Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website. The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

কালা জাহাঙ্গীর: এক রহস্যময় ডনের কাহিনী

একটি ফোন কলেই রাতের ঘুম হারাম হয়ে গেল ঢাকার একজন প্রখ্যাত ব্যবসায়ীর। এসি কামরায় বসেও দরদর করে ঘামতে শুরু করলেন তিনি। প্রচণ্ড আতঙ্কিত অবস্থায় পরদিন সব জানালেন সহকর্মীদের। কালা জাহাঙ্গীরের নাম করে কারা যেন বিশাল অঙ্কের চাঁদা দাবি করেছে তার কাছে, না দিলে পরিবার সহ মেরে ফেলার হুমকি। কালা জাহাঙ্গীরের নামটি শোনার সাথে সাথে পুরো রুমটিতে যেন বাজ পড়ল। তুমুল বিতর্ক শুরু হয়ে গেল সবার মধ্যে।

কেউ বলছে “কালা জাহাঙ্গীর তো সেই ২০০৪ সালেই খুন হইছে পিচ্চি হান্নানের হাতে। ওর দল আসলো কই থেকে?” বিরোধিতা করল অন্য একজন, “না খুন হয়নি। আত্মহত্যা করছেন কালা জাহাঙ্গীর।” আরেকজন আবার উড়িয়ে দিল তার মরার খবরটিকেই, বলল “আরে! কালা জাহাঙ্গীর এখনো বহাল তবীয়তেই আছেন ভারতে। পুলিশকে ধোঁকা দেয়ার জন্যই ছড়িয়েছেন এসব মৃত্যু সংবাদ। সেখান থেকে এখনো নিয়ন্ত্রণ করছেন ঢাকার আন্ডারওয়ার্ল্ড।” বিভিন্ন জনের কাছ থেকে উঠে এলো এমন আরো অনেক গল্প। কিন্তু নিশ্চিত করে কিছু বলতে পারছে না কেউই।

কালা জাহাঙ্গির; Image Source: বাংলাদেশ প্রতিদিন

উপরের ঘটনাটি কাল্পনিক হলেও সম্পূর্ণ অস্বাভাবিক কোনো ঘটনা নয়। ঢাকাই অন্ধকার জগতের এককালের শিরোমণি কালা জাহাঙ্গীর বস্তুত এক রহস্যময় ‘কিংবদন্তী’ হয়েই আছেন এখনো। আদৌ জীবিত আছেন নাকি মরে গেছেন এ বিষয়ে নিশ্চিত নন কেউই। নিশ্চিত নয় পুলিশও। বাংলাদেশ পুলিশের ওয়েবসাইটে মোস্ট ওয়ান্টেড লিস্টে এখনো সবার প্রথমে ভেসে আসে তার নাম। কিন্তু তার বর্তমান অবস্থান সম্পর্কে কোনো তথ্য নেই তাদের কাছে। একমাত্র সম্বল কালা জাহাঙ্গীরের আঠারো বছর আগেকার একটি ছবি। আর তার এ রহস্যময়তাকে পুঁজি করে এখনো বিভিন্ন চক্র তার নাম বেচে খাচ্ছে।

বড় কোনো সন্ত্রাসীকে পাকড়াও করলে কালা জাহাঙ্গীরের সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করা এখনো পুলিশের রুটিন কাজের একটি। জানতে চান শেষ কবে দেখা হয়েছিল বা যোগাযোগ হয়েছিল কালা জাহাঙ্গীরের সাথে। তবে অবাক করা বিষয় হচ্ছে তার কোনো উল্লেখযোগ্য তথ্য নেই আন্ডারওয়ার্ল্ডের কারো কাছেও। গোয়েন্দাদের কাছে এ এক বিশাল ধাঁধাঁ। অপরাধ বিশেষজ্ঞদের মতে, বিশ্বের তাবৎ গ্যাংস্টারদের কোনো না কোনো খোঁজ ইন্টারপোলের কাছে থাকে। কিন্তু এক্ষেত্রে কালা জাহাঙ্গীর সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম। ইন্টারপোলের মোস্ট ওয়ান্টেড লিস্টে তার নাম থাকার পরও কোনোরকম সন্ধান জানা নেই তার।

আজ ঢাকাই আন্ডারওয়ার্ল্ডের কথা বললেই প্রথমে যে নামটি আসে সেটি কালা জাহাঙ্গীর। অথচ এ অন্ধকার জগতে পা বাড়ানোর কোনো কারণই ছিল না তার। ছাত্র হিসেবে জাহাঙ্গীর ছিলেন তুখোড় মেধাবী। ১৯৯২ সালে এস.এস.সি পরীক্ষায় পাঁচটি লেটার সহ স্টার মার্কস নিয়ে পাশ করেন। সেসময় এমন রেজাল্ট করত বাছাই করা অল্প কিছু ছাত্রই। সবাই সমীহ করত তাদের। সে হিসেবে ভবিষ্যতে কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখে স্কুল শিক্ষিকা মায়ের মুখ উজ্জ্বল করারই কথা ছিল তার। কিন্তু সময়ের অদ্ভুত খেলার কথা কে জানতো! কে জানতো তার এ মেধা কাজে লাগবে অন্ধকার জগতে?

বাংলাদেশ পুলিশের ওয়েবসাইটে কালা জাহাঙ্গীরের প্রোফাইল

কালা জাহাঙ্গীরের ভালো নাম ফেরদৌস জাহাঙ্গীর। ১৯৭৭ সালে বগুড়ায় জন্মগ্রহণ করেন। বগুড়ার ধুনট থানার বনানীগাঁও তাদের গ্রামের বাড়ি। তবে বেড়ে উঠেন ঢাকার ইব্রাহিমপুরে। ১৩১/১ নং আদর্শপল্লীর বাসায় থাকতেন মায়ের সঙ্গে। অসাধারণ কৃতিত্বের সাথে স্কুল পেরোনোর পর ভর্তি হয়েছিলেন তেজগাঁও কলেজে। কিন্তু এসময় ঘটে যায় একটি দুর্ঘটনা। কাফরুল এলাকার লিটন ও মাসুম নামের দুই যুবকের সাথে বিরোধ বাঁধে জাহাঙ্গীরের। বিরোধের এক পর্যায়ে তাদের ছুরিকাঘাত করে বসেন জাহাঙ্গীর।

এ ঘটনার জের ধরে তাকে গ্রেফতার করে পুলিশ। জীবনে এই একবারই গ্রেফতার হয়েছিলেন তিনি। একুশ দিন হাজত বাস করে ছাড়া পান। কিন্তু এ একুশ দিনের হাজতবাসে বদলে গেছে অনেক কিছুই। এ একুশ দিনে তার ভেতরকার তুখোড় মেধাবী ছেলেটি বনে গেছে এক দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসী। এ একুশ দিনে ফেরদৌস জাহাঙ্গীর হয়ে উঠেছে কালা জাহাঙ্গীর।

১৯৯২ থেকে অন্ধকার জগতে পথচলা শুরু হয় এক নতুন গ্যাংস্টারের , কালা জাহাঙ্গীর। খুব অল্প সময়ের মধ্য দিয়ে দুর্ধর্ষ সব কিলিং মিশনে অংশ নিয়ে ও তার মেধার জোরে আন্ডারওয়ার্ল্ডের শীর্ষে উঠে আসেন তিনি।  নৃশংস সব গ্যাংস্টারদের নিয়ে গড়ে তুলেন নিজের দল ‘ব্ল্যাক প্যান্থার’। এরপর আন্ডারওয়ার্ল্ডে রদবদল হলে যোগ দেন ফাইভ স্টার গ্রুপে, এখানে তার ঘনিষ্ঠতা বাড়ে আরেক কুখ্যাত গ্যাংস্টার পিচ্চি হান্নানের সাথে। এসময় রীতিমতো অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেন কালা জাহাঙ্গীর। দাপিয়ে বেড়াতে শুরু করেন অপরাধ জগতের সব শাখায়।

১৯৯৫ সালের পর থেকে ঢাকার চাঁদাবাজির অধিকাংশই তার নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। দেশের সবচেয়ে বেশী অবৈধ অস্ত্রের মজুদও ছিল তার কাছেই। ১৯৯৬ সালে কিসলু হত্যার মধ্য দিয়ে পেশাদার খুনে হাতেখড়ি হয় কালা জাহাঙ্গীরের। এরপর একে একে তার হাতে খুন হতে থাকে ওয়ার্ড কমিশনার, আইনজীবী থেকে শুরু করে রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব এবং নামকরা ব্যবসায়ীও। সেসময়ে ঢাকা শহরে অধিকাংশ চাঞ্চল্যকর খুনগুলোর হোতা ছিলেন জাহাঙ্গীর।

ইন্টারপোলের ওয়েবসাইটে কালা জাহাঙ্গীরের প্রোফাইল

পিচ্চি হান্নানের আর কালা জাহাঙ্গীর একসাথে সরাসরি অংশ নেন কমিশনার শাহাদাত, এডভোকেট হাবিব মণ্ডল ও আদালত পাড়ায় মুরগী মিলনের কিলিং মিশনে। তবে সবচেয়ে আলোড়ন তোলা ঘটনাটি ছিল কমিশনার সাইদুর রহমান নিউটন হত্যা। জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় সংসদের সাবেক সহ-সভাপতি ও ঢাকা সিটি কর্পোরেশন আট নং ওয়ার্ডের কমিশনার নিউটন নিজেই ছিলেন প্রবল ক্ষমতাধর এক নেতা। নিউটনের নির্বাচিত মিরপুর এলাকা নিয়ে তার সাথে বিরোধ চলে আসছিলো আন্ডারওয়ার্ল্ডের শীর্ষ সন্ত্রাসীদের সাথে। এর চূড়ান্ত রূপই দেখা যায় ২০০২ সালের ১০ই মে।

সেদিন নিউটনের ভাইয়ের বিয়ের অনুষ্ঠান ছিল। সে উপলক্ষে তিনি ধানমন্ডি ২৭ নম্বরের অর্কিড প্লাজার শীতল হেয়ার ড্রেসারে যান চুলে কলপ করতে। বেলা তখন সাড়ে এগারোটা, অর্কিড প্লাজা রাজধানীর ব্যস্ততম মার্কেট গুলোর একটি। নিউটন সেলুন থেকে বের হয়ে সিঁড়ির সামনে আসা মাত্রই শুরু হয় চার দিক থেকে গুলিবর্ষণ। চার পাঁচজন অস্ত্রধারীর নিশানায় পরিণত হয়ে লুটিয়ে পড়েন নিউটন।  কিন্তু গুলি করা বন্ধ করেনি ঘাতকরা। একটি, দুটি নয় প্রায় বাইশটি গুলি এফোঁড় ওফোঁড় করে দেয় নিউটনের শরীর। এরপর নিউটনের মাইক্রোবাসটিকে লক্ষ করে কয়েক রাউন্ড গুলি চালিয়ে উধাও হয়ে যায় সন্ত্রাসীরা। মাত্র দেড় মিনিটে শেষ হয়ে যায় দুর্ধর্ষ এই কিলিং মিশন।

এ ঘটনা দেশ জুড়ে ভীষণ আলোড়ন তুলে। সরকার সমর্থিত ক্ষমতাধর একজন ওয়ার্ড কমিশনারকে এভাবে দিনে দুপুরে খুন করা তার ওপর আবার এ মিশনে সরাসরি অংশ নিয়েছিল শীর্ষস্থানীয় সব গ্যাংস্টার। কালা জাহাঙ্গীর, শাহাদাত সহ আরো বেশ কয়েকজনের উপস্থিতি ভাবিয়ে তোলে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীকে। নিউটন হত্যা মামলায় প্রথমে কালা জাহাঙ্গীর সহ কয়েকজনকে ফাঁসির আদেশ দেয়া হয়। পরবর্তীতে এ সাজা কমিয়ে আনা হয় যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে।

সরকার ২০০১ সালে ২৩ জন শীর্ষ সন্ত্রাসীর যে তালিকা প্রকাশ করে তাতে কালা জাহাঙ্গীরের নাম ছিল সবার শীর্ষে। এরপর র‍্যাব গঠন এবং আন্ডারওয়ার্ল্ডের টালমাটাল অবস্থায় ধীরে ধীরে আত্মগোপনে চলে যান জাহাঙ্গীর। তার অন্তর্ধান সম্পর্কে রটতে হতে শুরু করে একের পর এক গুজব। এরমধ্যে সবচেয়ে প্রচারিত গুজবটি ছিল এক সময়কার বন্ধু পিচ্চি হান্নানের হাতে তার খুন।

পিচ্চি হান্নান। Image Source: বাংলাদেশ প্রতিদিন

কথিত আছে আরেক সন্ত্রাসী নিটেলের বাসায় তাকে গুলি করে খুন করেন হান্নান। এসময় সাহেব আলী নামে আরেক গ্যাংস্টারও উপস্থিত ছিলেন। কালা জাহাঙ্গীর বেশ কয়েকজন প্রভাবশালী রাজনীতিবিদের ঘনিষ্ঠ ছিলেন। পরবর্তীতে র‍্যাবের ক্রসফায়ারে একই সময়ে পিচ্চি হান্নান, নিটেল আর সাহেব আলী নিহত হলে এর সাথে কালা জাহাঙ্গীরের মৃত্যুর যোগসূত্র খোঁজেন অনেকে।

তার মৃত্যু নিয়ে আরেকটি গুজব ছিল তার আত্মহত্যা। এটি জানা যায় তার একসময়কার ঘনিষ্ঠ সহযোগী রামপুরার সন্ত্রাসী শাহজাদার কাছ থেকে। ২০১০ সালে শাহজাদাকে গ্রেফতার  করে পুলিশ। জেরার মুখে সে জানায় ২০০৩ সালের ১৫ই ডিসেম্বর নিজ মাথায় গুলি ঠেকিয়ে আত্মহত্যা করেন জাহাঙ্গীর। পরে তাকে গুলশানের কড়াইলে একটি কবরস্থানে দাফন করা হয়। এ সংবাদ আবার সে জেনেছে তার আরেক সন্ত্রাসী লম্বা শামীমের কাছে যে কালা জাহাঙ্গীরের দাফনের সময় উপস্থিত ছিল।

তবে এ সংবাদটি ঠিক বিশ্বাসযোগ্য নয় বলেই মনে করে পুলিশ। পুলিশকে বিভ্রান্ত করতেই অনেক সময় সন্ত্রাসীরা মৃত্যু সংবাদ প্রচার করে থাকা। তাছাড়া কালা জাহাঙ্গীর একসময় তার এক আত্মীয়ের কাছে বলছিলেন, “প্রতিকূল পরিবেশ হলে আন্ডারওয়ার্ল্ডের টপ হিরোদের তিনটি পথ বেছে নিতে হয়, আজীবন জেলে থাকা, না হয় প্রতিপক্ষের হাতে খুন হওয়া অথবা দেশ ত্যাগ করা। এ ছাড়া চতুর্থ কোনো পথ আর খোলা নেই। যারা ভীরু তারা কোনো কিছু না বুঝে আত্মহত্যা করেন। তাই তার আত্মহত্যা করা নিয়ে সন্দেহ থেকেই যায়।

আরেক সূত্রের খবর যশোরের সীমান্তবর্তী এলাকায় প্রতিপক্ষের হাতে খুন হন জাহাঙ্গীর। খুন করার পর এসিড দিয়ে তার মুখ ঝলসে দেয়ায় তাকে চিনতে পারেনি কেউ। তবে এসব কেবল গুজব হয়েই আছে। সম্পূর্ণ তথ্য প্রমাণ ছাড়া পুলিশ তাকে নিহত ঘোষণা করতে পারে না বলে এখনো তাদের তালিকায় জীবিত হিসেবেই আছেন তিনি। অনেকের আবার দৃঢ় বিশ্বাস কালা জাহাঙ্গীর আসলেই জীবিত। পরিচয় গোপন করে এখন ভিনদেশে আছেন। স্ত্রী-সন্তান আর ব্যবসা-বাণিজ্য নিয়েই সুখেই আছেন রহস্যময় এই ডন।

কালা জাহাঙ্গীর নিজেকে ঘিরে যে রহস্যের গোলকধাঁধা সৃষ্টি করে গেছেন তা এখনো গোয়েন্দাদের বিভ্রান্তিতে ফেলে দেয়। তার অন্তর্ধানে নিশ্চিত হয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ও ফেলতে পারেনি সাধারণ মানুষ।  এ গ্যাংস্টারের নাম শুনলে এখনো তাদের বুকের রক্ত হিম হয়ে যায়। দেশের ইতিহাসে তিনি আজও এক অমিমাংসীত রহস্যের নাম।

This article is in Bangla language. It's about bangladeshi mysterious don kala jahangir. 

References:

1.  bd-pratidin.com/first-page/2015/08/05/97829

2.  bd-pratidin.com/last-page/2015/05/30/84356

3. sufiande.blogspot.com/2014/05/blueprint-for-crossfire-deaths.html

4.  bd-pratidin.com/last-page/2015/08/07/98271

Featured Image: tayyar.org

Related Articles