Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

বাংলাদেশে ‘লাল নৌবহর’: চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দরে সোভিয়েত নৌবাহিনীর অভিযান

১৯৭১ সালের মার্চে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ আরম্ভ হয়েছিল মধ্যপ্রাচ্যের বর্ধিতাংশ পশ্চিম পাকিস্তান এবং দক্ষিণ–পূর্ব এশিয়ার বর্ধিতাংশ পূর্ব পাকিস্তানের মধ্যে একটি আঞ্চলিক যুদ্ধ হিসেবে, যেটি ভৌগোলিকভাবে পূর্ব পাকিস্তানে সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু ক্রমে এই যুদ্ধটি একটি অভ্যন্তরীণ যুদ্ধ থেকে ভারতীয়–পাকিস্তানি দ্বিপাক্ষিক যুদ্ধে রূপ নেয় এবং অবশেষে স্নায়ুযুদ্ধের একটি রণাঙ্গনে পরিণত হয়। দুই অ্যাংলো–স্যাক্সন বৃহৎ শক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেন এবং সমাজতান্ত্রিক চীন এই যুদ্ধে পাকিস্তানের পক্ষ অবলম্বন করে, অন্যদিকে ‘স্লাভিক–তুর্কি’ কমিউনিস্ট পরাশক্তি সোভিয়েত ইউনিয়ন প্রাথমিকভাবে পাকিস্তানের ভৌগোলিক অখণ্ডতাকে সমর্থন করলেও পরবর্তীতে ভারতের পক্ষ অবলম্বন করে এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামকে সমর্থন জানায়।

১৯৭১ সালের ডিসেম্বরে বাংলাদেশের দক্ষিণ সীমান্তবর্তী বঙ্গোপসাগর অঞ্চল ভারতীয় ও সোভিয়েত নৌবাহিনীর হ্রদে পরিণত হয়। ১৯৭১ সালের ৩ ডিসেম্বর থেকে ভারতীয়–পাকিস্তানি নৌযুদ্ধ পূর্ণমাত্রায় আরম্ভ হয়। পূর্ব পাকিস্তান/বাংলাদেশে মোতায়েনকৃত পাকিস্তানি নৌবাহিনী ছিল অত্যন্ত দুর্বল এবং যুদ্ধের প্রথম দিন থেকেই ভারতীয় নৌবাহিনীর ব্রিটিশ–নির্মিত বিমানবাহী জাহাজ ‘আইএনএস বিক্রান্ত’ (INS Vikrant) পূর্ব পাকিস্তানকে অবরোধ করে রাখে। ভারতীয় বিমানবাহিনীর প্রবল বোমাবর্ষণে পাকিস্তানি নৌবাহিনীর বেশ কয়েকটি নৌযান সমুদ্রগর্ভে নিমজ্জিত হয়, এবং একই সঙ্গে কর্ণফুলী নদীর তীরে অবস্থিত চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর এবং মংলা ও পশুর নদীর সংযোগস্থলে অবস্থিত মংলা সমুদ্রবন্দর ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পূর্ব পাকিস্তানের ওপর আরোপিত ভারতীয় নৌ অবরোধ অকার্যকর করার উদ্দেশ্যে পাকিস্তানি নৌবাহিনী পশ্চিম পাকিস্তান থেকে মার্কিন–নির্মিত ডুবোজাহাজ ‘পিএনএস গাজী’কে (PNS Ghazi) পূর্ব পাকিস্তানের উদ্দেশ্যে প্রেরণ করে, কিন্তু এটি পথিমধ্যে রহস্যজনক পরিস্থিতিতে ধ্বংস হয়ে যায়। চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দরে ভারতীয় নৌবাহিনীর সম্ভাব্য প্রবেশ রোধ করার উদ্দেশ্যে পাকিস্তানিরা বন্দর দুটির প্রবেশপথে অসংখ্য মাইন ছড়িয়ে দেয়।

চীন পূর্ব পাকিস্তানে ভারতীয় হস্তক্ষেপের মৌখিক নিন্দা জানালেও চীনা–ভারতীয় হিমালয় সীমান্তে ভারতীয় সৈন্য মোতায়েন, ‘সাংস্কৃতিক বিপ্লবে’র কারণে চীনের সামরিক ও অর্থনৈতিক দুর্বলতা এবং জিনজিয়াং ও উত্তর–পূর্ব চীনে সোভিয়েত আক্রমণের আশঙ্কা প্রভৃতি কারণে ভারতীয়–পাকিস্তানি যুদ্ধে সামরিকভাবে জড়িত হতে অস্বীকৃতি জানায়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেন সামরিকভাবে বিপর্যস্ত পাকিস্তানের ওপর থেকে ভারতীয় চাপ হ্রাস করার উদ্দেশ্যে বঙ্গোপসাগর ও আরব সাগরে দুটি নৌবহর প্রেরণ করে, এবং পারমাণবিক অস্ত্রবাহী মার্কিন বিমানবাহী জাহাজ ‘ইউএসএস এন্টারপ্রাইজ’ (USS Enterprise) বঙ্গোপসাগরে প্রেরিত নৌবহরের অংশ ছিল। কিন্তু প্রত্যুত্তরে ভ্লাদিভোস্তক থেকে প্রেরিত সোভিয়েত নৌবাহিনীর প্রশান্ত মহাসাগরীয় নৌবহরের ২৬টি নৌযানের সমন্বয়ে গঠিত ‘১০ম অপারেটিভ ব্যাটল গ্রুপ’ (যাদের মধ্যে পারমাণবিক অস্ত্রবাহী ডুবোজাহাজও ছিল) মার্কিন ও ব্রিটিশ নৌবহরকে ঘিরে ফেলে এবং তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ এড়ানোর লক্ষ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেন ভারতীয়–পাকিস্তানি যুদ্ধে অংশগ্রহণ থেকে বিরত থাকে।

১৯৭৪ সালে চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর; Source: Miroslaw Kozlowski/Bangladesh Old Photo Archive/Facebook

ফলে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পূর্ব পাকিস্তানে/বাংলাদেশে মোতায়েনকৃত পাকিস্তানি সৈন্যরা ভারতীয়–বাংলাদেশি যৌথ বাহিনীর কাছে নিঃশর্তভাবে আত্মসমর্পণ করে এবং ১৭ ডিসেম্বর পশ্চিম পাকিস্তানে ভারতীয় ও পাকিস্তানি বাহিনীর মধ্যে যুদ্ধবিরতি হয়। আত্মসমর্পণের মাত্র কয়েক ঘণ্টা আগে পাকিস্তানি নৌবাহিনী পূর্ব পাকিস্তান থেকে লুণ্ঠিত প্রচুর স্বর্ণ ও রৌপ্যালঙ্কার এবং পাকিস্তান জাতীয় ব্যাঙ্কের পূর্ব পাকিস্তান শাখায় মজুদকৃত ৬টি বৃহৎ ট্রাঙ্কভর্তি স্বর্ণ বঙ্গোপসাগরে ডুবিয়ে দেয়

যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের অর্থনীতিকে সচল করার জন্য ধ্বংসপ্রাপ্ত চট্টগ্রাম ও মংলা সমুদ্রবন্দরকে পুনরায় কার্যোপযোগী করে তোলা ছিল নবগঠিত বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশের প্রধান সমুদ্রবন্দর চট্টগ্রাম ছিল বৈদেশিক বাণিজ্যের প্রাণকেন্দ্রস্বরূপ এবং অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্র মংলা সমুদ্রবন্দরও ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু সমুদ্রবন্দর দুটির চারপাশে পাকিস্তানি নৌযান নিমজ্জিত থাকায় এবং মাইনক্ষেত্রের উপস্থিতির কারণে বন্দর দুটিতে নৌযান প্রবেশ ছিল অত্যন্ত বিপজ্জনক। বাংলাদেশের ক্ষুদ্র নৌবাহিনীর সমুদ্রবন্দর দুটিকে নৌযান চলাচলের উপযোগী করে তোলার কোনো সামর্থ্য ছিল না। পশ্চিমা বিশেষজ্ঞরা ধারণা করছিলেন, চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দরকে ব্যবহারোপযোগী করে তুলতে কমপক্ষে ২ থেকে ৩ বছর সময় লাগবে।

প্রাথমিক পর্যায়ে ভারতীয় নৌবাহিনী চট্টগ্রাম বন্দরে মাইন অপসারণের কাজ শুরু করে। নৌযানের পাশাপাশি বন্দরের আশেপাশে বসবাসকারী বেসামরিক জনসাধারণের জন্যও এই মাইনগুলো ছিল বড় ধরনের একটি নিরাপত্তা ঝুঁকি। যেমন: ১৯৭২ সালের প্রথম দিকে এরকম একটি মাইন বিস্ফোরিত হয়ে ১৫ জন বেসামরিক মানুষ নিহত হয়েছিল। কিন্তু মাইন অপসারণের ক্ষেত্রে ভারতীয় নৌবাহিনীর অভিজ্ঞতা ছিল অত্যন্ত সীমিত এবং তাদের মাইন অপসারণকারী জাহাজের সংখ্যা ছিল নিতান্তই অপ্রতুল। বস্তুত এই প্রথম ভারতীয় নাবিকরা ‘জ্যান্ত’ (live) মাইন নিয়ে কাজ করছিল। ক্ষুদ্র ও পুরাতন ভারতীয় মাইন অপসারণকারী জাহাজগুলো মুম্বাইয়ে অবস্থিত তাদের মূল নৌঘাঁটি থেকে ২,৫০০ মাইল দূরে কাজ করছিল এবং সবচেয়ে নিকটবর্তী ভারতীয় নৌঘাঁটি বিশাখাপত্নম ছিল ৬০০ মাইল দূরে। ফলে ভারতীয় নৌবাহিনী রসদপত্র সরবরাহের ক্ষেত্রে চরম অসুবিধার সম্মুখীন হচ্ছিল।

১৯৭২ সালের এপ্রিলে সোভিয়েত নৌবহর চট্টগ্রাম বন্দরে নিমজ্জিত পাকিস্তানি জাহাজ ‘এমভি আল–আব্বাস’কে উদ্ধার করে ‘টো’ করে নিয়ে যাচ্ছে; Source: Bangladesh Old Photo Archive/Facebook

ভারতীয়রা বন্দি পাকিস্তানি নৌ কর্মকর্তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করে মাইনগুলোর অবস্থান ও গভীরতা সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করে। মাইন অপসারণের ক্ষেত্রে নাবিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য তাদেরকে জাহাজগুলোর ওপরের ডেকে অবস্থান করার নির্দেশ দেয়া হয়। অত্যন্ত প্রতিকূল পরিবেশে কাজ করে তারা বেশ কিছু মাইন নিষ্ক্রিয় করতে সক্ষম হয়। কিন্তু চট্টগ্রাম বন্দরে পাকিস্তানিদের সৃষ্ট বিস্তৃত মাইনক্ষেত্রের সম্পূর্ণ অংশ পরিষ্কার করা কিংবা নিমজ্জিত নৌযানগুলোর ধ্বংসাবশেষ উদ্ধার বা অপসারণ করার মতো সামর্থ্য ভারতীয় নৌবাহিনীর ছিল না। ইতোমধ্যে ভারতীয় নৌবাহিনীর একটি মাইন অপসারণকারী জাহাজ ‘আইএনএস বুলসার’ (INS Bulsar) চট্টগ্রাম বন্দরে মাইন অপসারণের সময় একটি মাইন বিস্ফোরিত হয়ে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং বেশ কয়েকজন ভারতীয় নাবিক হতাহত হয়।

তদুপরি, এসময় বাংলাদেশে ভারতীয় সৈন্যদের উপস্থিতি আন্তর্জতিক পরিমণ্ডলে ভারত ও বাংলাদেশের জন্য সমস্যার সৃষ্টি করছিল। ভারতকে ‘বাংলাদেশকে দখল’ করে রাখার দায়ে অভিযুক্ত করা হচ্ছিল এবং বাংলাদেশকে ‘ভারতীয় আশ্রিত রাষ্ট্র’ হিসেবে অভিহিত করা হচ্ছিল, যেটি বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি লাভের ক্ষেত্রে অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছিল। আত্মসমর্পণকারী পাকিস্তানি সশস্ত্রবাহিনীর ভারী অস্ত্রশস্ত্র ও সামরিক সরঞ্জামের প্রায় সম্পূর্ণ অংশ এবং হালকা অস্ত্রশস্ত্রের সিংহভাগ ভারতীয় সৈন্যরা হস্তগত করেছিল এবং বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে লুণ্ঠন চালানোর দায়ে ভারতীয় সৈন্যদের অভিযুক্ত করা হচ্ছিল। বাংলাদেশের কিছু কিছু রাজনৈতিক দল ভারতকে বাংলাদেশে ‘রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সাম্রাজ্যবাদ’ চালানোর দায়ে অভিযুক্ত করছিল। এমতাবস্থায় ভারত বাংলাদেশ থেকে দ্রুত সৈন্য প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে এবং ১৯৭২ সালের মার্চের মধ্যে বাংলাদেশ থেকে সকল ভারতীয় সৈন্যকে প্রত্যাহার করে নেয়া হয়। এর অংশ হিসেবে ভারতীয় নৌবাহিনীকেও বাংলাদেশের সমুদ্রসীমা থেকে প্রত্যাহার করে নেয়া হয়, কিন্তু অল্প কয়েকটি ভারতীয় মাইন অপসারণকারী জাহাজ তখনও চট্টগ্রাম বন্দরে কাজ চালিয়ে যাচ্ছিল।

ইতোমধ্যে বাংলাদেশ চট্টগ্রাম ও মংলা সমুদ্রবন্দরকে ব্যবহারোপযোগী করে তোলার জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সহযোগিতা প্রার্থনা করে। জাতিসংঘ ও প্রাক্তন সোভিয়েত ইউনিয়ন বাংলাদেশের আহ্বানে সাড়া প্রদান করে। জাতিসংঘ কোনো একটি অভিজ্ঞ কোম্পানিকে এই কাজটি দিতে চাচ্ছিল এবং এজন্য তাদের কিছু সময়ের প্রয়োজন ছিল। অন্যদিকে, সোভিয়েত ইউনিয়ন তাৎক্ষণিকভাবে বাংলাদেশকে সহায়তা করতে প্রস্তুত ছিল। ১৯৭২ সালের মার্চের প্রথম সপ্তাহে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সোভিয়েত ইউনিয়ন সফর করেন এবং এসময় সোভিয়েত ইউনিয়ন আনুষ্ঠানিকভাবে চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দরকে ব্যবহারোপযোগী করার কাজে বাংলাদেশকে সহায়তা করার প্রস্তাব করলে বাংলাদেশ প্রস্তাবটি গ্রহণ করে। এই উদ্দেশ্যে ২১ মার্চ ৯ সদস্যের একটি সোভিয়েত প্রতিনিধি দল ঢাকায় আসে এবং বাংলাদেশি কর্তৃপক্ষের সঙ্গে ৩৪ ঘণ্টা আলোচনার পর বাংলাদেশ ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে এই সংক্রান্ত একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।

১৯৭২ সালের মে মাসের মধ্যে ৮০০ সোভিয়েত নাবিক চট্টগ্রাম বন্দরে অবতরণ করেছিল; Source: The Daily Star

১৯৭২ সালের ২ এপ্রিল সোভিয়েত ‘উদ্ধার অভিযানে’র অগ্রবর্তী দল চট্টগ্রাম বন্দরে এসে পৌঁছে। রিয়ার অ্যাডমিরাল সের্গেই জুয়েঙ্কোর নেতৃত্বাধীন ১০০ জন নাবিক ছিল এই দলটির সদস্য। ৪ মে–র মধ্যে ২২টি সোভিয়েত জাহাজ (যেগুলোর মধ্যে ছিল মাইন অপসারণকারী জাহাজ, উদ্ধারকারী জাহাজ ও সহযোগী নৌযান) ও ৭০০ নাবিক বাংলাদেশে এসে পৌঁছে। বাংলাদেশে মোতায়েনকৃত সোভিয়েত নৌবহরটির ২২টি জাহাজ ও ৮০০ নাবিকের সকলেই ছিল সোভিয়েত প্রশান্ত মহাসাগরীয় নৌবহরের অংশ। সোভিয়েতরা বঙ্গোপসাগরে থাকা অবশিষ্ট ভারতীয় জাহাজগুলোর সঙ্গে তাদের কার্যক্রম সমন্বয় করার চেষ্টা করে, কিন্তু ব্রিটিশ–নির্মিত ভারতীয় জাহাজগুলোর সঙ্গে সোভিয়েত জাহাজগুলোর সমন্বয় করা কঠিন হয়ে দাঁড়ায় এবং ১৯৭২ সালের নভেম্বরে অবশিষ্ট ভারতীয় জাহাজগুলোকেও প্রত্যাহার করে নেয়া হয়। ইতোমধ্যে সোভিয়েতরা তাদের কাজ শুরু করে দেয়।

চট্টগ্রাম ও মংলা সমুদ্রবন্দরের বন্দর এলাকা ও তার আশেপাশে ৩০ থেকে ৪০টি পাকিস্তানি নৌযান নিমজ্জিত ছিল। এগুলোর অধিকাংশই ভারতীয় বিমান হামলায় নিমজ্জিত হয়েছিল, বাকিগুলো পাকিস্তানিরা নিজেরাই ডুবিয়ে দিয়েছিল যাতে বন্দরগুলো ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়ে। বন্দরগুলোর চারপাশ মাইনক্ষেত্র দিয়ে বেষ্টিত ছিল। স্বাভাবিক পরিস্থিতিতেই মাইন অপসারণ ও ডুবন্ত জাহাজ উদ্ধার করা অত্যন্ত কঠিন ও ঝুঁকিপূর্ণ কাজ। এক্ষেত্রে সেটি আরো কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। কারণ কর্দমাক্ত ও দূষিত কর্ণফুলী নদীর পানি ছিল অত্যন্ত ঘোলাটে এবং এর ফলে পানির নিচে দৃশ্যমানতা ছিল অত্যন্ত কম। নদীটির তীব্র স্রোতের কারণে সোভিয়েত ডুবুরিরা দৈনিক ৪ বারের বেশি নদীতে নামতে পারত না এবং প্রতিবার ৪০ থেকে ৪৫ মিনিটের বেশি পানির নিচে থাকা তাদের পক্ষে সম্ভব হচ্ছিল না। তদুপরি, সোভিয়েত নাবিকদের জন্য বন্দর দুইটির অত্যন্ত উষ্ণ ও আর্দ্র আবহাওয়ার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেয়া ছিল কঠিন এবং তাদের বসবাসের পরিবেশও তেমন ভালো ছিল না। এই পরিস্থিতির মধ্যে তাদেরকে কাজ করতে হয়েছিল।

নৌযানের ধ্বংসাবশেষ উদ্ধারের জন্য পানির নিচে বিস্ফোরণ ঘটানোর পদ্ধতি ছিল সোভিয়েত নাবিকদের দৃষ্টিতে বেশি কার্যকরী ও দ্রুত পদ্ধতি। কিন্তু চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দর দুটির নিকটবর্তী নদীগুলো ছিল অত্যন্ত সরু এবং সেখানে এই পদ্ধতি প্রয়োগ করলে বন্দরে থাকা জাহাজগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনা ছিল। তদুপরি, এর ফলে নদীগুলোর মাছ ও অন্যান্য জলজ সম্পদ ক্ষতিগ্রস্ত হতো। এজন্য সোভিয়েত নাবিকরা নিমজ্জিত নৌযানগুলো উদ্ধারে অপেক্ষাকৃত পুরাতন ‘ডুবন্ত পুন্টুন’ পদ্ধতি ব্যবহার করে। এই পদ্ধতিটি ছিল অত্যন্ত কঠিন, শ্রমনির্ভর ও সময়সাপেক্ষ। তা সত্ত্বেও ১৯৭২ সালের জুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহের মধ্যে সোভিয়েত নাবিকরা চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দর দুটিতে জাহাজ চলাচলের জন্য উপযোগী একটি প্রণালী সম্পূর্ণরূপে পরিষ্কার করে ফেলতে সক্ষম হয়। তখনো বন্দর দুটিতে অনেক নিমজ্জিত নৌযান ও মাইন ছিল, কিন্তু বন্দর দুটি জাহাজ চলাচলের উপযোগী হয়ে ওঠে। পশ্চিমা বিশেষজ্ঞরা যেখানে অনুমান করেছিলেন যে, বন্দর দুটি ব্যবহারোপযোগী হয়ে উঠতে ২/৩ বছর সময় লাগবে, সেখানে সোভিয়েত নৌবাহিনীর কর্মতৎপরতার ফলে মাত্র ৩ মাসেই বন্দর দুটি জাহাজ চলাচলের উপযোগী হয়ে উঠেছিল। এমনকি, এসময় বন্দর দুটির ধারণক্ষমতা যুদ্ধপূর্ব ধারণক্ষমতার চেয়েও বৃদ্ধি পেয়েছিল

১৯৭৩ সালে চট্টগ্রামে একটি ফুটবল ম্যাচের পর সোভিয়েত নাবিকদের সঙ্গে চট্টগ্রাম বন্দর ফুটবল দলের সদস্যরা; Source: Bangladesh Old Photo Archive/Facebook

১৯৭২ সালের জুলাই থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে সোভিয়েত নৌবাহিনী চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দর থেকে আরো নিমজ্জিত নৌযান উদ্ধার করে ও মাইন অপসারণ করে। ১৫ আগস্টের মধ্যে বন্দর দুটি খুব বড় জাহাজ চলাচলের জন্যও উপযোগী হয়ে ওঠে এবং ২১ অক্টোবরের মধ্যে বন্দর দুইটি থেকে অধিকাংশ মাইন অপসারিত হয়। একই মাসে বাংলাদেশি সরকারের অনুরোধে সোভিয়েত ডুবুরিরা পাকিস্তানিদের ডুবিয়ে দেয়া সম্পদ অনুসন্ধান শুরু করে। কিন্তু ইতোমধ্যে অধিকাংশ ডুবিয়ে দেয়া সম্পদই স্রোতের টানে গভীর সমুদ্রে ভেসে গিয়েছিল বলে ধারণা করা হচ্ছিল এবং পানির নিচে স্বল্প দৃশ্যমানতা ডুবুরিদের জন্য বড় একটি বাধা হিসেবে কাজ করছিল। এই পরিস্থিতিতে সোভিয়েত ডুবুরিরা ৫২.৭৫ তোলা স্বর্ণ, ৭০.০৫ কিলোগ্রাম রৌপ্য এবং ২২ লক্ষ ধাতব মুদ্রা উদ্ধার করতে সক্ষম হয়।

এরপর সোভিয়েত নৌবহরের বেশকিছু জাহাজ প্রত্যাহার করে নেয়া হলেও বাকি জাহাজগুলো তাদের কাজ অব্যাহত রাখে। ১৯৭৩ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে বন্দর দুটি সম্পূর্ণরূপে মাইনমুক্ত হয় এবং বেশ কিছু নিমজ্জিত নৌযান উদ্ধার হয়। এই সময়ই সোভিয়েত নৌবহরকে বাংলাদেশ থেকে সম্পূর্ণরূপে প্রত্যাহার করে নেয়ার কথা ছিল। কিন্তু ১৯৭৩ সালের ২০ ডিসেম্বর বাংলাদেশ ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে আরেকটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় এবং চুক্তি অনুযায়ী সোভিয়েত নৌবহর ১৯৭৪ সালের জুন পর্যন্ত বাংলাদেশে অবস্থান করে আরো কিছু নৌযান উদ্ধার ও বন্দর দুটির পুনর্নির্মাণ কাজে অংশগ্রহণ করতে সম্মত হয়। ১৯৭৪ সালের মার্চের প্রথমদিকে অবশিষ্ট দুইটি সোভিয়েত জাহাজ চট্টগ্রাম বন্দর ত্যাগ করে এবং এর মধ্য দিয়ে নির্ধারিত সময়ের তিন মাস আগেই বাংলাদেশে সোভিয়েত নৌবহরের উপস্থিতির সমাপ্তি ঘটে। ১৯৭৪ সালের ১২ জুন সোভিয়েত নৌবহরটির অবশিষ্ট কর্মীদের অধিকাংশ সোভিয়েত জাহাজ ‘এমভি খাবারভস্কে’ চড়ে চট্টগ্রাম ত্যাগ করে ভ্লাদিভোস্তকের উদ্দেশ্য যাত্রা করে এবং ২৪ জুন বাকিরাও বাংলাদেশ ত্যাগ করে।

প্রায় দুই বছরব্যাপী এই অভিযানে সোভিয়েত নৌবহর চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দর থেকে ২৬টি নিমজ্জিত জাহাজ (মোট ১,০০,০০০ টন ওজনবিশিষ্ট) উদ্ধার করে এবং সেগুলোকে বাংলাদেশের জাহাজ ভাঙন কেন্দ্রে পৌঁছে দেয়। এই জাহাজগুলোর মধ্যে ১৫,০০০ টন ওজনবিশিষ্ট একটি ফ্রেইটার থেকে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র উপকূলীয় জাহাজ ও মালবাহী নৌযান – সব ধরনের জলযানই ছিল। এর পাশাপাশি তারা সমুদ্রবক্ষ থেকে ১,৯০০ টন ধাতব বর্জ্য ও উল্লেখযোগ্য পরিমাণ নিমজ্জিত সম্পদ উদ্ধার করে। চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দরের ১,০০২ বর্গমাইল অঞ্চল তারা সম্পূর্ণরূপে মাইনমুক্ত করে। তদুপরি, সোভিয়েত নৌবহর বাংলাদেশকে ৩টি উদ্ধারকারী নৌযান উপহার দেয় এবং বাংলাদেশ ত্যাগের পূর্বে তাদের ডুবুরি ও অন্যান্য সরঞ্জামও বাংলাদেশকে উপহার হিসেবে প্রদান করে। এই দুই বছরে তারা ৪৪ জন বাংলাদেশি ডুবুরিকে প্রশিক্ষণ প্রদান করে এবং এই ডুবুরিরা ছিল স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম প্রশিক্ষিত ডুবুরি দল। সর্বোপরি, সোভিয়েত ইউনিয়ন এই সবকিছুই করেছিল বিনামূল্যে, যা সদ্যস্বাধীন ও যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের জন্য ছিল অত্যন্ত লাভজনক।

১৯৭৪ সালের জুনে সোভিয়েত নাবিকদের বাংলাদেশ থেকে প্রত্যাবর্তনের সময় বাংলাদেশি জনসাধারণ তাদেরকে বিদায় জানাচ্ছে; Source: Bangladesh Old Photo Archive/Facebook

এই দুই বছরব্যাপী উদ্ধার অভিযান চলাকালে একজন সোভিয়েত নাবিক প্রাণও হারিয়েছিলেন। ইউরি রেদকিন নামক তরুণ সেই সিনিয়র নাবিক ১৯৭৩ সালের ১৩ জুলাই একটি মাইন বিস্ফোরণে নিহত হন। চট্টগ্রামের পতেঙ্গায় অবস্থিত বাংলাদেশ ন্যাভাল অ্যাকাডেমি প্রাঙ্গনে তাকে সমাহিত করা হয়। প্রতি বছর ১৮ ডিসেম্বর রেদকিনের জন্মদিনে চট্টগ্রামে অবস্থিত রুশ কনস্যুলেট জেনারেল, বাংলাদেশ ন্যাভাল অ্যাকাডেমি ও চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের প্রতিনিধিরা রেদকিনের সমাধিতে পুষ্পস্তবক অর্পণ করে তার প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করেন।

সোভিয়েত নৌবহরের বাংলাদেশ ত্যাগের প্রাক্কালে এক বিদায় অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সোভিয়েত ইউনিয়ন ও সোভিয়েত নাবিকদের প্রতি তাদের সহায়তার জন্য বাংলাদেশের পক্ষ থেকে কৃতজ্ঞতা ব্যক্ত করেন। কিন্তু সামগ্রিকভাবে সোভিয়েতদের প্রতি বাংলাদেশি কর্মকর্তাদের মনোভাব ছিল শীতল। সোভিয়েত সহায়তার জন্য তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশের পরিবর্তে বাংলাদেশি কর্মকর্তারা সোভিয়েত নৌবহরের বাংলাদেশ ত্যাগের ফলে বেশি খুশি হয়েছিলেন। বাংলাদেশের চীনপন্থী ও ইসলামপন্থী রাজনৈতিক দলগুলো বাংলাদেশে সোভিয়েত নৌবহরের উপস্থিতি নিয়ে অসন্তুষ্ট ছিল। বাংলাদেশের বিভিন্ন চীনপন্থী রাজনৈতিক দল তদানীন্তন বাংলাদেশ সরকারকে ‘রুশ–ভারতের দালাল’ হিসেবে অভিহিত করেছিল। এর ফলে সোভিয়েত কূটনীতিবিদরা অসন্তুষ্ট হন, কারণ তাদের মতে, সোভিয়েত ইউনিয়ন বিনামূল্যে বাংলাদেশের জন্য এত কিছু করার পরও বিনিময়ে কোনো কৃতজ্ঞতার নিদর্শন পায়নি, বরং তাদের ‘সহায়তা’র জন্যই তাদেরকে দোষারোপ করা হয়েছে!

বাংলাদেশের চীনপন্থী রাজনৈতিক দলগুলো মূলত চীনা–সোভিয়েত দ্বন্দ্বের প্রেক্ষাপটে এবং ইসলামপন্থী দলগুলো সোভিয়েত রাজনৈতিক ব্যবস্থার প্রতি শত্রুভাবাপন্নতার কারণে বাংলাদেশে সোভিয়েত উপস্থিতির বিরোধী ছিল। কিন্তু সোভিয়েত উপস্থিতির প্রতি বাংলাদেশের সরকারি কর্মকর্তাদের অস্বস্তির কারণ আদর্শগত ছিল না, বরং এটি ছিল তাদের ‘রিয়েলপলিটিকে’র (Realpolitik) অংশ। বাংলাদেশে সোভিয়েত নৌবাহিনীর উপস্থিতিকে চীন প্রথম থেকেই নেতিবাচক দৃষ্টিতে দেখছিল। চট্টগ্রামকে সোভিয়েত নৌবাহিনী ভারত মহাসাগরের ওপর নজরদারি করার জন্য একটি ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহার করছিল বলে চীনারা দাবি করে আসছিল। বাংলাদেশি কর্মকর্তাদের ধারণা ছিল, এজন্যই চীন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিতে রাজি হচ্ছিল না। তদুপরি, সোভিয়েতরা বাংলাদেশে একটি স্থায়ী ঘাঁটি নির্মাণ করতে পারে, এই আশঙ্কাও বাংলাদেশি কর্মকর্তাদের মধ্যে ছিল। এজন্য তারা বাংলাদেশে প্রলম্বিত সোভিয়েত উপস্থিতি নিয়ে অস্বস্তিতে ছিলেন।

১৯৭৪ সালে সোভিয়েত ও বাংলাদেশি কর্মকর্তারা ইউরি রেদকিনের সমাধিতে শ্রদ্ধা জানাচ্ছেন; Source: Bangladesh Old Photo Archive/Facebook

বস্তুত এই সময় থেকেই সোভিয়েত–বাংলাদেশি সম্পর্কে এক ধরনের শীতলতা দেখা দেয় এবং ১৯৭৫ সালে বাংলাদেশি রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবের হত্যাকাণ্ডের পর তা চূড়ান্ত রূপ লাভ করে। ১৯৭৫ সালের আগস্টের সামরিক অভ্যুত্থানের পর থেকে বাংলাদেশ চীনা–সোভিয়েত দ্বন্দ্বে স্থায়ীভাবে চীনের পক্ষ অবলম্বন করে। এর মধ্য দিয়ে যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের পুনর্গঠনে সোভিয়েতদের এই অবদান নিমজ্জিত হয় ইতিহাসের গহ্বরে।

সোভিয়েত নাবিকদের বাংলাদেশ থেকে প্রত্যাবর্তনের পর সোভিয়েত সরকার তাদের অনেককে বিভিন্ন পদক ও সম্মাননা প্রদান করে। কিন্তু দীর্ঘদিন যাবৎ বাংলাদেশ তাদেরকে কোনো ধরনের আনুষ্ঠানিক সম্মাননা প্রদান করেনি। অবশেষে দীর্ঘ ৪০ বছর পর ২০১৩ সালের মার্চে বাংলাদেশ চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দর ব্যবহারোপযোগী করে তোলার সঙ্গে জড়িত কয়েকজন সোভিয়েত নাবিককে আনুষ্ঠানিক সম্মাননা প্রদান করে। এই অভিযানে জড়িত দুইজন নাবিক, ভ্লাদিমির মোলচানভ এবং ভিক্তর কোঝুরিন, বাংলাদেশে সোভিয়েত নৌবাহিনীর কার্যকলাপ সম্পর্কে ‘The Fairway Is Clean Again’ নামক একটি বই লিখেছেন।

This is a Bengali article discussing the assistance of soviet naval assistance in Bangladesh in Chattogram and Mongla port after the liberation war of Bangladesh. Necessary references have been hyperlinked.

Related Articles