Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

মেগাসিটি ঢাকার ৬টি ফ্লাইওভার

বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ মেগাসিটি হিসেবে পৃথিবীর বুকে অনেক আগেই জায়গা করে নিয়েছে ঢাকা। সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে প্রতিনিয়ত হয়ে উঠছে আধুনিক। বাড়ছে জীবনযাত্রার মান, উত্থিতি ঘটছে মানুষের। ভাগ্যের অন্বেষণে অবিরতভাবে বাড়ছে মানুষের চাপ। কাজের প্রয়োজনে মানুষ ছুটছে দণ্ডে দণ্ডে, বৃদ্ধি পাচ্ছে যানবাহন। কিন্তু গাড়ি বৃদ্ধির অনুপাতে সরণির বিস্তৃতি না হওয়ায় স্থবির হচ্ছে গতি। যারপনাই ফ্লাইওভার বা উড়ালসেতু হয়ে উঠছে নির্ভরযোগ্য বিকল্প এক মাধ্যম। সময় বাঁচাতে উড়ালসেতু রাখছে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। চলুন দেখে আসি এসব গুরুত্বপূর্ণ উড়ালসেতুর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনের নেপথ্যের গল্প।

১) মহাখালী উড়ালসেতু

সর্বপ্রথম খিলগাঁও উড়ালসেতুর নির্মাণ কাজ শুরু করা হলেও মহাখালী উড়ালসেতুর নির্মাণ কাজ আগে শেষ হয় এবং খিলগাঁও উড়ালসেতুর আগেই উদ্বোধন হয়। যে কারণে মহাখালী উড়ালসেতুকেই দেশের প্রথম উড়ালসেতু হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া যায়।

মহাখালী উড়াল-পথের নির্মাণ কাজ শুরু হয় ২০০১ সালের ডিসেম্বরে এবং যানবাহন চলাচলের জন্য খুলে দেয়া হয় ২০০৪ সালের নভেম্বরে। ১৯টি শক্তিশালী স্তম্ভের সাহায্য নির্মিত এ উড়ালসেতুর দৈর্ঘ্য ১.১২ কিলোমিটার। যানবাহন চলাচলের জন্য উভয় পাশে ৭.৫ মিটার চওড়া রাস্তা এবং ০.৬ মিটার ফুটপাত রয়েছে। প্রায় ১৯ মিলিয়ন মার্কিন ডলার ব্যয়ে উড়ালসেতুটির নির্মাণ কাজ শেষ করতে সময় লেগেছে প্রায় তিন বছর।

মূলত মহাখালী রেলক্রসিংয়ের জ্যাম নিরসনের উদ্দেশ্যে উড়ালসেতুটি নির্মাণ করা হয়েছিল। এটি বিএএফ শাহিন কলেজের একটু সামনে থেকে শুরু হয়ে কাকলীতে গিয়ে শেষ হয়েছে। আগে মাহখালীতে ক্রসিং-এর জ্যামের মধ্যে হাজার হাজার ঘণ্টা অতিবাহিত করতে হতো আর  উড়ালসেতুটি হওয়ায় প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ রেলক্রসিং-এর জ্যাম থেকে মুক্তি পেয়ে যায় কয়েক মিনিটেই।

সন্ধ্যাকালীন অবকাশ যাপনের জন্য কিংবা পথিকের উদাসী পথের সঙ্গি হিসেবে মহাখালী উড়ালসেতুর ফুটপাতদ্বয় একেবারেই মন্দ নয়। তাই অনেকেই নিন্তান্তই হাঁটাচলার জন্য প্রায়শ এখানে এসে থাকেন।

মহাখালী উড়ালসেতু; source: bdchronicle.com

২) খিলগাঁও উড়ালসেতু

খিলগাঁও উড়ালসেতু ঢাকার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এবং ব্যস্ত একটি উড়ালসেতু। এটি একদিকে রাজারবাগকে সংযুক্ত করেছে অন্যদিকে মালিবাগকে এবং তৃতীয় দিকে সায়েদাবাদকে। ২০১৬ সালে নির্মাণকৃত আরেকটি লুপ  মাদারটেক, কদমতলী, বাসাবো ও সিপাহীবাগকেও যুক্ত করেছে উড়ালসেতুর সাথে।

১.৯ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের এ উড়ালসেতুর নির্মাণকাজ শুরু  হয় ২০০১ সালে এবং সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত হয় ২০০৫ সালের মার্চ মাসে। ১৪ মিটার চওড়া খিলগাঁও উড়ালসেতু নির্মাণে ব্যয় হয় প্রায় ৮১.৭৫ কোটি টাকা। এটি নির্মাণের ফলে খিলগাঁও রেল ক্রসিংয়ের জ্যামের পরিমাণ কিছুটা প্রশমিত হয়েছে। কেননা এ রেলক্রসিং দিয়ে প্রতিদিন প্রায় ৭২ বার ট্রেন যাতায়াত করে থাকে। প্রতিবার ৫ মিনিট করে ধরলেও দিনে প্রায় ছ’ঘণ্টা ট্রেনের যাতায়াতের কারণে রাস্তাটি বন্ধ হয়ে থাকে। উড়ালসেতুটি হবার আগে অনেককেই প্রতিদিন এই ছ’ঘণ্টা আটকে থাকা লাগতো এই ক্রসিংয়ে। বর্তমানে উড়ালসেতুতে করে এই ক্রসিংটি পার হতে সময় লাগে এক/দুই মিনিট।

খিলগাঁও উড়ালসেতুর ইউ লুপ; source: flickr.com/crysisrubel

৩) বিজয় সরণি উড়ালসেতু

রাজধানীর বিজয় সরণিতে বহুল আলোচিত র‌্যাংগস ভবন ভাঙার কাজ শুরু করার মাধ্যমে ২০০৭ সালে বিজয় সরণি-তেজগাঁও সংযোগ সড়ক নির্মাণের কাজ শুরু হয়। ১ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের এ সড়কের ০.৭ কিলোমিটার অংশে রয়েছে উড়ালসেতু। তেজগাঁও রেলক্রসিং থেকে যানবাহনকে মুক্ত করতে এবং ঢাকার পূর্ব দিকের সাথে কেন্দ্রের যোগাযোগ স্থাপন করতে এই উড়ালসেতু বানানো হয়েছে।

সোডিয়াম বাতির আলোতে সজ্জিত সম্পূর্ণ সড়কটি নির্মাণে সর্বমোট ব্যয় হয়েছে ১১৪ কোটি টাকা। জমি অধিগ্রহণ বাবদ ৬৯ কোটি টাকা আর সড়ক নির্মাণে  তিন কোটি ৫৮ লাখ এবং রেলক্রসিংয়ের জন্য উড়ালসেতু নির্মাণে ব্যয় হয় ৩৮ কোটি ৯৫ লাখ টাকা। ২০১০ সালের এপ্রিলে এটি জনগণের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হয়।

উড়ালসেতুটি বিজয় সরণির সাথে গুলশান, তিব্বত এবং সাত রাস্তাকে সংযুক্ত করেছে। এই রাস্তায় আগে ভ্রমণ করতে হলে অনেকটা পথে ঘুরে যেতে হতো, এতে অনেক দুর্ভোগ পোহাতে হতো মানুষকে। উড়ালসেতুটি এসব ভোগান্তির অবসান করেছে। এসবের পাশাপাশি শুটিং স্পট কিংবা ফটোগ্রাফির উপযুক্ত স্থান হিসেবে বেশ সুনাম কুড়িয়েছে এই বিজয় সরণি উড়ালসেতু।

বিজয় সরণি উড়ালসেতু; source: picssr.com/photographybymeersadi

৪) কুড়িল উড়ালসেতু

চারটি লুপের সমন্বয়ে তৈরি কুড়িল উড়ালসেতু ঢাকার অন্যতম দৃষ্টিনন্দন একটি সড়ক। বিশেষ করে রাতের ঝলমলে আলোতে কুড়িল উড়ালসেতুর সৌন্দর্য আরও বর্ধিত হয়। স্থানীয় অনেক মানুষ সন্ধ্যাকালীন অবকাশ যাপনের জন্য এখানে এসে থাকেন।

৩.১ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের কুড়িল উড়ালসেতুর চারটি লুপ দিয়েই ওঠা-নামা করা যায়। এই লুপগুলো হলো বনানী, কুড়িল, খিলক্ষেত ও পূর্বাচল প্রান্তে। প্রথমে এর নির্মাণ ব্যয় ২৫৪ কোটি টাকা ধরা হলেও নির্মাণকাজ শেষে ব্যয় বেড়ে ৩০৩ কোটি টাকায় গিয়ে থামে। এর সম্পূর্ণ অর্থায়ন করা হয় রাজউকের নিজস্ব তহবিল থেকে। ৬৭টি পিলারের ওপর দাঁড়িয়ে থাকা এ উড়ালসেতুর উচ্চতা ৪৭.৫৭ ফুট এবং প্রস্থ ৩০.১৮ ফুট। উড়ালসেতুটি নির্মাণের ফলে রাজউকের শহর পূর্বাচল মূল ঢাকার সাথে সংযুক্ত হতে পেরেছে। নব্যনির্মিত ৩০০ ফিট রাস্তা দিয়ে মূল ঢাকা থেকে  ঢাকা-চট্টগ্রাম, সিলেট ও ময়মনসিংহ সড়কে চলে যাওয়া যাবে জ্যামকে উপেক্ষা করে। ২০১০ সালের মে মাসে শুরু হওয়া এই উড়ালসেতুর নির্মাণ কাজ শেষ হয় ২০১৩ সালের আগস্টে। সরকারিভাবে এটি কুড়িল বহুমুখী উড়ালসেতু নামে পরিচিত।

রাতের ঝলমলে আলোতে কুড়িল উড়ালসেতু; source: flickr.com/photographybymeersadi

৫) মেয়র হানিফ উড়ালসেতু

প্রায় ১১.৭ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের মেয়র মোহাম্মদ হানিফ উড়ালসেতু বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় উড়ালসেতু। ১৯৯৮ সালে এই উড়ালসেতু তৈরি হবার কথা থাকলে ১৫ বছর পর উড়ালসেতুটি পূর্ণতা পায়। ১০০ বছর আয়ুর এ উড়ালসেতুর কারণে উপকৃত হচ্ছেন দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের প্রায় ৩০টি জেলার জনগণ। ২০১০ সালের জুনে এর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হয় এবং ২০১৩ সালের অক্টোবরে সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হয়।

উড়ালসেতুটির লেন সংখ্যা চারটি এবং এতে প্রবেশের জন্য পথ রয়েছে ছয়টি। মোট ওঠা-নামার পথ রয়েছে ১৩টি। মেয়র হানিফ বা যাত্রাবাড়ী উড়ালসেতুর প্রতি কিলোমিটার নির্মাণ ব্যয় হয়েছে ২৩০ কোটি টাকা এবং সম্পূর্ণ প্রকল্পে খরচ হয়েছে ২,৩০০ কোটি টাকারও বেশি, যা দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সর্বোচ্চ ব্যয়ে নির্মিত। নির্মাণ ব্যয় তুলে নেবার প্রক্রিয়া হিসেবে টোল প্লাজা বসানো হয়েছে এ উড়ালসেতুতে। নির্মাণের পর থেকে ২৪ বছর পর্যন্ত চলবে টোল উঠানোর কাজ। তারপর এটি চলে যাবে সিটি কর্পোরেশনের দায়িত্বে।

আগে ডেমরা, শনিরআখড়া, যাত্রাবাড়ীগামী যাত্রিদের ভোগান্তির শেষ ছিল না। যাত্রাবাড়ী মোড় পর্যন্ত মাত্র দুই/তিন কিলোমিটার রাস্তা পার হতেই লেগে যেত প্রায় দেড়-দুই ঘণ্টা। আর এখন লাগে মাত্র পাঁচ থেকে দশ মিনিট। ঢাকার প্রবেশ মুখে তৈরি এ উড়ালসেতুটি প্রতিদিন প্রায় লাখখানেক মানুষের যাতায়াতের নির্ভরযোগ্য রুট হয়ে উঠেছে।

মেয়র মোহাম্মদ হানিফ উড়ালসেতু; source: orion-group.net

রাতের আলোতে আকর্ষণীয় মেয়র হানিফ উড়ালসেতু; source: flickr.com/photographybymeersadi

৬) জিল্লুর রহমান উড়ালসেতু

ঢাকার যাতায়াত ব্যবস্থায় যুগান্তকারী পরিবর্তন এসেছে জিল্লুর রহমান উড়ালসেতুর মাধ্যমে। আগে মিরপুর থেকে এয়ারপোর্ট যাতায়াত করতে গেলে বিজয় সরণি ঘুরে মহাখালী হয়ে তারপর এয়ারপোর্ট যেতে হতো। মিরপুর থেকে এয়ারপোর্টগামী একজন যাত্রীর ন্যূনতম দু-তিন ঘণ্টা সময় লেগেই যেত। আর জিল্লুর রহমান উড়ালসেতু দিয়ে একই দূরত্ব যেতে সময় লাগছে মাত্র ২০-২৫ মিনিট।

২০১১ সালের জানুয়ারি মাসে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে এই উড়ালসেতুটির কাজ শুরু হয়। নির্ধারিত সময়ের প্রায় তিন মাস আগেই ২০১৩ সালের মার্চে এর নির্মাণকাজ শেষ হয় এবং এটি সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হয়। জিল্লুর রহমান উড়ালসেতুর দৈর্ঘ্য ১.৭৯৩ কিলোমিটার এবং প্রস্থ ১৫.৫২ মিটার। উড়ালসেতুটি নির্মাণ করতে ব্যয় হয়েছে প্রায় ২০০ কোটি টাকা।

জিল্লুর রহমান উড়ালসেতুর চিত্তাকর্ষক দৃশ্য; source: skyscrapercity.com

ঢাকায় আরও বেশ কিছু উড়ালসেতু নির্মীয়মাণ রয়েছে এবং কিছু উড়ালসেতুর নির্মাণকাজ খুব শীঘ্রই শেষ হবে। যদিও যানজট নিরসনে এ ধরনের উড়ালসেতু নির্মাণ করা হচ্ছে, তবে যানজট কতটুকু কমছে তা-ই দেখার বিষয় হিসেবে রয়ে গেছে। কোনো কোনো উড়ালসেতুর বেশ সুফল দেখা দিলেও অনেক উড়ালসেতু শুধুমাত্র রাস্তায় গাড়ির সংখ্যা বাড়াতেই সাহায্য করেছে। এখন দেখার বিষয়, আগামীতে এসব উড়ালসেতু জনগণের দুর্ভোগ কতটা কমাতে পারে!

ফিচার ইমেজ- ফ্লিকার/Meer Sadi

Related Articles