Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

কোটাই কি বেকারত্বের মূল কারণ?

সম্প্রতি সারা দেশে কোটা সংস্কারের দাবীতে আন্দোলন চলছে। এই আন্দোলন এবারই প্রথম নয়, এর আগেও বহুবার এই দাবীতে আন্দোলন হয়েছে এবং প্রতি বারই হাজারো বেকারের স্বপ্নভঙ্গ হয়েই আন্দোলনের ইতি ঘটেছে। তাহলে কোটাই কি মূল সমস্যা? কোটার কারণেই কি চাকরি হচ্ছে না?

কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলন; ছবিসূত্র: প্রথম আলো/সাইফুল ইসলাম

চাকরির নিশ্চয়তা

পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার ২.১৮ শতাংশের বসবাস বাংলাদেশে। বর্তমানে এর জনসংখ্যা প্রায় ১৬ কোটি ৬০ লাখেরও বেশি, যা জনসংখ্যার পরিমাণের দিক দিয়ে পৃথিবীতে অষ্টম। বিপুল সংখ্যক এই জনগোষ্ঠীর প্রায় অধিকাংশ বসবাস করছে গ্রামে। শহরে বসবাসকারীর সংখ্যাও যে একেবারে কম, তা নয়। দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৩৫% এখন বাস করছে শহরে। এদের বেশিরভাগই জীবিকার তাগিদে শহরমুখী হয়েছে।

জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে পাল্লা দিয়ে বাংলাদেশে বাড়ছে কর্মসংস্থানের অভাব। বর্তমান প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা যে হারে শিক্ষার সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছে, চাকরি ক্ষেত্রে সে হারে সুযোগ মিলছে না। যার ফলে তৈরি হচ্ছে বেকারত্ব। চাকরিক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের পছন্দের তালিকার শীর্ষে রয়েছে বিসিএস। কেননা বিসিএসের মাধ্যমে চাকরি লাভ করলে, তার রয়েছে নিশ্চিত ভবিষ্যৎ। বিশেষ দুর্ঘটনা ব্যতীত সেই চাকরি হারানোর কোনো সম্ভাবনা নেই। পারিপার্শ্বিক সবকিছু বিবেচনা করে বিসিএসের মাধ্যমে প্রাপ্ত চাকরিকে তাই সোনার হরিণ বলা যায়। এখন প্রশ্ন হলো, বিসিএসের দিকে এত আকর্ষণের কারণ কী এবং অন্য চাকরিও নিশ্চয়তাপূর্ণ কিনা?

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) অনুযায়ী, ১৫ বছর বয়স হবার পর থেকে একটি মানুষকে কর্মক্ষম হিসেবে গণনা করা হয়। পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশে কাজ করার উপযুক্ত জনবলের সংখ্যা ছয় কোটি সাত লাখ। এ জনসংখ্যার বিপরীতে বেকারের সংখ্যা মাত্র ২৭ লাখ। অর্থাৎ এই ২৭ লাখ ব্যতীত সকলেই কর্মসংস্থানের আওতায় আছে। পরিসংখ্যান ব্যুরোর এ তথ্য অনুসরণ করে হয়তো মানুষ আশাবাদী হতে পারে। দেশের এই বিপুল পরিমাণ জনগোষ্ঠী বিভিন্ন কাজে নিয়োজিত রয়েছে জানার পর হয়তো অনেকেই তাদের ভবিষ্যৎ চাকরি লাভের দুশ্চিন্তা ছেড়ে দিয়ে নির্বিঘ্নে জীবনযাপন করতে পারে। এবার পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসেবের আরেকটু ভেতরে প্রবেশ করা যাক।

রিপোর্ট অনুযায়ী, কৃষিক্ষেত্রে এখনো বাংলাদেশের কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর সর্বোচ্চ অংশ কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করে। প্রায় দুই কোটি ৭৪ লাখ কৃষিজীবী বছরের বিভিন্ন সময় ফসল উৎপাদন করে থাকে। তবে সারা বছর তাদের কাজের কোনো নিশ্চয়তা তো থাকেই না, বরং প্রাকৃতিক দুর্যোগের ফলে অনেক সময় কাজ নষ্ট হয়ে যায়। সে হিসেবে বছরের তিন-চার মাস তাদের কর্মজীবী বলা যায়। বাকি সময়টা তারা বেকার হিসেবেই পার করে থাকে।

এদের অর্ধেককেও যদি বেকার হিসেবে গণনা করা হয়, তাহলে সংখ্যাটা দাঁড়ায় এক কোটি ৩৭ লাখ। বিবিএসের প্রতিবেদনে পরিবারে কাজ করে এমন এক কোটি ১১ লাখ মানুষকে কর্মক্ষম হিসেবে দেখানো হয়েছে এবং প্রতিবেদনেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, এই কাজের বিনিময়ে তারা কোনো মজুরি পান না। অর্থাৎ বিবিএসের প্রতিবেদন আনুযায়ী, অর্থ উপার্জন না করেও তারা চাকুরিজীবী। বাকিদের মধ্যে দিন মজুরের সংখ্যা এক কোটি ছয় লাখ। দিন মজুর হয়তো কোনো দিন কাজ পায় আবার কোনো দিন পায় না। তখন না খেয়েই দিন কাটাতে হয়। আবার অসুস্থতার কারণেও অনেক সময় কাজ করতে পারে না। সুনির্দিষ্ট  কাজ না থাকার ফলে তাদের কাজের নিশ্চয়তা নেই। প্রচণ্ড অনিশ্চয়তার মধ্যে থেকেই তারা যাপন করে তাদের জীবন।

কর্মক্ষম ১ কোটি ৬২ লাখ মহিলার কথা বলা হয়েছে রিপোর্টে, যাদের বেশিরভাগের চাকরির নিশ্চয়তা নেই বললেই চলে। এছাড়া রয়েছে ভাসমান মানুষরাও। তাদেরকেও কর্মজীবী হিসেবে গণনা করা হয়েছে। তাদের বেশিরভাগই ছোট কাজের মাধ্যমে নিজের কর্মসংস্থান করে নিয়েছে। হয়তো ফুটপাতে কিংবা বড় কোনো গাছের নীচে ব্যবসা পেতে বসেছে, এগুলো ঝড়-বৃষ্টির দিন তো বন্ধ রাখতেই হয়, পাশাপাশি জীবিকা নির্বাহও অনেকটা ভাগ্য নির্ভর হয়ে উঠে।

পরিসংখ্যান ঘেঁটে দেখা যাচ্ছে, পেশাজীবী ৫ কোটি ৮০ লাখ জনসংখ্যার মধ্যে প্রায় ৪ কোটিরই জীবনযাপন সম্পূর্ণ অনিশ্চিত। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও)-এর ধারণা অনুযায়ী এদের সকলেই বছরের কোনো না কোনো সময় বেকার থাকে। তাই এদের পরিপূর্ণ পেশাজীবী বলার আর কোনো সুযোগ থাকে না।

দিন মজুর; source: dw.com

শিক্ষিত বেকার

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর প্রতিবেদন ঘেঁটে দেখা যায়, বাংলাদেশে পড়াশোনা করে বেকার হবার তুলনায় পড়াশোনা না করে বেকার হবার সম্ভাবনা কম। অর্থাৎ দেশের শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর মধ্যেই বেকারত্বের সংখ্যা আশঙ্কাজনকভাবে বেশি। দেশের শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর মধ্যে নয় শতাংশই বেকার। উল্টো পড়াশোনার সুযোগ না পাওয়াদের মধ্যে বেকারত্বের পরিমাণ মাত্র ২.২ শতাংশ। অপ্রিয় হলেও এ কথা সত্য, এদেশে শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণ কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা নেই।

ব্রিটিশ প্রভাবশালী সাময়িকী দ্য ইকোনোমিস্টের এক জরিপে বলা হচ্ছে, বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষিত তথা স্নাতক পাশ ব্যক্তিদের মধ্যে ৪৭%ই পরবর্তীতে বেকার থেকে যাচ্ছে। বিভিন্ন সময়ের বিভিন্ন অনুসন্ধানে দেখা গেছে, প্রতি বছর বাংলাদেশে গড়ে ২৫ লাখের মতো কর্মক্ষম জনগণ কর্মবাজারে প্রবেশ করে। কিন্তু সরকারি কিংবা বেসরকারিভাবে চাকুরির সংখ্যা রয়েছে মাত্র দুই লাখের মতো। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য মতে, প্রতি বছর চাকরি লাভ করে তিন লাখ মানুষ। অর্থনীতি সমিতির আরেক গবেষণায় বলা হয়েছে, প্রতি বছর কর্মক্ষেত্রে যোগ দেয় সাত লাখ মানুষ। অর্থাৎ যদি গবেষণা ফলাফলে সর্বোচ্চ সংখ্যক চাকরি লাভের ফলাফলটিও গ্রহণ করা হয়, তারপরও বেকারের সংখ্যা দাঁড়ায় প্রতি বছর ১৮ লাখ।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরির সামনে চাকরি প্রত্যাশীদের ভিড়; ছবিসূত্র: প্রথম আলো/সাইফুল ইসলাম

আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) তথ্য মতে, দেশে বর্তমানে বেকারত্বের হার ৪.৩৫ শতাংশ। দেশে যে পরিমাণে কর্মক্ষম মানুষের সংখ্যা বাড়ছে সে পরিমাণে কর্মসংস্থান তো বাড়েইনি, বরং কর্মসংস্থান কমে যাচ্ছে। ফলে বৃদ্ধি পাচ্ছে অতিরিক্ত মানুষের চাপ। আইএলও-র গবেষণা প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশে প্রতি বছর ২৭ লাখ কর্মক্ষম ব্যক্তি চাকরি উপযুক্ত হয়ে উঠছে, আর এর বিপরীতে কাজ পাচ্ছে মাত্র সাত শতাংশ বা এক লাখ নব্বই হাজার। অর্থাৎ প্রায় ২৫ লাখ মানুষ প্রতি বছর বেকার তালিকাভুক্ত হচ্ছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর গবেষণায় বর্তমান বেকারের সংখ্যা ২৭ লাখ হলেও আইএলও বলছে পরিমাণটা আরো অনেক বেশি। তাদের পরিসংখ্যানে, বেকারত্বের পরিমাণ বৃদ্ধি পাওয়া সেরা ১২টি দেশের মধ্যে একটি হলো বাংলাদেশ এবং ২০১৫ সালের হিসেবে বাংলাদেশে বেকারের সংখ্যা প্রায় তিন কোটি!

নতুন সমস্যা সৃষ্টি

বেকারত্বের ফলে সমাজে সৃষ্টি হচ্ছে আরও নানাবিধ সমস্যা। একথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, বর্তমান সমাজে একজন বেকারকে বোঝা হিসেবেই বিবেচনা করা হয়। যেখানে প্রতিটি পরিবার ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা করায় যেন তারা স্বনির্ভর হয়ে উঠতে পারে, সেখানে পড়াশোনা শেষ করেও পরিবারের ওপর নির্ভর করে থাকা শিক্ষিত মানুষের জন্য অপমানজনকও বটে। দিনশেষে বেকারত্বের দায় কিন্তু সরাসরি রাষ্ট্রের ওপরেই বর্তায়।

তরুণ শিক্ষিত প্রজন্মের মধ্যে ভর করছে হতাশা; Source: karobardaily.com

দেশে যে ধরনের শিক্ষা ব্যবস্থা চালু রয়েছে, তার অধিকাংশেরই কর্মসংস্থান নেই। অনেক বিষয়ে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠদান করা হয়ে থাকে, যেগুলোর সাথে সম্পৃক্ত চাকরির কোনো শাখাই এদেশে নেই। এ বিষয়ে জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়ন কমিটির সহ-চেয়ারম্যান ও অর্থনীতিবিদ ড. কাজী খলীকুজ্জমান বলেন,

“বাংলাদেশে দিন দিন শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা বাড়ার অন্যতম কারণ ইন্ডাস্ট্রির সঙ্গে উচ্চশিক্ষার কোনো সমন্বয় নেই। কোন সেক্টরে কত লোক প্রয়োজন তার পরিসংখ্যান তো দূরে থাক, কোনো ধারণা পর্যন্ত নেই। অর্থনৈতিক গতির সঙ্গে শিক্ষার কোনো সমন্বয় না থাকা শিক্ষিত বেকারত্ব বাড়ার অন্যতম কারণ।”

অর্থাৎ সরকারের কাছে নির্ধারিত কোনো রূপরেখা না থাকার ফলে বেকারত্বের পরিমাণ এরকম আশঙ্কাজনক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। দেশের রাজনৈতিক অস্থিরতাও বেকারত্ব বৃদ্ধির জন্য দায়ী। বাংলাদেশ এমপ্লয়ার্স ফেডারেশনের তথ্যমতে, রাজনৈতিক প্রতিহিংসা এবং অস্থিরতার ফলে বিভিন্ন সময়ে কল-কারখানা বন্ধ হয়ে প্রায় ১০ লাখেরও বেশি মানুষ চাকরিচ্যুত হয়েছে। গত তিন বছরে প্রতিযোগিতার বাজারে থেকে নিজেদের গুটিয়ে নিয়েছে প্রায় ছয়শ’রও অধিক গার্মেন্টস কারখানা। আরো প্রায় তিনশ’র মতো শিল্প কারখানা রয়েছে বন্ধের দ্বারপ্রান্তে।

ঢাকার বাইরে বিভিন্ন স্থানে নতুন শিল্পায়নের নামে পুরনো কারখানাগুলো বন্ধ হয়ে যাওয়ার ফলে কাজ হারিয়েছে ব্যাপক পরিমাণ জনগোষ্ঠী। আবার অনেক বিদেশি কাজ করছে বাংলাদেশের বড় বড় সেক্টরগুলোর বড় বড় পদে। এতে বঞ্চিত হচ্ছে এদেশের উচ্চ শিক্ষিতরা। এসব কিছুর পাশাপাশি দুর্নীতি তো আছেই!

দুর্নীতির কারণে অনেকের চাকুরি হয় না; source: express.co.uk

শুরুতে দুটো প্রশ্ন রাখা হয়েছিলো, তাহলে কোটাই কি মূল সমস্যা? কোটার কারণেই কি চাকুরি হচ্ছে না? কোটা ব্যবস্থা মূলত অনগ্রসর কোনো জনগোষ্ঠীকে সুযোগ দেয়া এবং একইসাথে কয়েক বছরের মধ্যে তাদের অগ্রসর করে তোলার ব্যবস্থা করা। কিন্তু তা না করে কোটার পরিমাণ বৃদ্ধি করে গেলে সেসব জনগোষ্ঠী কখনো অগ্রসর হবে না। চাকুরি ক্ষেত্রে কোটা সমস্যা সংস্কার করা যেমন প্রয়োজন, পাশাপাশি নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি তার চেয়ে আরো অনেক বেশি প্রয়োজন। কোটা সংস্কার করলে হয়তো কিছু সাধারণের ভাগ্যে চাকরি মিলবে, কিন্তু সামগ্রিকভাবে নতুন কর্মসংস্থান বাড়বে না। অর্থাৎ চাকরির পরিমাণ যা ছিল, তা-ই থাকবে এবং বেকারের পরিমাণও পরিবর্তিত হবে না। তাই বেকারত্ব সমস্যার সমাধানে নতুন কর্মসংস্থান বৃদ্ধির বিকল্প কিছুই নেই।

ফিচার ইমেজ- ফিনান্সিয়াল ট্রিবিউন

Related Articles