Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

ঢাকার জলাবদ্ধতা সমস্যা এবং নিরসনে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ

সম্প্রতি জলাবদ্ধতা ঢাকা শহরের অন্যতম একটি বিরাট সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। মাত্র দু’ঘণ্টার ঝুম বৃষ্টিতে তলিয়ে যায় ঢাকার অনেক এলাকা। কোথাও দেড় থেকে দুই ফুট, কোথাও প্রায় হাঁটুপানি আবার কোনো কোনো অলি-গলিতে কোমর পর্যন্ত পানি উঠে পড়ে। আর এই পানি নেমে যেতে তিন ঘণ্টা থেকে শুরু করে অনেক ক্ষেত্রে এক/দু’দিনও লেগে যায়। এই জলজটের মধ্য দিয়ে রাস্তায় গাড়ি/রিকশা সহ অন্যান্য যানবাহন চলাচল করে। কখনো কখনো এসব যানবাহনের ভেতরেও পানি ঢুকে যায়। ঢাকা শহরের আধুনিকায়নের সাথে সাথে বাড়ছে জলাবদ্ধতার পরিমাণ এবং সমানুপাতিক হারে বাড়ছে রাস্তায় যানজট এবং মানুষের ভোগান্তি।

ঢাকার জলাবদ্ধতার কারণ

ঢাকার অবকাঠামোগত পরিবর্তন হলেও বিগত কয়েক দশকে জলবায়ু এবং পরিবেশগত খুব বেশি পরিবর্তন সাধিত হয়নি। তারপরও বিগত কয়েক দশকের চাইতে বর্তমানে ঢাকার জলাবদ্ধতা সমস্যা সবচেয়ে প্রকট আকার ধারণ করেছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, ঢাকার পার্শ্ববর্তী প্রায় সবকটি নদী দখলদারদের হাতে চলে গেছে। এ কারণে নদী হারিয়েছে তার প্রাণ। এছাড়া ঢাকায় আশেপাশে প্রায়শই বিভিন্ন ধরনের ছোট-বড় খালের দেখা পাওয়া যেত যা এখন আর একেবারেই দৃষ্টিগোচর হয় না। এসকল কারণে পানি নেমে যাবার মতো জায়গা পায় না, যার ফলে সৃষ্টি হয় জলাবদ্ধতা। এ ব্যাপারে বুয়েটের আরবান অ্যান্ড রিজিওনাল প্ল্যানিং বিভাগের প্রধান ইশরাত ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন,

“ঢাকায় বৃষ্টির পানি সরে যাওয়ার প্রাকৃতিক ব্যবস্থাটি নষ্ট হয়ে গেছে। আগে শহরজুড়ে খাল ছিল। বৃষ্টির পানি খাল দিয়ে নদীতে চলে যেত। এখন নদীগুলো দখল আর খালগুলো সব ভরাট হয়ে গেছে। বাড়ির সামনে খোলা জায়গা বা উঠান ছিল, যেখানে বৃষ্টির পানি মাটি শুষে নিত। এখন মাটিও পাকা করে ফেলা হয়েছে।”

ঢাকায় দখল এবং ভরাটের তালিকায় ২৮টি নদী; source : kalerkantho.com

ঢাকার দুর্বল পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থাও জলাবদ্ধতার জন্য দায়ী। ঢাকায় যে ধরনের ড্রেনেজ সিস্টেম রয়েছে তাতে খুব সহজেই পানির সাথে পলিথিন এবং অন্যান্য অপচনশীল পদার্থ ভেসে গিয়ে নালার মধ্যে আটকে যায়, যে কারণে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়। এছাড়াও নালা দিয়ে পানি খোলা জলাশয়ে পৌঁছুতে না পারার কারণে নালা উপচে পানি বাইরে চলে আসে এবং জলাবদ্ধতা সৃষ্টি করে। ঢাকার পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থার মূল দায়িত্ব ঢাকা ওয়াসার। এ ব্যাপারে ঢাকা ওয়াসার দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে প্রশ্ন করা হলে বর্তমানে কৃত্রিম ড্রেনেজ ব্যবস্থার মাধ্যমে পানি পাম্প করে বের করে দেয়া হচ্ছে বলে দাবি করেন তিনি। তবে জলাবদ্ধতা প্রশমনে দেরি হবার কারণে অতিবৃষ্টির ওপর দায় চাপান এবং বৃষ্টিপাতের পরিমাণ অনুযায়ী পয়ঃনিস্কাশনের ব্যবস্থা না থাকার দুর্বলতাও উল্লেখ করেন তিনি। ভবিষ্যতে এ সমস্যা সমাধনে অশনি সংকেত শুনিয়ে তিনি ঢাকাকে একটি অপরিকল্পিত নগরায়নের শহর উল্লেখ করে এখানে এর চাইতে ভালো পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা করা দুষ্কর বলে মন্তব্য করেন।

ঢাকা শহরের জলাবদ্ধতার মোট পানির ৬০-৭০ শতাংশ আসে বিভিন্ন বাড়ির ছাদে জমে থাকা পানি থেকে। বৃষ্টির পানি আগে বিভিন্ন জলাশয়ে সরে গেলেও বর্তমানে বাড়ির ছাদ থেকে পাইপে করে নেমে তা আর যাবার জায়গা পায় না। ফলে বিভিন্ন নালা উপচে পানি শহরের রাস্তায় জমে যায় এবং জলজট সৃষ্টি করে।

ঢাকার রাস্তায় জলাবদ্ধতা; source: bbc.com

সংসদ ভবনের সামনে ধানমণ্ডি ২৭; source: bbc.com

জলাবদ্ধতা নিরসনে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ

বাংলাদেশের অনেক এলাকাতেই বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ করে তা দৈনন্দিন জীবনের নানা কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে। তবে তা এখনো কোনো সরকারি উদ্যোগের মাধ্যমে আসেনি। মানুষ ব্যক্তিগত ও ঘরোয়াভাবেই তা করে আসছে। বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন বাপার ভাইস প্রেসিডেন্ট স্থপতি মোবাশ্বের হোসেন মনে করেন বৃষ্টি শুরু হবার পাঁচ মিনিট পরই পরিস্কার পানি ঝরতে শুরু করে, যা সরাসরি পান করা যায়। প্রকৃতি প্রদত্ত এই পানি সংরক্ষণ করা গেলে ঢাকার জলাবদ্ধতার ৬০-৭০ ভাগ নিরসন সম্ভব বলেও দাবি করেন তিনি।

ঢাকার প্রায় পৌনে দুই কোটি মানুষের পানির চাহিদার পুরোটাই পূরণ করা হয় মাটির নিচে থাকা পানির স্তর থেকে। এতো বিপুল পরিমাণ পানি ভূগর্ভ থেকে উত্তোলন করার ফলে প্রতি বছর প্রায় তিন মিটারের বেশি নিচে নেমে যাচ্ছে পানির স্তর। ঢাকায় প্রচলিতভাবে পানির সঙ্কট দেখা যায় এবং এমন অবস্থা চলতে থাকলে সামনে পানির সঙ্কট আরও বাড়বে বলে মনে করছেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের পানি সম্পদ প্রকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ডক্টর মোস্তফা আলী।

পানি সংরক্ষণের একটি নিয়ম; source: amaderpani.org

বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের গুরুত্বের ওপর জোর দিয়ে এ পানি সংরক্ষণ করলে ঢাকার জলাবদ্ধতা কমার পাশাপাশি ঢাকায় বসবাসরত মানুষের প্রায় ১৫ শতাংশ পানির চাহিদা পূরণ করা সম্ভব হবে বলে বিভিন্ন গবেষণার বরাত দিয়ে উল্লেখ করেন এই পানি বিশেষজ্ঞ।

বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের উপায়

সাধারণভাবে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের জন্য বাড়ির ছাদে বড় ড্রাম কিংবা চৌবাচ্চার উপরাংশে ছাঁকনি ব্যবহার করে তা সংরক্ষণ করা যায়। তবে এভাবে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ খুব বেশি পানির চাহিদা পূরণ করতে পারবে না। এ জন্য প্রয়োজন বড় ধরনের উদ্যোগ। সরকারিভাবে পানি সংরক্ষণের জন্য কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করা না হলেও বেসরকারি উদ্যোগে কাজ করছে কয়েকটি প্রতিষ্ঠান।

আন্তর্জাতিক সংস্থা ওয়াটার এইড বাংলাদেশ-এর সহায়তায় একটি প্রকল্পের অধীনে ঢাকার সাভারে বেসরকারি উন্নয়ন প্রতিষ্ঠান ভার্ক-এর কার্যালয়ে প্রায় ২৬ হাজার মিলিলিটার বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ করা হয়, যা বিভিন্ন প্রয়োজনে ব্যবহার করা হয়ে থাকে। এ ব্যাপারে  ভার্কের কর্মকর্তা মাসুদ হাসান বিবিসি বাংলাকে বলেন,

“আমাদের অফিস ভবন ৩,৩০০ বর্গ ফুট এরিয়ার এবং পঞ্চম তলার ছাদে চারদিক দিয়ে পাইপের মাধ্যমে পানি সংরক্ষণ করি। পেছনে ফিল্টারে নিয়ে পরে সেখান থকে জলাধারে সংরক্ষণ করা হয়। মাসে একবার মেইনটেইন করতে হয়। পানির সংকট হলে আমরা ওয়াশরুম বা অন্যান্য কাজে ব্যবহার করি”।

বৃষ্টির পানি রিচার্জ করে ভূগর্ভে পাঠানোর মেশিন; source: bbc.com

বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের প্রসঙ্গে ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপক বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা স্বীকার করেন এবং এ বিষয়ে উদ্যোগ নেয়া হয়েছে বলেও আশ্বস্ত করেন। এ ব্যাপারে ওয়াসা একটি পাইলট প্রকল্প হাতে নিয়েছে এবং তারা সফলতাও অর্জন করেছেন বলে জানান তিনি। এ প্রকল্পের মাধ্যমে বৃষ্টির পানি কৃত্রিমভাবে বাড়ি-অফিসের বা প্রতিষ্ঠানের ছাদ থেকে পাইপের মাধ্যমে মাটির নিচে পাঠানো হবে, প্রয়োজন অনুসারে খাবারের জন্য আবার তা উত্তোলন করা হবে। সামান্য পরিসরে কয়েকটি ভবনে এর কার্যক্রম চলছে বলেও জানান ওয়াসার এই কর্মকর্তা।

অন্যদিকে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা উল্লেখ করে আশার বাণী শুনিয়েছেন রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের পরিকল্পনা সদস্য সচিব জিয়াউল হাসান। ঢাকার বাড়ি তৈরির নকশায় বৃষ্টির পানি সংগ্রহ এবং তা ভূগর্ভে রিভার্স করার জন্য নীতিমালা প্রণয়ন করা হচ্ছে বলে জানান তিনি। নতুন নির্মাণাধীন বাড়ির ছাদে অবশ্যই বৃষ্টির পানি সংগ্রহ এবং তা ব্যবহার করার জন্য রিচার্জ সামগ্রী থাকতে হবে। শর্তপূরণ না হলে বাড়ি অনুমোদন পাবে না। তবে গ্রাউন্ডে ৫০০ বর্গ মিটার বা তার চেয়ে বেশি জায়গা থাকলে সেখানে এই বিধানটি কার্যকর হবে। এ কারণে রাজউক ঢাকা মহানগর ইমারত নির্মাণ বিধিমালা (২০০৮) সংশোধন করে ‘ঢাকা মহানগর ইমারত (নির্মাণ, উন্নয়ন, পরিবর্তন, সংরক্ষণ, অপসারণ) বিধিমালা-২০১৬ প্রণয়ন করছে বলে জানান রাজউকের এই কর্মকর্তা। তবে পুরনো কোনো ভবনের কেউ চাইলে আগের নকশা নবায়ন করে দেয়া হবে এবং নীতিমালা গেজেট আকারে প্রকাশ হলে বাড়ির ছাদে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ বাধ্যতামূলক হবে বলে উল্লেখ করেন তিনি।

ঢাকা ওয়াসার একটি পানির ট্যাঙ্ক; source: jagonews24.com

বৃষ্টির পানি প্রক্রিয়াজাতকরণ এবং বাণিজ্যিকভাবে বিক্রি

বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলে পানিতে লবণের পরিমাণ বেশি থাকায়  সেখানে সারা বছরই সুপেয় পানির অভাব লেগে থাকে। এ অভাব মেটাতে খুলনার দাকোপের বাজুয়া ইউনিয়নের একটি প্রত্যন্ত অঞ্চলে বৃষ্টির পানি সংগ্রহ করে তা বাজারজাত করা হচ্ছে। প্রতি লিটার পানি দেড় টাকায় বিক্রি করা হয় এবং প্রতিদিন প্রায় আড়াই থেকে তিন হাজার লিটার পর্যন্ত পানি বিক্রি হয়।

চট্টগ্রামে পাহাড়ে ঘুরতে গিয়ে সেখানে পলিথিন দিয়ে বৃষ্টির পানি সংগ্রহ করতে দেখে এ ধরণের চিন্তা মাথায় আসে বলে জানান বেসরকারি প্রতিষ্ঠান শরিফসের (সোর্স অব হোপ অ্যান্ড অ্যামবিশন-রেসটোরিং এনকারেজমেন্ট অ্যান্ড এন্ডিং ফিউটাইল স্ট্রাগেলর) কোষাধ্যক্ষ প্রসেন ব্রায়ান। তারপর নানান চেষ্টা চলতে থাকে। প্রথম চেষ্টায় ব্যর্থ হলেও পরবর্তীতে আসে সফলতা। প্রায় চার বিঘা আয়তনের একটি ১০ ফুট গভীর পুকুরে পানি সংরক্ষণ করা হয়। পুকুরটির পানি ধারণক্ষমতা ১ কোটি ৩৩ লাখ লিটার।

পুকুরে জমাকৃত পানি নয়টি ধাপে পরিশোধনের মাধ্যমে বোতলজাত করে বাজারজাত করা হয়ে থাকে। এ পানির গুণগত মান টিডিএস (টোটাল ডিজলভ সলিড) অন্যান্য পানির থেকে অনেক ভাল। সাধারণত বাজারে প্রচলিত মিনারেল ওয়াটারের টিডিএস ১৫-১৯। এক পরীক্ষায় দেখা গেছে, এলাকার মানুষ যে পানি পান করে, তার টিডিএস ২৪৫ আর শরিফসের পানির টিডিএস ১২-১৪। তাই এর গুণগত মান নিয়েও আর কোনো প্রশ্ন তোলার সুযোগ থাকছে না।

বৃষ্টির পানির বিপণন প্রক্রিয়া; source: prothom-alo.com

বাংলাদেশের ভূগর্ভস্থ পানির স্তর প্রতি বছর কয়েক মিটার করে নিচে নেমে যাচ্ছে এবং প্রতিনিয়ত বাড়ছে পানির চাহিদা। বিশ্বের অনেক দেশ বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের উদ্যোগ নিয়েছে এবং সফলও হয়েছে। এমনকি পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতেও বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের দৃষ্টান্ত রয়েছে। এমতাবস্থায় বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ বাংলাদেশে পানির এ বিপুল চাহিদা মেটাতে বিশেষ ভূমিকা পালন করবে বলে করেন বিশেষজ্ঞরা।

ফিচার ইমেজ: ইউটিউব

Related Articles