাঁটলেই মেগালিথিকগুলোর দেখা পাওয়া যাবে। এই মেগালিথিক প্রত্নস্থানটি জয়ন্তশ্বরী মন্দিরের সামনেই অবস্থিত। এখানে একটি রাস্তা রয়েছে যার দুই পাশে আরো দুইটি মেগালিথিক প্রত্নস্থান রয়েছে। সবচেয়ে বড় মেনহিরটির উচ্চতা ১.৬০ মিটার। এখানে নয় পা বিশিষ্ট একটি মেগালিথ রয়েছে যার দৈর্ঘ্য ৬.৫ মিটার এবং প্রস্থ ৫.২ মিটার। তবে এগুলোর অবস্থা খুব একটা ভালো না।

মুক্তারপুর অঞ্চল

জয়ন্তশ্বরী মন্দিরের উত্তরে নয়াগাঙের উত্তর পাড়ে মুক্তারপুর অঞ্চলের মেগালিথিক সৌধগুলো অবস্থিত। ১৯৪৮ সালে সেখানে চারটি মেনহির এবং ১৯৬০ সালে সাতটি ডলমেনের দেখা পাওয়া গেলেও, বর্তমানে তাদের সংখ্যা যথাক্রমে তিন এবং চারে নেমে এসেছে। প্রায় ভঙ্গুর হয়ে আসা ডলমেনগুলোর সঠিক মাপ এখন আর নির্ণয়ও করা সম্ভব নয়। কোনোমতে দাঁড়িয়ে থাকা মেনহিরগুলোর মধ্যে যে দুটির অবস্থা একটু ভালো, তাদের উচ্চতা ৪.৫৮ মিটার এবং ৪.৫৫ মিটার। স্থানীয়দের মুখে শোনা যায়, এখানে কোনো এক রাজকুমারীর সমাধি রয়েছে।

খাসিয়া পল্লী অঞ্চল

জয়ন্তশ্বরী মন্দির হতে এক কিলোমিটার দক্ষিণ পূর্বে নিজপাটে এই সৌধগুলো অবস্থিত। এখানে এখনো দুটি মেনহির এবং দুটি ডলমেন টিকে আছে। পূর্বদিকের মেনহিরটির অবস্থা বেশ খারাপ। ২.৪০ মিটার দৈর্ঘ্যের এই মেনহিরটি পশ্চিমের ৩.৫০ মিটার দৈর্ঘ্যের অপর মেনহিরের সাথে পদ্মফুলের আকৃতি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

খাসিয়া পল্লীর মেগালিথিক; Source: newagebd.net

ইতিহাস থেকে জানা যায়, খাসিয়া ধর্মমতের যদি কেউ মারা গেলে তাদের কবর দেওয়ার জন্য এই ধরনের পাথরের সমাধি সৌধ নির্মাণ করা হতো। যাদের অর্থবিত্ত তুলনামূলক কম ছিল তারা বড় বড় পাথর দিয়ে সমাধি সৌধ তৈরি করতে পারত না। তাই তাদের সমাধি সৌধ তৈরিতে অপেক্ষাকৃত ছোট পাথর ব্যবহার করা হতো। কিন্তু যাদের আর্থিক অবস্থা ভালো ছিল, তারা সমাধি সৌধ তৈরি করতে বিশাল আকৃতির পাথর ব্যবহার করত। বর্তমানে এই অঞ্চলে আদি খাসিয়া ধর্মের প্রচলন আর নেই, অধিকাংশ খাসিয়াই এখন খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী। কাজেই বর্তমানে বাংলাদেশে হারিয়ে যেতে বসেছে এ ধরনের সৌধ। তবে আসামের খাসিয়ারা এখনো মেগালিথিক সমাধি সৌধ নির্মাণ করে থাকেন। আর এ থেকেই মোটামুটি নিশ্চিত হওয়া যায় যে, বাংলাদেশের মেগালিথিক সৌধগুলো খাসিয়াদেরই বানানো।

প্রত্যেকটি প্রাচীন স্থাপনার সাথে জড়িয়ে থাকে স্থানীয়দের দিনলিপি, তাদের জীবনযাপন রীতি, তাদের জীবনের গল্প। স্থানীয়দের মতে, এই মেগালিথিকগুলো রাজার রাজকার্যের জন্য ব্যবহার করা হতো। সবচেয়ে বড় ডলমেনটিতে রাজা বসতেন এবং তার পাশের ছোট ডলমেনগুলোতে বসতেন আঞ্চলিক প্রধানরা। আবার অন্য মত অনুযায়ী, এখানে বসে তৎকালীন রাজ কর্মচারীরা খাজনা আদায় করতেন। তবে মুক্তারপুর অঞ্চলের সৌধ সম্পর্কে স্থানীয় লোকেদের মুখে শোনা যায় যে, এখানে কোনো এক রাজকুমারীর সমাধি রয়েছে। সবই অবশ্য শোনা কথা, আজ আর তা প্রমাণ করার কোনো উপায় নেই।

ছবিতেই ফুটে উঠেছে মেগালিথিকগুলোর ভগ্নদশা; Source: offroadbangladesh.com

দুঃখের বিষয়, বাংলাদেশের একমাত্র মেগালিথিক প্রত্নতাত্ত্বিক স্থানটি সকলের কাছে পরিচিত নয়। এখানকার অধিকাংশ মেগালিথিকের অবস্থায় খুবই শোচনীয়। বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর শুধুমাত্র একটি সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে রেখেছেন বটে, তবে তা খুব একটা কার্যকর নয়। এগুলো রক্ষণাবেক্ষণের জন্য কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণ করা হলে সিলেট ভ্রমণকারী কিংবা যেকোনো ভ্রমণপিপাসু পর্যটকের কাছেই বাংলাদেশের মেগালিথিকগুলো হয়ে উঠবে অন্যতম আকর্ষণীয় স্থান।

তথ্যসূত্র: মজুমদার, ড. রমেশচন্দ্র, বাংলা দেশের ইতিহাস (১৯৯৮), পৃষ্ঠা নং- ২২০-২২২, জেনারেল প্রিন্টার্স অ্যান্ড পাবলিশার্স লিমিটেড।

ফিচার ইমেজ- travel-bangladesh.net

Related Articles